
গত শুক্রবার বাবা মারা গেছেন। মেডিকেল কলেজ নন-কোভিড দের জন্য বন্ধ করে দেওয়ায় বাবার চিকিৎসাও বন্ধ ছিল। গরীবের তো অ্যাপোলো নেই৷
৪ দিন হস্পিটালে ভর্তি ছিল বাবা। কিন্তু তাতে রোগের চিকিৎসার উপযুক্ত পরিকাঠামো ছিলো না। ভেন্টিলেশনের পেশেন্টের ব্লাড টেস্টের রিপোর্ট বেসরকারি ল্যাব থেকে যতদিনে আসার কথা তার আগেই পেশেন্ট মারা যাচ্ছে।
রাত ১২ টায় একটা হস্পিটাল পেশেন্টকে বের করে দিতে চায় ভেন্টিলেশন নেই বলে। না, কোনোরকম ব্যবস্থা করে দিতেও তারা চায়নি। অবশেষে ৫ ঘন্টা টানাপোড়েনে ভর্তির ব্যবস্থা হয় অন্য হস্পিটালে।
করোনা টেস্টের রিপোর্ট আসেনি বলে গুরুতর অসুস্থ রোগীর চিকিৎসা করতে নারাজ কোভিড, নন-কোভিড দু ধরনের হস্পিটালই। ৩ নং ধরনের হাস্পাতালটা তো বানানো নেই। আর চিকিৎসা করবেই বা কোথায়? ১০ হাজার রোগীর জন্য ৫-৬ টা ভেন্টিলেশন। ১০-১২ টা ccu বেড।
সহযোগিতার বদলে অসহযোগিতা এখন নিয়ম। আক্রমণ গালিগালাজ সবই। এমনকি করোনা আক্রান্ত বা করোনা সাস্পেক্টেড রোগীর মৃত্যু হলে বাকিরা বেঁচে যাবে - একথা মৃত্যুপথযাত্রী রোগীর স্ত্রী -মেয়েকে বলতে কেউ ছাড়েনি।
অসামাজিক এই জীবেদের মুখের উপর বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে যারা দিন রাত পাশে রইলো তাদের মেরুদণ্ড যে বিক্রি হয়নি তার প্রমাণ আগেই বহুবার পেয়েছি। যারা সামাজিক চাপ উপেক্ষা করে সবটা দিয়ে সহযোগিতা করলো, বাড়ির গেটে খাবার রেখে যাওয়া থেকে ফোন করে বিভিন্ন ব্যবস্থা করে দেওয়া; অন্য মতাদর্শের রাজনৈতিক দলের হয়েও যারা প্রতিবেশি, বন্ধু হয়ে পাশে রইলো তাদের মনে থাকবে। সমাজ তো এমনই হওয়ার কথা ছিল। রাজনৈতিক কথাটি জোর দিয়ে বললাম কারণ পাশে যারা সবটা দিয়ে থেকেছেন তারা প্রায় প্রত্যেকেই কোনো না কোনো রাজনীতি করেন; নইলে সোসাল ওয়ার্ক।
৪ দিন মারাত্মক মানসিক চাপ আক্রমণে কেটেছে। আজ বিডিও এসেছিলেন হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসের জোগান দিতে। সহযোগিতা করবেন কথা দিয়ে গেছেন। প্রতিবেশিরাও সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন। আশা কর্মীরা অসুস্থতার দিন থেকেই সব রকমের চেষ্টা করে যাচ্ছেন সাহায্যের। অনেকেই এই পরিস্থিতিতে অনেক দূরে থাকে বলে না আসতে পারার আক্ষেপ করছে।
সময়ে আসলে বন্ধু আত্মীয় পরিজন চেনা যায়।
বন্ধুরা অনেকে ফোন করছিস। এত ফোন ধরার মতো মানসিক অবস্থা নেই। দেখা হবে মহামারী শেষে। সাবধানে থাকিস।
সকলের জন্য যে সমাজটা নয় তা আরও একবার নিজের জীবন দিয়ে বুঝলাম। যদিও পাশে থাকার মতো অনেকগুলি হাত এখনো, এখনো আছে। তাই এখনও মানুষ স্বপ্ন দেখতে পারে।
স্বাস্থ্য এখনো সকলের নয়। কাল কোভিড বা নন-কোভিডে অসুস্থ হলে আমাদের ট্রিটমেন্ট কিকরে হবে জানা নেই। সমাজের মানসিক স্বাস্থ্যও রেড এলার্টে। তাই লড়াইটা এখনো শেষ নয়। অনেক বাকি।
এত জঘন্য পরিস্থিতির মধ্যেও দুটি খবর পেলাম। সেও লড়াইয়ের ই খবর। ইন্টারনেটহীন-আড়ম্বরহীন- বঞ্চনার লাল দাগের অঞ্চলগুলির মধ্যে রানী শাবানারা নিজের জেদে আর তাদেরই মতো জেদী হাল না ছাড়া বন্ধুর মতো গৃহশিক্ষকের সাহায্যে উচ্চমাধ্যমিকে ৯০% পেয়েছে।এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠলে প্রীতিলতার বইটা ওদের নিশ্চই দিতে যাবো।
মেডিকেলের ডাক্তাররা শুধু "ডাক্তার" না হয়ে দায়িত্বশীল নাগরিকের পরিচয় দিয়ে আন্দোলন জিতে নন- কোভিড রোগীদের জন্য ও হস্পিটালটা খুলতে পেরেছে। এটা আরও কয়েকমাস আগে হলে বাবার চিকিৎসা বন্ধ করতে হতোনা।
পূর্বাশার থ্যালাসেমিয়া পরীক্ষা লকডাউনের জেরে এখনো আটকে আছে।
সবশেষে একটাই কথা বলার ঘুন ধরে যাওয়া ব্যবস্থা যেমন থাকে, তার পাল্টা সংগ্রামও পাশাপাশিই থাকে। মানুষ স্বার্থপর যেমন সত্যি, মানুষ মানুষের জন্য এখনও উদ্বিগ্ন হয়- এটাও সত্যি। বাবা যে যথার্থ চিকিৎসা পায়নি পরিকাঠামোর অভাবে এ যেমন সত্যি, যারা চেষ্টা করে গেলেন তা দেওয়ার, এবং এখনো চেষ্টা করছেন আমাদের সহযোগিতা করার তারাও সত্যিই।
আশা রাখবো এই নতুন পরিস্থিতিতে, সমস্ত মানুষের যথার্থ চিকিৎসা এবং খাদ্যের সুরক্ষার জন্য সবকটি সরকারের যা যা করণীয় তা তারা করার ধক রাখবে।
কী মর্মান্তিক !
i | 59.102.***.*** | ২১ জুলাই ২০২০ ১৪:৫২95403ভাষাহীন!
Sekhar Sengupta | ২২ জুলাই ২০২০ ১১:৫৩95418লেখাটা পড়ে আঁতকে উঠছি। সুড়ঙ্গের শেষে আলো কি আদৌ দেখতে পাব?