এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ  গুরুচন্ডা৯ নয়

  • আমি ও ভিকিদা

    দীপ্তেন
    আলোচনা | বিবিধ | ০১ সেপ্টেম্বর ২০০৬ | ১০৮৭ বার পঠিত | রেটিং ৪.৫ (২ জন)
  • নীতিসম্পন্ন বিতর্কীকরন :

    দোহাই পাঠককুলকে, ভুল বুঝবেন না। এই লেখার প্রতিটি চরিত্রই জলজ্যান্ত। সব কটি অক্ষরই নিতান্ত ব্যক্তিগত। এটাকে নৈর্ব্যক্তিক ইয়ার্কিমুখী কাল্পনিক কথোপকথন ভাববেন না। এটি এক সিরিয়াস দলিল, মন দিয়ে পড়লে দুই প্রজন্মের বিভেদ ও বিভাগের সব রহস্যের চাবি কাঠি একেবারে আপনার হাতের মুঠঠিতে, হুঁ।

    আসুন, আলাপ করুন ভিকিদার সাথে। বয়সে প্রবীণ, কলেস্টরলীয় আশংকায় নবীন, টাকেতে উজ্জ্বল, তিন পেগের পর এক প্রানচঞ্চল সংসারী পুরুষ। আর দীপ্তেন - এক বিচক্ষন প্রাপ্তমনস্ক যুবক, তার তরুন চোখে বিশ্বব্যাপী সাম্য, সৌভ্রাতৃত্ব, পরিবেশ সচেতনতা ও গ্রীন কার্ডের সবুজ স্বপ্ন।

    ভিকিদা জন্ম আঁতেল। তাঁর সম বয়সী ছেলেরা যখন নেসফিল্ডের গ্রামার বই'এর ভিতরে নুকিয়ে বাংলা চটি পর্নোগ্রাফি পড়তো তখন ভিকিদা সেটা পড়তেন কাফকার বই'র মধ্যে লুকিয়ে। একবার আরেকটু হলেই কঠ উপনিষদ প্রায় পড়ে ফেলে ছিলেন আর কি - সেই স্মৃতিতে খুব উত্তেজিত হয়ে তিনি এখনো খুব গভীর দার্শনিক বানী দেবার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়েন। কিন্তু অমন কঠিন তত্ত্ব শুনবে - আজকাল ছেলে ছোকরাদের কি সেই ধৈর্য্য রয়েছে মোটে?

    দীপ্তেন খুব রাগী যুবক। বেশীর ভাগ জিনিস ই তার নাপসন্দ। পলিটিকস, অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট, দুর্গা পুজা, মিনি বাস, বিউলির ডাল, নিজের বাম কনুই, ইত্যকার বহু জিনিস নিয়েই তার আপত্তি আছে - কিন্তু তার কথাই বা শোনে কে?

    কিন্তু বয়সের যথেষ্ট পার্থক্য থাকলেও কিছু কিছু যায়গায় বেশ মিল আছে, যেমন দুজনেই অপছন্দ করেন গোলা কাঁঠাল, ডোরাকাটা হুলো বেড়াল আর সর্দীকন্ঠী পিয়ালী সেনের গাওয়া "সেদিন কেনো চাঁদ হেসেছিলো" গানটি। আবার পছন্দের তালিকায় দুজনেই ভালোবাসেন তর্ক বসুর ভুগোলের উপর কবিতা, আমের পানা আর শীতকাল।

    দুজনেই ছাতা পছন্দ করেন তবে ভিন্ন কারনে। ভিকিদার যৌবনে একবার সেই দেওঘরে, দিনশেষের আলোয় রাঙা চৈত্রমাসে একটা রাগী গরু তাড়া করলে তিনি আর কিছু না পেয়ে হাতের ছাতা টিকে খুলে ধরেন - যদি শিংএর মোমেনটাম কিছুটা থমকানো যায় এই দুরাশায় - কিন্তু খোলা ছাতায় সেই বদমেজাজী গরু কি সর্বনাশ দেখেছিলো কে জানে, তখুনি অ্যাবাউট টার্ন করে বিকট হাম্বা গর্জনে পাড়া কাঁপিয়ে পালিয়ে গেছিলো। ভিকিদা তারপর খুব কম সময়েই ছাতা ছাড়া অচেনা যায়গায় যান।

    দীপ্তেনের বয়স কম, হর্মোনের শাসন মেনে বিনা পয়সার পার্কে বান্ধবীকে নিয়ে গেলে ছাতা'র আব্রুতে তাদের অনুরাগ পর্ব বেশ চমৎকার চলে। তাই ভর গ্রীষ্মে নির্মেঘ সন্ধ্যাবেলাতেও দীপ্তেন ছাতা বগলে বান্ধবীর জন্য উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করে - কখন আসবেন তিনি বটুয়াতে খবরের কাগজ নিয়ে।

    তবে মুল্যবোধের তফাৎ তো থাকবেই - প্রায় বছর তিরিশের ফারাক যখন রয়েছে দুজনের জন্মদিনের মধ্যে।

    এই ধরুন না ভিকিদা প্রবীন ও কেমন শান্ত মানুষটি, রাগে একেবারে ফেটে পড়েন যদি ইলিশের সর্ষে বাটা ঝোলে কেউ বেগুন দ্যায় অথচ অমন যে রগচটা দীপ্তেন সে কেমন নির্বিকার মুখে কি ইলিশ কি বেগুন দুটোই কচমচিয়ে খেয়ে ফ্যালে।

    তবু তাদের মধ্যে একটা বন্ধুত্বের বাতাবরন (বাতাবরন ই তো কথাটা?) এক অসমবয়সী সৌহার্দ্যের একেবার ইয়ে গড়ে উঠেছে (মানে আর একটা বাতাবরন) ফলে তাদের আড্ডাটা বেশ জমে।

    এমন ই একদিন সাঁঝবেলাতে :

    ফিফটি প্লাস ভিকিদার বৈঠকখানায় দুজনে বসে, স্বাস্থ্য সচেতন দীপ্তেন লাল চোখ করে বাটার মিল্ক খাচ্ছে, ভিকিদার সবে দেড় পেগ হয়েছে - মুখে অলরেডী একটা স্বর্গীয় হাসি লুকোচুরি খেলছে।

    দীপ্তেনের পরনে লো রাইস ডেনিম, পরিষ্কার দেখা যায় তার সুঠাম কোমর ও ঝকঝকে আন্ডি'র সীমারেখা। বগল কাটা কালো টি শার্টের উপর ঝলমলে রুপালী রঙে জাবদা অক্ষরে নিতান্ত ফাজিল বাক্যবন্ধ। ভিকিদা চেয়ারের উপর এক ঠ্যাং তুলে বসে, পরনে হাই রাইস সবুজ চেক কাটা লুংগি আর স্যান্ডো গেঞ্জী। দুটোতেই যথেষ্ট পরিমানে টুথপেস্ট ও নানান লাঞ্চ ডিনার ও ব্রেকফাস্টের নিশানা। প্রায় বুক থেকে শক্ত গিঁট দিয়ে বাধলেও ভিকিদার ন্যাদোস ভুঁড়ি পষ্টই বোঝা যায়। আর একথা সকলেই জানেন তর্কের তাপমানের সাথে লুংগির ফস্কা গেরোর একটা নিটোল সম্বন্ধ রয়েছে সভ্যতার প্রথম থেকেই । খুব রেগে গেলে লুংগীর গিঁট খুলে যাবেই। ভিকিদা এব্যাপারের যথেষ্ট সচেতন ও অভিজ্ঞ হলেও সমস্যাটা থেকেই গেছে।

    দীপ্তেন চোখ লাল করে বলে: তোমাদের ঐ নস্টালজিয়া শুনলেই রাগ হয়। (ভেঙিয়ে) আহা হা, সে ছিলো আমাদের সময়। পুন্নিমার চাঁদ কি গোল ছিলো, বিষ্টির ফোটা গুলো পজ্জন্তো ইয়াব্বড়া টুসটুসে ভেজা ভেজা, আর ফুলকপি খেলে সারাটা দিন একটা মৃদু হাস্নুহানার সৌগন্ধ ছেয়ে থাকতো? ছ্যা:।

    এটা দুজনেরি ফেবারিট তক্কের সাবজেক্ট তাই ভিকিদা রাগেন না। বরং একগাল "ওরে আমার আদুরে বাঁদর" হাসি হেসে মিঠে গলায় বলেন "ছিলো। অনেক কিছু ই ভালো ছিলো। লোকে মুখে মুখে বড় বড় নামতা মুখস্ত বলতো। আর এখোন দ্যাখ ধোপা আটটা বড় আর চাট্টে ছোটো জামা নিলে ও ক্যালকুলেটর ছাড়া হিসেব কেউ কত্তে পারে না। তাপ্পর ধর না কেনো, পাওনাদারদের স্বচ্ছন্দে বলা যেতো "সি কি ,আপনি চিটি পাঠিয়েছিলেন? কই পাই নি তো, অথবা ফোন করেছিলেন? রিং হয়ে যাচ্ছিলো। ও মশাই ফলস রিং। পুরো পাড়ার ফোন দু মাস ধরে খারাপ।" হায়! সে দিন গেছে। সেলফোন, ইমেইল, কুরিয়ারের জ্বালায় ছেঁদো যুক্তি কিছুত্তেই আর দেওয়া যায় নারে।

    "কিন্তু তোমার এই অহৈতুকী বানী দেওয়া বন্ধ করো।" দীপ্তেন বলে আর সগর্জনে বাটার মিল্কের গ্লাসে রাগী চুমুক দ্যায় "এই যে সারাক্ষন ফাটা রেকর্ড চালাও। আমাদের ছিলো ইমোশোন আর তোদের আছে মোশোন, আমাদের ছিলো প্যাশন আর তোদের আছে ফ্যাশন। এটাও এবার থামাও তো। কি কনস্টিপেটেড প্রজন্ম ছিলে তোমরা, বাপরে?"

    ভিকিদা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার মমতাময় মনের বহি:প্রকাশ করেন, একটু ইতিউতি তাকিয়ে একটা সিগারেট ধরান আর বলেন "ওরে, যুগ যন্তন্না কি - সে কি আমি বুঝি নে? এই যে তোরা, তিরিশ হলেই ফ্ল্যাট কিনবো, কোথায় কিনবো, গাড়ী কিনবো - কি মডেলের হবে- কি অসুবিধেয় পড়িস আর আমরা পঞ্চাশের আগে এসব নিয়ে ভাবতামই না আর নেহাৎই চিন্তা কল্লে অ্যাম্বাসেডার না ফিয়াট - ব্যাস। অথচ এখন তোরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কি অসুবিধেতেই না পড়িস। তবে কি জানিস? ঐ নস্টালজিয়া। ইয়েতে ফোঁড়ার মতন বড্ড কষ্ট দেয়। এই মহানগর কলকাতার বুকের উপর বসে শীতকালে চাঁদনী রাতে শুনেছি খ্যাঁকশ্যালের হাহাকার আর বর্ষাকালে লক্ষ কোলাব্যাংএর গনসংগীত। শরতের সকালে দোয়েলের কোয়েলের মিঠে বোল......."

    দীপ্তেন থামিয়ে দ্যায়। "থামো তো। কোলা ব্যাং পাবে কি করে? ঐ ডোবার উপর গজিয়েছে তাল ঢ্যাঙা স্কাইস্ক্র্যাপার আর তারই এগারো তলায় ফ্ল্যাট কিনে তুমি ব্যাঙের দু:খে হেদিয়ে মরছো? পাখীর আওয়াজ পাবে কোথে্‌থকে এগারো তলার বারান্দায়। তার চে' এই নাও আমার সেল ফোন। শোনো কোয়েল, দোয়েল,উটপাখী - সব্বার কুহুধ্বনী। সত্যি, জলহস্তীরাও তোমাদের মতন অমন হিপোক্রিট নয়। সকাল বেলা পুলিশকে ঢিল ছুঁড়েছো, দুপুরবেলা শ্লোগান আর সন্ধ্যাবেলা নোট বই হাতে প্রফেসরের বাড়ী। দিন বদলের গান টান গেয়ে দিব্যি তো চাকরী বাকরী করছো। আর এই সিগারেট টা নেভাও তো, বিদিকিচ্ছিরি গন্ধো।"

    উত্তর আধুনিক প্রজন্মের প্রতিভু দীপ্তেনের সবুজ চেতনা অনেক সময়েই অবুঝের দিকে যায়। ভিকিদা কখনো জিমে যায় নি। সেই লাল গরুর মুখোমুখী হয়ে দেওঘরে ছাতা বগলে একবার দৌড়েছিলেন উন্নিশো একাশী সালের বাইশে মার্চ। তার পর আর কখনো তাকে গরুতে তাড়া করে নি - ফলে ভিকিদাও আর দৌড়ান নি। কিন্তু দীপ্তেন ভোর বেলা স্প্রাউটেড বীনস মধু অরেঞ্জ জুস ইত্যকার নানান ভিটামিন সমৃদ্ধ হিজিবিজি খেয়ে মাইল পাঁচেক ছুটে আসে। শনি রবি জিমে যায়। সিগ্রেটের ঘোর বিরোধী, আর মাঝে মাঝে দামী ওয়াইন খায় বটে কিন্তু নেশা করে না। ভিকিদার আবার সপ্তাহে একবার দুবার কথাটা জড়িয়ে না আসলে ঠিক জমে না। পাখীর সুমধুর আওয়াজে পুলকিত হলেও সেই পক্ষীপ্রেম মুর্গী পর্যন্ত টানবার কোনো ইচ্ছাই নেই ভিকিদার কিন্তু দীপ্তেন প্রায় নিরামিশাষী ।

    গোল গোল চোখ করে ভিকিদা তাকান দীপ্তেনের দিকে "ওরে, ঐ ঢিলের ফ্যায়দা এখন তোরা লুটছিস। আর ওসব মোটেই ঠাট্টা ছিলো না। যা করেছি তার ফলে এখন মিডিয়া থেকে মন্ত্রী - সবাইকেই অনেক ইয়ে হতে হয়েছে - বুঝলি? আর ফ্যাশন আমাদের সময়েও ছিলো। ঝাঁকরা চুল, নোংরা ঢোলা পাজামা, আজানু বিস্তৃত পাঞ্জাবী, কানে বিড়ি, বারদুয়ারীতে চুল্লুর গ্লাসে চুমুক..... ওটা আমাদের ফ্যাশন ছিলো। তো সেই ফ্যাশন ঠাকুরের কাছে নৈবিদ্দি দিয়ে সবই মানত করেছি তখন ... ড্রেনের মধ্যে গড়াগড়ি খেয়ে খালাসিপট্টিতে রাত কাটানোটাও। যেমন এখন তোদের মেট্রোসেক্সী নাচ গান, ডিস্কো, ডেনিম। সারা রাতের মোচ্ছোব।"

    গ্লাসে লম্বা চুমুক দিয়ে ভিকিদা আরো বক্তব্য রাখেন "বুঝলি না ? সবই করেছি কিন্তু লক্ষ্য থেকে চোখ সরাই নি।"

    - "কি তোমাদের ইয়ের লক্ষ্যটা ছিলো শুনি?"

    - "ইয়ে, মানে সমাজ, সংস্কৃতি, সামাজিক দায়বদ্ধতা ..... "

    রাগী দীপ্তেনও হেসে ফেলে। "তোমরা আজীবন ছেলেমনুষ থেকে গেলে। কিছু চীনামাটীর পুতুল ভেঙে জিন্দগী ভর গোঁফ মুচড়িয়ে গেলে আমরা কি হনু রে। আর আমরা জম্ম থেকেই সাবালক - যদি পুতুল ভাঙি তো পয়সা নিয়ে ভাঙবো।"

    "তো আমাদের যদি মটো ছিলো ভাঙছি পুতুল দেখবি আয় তোদের স্লোগানটা কি?" গ্লাসে লাস্ট পেগটা ঢেলে খুব হতাশ ভাবে জল মিশায় ভিকিদা।

    "বল্লে হবে - খচ্চা আছে" - বুঝলে এটাই বাইবেল।

    ফোঁস ফোঁস করে নি:শ্বাস ফেলে ভিকিদা বলেন আরে আমরা দুজনেই তো একই কথা বলছি। তোরা বড়ই ক্যালকুলেটিং। প্রেমে ও পড়িস অংক কষে। জন্ম থেকেই কেরিয়ার নিয়ে এতোই ব্যস্ততা আর কিছু তোদের নজরে পড়ে না। কখনো রিবেল করতেই শিখলি না? শুধুই এস্টাব্লিশমেন্টের ধামাধরা আর নিজেরটা গুছিয়ে নেওয়া। আর তোদের কালচার? ছ্যা:। কে ঐ তীর্থংকর তো আজকাল খুব কবিতা লিখছে । কি না "কি সুন্দর কবিতা লিখছে মল্লিকা / ধর ধর ওকে ধর"। এটা কবিতা?

    তো ভিকিদার উষ্মার যথেষ্ট কারন আছেন। বহু কোটি ব্যার্থ কবিদের দংগলে আমাদের ভিকিদাও পরেন। বড় পত্রিকায় নিয়মিত কবিতা পাঠিয়ে একটাও ছাপা নাহওয়ায় উনি দুরন্ত এস্টাব্লিশমেন্ট বিরোধী কবি হয়ে ওঠেন কিন্তু লিটিল ম্যাগাজিনেও যে কি ভীষন ভীড় কবিদের। ঠেলে ঠুলে ওখানে ও বসার যায়গা না পেয়ে তিনি কবি (প্রকাশিত) হবার আশা জলাঞ্জলি দিয়েছেন। আপাতত: একজন আত্মজৈবনিক ঔপন্যাসিক হবার গূঢ় স্বপ্ন দেখছেন কিন্তু কোনো ভালো থীম খুঁজে পাচ্ছেন না। তাই বর্তমান প্রজন্মের কবিদের উপর ভিকিদার রাগ সর্বাধিক, তিনি প্রায়ই বলে থাকেন হ্যাঁ, গান টান মন্দ হচ্ছে না, নাটক ও তো দেখছি ভালোই জমেছে আজকাল, সিনেমাও। কিন্তু ঐ কবিতা : এ: হে হেহে। কিস্‌সু হচ্ছে না। কিস্‌সু না।

    দীপ্তেন কবিতা লেখে না, জীবনমুখী গান শুনলে আন্তরিক চটে যায়। তাই আধুনিক কবিদের গাল দিলে তার কাঁচকলা। দীপ্তেনের এক জ্যাঠা খুব ভালো কীর্তন গাইতেন তাই না চাইলেও দীপ্তেনের গলা বড় সুরেলা, মাঝে একবার ভেবেছিলো একটা র‌্যাপ কেত্তন গোছের ফিউসন ভক্তিগীতি র দল চালু করবে। কিছুদিন চেষ্টা করে বুঝলো যে তার সময় এখনো আসে নি তাই কবিতায় বীতস্পৃহ হলে ও গানের টপিক উঠলে দীপ্তেন বড় আবেগপ্রবন হয়ে যায়। কিস্‌সু হচ্ছে না দীপ্তেন ও বলে। হয় ন্যাকা ন্যাকা কবিতাগুলোকে ঘ্যান ঘ্যানে সুরে গাওয়া হছে নয়তো সব কমিউনিস্ট গান - ধুস।

    তো, তো কি? দীপ্তেন উবাচ, "সগর্বে বলো আমি নিজেকে ভালোবাসি। আমার বডি ফিট। আমার বাজে নেশা নেই। ফালতু কবিতা লিখি না। নিল্লজ্জ, বেহায়া, দু কান কাটার মতন নিজেকে ভালোবাসি। আমি ই আমার ভগবান। আমার আর কোনো ঠাকুর নেই। আমি মুক্ত, স্বাধীন।"

    ভিকিদা সায় দ্যান সেটা ঠিকই, তোরা হচ্চিস ছাড়া গরু। কিন্তু আমাদের যৌবন শুধু আনুগত্যেই ভর্তি ছিলো। রাজনীতিতে গুরু ছিলো, সিনেমা, নাটক, কবিতা। সবেতেই কেউ বা কোনো দলের ন্যাজ ধরে থাকতাম। নিদেন পক্ষে ইস্টবেঙ্গল মোহোনবাগানের। উত্তম সৌমিত্রের। আর এখন তোদের কোনো বিশ্বাস নেই তোরা স্বাধীন। বলেন আর সুদীর্ঘ চুমুক দেন হুইস্কিতে। একটু মুচকি হাসেন ভিকিদা "তাইলে? খামোখা তক্কো করছিলি ক্যানো? তোরা হচ্ছিস হৃদয়হীন গামবাট। যাকে বলে স্বার্থপর। আমি বলছি। আর তুই ও মানছিস। তাইলে তক্কো করিস ক্যানো? অ্যাঁ?"

    খুব ঐতিহ্যময় এই তর্কের আসরে এটা একটা টার্নিং পয়েন্ট। এখান থেকে ই দুজনে জোর গলায় চেঁচাতে থাকে আর দুজনেই দুজনকে বলে "খামোখাই মেজাজ গরম করছিস/করছেন ক্যানো?"

    বাটার মিল্ক টা বোধ হয় ভালো ছিলো - নয়তো দীপ্তেনের ক্ষিদে পেয়েছিলো - মোটকথা দীপ্তেন রাগলো না। এক পরমহংস হাসি হেসে বল্লো "আমরা ঢাক পিটিয়ে স্বার্থপর, কেননা আমরা অনেস্ট। আর তোমাদের হচ্চে ঘোমটার আড়ালে খ্যামটা। আমাদের কোনো দল নেই। নিজেরটা ভালো বুঝি তাই চাই দুনিয়াটাও ভালো হোক। দুনিয়া সবুজ হোক। সবাই সমান হোক এটা চাই না - কিন্তু সবার পাতে ই কিছু পরুক। ব্যাস"

    আড়াই পেগের ঝিমুনী ধরেছে। ভিকিদা একটু চুপ করে থাকে। বহুগামী বল্লে বেশ উদ্দীপনা হয় কিন্তু দ্বিচারিতার কথা উঠলে মন কেমন করে। একটা যুৎসই কোটেশন দেবার জন্য ছট ফট করলেও কিছুতেই মনে আসে না। কে যেন বলেছিলো - সেই কি যেন কথাটা ? উফ ।

    "তো বল" ভিকিদা শংকিত হয়ে প্রশ্ন করেন "সবাই ধান্দা করলে ছবি আঁকবে কে? নাটক লিখবে কে?"

    "সে পাগোল সব দেশে ই পাবে" আশ্বাস দেয় দীপ্তেন "সব যুগে ই থাকবে। আমরা তাদের পুষবো। এট্টু আট্টু রঙ্গ তামাশা, সামান্য বিদ্রোহ চলবে। অগ্নিবর্ষী কবি পেলেই পুরষ্কার দিয়ে দেবো।নৈলে অধ্যাপক করে দেবো। আর ও সব ছাড়াও দিব্যি চলে যায় জীবন। হুইস্কি ছাড়া তো থাকত্যে পারো না - লাস্ট ভালো কবিতা পড়েছো কবে? মনে পড়ে?"

    ভিকিদা কট মট করে তাকায় "তুই যদি আমার ছেলের বয়সী না হতি তো বলতাম - ইয়ে - অত্যন্ত পেছন পাকা সব জান্তা গাড়োল।"

    দীপ্তেনও চটে যায় "নেহাৎ প্রায় বাপের বয়সী না হলে আমি ও বলতাম স্রেফ বাত্তেলাবাজ ঢ্যামনা"।

    দুজনে ই রাগী চোখে দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে। এক ফাজিল টিকটিকি শুধু বলে ঠিক ঠিক ঠিক।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ০১ সেপ্টেম্বর ২০০৬ | ১০৮৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • ` | 134.238.***.*** | ৩০ মে ২০২২ ১৬:১৯508242
  • `
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন