করোনা রোগের লিস্টে একটি নতুন বিপর্যয়। কিন্তু অত্যাধুনিক উন্নত প্রযুক্তির যুগেও এই সামান্য রোগ দুনিয়া জুড়ে এত হাহাকার ফেলে দিতে পারলো কিকরে? এই প্রশ্নের উত্তর ভাইরোলজিতে পাওয়া যাবেনা। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে সমাজটা কিভাবে চলে সেই নীতি নিয়মে।
প্রথমে নিজের অভিজ্ঞতাই বলি। গুরুতে আগেও লিখেছি। তবু আর একবার শুরু থেকে বলি।
আমাদের মধ্যবিত্ত বাড়ি। বাবার প্রাইভেট টিউশন এবং মার আই সি ডি এস চাকরি৷ আমি বাইরে থাকি পড়ার জন্য। এ বছরের শুরুতে, জানুয়ারীতে বাবার অনেক গুলি অসুখ ধরা পরে। কিডনির, লিভারের, সুগার ইত্যাদি। এতদিন জানা যায়নি কারণ আমাদের বাড়ির পাশের সাবডিভিশন হস্পিটালে এত উন্নত ট্রিটমেন্ট নেই। আর খরচ করে চিকিৎসা করাতে চায়না যে পরিবারগুলো; কেন চায়না জানতে গেলে তাদের দৈনন্দিন জীবন জানার কষ্ট করতে হবে। প্রাইভেট টিউটর বাবার প্রত্যেকদিন মেডিকেল বা এন আর এস গিয়ে চিকিৎসা করানোর সুযোগ নেই। তাই খুব কষ্ট না হলে আমাদের মতো পরিবারের কারোর রোগ ধরা পরেনা। যাইহোক, জানুয়ারীতে একরকম জোর করেই বাবাকে ক্যালকাটা মেডিকেল হস্পিটালে নিয়ে যাওয়া শুরু করি। বাবা ক্যানিং থেকে ভোর ৪ টে নাগাদ ট্রেন ধরে গিয়ে লাইন দিত। বিকালে ফিরে টিউশন পড়াতে যেতে হবে বলে। ট্রিটমেন্ট চলছিল যত অসুবিধাই থাক। অপারেশন এর কথাও ছিল মার্চ-এপ্রিলে। সেসব আজ আর লিখবোনা।
মার্চে হঠাৎ প্লেনে চড়ে করোনা এল। মেডিকেল কলেজ এক্সক্লুসিভ করোনা মডেলে বন্ধ হয়ে গেলো অন্যান্য রোগীদের জন্য। কড়া লকডাউনে কোলকাতা যাতায়াত অসম্ভব হয়ে পড়লো। পরিস্থিতি এমনই দাঁড়ালো, অন্য কোন হস্পিটালে নিয়ে যাবো সেটা আর ঠিক করতে পারলাম না। তার উপর লকডাউনে প্রাইভেট টিউশন বন্ধ হয়ে বাবার ইনকাম বন্ধ। ৫৫ বছরের একজন শিক্ষক এক মাসে অনলাইন ক্লাস শিখে উঠতে পারেননি। আর ক্যানিং এর মতো জায়গায় ছাত্র-ছাত্রীরাও অনলাইন ক্লাসে অভ্যস্ত নয়। ফলে এরকম একটি বিপর্যয়ে, হাজার হাজার টাকা দিয়ে গাড়ি ভাড়া করে, বিভিন্ন হস্পিটালের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে বেড়ানোর মতো মানসিক ইচ্ছা বাবা মা আমার কারোরই আর হয় নি। যথারীতি পুরানো ওষুধ গুলোই চলছিল ৪ মাস বিনা চেকাপেই।
এর মধ্যে নতুন উপদ্রব করোনা সেন্টার এবং মানুষের আতঙ্কে বিকারগ্রস্ত আচরণ। বাড়ির পাশের হস্পিটাল সামান্য জ্বর কাশি হলেও পাঠিয়ে দিচ্ছে করোনা সেন্টারে। সেখানে সুস্থ স্বাভাবিক কোনো মেন্টেনেন্স নেই। যে কেউ, যার সরকারি হস্পিটালের অভিজ্ঞতা আছে, সে আন্দাজ করতে পারবে সরকারি কোয়ারেন্টাইন সেন্টার কিরকম হতে পারে। শুধু অব্যবস্থা তো নয়, সাথে জড়িয়ে আছে ভয়। যে ভর্তি তারও মানসিক অবস্থার অবনতি হবে। যারা কাজ করছে ওই সেন্টারে, তারাও ঢাল তরোয়ালহীন নিধিরাম সর্দার হয়ে দুরুদুরু বুকে কতটাই বা পরিষেবা দেবে। এরপর আশে পাশের মানুষজন যদি শোনে কোভিড সেন্টারে গেছে, রোগী এবং তার পরিবারের করোনা হোক না হোক, বাড়িতে-এলাকায় স্বাভাবিক ভাবে থাকা যে আর হবেনা এটা নিশ্চিত। যদি বাড়ি বয়ে একদল আতঙ্কগ্রস্ত কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোকজন মারতেও আসে, মৃত্যুর আগে যে প্রশাসন এসে পৌঁছাবে না এ গ্যারান্টি দেওয়াই যায়। পৌঁছালেও সেটা ওই ১-২% ব্যতিক্রম লিস্টে। ফলে বাবা এবং বাবার মতো বহু মানুষ যে কোনো ধরনের অসুখই অত্যন্ত যত্নে লুকিয়ে রাখছে। এমনকি নিজের বাড়ির লোকের থেকেও।
জুলাইয়ের ৯ তারিখ নাগাদ বৃষ্টি ভিজে, শারীরিক পরিশ্রমের কিছু কাজ করে বাবা একটু অসুস্থ হয়। হাল্কা জ্বর, কাশি, প্রস্রাব লাল। এই উপসর্গ বাবার প্রায় সব সময়ই হয়। করোনা যখন ছিলোনা তখনও। যাইহোক সরকারি হস্পিটালে ভরসা করে যেতে না পেরে প্রাইভেট ডাক্তারের চেম্বারে যায়। ডাক্তার জানায় প্রেসার বেড়ে গেছে। এবং আগের জটিলতা। ওষুধ দেয়। ৪ দিন পর না কমলে বিভিন্ন টেস্ট করাবে বলে। বাবার পরের দিনই জ্বর কাশি কমে যায়। তারপর ৩ দিনের দিন বিকালে হঠাৎ হাল্কা শ্বাসকষ্ট, প্রবল ঘাম এবং শরীর ঠান্ডা হয়ে যেতে শুরু করে। মা ভয় পেয়ে হস্পিটালে নিয়ে যায়। অনেক কষ্টে একটা গাড়ি পাওয়া যায়। কারণ অসুস্থ রোগীদের নিয়ে যাওয়ার জন্য কোনো গাড়িই আসছেনা সহজে। লকডাউনের জন্য বিকালের পর আমিও গাড়ি না পেয়ে অতদূর থেকে এসে উঠতে পারিনি। হস্পিটালে নিয়ে গেলে ইমার্জেন্সিতে রোগীকে বসিয়ে রেখে ডাক্তার শ্বাসকষ্ট শুনেই মাকে চলে যেতে বলে কোভিড সেন্টারে। ওই একটা শব্দ শোনার পর আর কোনো কথাই সেদিন ডাক্তার শোনেনি। কোনো গাড়িও পাওয়া যায়না কোভিড সেন্টারে বাবাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আর হস্পিটালেরও ওসব যায় আসেনা। অনেক কষ্টে অন্য জায়গায় যাবে বলে একটা টোটো নিয়ে কোভিড সেন্টারের অনেক দূরে মা আর বাবা নেমে যায়। মার কথায় "ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল লোকটা। ঘামে ভিজে গেছে পুরো। হাপাচ্ছে। সেই অবস্থায় অনেকটা হেঁটে হেঁটে কোভিড সেন্টারের একটা গেটে নিয়ে গেলাম। ওরা বললো অন্য গেট দিয়ে আসতে।" রাতের অন্ধকারে নোংরা আবর্জনার পাশ দিয়ে চোর ডাকাতের ভয় নিয়ে অনেকটা পথ আবার হাঁটিয়ে বাবাকে মা অন্য গেটে নিয়ে যায়। সেখানে প্রায় ৩ ঘন্টা বাবাকে বসিয়ে রাখা হয় চেয়ারে, বিনা ট্রিটমেন্টে। বাবা তখনও ফোনে আমায় বলছে, " আমাকে কেউ অক্সিজেন দিচ্ছেনা"। তারপর বাবাকে ভর্তি নেয় ওরা। মা বাড়ি আসে। আসার এক ঘন্টা পর হস্পিটাল থেকে ফোন আসে, " পেশেন্টের অবস্থা খারাপ হচ্ছে, এখানে ব্যবস্থা নেই। এক্ষুনি নিয়ে যান"। মা অসুস্থ হয়ে পড়ে। রাত ১০ টায় একা একা যায় সেখানে। আর একজন পরিচিত দাদা খবর পেয়ে যায়। কোভিড হস্পিটাল বলে, রেফার করার নিয়ম নেই। তাই বন্ড সাইন করে পেশেন্ট নিয়ে চলে যেতে হবে। নয় পেশেন্ট বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে। আইসিইউ তে বেড ভর্তি। কোনো এম্বুলেন্স বা বেডের ব্যবস্থা করে দিতে ওরা পারবেনা। আমি, ওই দাদা, আরও কয়েকজন মিলে ক্রমাগত প্রাইভেট ভাড়াগাড়ি, এলাকার সবকটি এম্বুলেন্সএ ফোন করে ফেলি। কোভিড হস্পিটালের গেট থেকে কোনো গাড়ি, কোনো এম্বুলেন্স পেশেন্ট নিয়ে কোলকাতা যেতে রাজি হয়না। আর যে কোনো গাড়িতে বাবাকে নিয়েও যাওয়া যেত না, অক্সিজেন ছাড়া। ১০২ এ ফোন করলে জানায় রেফার না লিখলে ওই এম্বুলেন্স নিয়ে যেতে পারবেনা। কোলকাতা থেকে এম্বুলেন্স এনে নিয়ে যেতে যে ৪ ঘন্টা মিনিমাম লাগবে। তারপরও কোনো হস্পিটাল রেফার ছাড়া আদৌ ভর্তি নেবে কিনা আমাদের জানা ছিলোনা। এভাবে রাত ১২ টা বেজে যায়। তারপর মা বলে, "বাইরে বের করে দিন অক্সিজেন খুলে, একেবারে ডেথ সার্টিফিকেট লিখিয়ে শ্মশানে নিয়ে যাই"। এরপর সদর হস্পিটালে রেফার করে ওরা। কোনো স্টাফ আসেনি এম্বুলেন্স এ তুলে দিতে। মা আর ওই দাদা মিলে তোলে এম্বুলেন্সে। অক্সিজেন সিলিন্ডার ড্রাইভার খুলতে পারছিলেননা। তাতেও কোনো স্টাফ আসতে চায়নি। শেষে একজন বাচ্চা মেয়ে, নার্স, বাবা মাকে চিনতে পেরে এগিয়ে এসে অক্সিজেন সিলিন্ডার খুলে দেয়। তাতেও তাকে বারণ করে অন্য স্টাফেরা। আমি ওদের দোষ দেইনা। কারণ যথেষ্ট পিপিই নেই ওদের। ওসুস্থ হলে উন্নত চিকিৎসার গ্যারান্টিও নেই স্টাফেদের। কদিন আগেই দেখলাম কোভিড চিকিৎসক ৩ খানা হস্পিটালে ঘুরেই মরে গেলেন।
সদর হস্পিটালেও বাবাকে নিয়ে যায় মা আর দাদা। কোনো স্টাফ আসেনি।ভেন্টিলেশন দেওয়া হয় রাত একটায়। মাকে বলা হয় রাতে থেকে যেতে। দাদা ফিরে যায় বাড়ি। তারপর শুরু হয় আক্রমণ। ওই দাদাকে আক্রমণ করা হয়। রটিয়ে দেওয়া হয় আইসিইউতে ভর্তি করোনা নিয়ে। দাদা এবং দাদার পরিবার বিব্রত হয়ে যায়। অন্যান্য রোগীর পরিবার মাকে বের করে দেয় হস্পিটাল থেকে রাতে। কোনো এক কোনায় হস্পিটালের বাইরে অ-সুরক্ষিত অবস্থায় সারারাত বসে থাকে মা একা।
সকালে আমি পৌঁছাই৷ ডাক্তার জানিয়েই দেয় রাতে আর আধ ঘন্টা দেরি হলে সেদিনই বাবা মারা যেত। এরপর ৪ দিন চলে যুদ্ধ। মা অসুস্থ হয়ে পড়ায়, একা মাকে বাড়িতে রেখে সারাদিন আমি আর আমার বন্ধুরা হস্পিটালে বসে থাকি। যেই আসে হস্পিটালে তাকেই আক্রমণ করে পেশেন্ট পার্টিরা। তাদের পরিবার এবং বাড়িতেও চাপ সৃষ্টি করে একদল মানুষ নানাভাবে। তাও তারা এসেছিল। আইসিইউ তে বলা হয় সারাদিন একজন গেটে থাকতে। অথচ পেশেন্ট পার্টি কোনোভাবেই সেখানে থাকতে দিতে চায়না৷ হস্পিটালে পরিস্থিতি জানিয়েও লাভ হয় না।
এখানে উন্নত ট্রিটমেন্ট নেই আগেই বলেছি। নেই কিডনি হার্টের ট্রিটমেন্টের কোনো ভালো ব্যবস্থা। এমনকি টেস্ট গুলোও হস্পিটালে হয়না। ডাক্তাররা জানায় লিমিটেড ব্যবস্থায় যা যা করা সম্ভব তারা করছেন। টেস্ট যা করতে দিয়েছিলাম তার রিপোর্ট আসার কথা ৭ দিন পর। ভেন্টিলেশনের পেশেন্টের টেস্ট রিপোর্ট আসে বেসরকারি ল্যাব থেকে ৪দিন ৭ দিন ১০ দিন পর।
আমরা ৪ দিন অপেক্ষা করছিলাম একটা পজিটিভ বা নেগেটিভ রিপোর্টের। তাহলে বাবাকে রেফার করে নিয়ে যাওয়া যেত ''ভালো'' জায়গায়। ১৩ তারিখের প্রথম কোভিড রিপোর্ট, যা কোভিড সেন্টার থেকে করিয়েছিল, সেটা আর জানায়নি কেউ। ১৫ তারিখ হস্পিটাল নতুন করে রিপোর্ট করালে সেটা এসে পৌঁছায় ১৮ তারিখ। কোভিড পজিটিভ। বাবা মারা গেছে ১৭ তারিখ। রিপোর্টের অভাবে ততক্ষণে ডেডবডি চলে গেছে কোলকাতা মর্গে।
কোথা থেকে বাবার সংক্রমণ হয়েছে, বাড়ি না হাস্পাতাল, আমরা জানিনা। হস্পিটালে আমাদের মারধোর করার তোড়জোড় করে একদল লোকজন৷ ডাক্তার বাঁচায়। তবে আমরা বাড়ি এলে আবার শুরু হয় সমস্যা। হোম কোয়ারেন্টাইনে নিজে থেকেই রয়েছি আমরা ১৭ থেকেই। তারপরও প্রতিবেশীদের নানা সমস্যা। অন্যন্য সুস্থ পাড়া প্রতিবেশীরাই সামলেছেন সেসব। খাবার দেওয়া থেকে খোঁজ নিয়ে যাওয়া সবই করছেন তারা। বিডিও ঘুরে গেছেন খাবার দাবার নিয়ে।
এই ঘটনা অনেকগুলি প্রশ্ন তুলে রেখে যায়। স্বাস্থ্যব্যবস্থার এমন হালের জন্য কে দায়ী? বেড নেই, কে দায়ী? এত বছরেও একটা মাত্র সদর হস্পিটালে, যেখানে আশেপাশের বিস্তারিত এলাকার হাজার হাজার মানুষ নির্ভর করে, সেখানে উন্নত পরিষেবার ব্যবস্থা নেই; তার জন্য কে দায়ী? আতঙ্কিত হয়ে মানুষজনের হামলার জন্য কে দায়ী? "জানলা দিয়ে লাফিয়ে করোনা ঢোকে" দেখানো মিডিয়া?? যে শিক্ষা ব্যবস্থায় ভুড়ি ভুড়ি ডিগ্রি পেয়েও বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে ওঠা যায়না সেই শিক্ষা ব্যবস্থা??? নাকি "চিকিৎসা পাবেনা" জানা আতঙ্কিত মানুষগুলো একাই দায়ী???
ভবিষ্যতে আমরা অসুস্থ হলে ট্রিটমেন্ট পাবোনা ধরে নিয়েই বাড়ি বসে আছি। তবে এভাবে বসে থাকা যায়না। বাড়িতে চাল ফোটাতে গেলে, আবশ্যিক প্রয়োজন মেটাতে গেলে বেরোতেই হবে। আমাদের স্বাস্থ্য, খাদ্য, শিক্ষা, চাকরির জন্য তো আর "রাষ্ট্র " নেই! তার দায়ও নেই। রাষ্ট্রের দায় বলিউড বা ক্রিকেট খেলায় "মেরা ভারত মহান " থেকে শুরু করে হস্পিটাল-রেল-মানুষের স্বপ্ন- ভাঙা থালা বেচে দেওয়া অব্দি। অগত্যা জন্মগত আত্মনির্ভর।
যা বর্ণনা করলাম তা একা আমার অভিজ্ঞতা নয় জানি। আরও অনেকের এর থেকেও খারাপ অভিজ্ঞতা আছে। আমার সামনেই, পজিটিভ রেজাল্ট আসা প্রায় ৭০ বছরের বৃদ্ধকে আই সি ইউ থেকে সিঁড়ি দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে গেছে হস্পিটালের বাইরের এম্বুলেন্স অব্দি। আমার সামনেই গেট দিয়ে রাত ১০ টায় ফিরিয়ে দেওয়া পেশেন্ট আই সি ইউ বেড না পেয়ে কোভিড সেন্টারে রাতে মারা গিয়েছে; খবর পেয়েছি। এরকম বহু বহু ঘটনা যা এখন ঘটছে ভারতে তা স্বাধীনতার আগেও ঘটতো। স্বাধীনতার এত বছর পরেও ঘটছে। শুধু ভারতে কেন, সারা পৃথিবীতেই। কোভিড শুধু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে সমাজে ঘুন ধরে গেছে৷ বাঁচতে গেলে সিস্টেম বদলাতে হবে। নইলে প্রজাতি হিসাবেই মৃত্যু।
১৪ দিন শেষ হলে জীবন সংগ্রামে বেরোতেই হবে। একরাশ আশা আর ঘৃণা নিয়ে। বাবার মৃত্যুর পর খবরে দেখলাম রুপো দিয়ে উদ্বোধন হবে রাম মন্দির। এও দেখলাম, বাবা তো দূর, চিকিৎসা পাচ্ছেননা সামনের সারির কোভিড যোদ্ধারাই। যে দেশে ভেন্টিলেশনের থেকে রামের কদর বেশি, যে রাষ্ট্রে এম্বুলেন্সের আগে রাজনৈতিক সভার জন্য জায়ান্ট স্ক্রিন আসে; সে দেশকে আমি ঘৃণা করিনা; ঘৃণা করি তার সিস্টেম এবং সিস্টেম চালানো লোকগুলোকে। ঘৃণা করি সব দেখেও চোখ বন্ধ করে বসে থাকা ভীড়ু জনগণের ভীরুতাকে৷ এই ১% সুবিধার জন্য বানানো সিস্টেমে, সিংহাসনে যেই বসুক অবস্থা বদলাবেনা।
আশাও আছে। কারণ এখানো অনেকে আলোর মশাল জ্বেলে রেখেছে৷ সহযোগিতা সহমর্মিতা এবং প্রশ্ন করার ধক তাদের এখনো আছে। সেই সংখ্যাটা কম হলেও, কমজোর নয়।
একটি প্রস্তাব রেখে গেলাম। এলাকায় এলাকায় যে কজন দায়িত্ববান সুস্থ মানুষ আছেন তারা যদি একটা হেল্প ডেস্ক খোলেন। প্রতিবেশীদের সচেতন করা, বেডের জন্য হন্যে হয়ে দৌড়ানোর সময় যতটুকু সহযোগিতা করা যায়, হোম কোয়ারেন্টাইন থাকা কালীন পাশে থাকা, ইত্যাদি যদি করা যায়। জানি কঠিন৷ লাখ লাখ মানুষের আর্তচিৎকার ভেসে আসবে দুদিন পর। উদাসীন সরকারের হাওয়া-ব্যবস্থার বিপরীতে দাঁড়িয়ে সাধারণ মানুষ এসবের প্রায় কিছুই করে উঠতে পারবেনা বাস্তবিক কারণে৷ তবু যদি ছোটো ছোটো এলাকায় ভাগ করে চেষ্টা টা করা যায়।
সব শেষে বলবো ভুগছেন যারা তারা আর ভয় না পেয়ে আওয়াজ তুলুন। আওয়াজ তুললে "রাষ্ট্রের বুট" গলায় চেপে বসবে জানি। কিন্তু আওয়াজ না তুললে বর্তমান এবং ভাবী প্রজন্মকে অপেক্ষা করতে হবে বন্যায় ভেসে যাওয়ার, সাইক্লোনে না খেতে পেয়ে শুকিয়ে যাওয়ার, কিংবা করোনা বা এরকম কোনো ভাইরাসের কবলে বিনা চিকিৎসায় মরে লাশ হয়ে যাওয়ার। চয়েস আপনার৷
ভালো লেখা। প্রয়োজনীয় লেখা
আপনার যোগাযোগের no দিতে পারেন?
'পরিচিতি ছাড়া, প্রভাব ছাড়া এখন চিকিৎসা পাওয়া সম্ভব হচ্ছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না।' - ওদিকে সুসিল সমাজ বলিউডের নেপোটিজম নিয়ে কেঁদে আকুল। কাগজে খবর অমিতাভ বচ্চনের ঘুম হয়নি। আজব বীভৎস সার্কাস চলছে এক।
অনেক লোকজন করতে চাইছেন কাজ, সেটা মনে হয়, অমৃতা পাণ্ডা বা অভিজিতের আত্মীয়ের অভিজ্ঞতা যেমন আশা জাগায়। কিন্তু এতটাই এলোমেলো এবং নড়বড়ে ব্যাবস্থা যে কার কী হবে তা যেন অদৃষ্টের হাতে।
অন্যদিকে শহর ও শহরের বাইরে দিনরাত। ড. জয়ন্ত ভট্টাচার্যের বুলবুলভাজার প্রথম অনুচ্ছেদে ওয়াশিংটন পোস্টের অবজার্ভেশন পড়লাম গ্রামীন ভারতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বা রিপোর্টিং নিয়ে এক লাইন। সত্যিই বিপুল গ্রামীন এলাকা পুরো ব্ল্যাকবক্স।
সিএনএনে আমেরিকার করোনা অবস্থা নিয়ে একটা ইন্টারেস্টিং জিনিস খেয়াল করেছিলাম। সেখানে শিকাগো শহরের একটা ডাটা দেখালো যে ওই শহরের জনসংখ্যার ৩০% হচ্ছে ব্ল্যাক আমেরিকান, কিন্তু করোনা আক্রান্তদের মধ্যে ৫২% আর মৃতদের মধ্যে ৬৮% ই হচ্ছে ব্ল্যাক আমেরিকান (এতদিনে পারসেন্টেজ বদলে যেতে পারে)। করোনা আক্রমণের এই রেশিয়াল ডিসপ্যারিটি, মানে ব্ল্যাকদের বেশি আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে নিউজে একজন শিকাগোর করোনা মোকাবেলার একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বললেন - This is a problem of chronic disinvestment in black population's health.
এই Disinvestment শব্দটা মূলত আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বেশি ব্যবহৃত হয়। এটা দিয়ে মূলত পলিটিকালি মোটিভেটেড অ্যাক্ট নির্দেশ করা হয় যেখানে কোন দেশের একটা খাত থেকে অপর একটা রাষ্ট্র বিনিয়োগ সরিয়ে নিয়ে এসে তাদের উপর রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে, যেমন যুক্তরাষ্ট্র ইরান, সুদানের উপর এই কাজটা করে থাকে। এটাকে স্বাস্থ্য রাজনীতিতে ব্যবহারের বিষয়টা বেশ ইন্টারেস্টিং ছিল। এখানে Disinvestment বলতে সিএনএনের ওই ব্যক্তি বুঝিয়েছেন যে মার্কিন সরকার আমেরিকান ব্ল্যাকদের স্বাস্থ্য আর বাসস্থান খাতে বিনিয়োগ রাজনৈতিক কারণে কমিয়ে রাখার ফলে তাদের মধ্যে আনকনট্রোলড কো-মর্বিডিটি- হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিস বেশি। এর ফলে ব্ল্যাকদের মধ্যে করোনায় আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যাও বেশি পাওয়া যাচ্ছে।
আমি বাংলাদেশী। আপনার লেখায় ভারতের পরিস্থিতি দেখার পর আমার এখন আমার দেশের এই Disinvestment এর কথাই মনে আসছে, সেটা নিয়েই কিছু বলি, ভারতে কি হচ্ছে তার সাথে এর তুলনা করতে পারেন। এই Disinvestment প্যারাডাইম ব্যবহার করেই বর্তমানের বাংলাদেশের করোনা সংকট বোঝার চেষ্টা করা যেতে পারে, আর এখানে Disinvestment এর মধ্যে অর্থনৈতিক বিনিয়োগহীনতার পাশাপাশি চিন্তাভাবনা আর বুদ্ধিশক্তির বিনিয়োগের অভাবটাও গুরুত্বপূর্ণ...
Acute Disinvestment
পিপিই সরবরাহ সংকট, পর্যাপ্ত টেস্টিং কিট, প্রাইমারি কেয়ার গিভারদের স্বাস্থ্য বীমা এগুলো সাধারণ কথা, এর বাইরে একটা বিশেষ দিকে নিয়ে বলা যাক। বাংলাদেশে করোনা মোকাবেলায় প্রথম যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয় তাতে মেডিকেল আর এগ্রিকালচার সেক্টর ছিল না, প্রথমেই ছিল গার্মেন্টস সেক্টর (বাংলাদেশে বাইরে থেকে অর্থের ফ্লো আসে মূলত যে সেক্টর থেকে)। অথচ গার্মেন্টস এর চেয়ে এই দুটো সেক্টর সেই মুহূর্তে হাজার গুণ বেশি দরকারি ছিল। হেলথের কথা যদি বাদ দেই আপনি গার্মেন্টসের সাথে এগ্রিকালচারের ইস্যুটা তুলনা করে দেখতে পারেন- গার্মেন্টস এ ভর্তুকি, ঋণ দেওয়ার পরও মালিকেরা বেতন দেওয়া নিয়ে সমস্যা করছে, কর্মীদের লে অফ করছে। এখন ধরা যাক, গার্মেন্টস মালিকেরা সম্পূর্ণ বেতন দেওয়া বন্ধ করে দিলো তারপরেও যদি আমাদের কৃষি সেক্টর ফাংশনিং থাকে আমরা সরকারি টাকা দিয়ে রেশন কিনে হলেও গার্মেন্টস কর্মীদের বাঁচিয়ে রাখতে পারবো। কিন্তু কৃষি সেক্টর যদি ফল করে তখন কোটি টাকা থাকলেও দুর্ভিক্ষ ঠেকিয়ে রাখা যাবে না, কারণটা সিম্পল- টাকাকে চিবিয়ে খাওয়া যায় না। এত কিছুর পরও আমাদের নীতিনির্ধারকরা গার্মেন্টসেই "প্রনোদনা" দিল, হেলথ আর এগ্রিকালচারের দিকে নজর দিল না। কারণটাও খুব স্পষ্ট, রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকগণ তাদের আর আপার ক্লাসের স্বার্থটাই দেখেছে, তাই তাদের স্বার্থের সাথে সরাসরি রিলেটেড সেক্টরেই "ইনভেস্ট" করেছে, আর হেলথ ও এগ্রিকালচারের মত সেক্টরে যেহেতু তাদের কোন সরাসরি স্বার্থ নেই, তা মূলত মাস পিপলের স্বার্থের সাথে জড়িত, আর তাদের প্রতি এই সরকারের, বিশেষ করে করোনা টাইমের সরকারের কোন জবাবদিহিতাই দেখা যায়না তাই এইসব সেক্টরে হয় "ডিজিনভেস্টমেন্টঃ।
এছাড়া প্রাইভেট হাসপাতালগুলাতে করোনা আতংকে রোগী কমে যায়, ফলে এখানে কোন প্রণোদনা না থাকায় অনেকেই ডাক্তারদেরকে লে অফ করতে চায়, পরিচালকদের সিদ্ধান্তেই হাসপাতাল বন্ধ হয়ে যায়। এই প্রাইভেট সেক্টরের চাপ সরাসরি পড়ে পাবলিক হাসপাতালগুলাতে। এইখানেই আসে chronic disinvestment এর কাহিনী।
Chronic Disinvestment
স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশের বাজেট পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বাংলাদেশে স্বাস্থ্যকে কখনই খুব একটা গুরুত্ব দেয়া হয়নি। পাবলিক আর প্রাইভেট কোন স্পেন্ডিংই এই খানে গড়ে ওঠেনি। মেডিকেল এডুকেশন পোস্টগ্র্যাজুয়েশনেও কিছু সিনিয়রদের কায়েমী স্বার্থবাদী আচরণের কারণে ভঙ্গুর দশায় আছে। তার সাথে পুরো সেক্টরের দায়িত্বশীল আর চিন্তাশীল আচরণের অভাব লক্ষণীয়।
এক ডাক্তার বড় ভাই এর কাছে এই দেশের হেলথ সেক্টরের অবস্থা শুনেছিলাম। টারশিয়ারি হাসপাতালগুলাতে মধ্যযুগীয় গিল্ড প্রথার মত অল্প ও বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করিয়ে নেওয়ার জন্য রেসিডেন্ট আর এইচএমওদের বসিয়ে রাখা হয়েছে যারা নরমাল কন্ডিশনেই বার্ন-আউট অবস্থায় থাকে। এদের পক্ষে গোটা প্রাইভেট হেলথ সেক্টর বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রেশার বেশিদিনের জন্য নেওয়া সম্ভব না। কোন সেন্সিবল থিংকিং এই লাইনে কাজ না করায় পাবলিক হাসপাতালগুলাতে প্রপার ম্যানেজমেন্ট আর রেফারেল প্রটোকল তৈরি হয়নি, দায়সারাভাবে পেইন কিলার ক্যালসিয়াম বিতরণ ব্যবস্থা হিসাবে পুরো সিস্টেমটা দাঁড়িয়ে আছে।
প্রপার অ্যাকিউট ইমার্জেন্সি মেডিসিন আর ক্রিটিকাল কেয়ার মেডিসিন ডিসিপ্লিন ডেভলপ করেনি দেশে। ফলে দাদাগিরি দেখানোর জন্য লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট শুরু হলেও ইমার্জেন্সি লাইফ সাপোর্ট সিস্টেমের অবস্থা এখানে লজিস্টিকালি খুব দুর্বল। বাংলাদেশের প্রপার আইসিইউগুলোতে বেডের সংখ্যা সম্বন্ধে যেসব ডাক্তারের ধারণা আছে তাদেরকে যদি আয়রন ম্যানের স্যুটও দেওয়া হয় তারপরেও সরাসরি ক্রাইসিস ডিল করতে গেলে তাদের অবস্থা খারাপ হয়ে যাবার কথা। পারসোনাল চেম্বার বা প্রাইভেট হাসপাতাল যেখানে করোনা রোগীর ট্রিটমেন্ট বা টেস্টিং এর সুবিধা নেই সেগুলো বন্ধ করে দেয়া সোশ্যাল ডিসটেন্সিং এর প্রটোকল হিসাবে কার্যকরি পদক্ষেপ হলেও Chronic disinvestment এর কারণে রুগ্ন পাব্লিক হেলথ সেক্টরের এই চাপ খুব বেশিদিন সহ্য করারও কথা না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, প্রথমে বর্ণিত সিএনএনের নিউজে ব্ল্যাকদের স্বাস্থ্যখাতে বিনিয়োগ না করার আমেরিকার মূল মোটিভেশন ছিল ব্ল্যাকদের প্রতি হোয়াইট এস্টাব্লিশমেন্টের জাতিবিদ্বেষ কিন্তু বাংলাদেশে যেখানে শাসক শাসিত উভয়েই বাঙালি সেখানে দেশের স্বাস্থ্যখাতকে অবহেলিত রাখার কারণ কি। এর উত্তর পাওয়া যায় এদেশের রাজনৈতিক বিকাশের ইতিহাসেই। কার্যকরী গণতন্ত্র কোনদিনও ছিল না, তাই জনসাধারণের জন্য জবাবদিহিতাও ছিল না। আর একদিকে ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের মাধ্যমে নীতি নীর্ধারনী ক্লাস আর বিজনেস ক্লাস সবসময় নিজেরা নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করে এসেছে, ফলে মাস পিপলের সেক্টরে সবসময়ই উপরে আলোচিত "disinvestment" চলে এসেছে বরাবরই। এই করোনা এসে এই সমস্যাটাকে খুব প্রকটভাবে দেখিয়ে গেল, কিন্তু তারপরও যদি কারও হুঁশ আসে...