(১)
সেই চিরন্তন প্রশ্ন! দর্শন, ইতিহাস, বিজ্ঞান-- সব ঘেঁটে দ'। এলেম আমি কোথা থেকে? কোথ্থেকে আবার? সবাই যেখান থেকে আসে। সবাই কি একজায়গা থেকেই আসে? তাহলে সবাই কি ময়মনসিং থেকেই আসে? কি জানি!
বন্ধুবর প্রণয় শর্মা "আউটলুক' ম্যাগাজিনের ফরেন ডেস্কের সম্মানিত সম্পাদক। জিগ্যেস করায় দাঁত বের করে বল্লো--- এই গো-বলয়ের ম্যাঙ্গো-পাবলিক ফোনে কথা বলতে জানে না। প্রথমেই বলবে-- আপ কহাঁ সে ?
আমি জবাবে বলি-- ম্যাঁয় তো মুহ্ সে, আপ কহাঁসে?
ছোটবেলা থেকেই জেনে গেছি মা-কাকিমারা হাসপাতালে গেলে ডাক্তারবাবু ভাই-বোন দিয়ে দেন। যার যেমনি দরকার। তারপরে বরানগর রামকৃষ্ণ মিশনের হোস্টেলে গিয়ে ক্লাস সিক্সে দেখলাম যাত্রা ---"" কংসবধ'' পালা। সে দেখে তো চক্ষু চড়ক গাছ। কংস নিজের কালাপাহাড়ি স্বভাবের জন্যে দায়ী করছে নিজের জন্মকে!
এক ভর সন্ধ্যেয় কংসের মাতা ঠাকরোন কোন পার্কে, থুড়ি উদ্যানে, একা বসে ছিলেন।
সেই সময় এক দৈত্য এসে ""আমার মাতারে ধরি দিলা আলিঙ্গন,
সেইক্ষণে এইজন্ম হইল আমার''।
তাহলে কোলাকুলি থেকেও মানবশিশু জন্ম নিতে পারে! কেন নয়? ভগবানের পালা, সে কি মিথ্যে বলবে? আমার সমস্ত প্রিমিটিভ বায়োলজি জ্ঞান উল্টে-পাল্টে গেল। তখন থেকে আমি কোলাকুলি এড়িয়ে চলি, সে ঈদ হোক, কি বিজয়াদশমী। কি জানি বাবা, সাবধানের মার নেই!
এখন আমি ক্লাস এইটের ছাত্র। হোস্টেলের পরিবেশ থেকে অর্জন করেছি প্রাকৃত শব্দাবলীতে বিশেষ অধিকার। আর নতুন দাঁত বেরুনো বাচ্চার মত সেইসব শব্দ যত্রতত্র ব্যবহার করে দু -একবার ক্যাল খাওয়ার পালাও এসেছে।
এক ফাল্গুনসন্ধ্যেয় যখন হোস্টেলের ছাদে দখিনাবাতাস আমাদের তিন বন্ধুকে সুড়সুড়ি দিচ্ছে তখন এক সিনিয়র দাদা গায়ে পড়ে আমাদের আদম-ঈভ থেকে শুরু করে আধুনিক যুগ অব্দি মানব সমাজের বায়োলজিক্যাল ট্র্যাডিশন নিয়ে টিউটোরিয়াল ক্লাস নিতে এলেন।
হেমিংওয়ে ওনার "ফর হুম দি বেল টোল্স্' উপন্যাসে বলেছেন যে স্প্যানিশ ভাষায় গালাগালি তার সাংকেতিকতার চরমে পৌঁছেচে। তাতে অশ্লীল ক্রিয়াটির উল্লেখ না করে শুধু মাত্র ""করেছে'' বলা হয়। উনি স্পষ্টত:ই আমাদের মিশনে পড়েন নি। নইলে স্প্যানিশ আর বাংলা ভাষাকে একই ব্র্যাকেটে রাখতেন।
সে যাকগে, দাদাটি জানালেন যে সন্তানের জন্মের কারণ হইল পিতামাতার যৌনসঙ্গম, একেবারে "মেরে মন কী গঙ্গা অউর তেরে মন কী যমুনা'; এবং ইহার কোন ব্যতিক্রম নাই।
তো আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল--""তাহলে আপনার বাবা আপনার মাকে করেছেন?''
ফুটন্ত তেলে জল পড়ল। সিনিয়রের বাপ-মা তোলা ? এ তো গো-হত্যা, ব্রহ্মহত্যার চেয়ে বড় অপরাধ।
তবে দাদাটি গান্ধীবাদী ছিলেন। তাই নিজে হাত-পা না চালিয়ে আঙুল মটকে পৌরাণিক ঋষিদের শৈলীতে অভিশাপ দিয়ে গেলেন। আমরা তিনবন্ধু বলির আগে পাঁঠার মত আশঙ্কায় কাঁপতে থাকলাম। এবং অবিলম্বে আমাদের আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণিত করে ক্লাস টেনের হার্মাদবাহিনীর তিন জল্লাদ হাজির। একজনের হাতে বেল্ট।
--- কী ব্যাপার? তোদের দেখছি পাখা গজিয়েছে!
আমরা নিজেদের ডিফেন্স স্ট্র্যাটেজি হিসেবে ""শরণাগত দীনার্ত পরিত্রাণপরায়ণে'' সুর এনে মুম্বাইয়া ফিলিমের "হুজুর মাঈবাপ্' টোনে বল্লাম-- এইসা গুস্তাখি মাফ কিয়া জায়। আমাদের আদৌ কারো বাপ-মা নিয়ে কোন মন্তব্য করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না। মুখ দিয়ে যা বেরিয়েছে তা নেহাৎই অজ্ঞতা প্রসূত "জিকে' বাড়ানোর জন্যে মিনিমাম কৌতূহল। ভেবে দেখুন, ঐ প্রশ্নটি দাদাটির দেয়া লেসনের হোমটাস্ক, বা লজিক্যাল করোলারি। আমাদের ট্র্যাক রেকর্ড দেখুন। কোনদিন আমরা ছোটবড় কারো বাপ-মা তুলেছি?
জল্লাদেরা হেসে ফেল্লো । আর আঙুল উঁচিয়ে এবারের মত! বলে শাসিয়ে গেল।
আমরা তিনজনেই তখনকার ""অ্যাল্ ইজ্ ওয়েল'' এর সমকক্ষ ফিল্মি গান ""জ্যোতি সে জ্যোতি জাগাতে চলো, প্রেম কী গঙ্গা বহাতে চলো'' গাইতে আর নাচতে লাগলাম। এভাবেই ""সংঘম্ শরণং গচ্ছামি'' মন্ত্রে দীক্ষিত হলাম।
না:, জন্ম-মৃত্যুর রহস্য আজীবন মানুষকে তাড়িয়ে বেড়ায়।
আমার মা স্মৃতিকণা জন্মেছিলেন নেত্রকোণা সাব ডিভিসনের এক অখ্যাত গাঁয়ে, নাম উয়ারা। কিন্তু পাশের গন্ডগ্রাম ইত্ননা্ বিখ্যাত হয়ে গেল তৎকালীন অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির ডাকসাইটে নেতা রাজ্যসভার সদস্য ভুপেশ গুপ্ত মশায়ের জন্মভূমি হিসেবে। বড়পিসিমা শিশিরকণার বিয়েতে বর ও নিতবরের জন্যে ভুপেশ গুপ্ত মশায়ের বাবা মহেশ গুপ্তের কাছ থেকে দুটি হাতি ধারে আনা হয়েছিল। সুদের কারবারী মহেশ গুপ্ত ঠাকুর্দাকে কিছু টাকা ধারও দিয়েছিলেন। আবার আমার দাদামশায় রসিকলাল দত্ত মশায় কমরেড ভুপেশের পৈতৃক ভিটেয় দুপুরবেলা মাছের ঝোল দিয়ে ভাত মেখে মুখে তোলার সময় কালঘুমে চোখ বুঁজলেন।
তাহলে দেখতেই পাচ্ছেন কমরেড ভুপেশের সঙ্গে আমাদের কি'রম যেন লতায়-পাতায় একটা সম্পর্ক আছে। (উনি আমার কি লাগেন? ঠাকুরবাড়ির গাই লাগেন।)
আরে, এখানেই শেষ নয়। বেয়াল্লিশের মন্বন্তরের সময় গান্ধীজি করলেন ""ভারত ছোড়ো'' আন্দোলন। কিন্তু কমিউনিস্টরা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক পিতৃভুমি(!) রক্ষার লড়াইয়ে মিত্রশক্তি অর্থাৎ বৃটিশের সঙ্গে যুক্তফ্রন্টের ডাক দিল। বুভুক্ষু মানুষের জন্যে লঙ্গর পরিচালন তখন তাদের মুখ্য কর্মসূচী হয়ে দাঁড়াল। সলিল কুমার থাকতেন জ্যোতি সিনেমার কাছে ধর্মতলায় একটি মেসে। সেখানে বোর্ডারদের টাইমপাস রাজনৈতিক বিতর্কে কমিউনিস্টদের অবস্থানকে দেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা বলে চড়া গলায় চেঁচিয়ে ছিলেন। কাছেই ছিল ""ইস্কাস্'' বা ""ইন্দো-সোভিয়েত কালচারাল সোসইটি''র অফিস। কমরেড ভুপেশ তখন সেইখানেই থাকতেন। শুনে বল্লেন-- ওনাকে এখানে ডেকে আন, বুঝিয়ে দেব।
কিন্তু ময়মনসিংহের গোঁয়ার যুবক সলিল কিছুতেই বুঝলেন না।-- নেতাজিকে কুইস্লিং বলা!! হুঁ:।
আবার ধান ভানতে শিবের গীত শুরু করেছি। তো স্মৃতিকণা পিতৃহীন হলেন ছ'বছর বয়সে। বাবার নামে খোলা মায়ের পড়ানো প্রাইমারি স্কুলে পড়লেন। তারপর আরও পড়তে হলে মহকুমা সদরে যেতে হবে। দাদা রাজি হলেন না। মনের দু:খ মনে রেখে স্মৃতিকণা কবিতা পড়তে লাগলেন। ভাবুন, সেই সময় অজ পাড়া গাঁ থেকে আসা মেয়েটি পড়ে রবীন্দ্রনাথ, আর বিয়ের পর কোলকাতায় এসে জীবনানন্দ! বিয়েতে উপহার পেয়েছিলেন ""সঞ্চয়িতা'' আর সুবোধ ঘোষের ""ভারত প্রেমকথা''।
ফলে নিজের সন্তানদের ঘুম পাড়াতে শোনাতেন সেইসব। বাড়ির কাজের মেয়েদের বা অন্যান্য ননদ ইত্যাদিরা যেসব ঘুমপাড়ানি গান শোনাতেন তাতে কিঞ্ছিৎ এলিট রুচিসম্পন্ন স্মৃতিকণার নাকসিঁটকানো ভাব ছিল।
সবচেয়ে কমন ঘুমপাড়ানি গান বা লোরি/লুলাবি ছিল-----
""আয় ঘুম, যায় ঘুম, ঘুমালো গাছের পাতা,
হেঁসেলঘরে যায় ঘুম মাগুরের মাথা।
আগদুয়ারে যায় ঘুম কালো কুকুর,
বিছানাতে যায় ঘুম বাপের ঠাকুর''।।
কিন্তু চা-বাগানের মজুর পরিবার থেকে কেনা আমাদের ট্র্যাডিশনাল দাসী পরিবারের মহিলা ভেলিপিসি শোনাতেন একেবারে ""মা-মাটি-মানুষ'' স্তরের গান।
"" অলি-ললি রে, কালবাদুড়ের ছা',
দুইলাবাদুড় মাইর্যা দিলম ডাল অ বইয়া খা';
ডাল-ডুল ভাইঙ্গ্যা গেল তেলি বাড়িত্ যা।
তেলি এ দিল ত্যাল, মালী এ দিল ফুল,
রাখ্খাল রাজায় বিয়া করে উন্দুরে বাজায় ঢুল্।।''
কিন্তু স্মৃতিকণা যেদিন ঘুম পাড়াতেন সেদিন শোনা যেত---""তোমার শঙ্খ ধুলায় পড়ে কেমন করে সইব?'' বা, "" কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও'', অথবা ""হায় চিল, সোনালি ডানার চিল''।
মায়ের কোলের থেকেই এত কবিতা! ধম্মে সইবে? আরে, আগে অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত, স্বরবৃত্ত শেখ, তা না--।
না, ধম্মে সয় নি। তাই আমাদের দুই ভায়ের ইহকাল-পরকাল ঝরঝরে হয়ে গেল। আর তৃতীয় ভাইকে কোলেনিয়ে ঘুম পাড়ানোর সময় উনি শোনালেন সেই সময়ের সাম্যবাদী
দলের মহিলা শাখার মুখপত্র ""একসাথে'' ( সম্পাদক সম্ভবত: সরোজ মুখুজ্জের স্ত্রী কনক মুখুজে) পত্রিকায় প্রকাশিত একটি ঘুমপাড়ানি গান।
""ও মোর যাদুধন, ও মোর যাদুধন,
তোর ঘুম কে করে হরণ?
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কিসে?''
একটু বড় হয়ে হাতে এল সেই ম্যাগাজিন। কবিতাটি পড়ে আমার মাথা তাঝ্ঝিম-মাঝ্ঝিম্ করতে লাগল। কবিতাটি ট্রামের ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদী মিছিলে পুলিশের গুলিতে নিহত ছেলের জন্যে মায়ের বিলাপ। এই গান উনি শুনিয়েছেন ছোটছেলেকে দিনের পর দিন?
পঁয়ত্রিশ বছর পরে সেই পার্কসার্কাসের বাড়ির দোত্লা থেকে এক ভোরে রক্তবমি করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামছে ছোটছেলে অমিত। ট্যাক্সি করে হাসপাতালে যাবে। আর নীরবে পেছন পেছন রক্তের দাগ মুছতে মুছতে নামছেন স্মৃতিকণা। ছোটছেলেকে সেই শেষ দেখলেন। পরের দিন ভোর পাঁচটায় কেওড়াতলায় বিদ্যুৎচুল্লীতে ভাইয়ের শরীর ঢোকাতে ঢোকাতে বড়ছেলের কানে বাজতে লাগল মায়ের সেই গান-- ও মোর যাদুধন।
(চলবে)