আটষমির শীতের কোলকাতা। সলিলকুমার মধ্যপ্রদেশের ভিলাইনগরের থেকে তাড়াহুড়ো করে নাকতলায় পরিবারের এজমালি বাড়িতে উঠেছেন, ছেলের সংগে দেখা করতে। সন্ধ্যে সাতটা বাজে, ছেলেকে খবর পাঠানো হয়েছে। এখনও এসে পৌঁছয়নি। সলিলের ছট্ফটানি বাড়ছে।
আসলে সলিল সাতদিন আগে মায়ের একটি চিঠি পেয়েছেন--- তোমার ছোটছেলে বাড়ি ছাড়িয়া গেছে। লেখাপড়া করিবে না, দেশোদ্ধার করিবে। কোন্ বিদেশি গুরুঠাকুরের কাছে দীক্ষা নিয়াছে কে জানে! তিনি নাকি বলিয়াছেন-- যে যত পড়ে সে তত মুর্খ হয়। অনেক বুঝাইয়াছি। ওরে, তোর মা-বাবার কথা একবার ভাব। কত আশা নিয়া ভিলাই হইতে টাকা পাঠাইতেছে, তোরা লেখাপড়া শিখিয়া পরিবারের মুখোজ্বল করিবি। কিন্তু চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনি। সে উল্টা আমাকে বুঝায়,------------ শচীমাতা যদি না কাঁদিত, নিমাই কি করিয়া জগৎকে প্রেমধর্ম শিখাইত? তুমি একবার আসিয়া দেখ, যদি পথে ফিরাইতে পার। আমি হার মানিয়াছি।
দরজায় হাল্কা করে কড়া নড়ে উঠলো। সলিল সিগ্রেট অ্যাশ্ট্রেতে গুঁজে প্রায় লাফিয়ে গিয়ে দরজা খুল্লেন। দুটি ছেলে দাঁড়িয়ে, বয়স সতেরো-আঠেরোর মধ্যে।
একজন ভেতরে এসে সলিলের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো। সলিল ছেলেকে বল্লেন-- ভেতরে এস, বন্ধুকেও ভেতরে এনে বসাও।
--- না, ও রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবে, আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবে।
----মানে? তুমি আজকে রাত্তিরে এখানে থাকবে না? তোমার মা ও এসেছেন, তাঁর সঙ্গে দেখা করবে না? কথা বলবে না?
--- দেখা করবো না কেন? কিন্তু রাত্তিরে আমাকে ফিরে যেতেই হবে।
---- সো মাচ্ কমিটমেন্ট! অ্যাট্ দিস্ টেন্ডার এজ? বেশ, কিন্তু আমার সঙ্গে যে অনেক কথা বলার আছে। তার কি হবে?
---- ঘন্টা দুই বসছি, এর মধ্যে সব কথা শেষ হওয়া উচিৎ।
---ইয়ং ম্যান, you owe me some explanation. Don't you think so?
বাপ-ছেলের রাজনীতি-সমাজনীতি নিয়ে শাস্ত্রবিচার মাত্র কুড়ি মিনিটে শেষ। ছেলে বড় একগুঁয়ে। সলিল যত বলেন যে বিশাল বহুমাত্রিক ভারতবর্ষের সমস্যাকে বোঝা এত সহজ নয়, চীন-ভারতের সামাজিক-রাজনৈতিক গঠন আলাদা, চীনের চশমায় এ দেশকে বোঝার চেষ্টা বাতুলতা। এর চেয়ে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের লেখা পড়লে ভাল হবে,-- ছেলের মুখের ভাবে কোন পরিবর্তন হয় না। যেন কাঁচের দেয়ালের সঙ্গে কথা হচ্ছে।
সলিলের ভেতরের চাপা অসহায় রাগ এবার ফুটে বেরুলো।
--- আমি জানতে চাই, তুমি নিয়মিত পড়াশুনো করে হায়ার সেকন্ডারির পর এখান থেকে এম এ কমপ্লিট্ করবে কি না? আমি আমার পরিশ্রমের পয়সা তোমাদের পেছনে জলের মত ঢালছি। সে কি ফুটোপাত্রে? জবাব দাও। আর যে ভদ্রলোক পড়াশুনো করে মুর্খ হয় শেখাচ্ছেন তিনি নিজে কি পড়েন নি? বা বই লেখেন নি? পড়লেই যদি মূর্খ হয়, তাহলে ওঁর বইগুলোই বা কেন পড়তে হবে?
তোমরা ধর্ম মান না। বেশ, কিন্তু ভেবে দেখেছ কি যে ""রেড্বুক'' এর কোটেশন মুখস্ত করা আর না বুঝে রোজ গীতাপাঠ করা প্রায় একইরকম!
ছেলে চেয়ার থেকে উঠলো।-- আমি যাচ্ছি, মা কে ডেকে দাও।
সলিল হতবাক্। ক'মাস আগেও ছেলেটা এই বাড়িতে থেকে পড়াশুনো করেছে, স্কুল গেছে। আর আজ এমন করছে যেন আউটসাইডার। ভেতরের ঘরে যাচ্ছেন!।
এর মধ্যেই এত দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে! কি করে?
রাত প্রায় বারোটা। শীতের নাকতলা ঘুমিয়ে কাদা। সলিলের চোখে ঘুম নেই। ছেলে মায়ের কান্নাকাটিতেও গলে নি, চলে গেছে। এই ছেলেটা এমন পাষাণ হয়ে গেল? আর কি অহংকার! সলিলের প্রশ্নগুলোর ঠিক করে জবাব দেয়ার দরকার মনে করলো না! এইটুকু পুঁচকে ছেলে, মাত্র সেদিন ডিম ফুটে বেরিয়েছে।
কি পড়েছে এরা? দেশকে কতটুকু জানে? দেশের ইতিহাস, জনমানস---এত সোজা বিপ্লব করা? বিপ্লবে লেখাপড়ার কোন দরকার নেই? কী সর্বনেশে কথা! এখনও তো স্কুলের গন্ডি ডিঙোয় নি।
( রাত্তিখানি উনিপুক, তার নাই নাকমুখ, হে আইছে আমারে শিখাইতে?)
কেন যেন সলিলের মনে পড়ে আর এক উদ্ধত তরুণের কথা---
গগনচন্দ্র রায়, সলিলের পিতামহ। সলিলের রোল্ মডেল।উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ভাল সিভিল অ্যাড্ভোকেট। স্যার রাসবিহারী ঘোষের জুনিয়র। দীঘাপাতিয়া এস্টেটের মামলা জিতিয়ে দীঘাপাতিয়ার রাজার থেকে দোশালা উপহার প্রাপ্তি। কিন্তু নিষ্ঠাবান হিন্দু। নিজের জীবনে চতুরাশ্রম পালন, বাণপ্রস্থ গমন ও সন্ন্যাস ,--- কোনটাই ফাঁকি দেন নি। পেয়েও ত্যাগ করতে পারার ক্ষমতা ভিক্টোরিয়ান রুচির সলিলকে বড় আকর্ষণ করে, আকর্ষণ করে ব্রহ্মচর্য্য। বিশ্বাস করেন যে বীর্য কে ধরে রাখা বীর্যত্যাগের চেয়ে বড়। বিশ্বাস করেন যে শরীরের ভাঁড়ারে বীর্যের স্টকপাইল্ যখন তার ছাদ বা ব্রহ্মতালু ছোঁবে তখন মানুষ অমিত শক্তিধর হবে।
কেন? বার বার চেষ্টা করেও হেরে যান বলে? তাই বোধহয় সমারসেট মম এর উপন্যাস ""অফ্ হিউম্যান বন্ডেজ'' সলিলের এত প্রিয়। কিন্তু আজ রাত্রে মনে পড়ছে প্রৌঢ় হিন্দু গগনচন্দ্রকে নয়, এক গর্বিত তরুণ গগন রায়ের কথা।
১৯৯৫ সালের ময়মনসিংহ শহর। তখনও এই শহর দেশের প্রথম র্যাংলার আনন্দমোহন বসু বা উমেশ্চন্দ্র ব্যানার্জি বা নীরদ সি চৌধুরির শহর হয়ে ওঠেনি। শহরটির উপকন্ঠে লালবাতি এলাকা। তার কাছেই শস্তায় একখানি ঘর ভাড়া নিয়ে বিধবা মায়ের বড় ছেলে গগন প্রবেশিকা, থুড়ি এন্ট্রান্সের পড়া করছেন। স্বপাকে খান। কিন্তু একদিন এক বয়স্ক মহিলা এসে বল্লেন-- তোমাকে দেখি। রোজ পাত্কো থেকে রশি টেনে জল ভর, রান্না কর, তারপর খেয়ে বাসনমেজে পড়তে যাও। যদি কিছু মনে না কর তাহলে আমি তোমাকে জল তুলে বাসন মেজে মশলা বেটে দেব, কোন পয়সা লাগবে না। আমার এই সামান্য সেবাটুকু স্বীকার কর , বাবাঠাকুর!
গগনচন্দ্র রাজি হলেন। খানিকটা নতুন বয়সের উদার চিন্তার প্রভাব, খানিকটা সেবা ও সুবিধে পেতে ভালো লাগে,--- রক্তে মিশে আছে যে।
এইভাবেই দিন কাটছিল। গগন্চন্দ্রের স্বপ্নÀ বড় আকাশে ওড়ার।
স্কুলের পর ওকালতি পাশ করে কোলকাতায় প্র্যাক্টিস্ করা। আঠারবাড়িয়ার গ্রামীণ সমাজের আবহাওয়ায় কেমন যেন দমবন্ধ ভাব। আর একটা জিনিস ওনার বড় অপছন্দ, তা হল গ্রামের কৃষ্ণলীলা,-- সে আসরে গড়াগড়ি দিয়ে কীর্তন গাওয়াই হোক বা ""ঘাটু'', অর্থাৎ বর্ষাশেষে নদীর ঘাটে ছোটছেলেদের রাধা বা গোপিকা সাজিয়ে কৃষ্ণলীলা। বড় স্থুল, প্রায় অশ্লীল।
একদিন এক টেলিগ্রাম এল।-- ""মাদার ইল, কাম শার্প''। গগনচন্দ্র ভাড়াটে বাড়ির দরজায় তালা ঝুলিয়ে সেই বিগতযৌবনা রূপোপজীবিনী মহিলাকে চাবি দিয়ে গৃহগ্রাম আঠারবাড়িয়ার দিকে রওয়ানা হলেন। রেলস্টেশনে নেমে কয়েকমাইল হাঁটাপথ। মাঝরাস্তায় পেয়ে গেলেন গাঁয়ের দফাদার ""মিছার-বাপ''কে।
মিছার-বাপের আসল নাম আলাদা। কিন্তু সর্বজনস্বীকৃত নাম মিছার-বাপ। এবং উনি সার্থকনামা,মিথ্যে কথা বলতে একটু আটকায়না। তা' বলে কর্তার সামনে মিথ্যে বলা? কাজেই গগনচন্দ্রের উৎকন্ঠাজনিত স্বাভাবিক প্রশ-À --"" মা কেমন আছেন?'' এর উত্তর দিতে দফাদারের বিষম খাওয়ার অবস্থা। গলা খাঁকরে বল্লো--- এখন ভালই আছেন।
--- কি হইছিলো? অসুখডা কি? -- এর উত্তর দিতে আবার গলা খাঁকরি, এবং শেষে-- আপনে বাড়ি গিয়া সব জানবেন।
রহস্যের গন্ধ! গগনচন্দ্র উত্তেজিত। সামনের মাসে পরীক্ষা। ভেবেছিলেন পরীক্ষা দিয়ে একেবারে শহরের পাট চুকিয়ে বাড়ি আসবেন। বাড়ি পৌঁছেই দেখলেন সামনের ঘরে মা মোড়া পেতে বসে আছেন। চেহারায় অসুস্থতার চিহ্ন মাত্র নেই। তাহলে তাঁকে মিথ্যে টেলিগ্রাম করে ডাকা হয়েছে! এই দু:সাহস কার? গগনচন্দ্রের ক্রোধ গলার ঝাঁঝে প্রকাশ পেল। লেখাপড়া শেখা বড়ছেলের প্রশ্নের জবাবে অপরাধী মা আমতা-আমতা করে বল্লেন-- দ্যাবতাদের নির্ণয় হইছে।
দ্যাবতা? মানে দেবতা? ও হরি! ভুদেব? মানে গাঁয়ের ব্রাহ্মণসমাজ!
ইতিমধ্যে দফাদারের পেছন পেছন বারান্দায় উঠেছেন জনাতিনেক বর্ষীয়ান ভদ্রলোক, খালি গায়ে উত্তরীয় সম্বল, যজ্ঞোপবীত চোখে পড়ে। সবার আগে যিনি তাঁর ধুতি ও উড়ুনি একটু দামী। শ্যামাচরণ চক্রবর্তী, রায়েদের পাল্টি ভূমধ্যাধিকারী পরিবার, ব্রাহ্মণসমাজের মাথা।--- আইয়া পড়ছ বাপ? হাত-পাও ধইছ? কিছু মুখে দিছ? এইতা সাইর্যা লও, তারপরে কথা হইব।
--- গৌরচন্দ্রিকার দরকার নাই, কামের কথা কন। এইসব ছল-প্রপঞ্চের কি দরকার ছিল?
-- দরকার ছিল, দরকার ছিল। মাথা ঠান্ডা কর, তবে বুঝবা। তাই কই স্নান কইরা খাইয়া লইয়া তারপর কথাবার্তা কইলে কামে দিব। --- না, আগে কন। না হইলে আমর গলা দিয়া অন্ন নামবো না।
চক্রবর্তীমহাশয়ের চোয়াল শক্ত হল।
---- বেশ, কামের কথাই কই। তুমি ময়মনসিং শহরে গেছ অধ্যয়ন কইরা মানুষ হইতে, তোমার পিতাঠাকুর ঈশ্বর রামকানাই ইন্দ্রের ভূ-সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ ও বংশধারার প্রতিপালন করার যোগ্য হইতে। ঠিক কইলাম?
--- ঠিক, কিন্তু আমার আচরণে এর অন্যথা হইতে কই দ্যাখলেন? আমি কি মন দিয়া পড়াশুনা করি নাই? তা হইলে পরীক্ষায় ভাল ফল হয় ক্যামনে?
----- তুমি বুদ্ধিমান, পড়াশুনায় নিষ্ঠার অভাব এমন কথা পরমশত্রুতেও কইবো না। কিন্তু আমাদের কাছে খবর আছে যে ইদানীং একটি ব্রাহ্মপরিবারে তোমার যাতায়ত বেশি। সেই বাড়িতে দুই বয়স্থা অবিবাহিত কন্যা। তারা পর্দা মানে না। পরিবারের বাইরের পুরুষের সঙ্গে অনায়াসে আলাপ করে, এমনকি তাদের গুরুজনদের উপস্থিত থাকা দরকারী মনে করে না। এই যাবনিক- আধা- কিরিস্তান পরিবেশে তোমার নিয়মিত উপস্থিতির খবরে তোমার মাতাঠাকুরাণীর বুকের ব্যথা সত্যই বৃদ্ধি পাইছিল। তোমাদের বাড়ির নাটমন্দিরে গোবিন্দজীউ'র অধিষ্ঠান, নিত্য ভোগ আরতি হয়। শালগ্রাম শিলার পূজা হয়। তোমরা বংশপরম্পরায় ত্রিপুরার পত্তনের বিখ্যাত গোস্বামীপরিবারের যজমান। তুমি সনাতন হিন্দুধর্মের এই বৈভব ছাইড়া ইংরেজঘেঁষা ব্রাহ্মদের আবোলতাবোল তামসায় যোগ দিবা-- এইডা কি উচিৎ?
রোগা, খেঁকুড়ে, টিকিতে ফুলবাঁধা আচায্যি চেঁচিয়ে উঠলেন--- ব্রাহ্মরা ছেলেধরা। অরা মাইয়াদের বাল্যবয়সে বিয়া দেয় না। ভালবংশের ছ্যামড়া দেখলে বাড়িতে ডাইক্যা আইন্যা চা আর সায়েববাড়ির বিস্কুট খাওয়ায় আর মাইয়া দের লেলাইয়া দেয়।
ক্রুদ্ধ গগনচন্দ্র জলচৌকি থেকে উঠে দাঁড়ালেন।---- ভূদেবরা এইবার আসেন। আমি প্রাপ্তবয়স্ক হইয়া নিজের বুদ্ধি-বিবেকের হিসাবে কি করবাম হেইডা আমার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। এই নিয়া গ্রামে সালিশীসভার প্রয়োজন দেখি না। আর ব্রাহ্মদের আপনারা কাছের থেইক্যা দ্যাখেন নাই। তাঁরা সংস্কৃতিবান রুচিশীল মানুষ। নিরাকার ব্রহ্মের উপাসক। উপনিষদের মন্ত্র উচ্চারণ কইরা প্রার্থনা করেন। হ্যাঁ, পাথর বা গাছের গোড়ায় জল ঢাইল্যা পূজা করেন না। কিন্তু তারা যে হিন্দুধর্মের বাইরের সম্প্রদায় কি আধা-খ্রীস্টান, সেই বিচার আপনারা ক্যামনে কইর্যা ফ্যালেন?
শ্যামাচরণ চক্রবর্তী গোঁফের ফাঁকে হেসে ফেল্লেন। ---- তুমি কি আমরার লগে শাস্ত্রবিচার করতে চাও? এই বয়সেই নৈয়াকিক হইবা? তুমার শাস্ত্রজ্ঞান কতটুকু?
গগনচন্দ্র দমবার পাত্র ন'ন।--- বয়সের কথা ছাড়ান দেন। আপনারাই পরীক্ষা কইর্যা দেইখ্যা নেন।
শ্যামাচরণের চোখ গগনচন্দ্রের চোখে নিবদ্ধ। ---বেশ, কিন্তু একখান শর্ত আছে। যদি পরাজিত হও? তাহইলে সারাজীবন নিষ্ঠাবান হিন্দুর আচার পালন করতে অইবো। আপত্তি আছে?
---- কুন আপত্তি নাই। কিন্তু আমারও একখান শর্ত আছে। যদি উল্টাডা হয়, তাহইলে আপনেরা আমার কুন কাজে বাধা দিতে পারবেন না। কি কন?
--- রাজি। কাইল তোমাদের বাড়ির নাটমন্দিরের সামনে, সন্ধ্যারতির পর। জয়-পরাজয়ের নিষ্পত্তি কিভাবে?
---- অতি সহজ। আমি আপনাদের প্রশ্নের সামনে নিরুত্তর হইলেই আমার হার।
সুর্য ডুবলেও আকাশে তখনও গোলাপি আভা। গাঁয়ে গাঁয়ে এই বার্তা রটি গেল ক্রমে। আরতির পর--"" হে গোবিন্দ, হে গোপাল! কেশব-মাধব-দীনদয়াল'' শেষ হল। নাটমন্দিরের সামনে খালি জায়গাতে গোটা দুই তক্তপোষ আর চারটে জলচৌকি। একটু দূরে দাঁড়িয়ে পাশের তিনচার গাঁয়ের জনা তিরিশেক ইতরজন। এই মল্লভূমিতে কোন মহিলা উপস্থিত ন'ন।
পূর্বপক্ষ গগনচন্দ্র শুরু করলেন।
---- ব্রাহ্মসমাজ হিন্দুধর্মের বিশিষ্ট অঙ্গ, শুধু তাই নয় চিন্তনপ্রক্রিয়ায় সবচেয়ে অগ্রগামী অংশ। উপনিষদ এর দর্শনচিন্তার সার হল শঙ্করাচার্য্য প্রচারিত অদ্বৈতবেদান্ত। অর্থাৎ ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা। ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়। কাজেই নিরাকার। কারণ এই "" অণোরণীয়ান মহতোমহীয়ান '' তত্ত্বকে কোন পরিচিত আকারে বাঁধা যায় না। অতএব এই নিরাকার ব্রহ্মের উপাসক ব্রাহ্মধর্মকে কি ভাবে বৃহত্তর হিন্দুসমাজের বিরোধী ও যাবনিক বলা যায়? আর এরা জ্ঞানমার্গের পথিক। সাধনপদ্ধতিতে নির্গুণ ব্রহ্মের উপাসনা অতি উত্তম। ভক্তিমার্গ, পুরাণকথা, তেত্রিশকোটি দেবতার পূজা-- এইসব অশিক্ষিত ইতরসমাজের উপযুক্ত। উনবিংশ শতাব্দীর শিক্ষিত ভদ্রসমাজের জন্য ব্রাহ্মমত সর্বথা উৎকৃষ্ট।
----অ! আগে জগৎমিথ্যাত্ব প্রতিপাদিত কর!
----- দার্শনিক স্তরে যাহা অপরিবর্তনীয় বা শাশ্বত, তাহাই সত্য। নামরূপের বন্ধনে প্রকাশিত এই জগৎ সদা পরিবর্তনশীল। যাহা দেশকালের উর্ধ্বে নয়,অপরিবর্তনশীল নয়, তাহা নশ্বর। অত: মিথ্যা।
----- এই " মিথ্যা'' জগৎ কিভাবে সৃষ্ট হয়? বা সত্যরূপে প্রতিভাত হয়?
---- ব্রহ্মের মায়ায়। জীবের চেতনায় অবিদ্যাজনিত ভ্রমের কারণ এই নশ্বর অসত্য জগৎ সত্যরূপে প্রতিভাত হয়, যথা রজ্জুতে সর্পভ্রম। পন্ডিতেরা মুখচাওয়া-চাওয়ি করে চোখে চোখে একটু হাসলেন, সেটা গগনচন্দ্র দেখতে পেলেন না।
----- এই "" মায়া'' কি ব্রহ্ম হইতে স্বতন্ত্র কোন তত্ত্ব? না ইহা ব্রহ্মের কোন ধর্ম?
গগনচন্দ্র গুগলিটা দেখতে দেরি করে ফেলেছেন। ওনার ইতস্তত: ভাব দেখে আচায্যি উঁচু স্বরে বল্লেন---
কিছু বলার আগে ভাল কইর্যা ভাব। যদি মায়া ব্রহ্মনিরপেক্ষ কোন স্বতন্ত্র বস্তু হয়, তাহা হইলে অদ্বৈতের জায়গায় দ্বৈতবাদের স্থাপনা হয়। যদি ইহা ব্রহ্মেরই ধর্ম বা বৈশিষ্ট্য হয়, তাহা হইলে বিকৃতিশূন্য নির্গুণ ব্রহ্ম থাকে কই?
গগনচন্দ্রের গলায় আগের জোর নেই। তবু বল্লেন---- মায়া ব্রহ্মের অনির্বচনীয় ধর্ম। মানবমন ব্যবহারিক নামরূপের জগৎ ও নিরাকার নির্গুণ ব্রহ্মের মাঝে সেতুস্বরূপ এই মায়ার কল্পনা করে।
----- বেশ, তবে পারমার্থিক ছাড়া এই নামরূপের জগৎকে তোমরা "" ব্যবহারিক'' রূপে স্বীকার কর। শংকর পউচ্ছতবৌদ্ধ ছিলেন। বেদ্বান্তের শংকরভাষ্য পড়েছ, কিন্তু রামানুজের সাতটি আপত্তি পড়া হয় নাই। আসলে তোমার অধ্যয়নের অগ্নিমান্দ্য হয়েছে। শোন, আমরা বৈষ্ণবধর্মাবলম্বীরা বৃহৎ অর্থে রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের অনুযায়ী, আর সুক্ষ্ম অর্থে চৈতন্যমহাপ্রভূর "" অচিন্ত্যভেদাভেদ'' দর্শনের। আরও শোন,-- পারমার্থিক জগৎ ছাড়াও নামরূপের ব্যবহারিক জগতের অস্তিত্বকে কেবল বাগ্বিভূতি দিয়ে অস্বীকার করা যায় না। শংকরও পারেন নাই। তাই পরে শিবাষ্টক স্তোত্র, গঙ্গাস্তোত্র লেইখ্যা পাপ-স্খালনের চেষ্টা।
এই জগৎ মায়া নয়, ব্রহ্মের লীলা। "" একোহং বহুস্যাম''। একাকী ব্রহ্ম মনে করিলেন আমি বহু হইব। এই এক থেকে বহু হওয়ার ইচ্ছা মানবমনের একটি চিরন্তন সংস্কার। কারণ আমরা ব্রহ্মের অংশ। তাই পুরুষ-প্রকৃতি, তাই সন্তানসন্ততির আকাংখা। তাই সমাজনির্মাণ। নইলে মানুষ আজও জংগলে থাকিত।
গগনচন্দ্র নিরুত্তর।
শ্যামাচরণ চক্রবর্তী যেন দেখেও দেখলেন না।
---- জ্ঞানমার্গ সবার জন্যে নয়। তুমি সেই পথের পথিক, ভাল কথা। কিন্তু বহুসংখ্যক মানুষের ভক্তিমার্গ নিয়া আবেগকে তুচ্ছ কর কোন অধিকারে? চৈতন্যমহাপ্রভূ প্রথম জীবনে তোমার মত উদ্ধত নৈয়ায়িক ছিলেন। নবদ্বীপে লোকে কইত "" নাস্তিকের শিরোমণি''। তিনিই পরে নামলেন নগরসংকীর্তনে,- ""আচন্ডালে ধরি দেই কোল''। আর নিরাকারসাধনা একাংগী, সাকারসাধনায় নিরাকার ও নিহিত অছে, বর্জিত নয়। রাজপথ ছেড়ে অন্ধগলিতে যাও কেন? ব্রাহ্মসমাজ আসলে নিরাকার সাধনার আড়ালে মূলত: সনাতন হিন্দুধর্মের বিরুদ্ধে ""পৌত্তলিকতা''র অপবাদ দিয়া ইংরেজদের রাজধর্মের তোষামোদ করে। অধিকাংশ ব্রাহ্মপরিবার ধনী। তারা ইংরেজ রাজপুরুষদের চাটুকারিতা করে--- ইহা দেখ নাই? আমাদের বৈষ্ণবধর্ম আপামর জনসাধারণের জন্যে। সমাজের বিরুদ্ধতা করায় মানুষ শক্তিহীন হয়, সঙ্গে থাকলে শক্তিবৃদ্ধি।
গগনচন্দ্র নিরুত্তর।
তামাসা দেখা লোকজন হতাশ হয়ে অনেক আগেই কেটে পড়েছে।
নাটমন্দিরে ঘন্টা বাজলো। ঠাকুরকে শোয়ানোর সময় হয়েছে। পূজারী এসে সবাইকে প্রসাদ দিলেন। গগনচন্দ্র খানিকক্ষণ ভাবলেন, তারপর মাথায় ছুঁইয়ে গ্রহণ করলেন।
পাঁচ প্যাকেট পানামা সিগ্রেট শেষ। বাগানে নারকোল গাছে কোন একটা পাখি ডেকে উঠলো। পাশের সুপুরি গাছ থেকে জবাব দিল আরো একটা পাখি।
অন্ধকার ফিকে হয়ে আসছে। সলিল বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। ঠাকুর্দা গগনচন্দ্র কথা রেখে ছিলেন। সারাজীবন নিষ্ঠাবান হিন্দু রইলেন। ওকালতিতে ও তালুকদারিতে সফল হলেও "" পঞ্চাশোর্ধ্বেবনং ব্রজেৎ'' এই আপ্তবাক্য স্মরণ করে ছেলে সতীশচন্দ্রের হাতে সংসারের ভার সঁপে দিয়ে বৃন্দাবনে কুটির নির্মাণ করে রইলেন। দুবেলা মাধুকরীবৃত্তি করে ( গোদা বাংলায়"" ভিক্ষে দাও গো ব্রজবাসী'' বলে) আহার করলেন। বারো বছর পরে দেশের বাড়িতে ফিরে এসে বাইরের দিকে একটা ঘর বানিয়ে শেষ জীবনটা কাটিয়ে দিলেন।
হ্যাঁ, বড় নাতি সলিল কুমার প্রায়ই সন্ন্যাসীদাদুর পুকুরের ঘাটে পায়খানা করে রাখতেন। মনে আশা যে দাদুর পা' ওখানেই পড়বে। সে আশা প্রায়ই পূর্ণ হত। অজান্তেই সলিলের ঠোঁটের ফাঁকে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। তারপর বুকের মধ্যে একটা ব্যথা চিন্চিন করে উঠলো। না, তাঁর আর ছেলের কথাবাতা Ñ ঠাউর্দার প্রথম জীবনের বিতর্কসভার মত করে শেষ হয় নি। দুর্বিনীত ছেলে মাথা নোয়ায় নি, চলে গেছে।
সময় বদলে গেছে অনেকখানি। প্রায় আশিবছরের তফাৎ। এবার সলিলকে ফিরতে হবে, ভিলাইয়ে, নীরস কর্মক্ষেত্রে। বাড়িতে থাকবেন মাত্র দুজন। সলিল আর স্মৃতিকণা। খালি সময় যেন গিলতে আসবে। তবু তাঁরা অপেক্ষায় থাকবেন। যদি ছেলে ফিরে আসে, অকাল- বনবাস থেকে। কোন দিন, কোন মাস, কোন বছর।
(চলবে)