এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • মহামারী, কোয়ারেন্টাইন ও দেশকাল - পর্ব ৩

    দীপঙ্কর দাশগুপ্ত লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ১৮ জুলাই ২০২০ | ৩৫৮৯ বার পঠিত
  • ব্রিটিশ শিল্পী উইলিয়াম হগার্থের আঁকা চিত্র -- "দ্য ইনস্পেকশন"। সিফিলিসে আক্রান্ত ভিসকাউন্ট স্কোয়ান্ডারফিল্ড এবং তাঁর প্রণয়িনী। মিউজিয়াম অব দ্য রয়্যাল ফার্মাসিউটিক্যাল সোসাইটি।


    মহামারী ও নাসিকাপুরাণ


    মহামারীর সঙ্গে আবার নাকের কী সম্পর্ক? এমন বেমক্কা শিরোনাম দেখলে গোড়াতেই এই প্রশ্ন উঠবে। তবে এর উত্তর খোঁজার আগে চলুন একটা ছোট্ট কিন্তু নির্মম রসিকতা শুনি।
    সপ্তদশ শতকের ইংরেজ কবি ও নাট্যকার স্যার উইলিয়াম ডেভেনান্টকে বলা হত শেক্সপীয়ারের মানসপুত্র। মন্দলোকে অবশ্য গুজব রটায় ডেভেনান্ট নাকি শেক্সপীয়ারের জারজ সন্তান। সে যাই হোক, একদিন তিনি মিউজ নদীর ধারে হাঁটছেন। এমন সময় এক বৃদ্ধা ভিখারিনী তাঁকে বললেন, "ঈশ্বর যেন আপনার দৃষ্টিশক্তি অক্ষুণ্ণ রাখেন!" ভারি অবাক হলেন কবি। অযাচিত এমন শুভেচ্ছার কারণ কী? জানতে চাইলেন সেকথা। তখন বৃদ্ধাটি বললেন, "মহাশয়, পরম করুণাময় ঈশ্বরের প্রসাদে আপনার চোখের জ্যোতি যেন কখনও ম্লান না হয়। কারণ আপনার তো চশমা ঝোলাবার জায়গাই নেই!" ঠিকই, নাকই যদি না থাকে তাহলে কি আর চোখে চশমা আঁটা যায়?



    দুই যুবকের সম্মুখীন মৃত্যুর সমনধারিণী এক কঙ্কালসার পতিতা। জে জে গ্র্যান্ডভিলের লিথোগ্রাফ, ১৮৩০। ওয়েলকাম ইমেজেস



    ঘটনা হল, ডেভেনান্ট তাঁর নাসিকাটি খুইয়েছিলেন। আমাদের উপেন্দ্রকিশোরের টুনটুনির বইয়ের রাজামশাইয়ের নাক কাটা গিয়েছিল। অষ্টাদশ শতকের ইংরেজ লেখক লরেন্স স্টার্নের বিখ্যাত উপন্যাস ট্রিস্ট্রাম শ্যান্ডির নায়কের জন্মের সময় সদ্য-আবিষ্কৃত ফরসেপ ব্যবহারের গন্ডগোলে নাকটি খাঁদা হয়ে গিয়েছিল। সেই খাঁদা নাকের জন্যে তার জীবনে বিড়ম্বনার একশেষ। কিন্তু ডেভেনান্টের ব্যাপারটা আলাদা। তাঁর নাক গিয়েছিল মারাত্মক যৌনরোগ সিফিলিসের সংক্রমণে। সে সময় পেনিসিলিন বা এন্টিবায়োটিক আবিষ্কার হয় নি। দাওয়াই বলতে ছিল একটানা মাসাধিককাল ধরে মারকারি বা পারদের উষ্ণ ভাপ নেওয়ার এক উৎকট চিকিৎসা। রোগ উপশমে পারদ-চিকিৎসার প্রবর্তন করেছিলেন টক্সিকোলজি বা বিষবিদ্যার জনক প্যারাসেলসাস। এও ছিল এক রকমের কেমোথেরাপি। পারদের বিষক্রিয়ায় প্রবল লালা নিঃসরণ হত। তখন ধারণা ছিল, রোগের কীট লালার মধ্যে দিয়ে দেহ থেকে বেরিয়ে যাবে। কিন্তু চিকিৎসার আরও অনেক জঘন্য পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে অবধারিত ভাবে নাকের কার্টিলেজটি ভেঙে যেত। আর সেই খসে যাওয়া নাক ছিল তখনকার সমাজে অফুরন্ত রঙ্গ-রসিকতার খোরাক। অনেক ক্ষেত্রেই তামাশাগুলিতে মানুষের নানান দুর্দশার প্রতিফলন থাকলেও লোকে তা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করত। ডেভেনান্টকে নিয়ে এই রসিকতাটি প্রথম স্থান পায় ১৭২৮ সালে প্রকাশিত "পলি পিচ্যামস জেস্টস" শীর্ষক কালজয়ী এক জোকস সংকলনে। আর ওই ধরণের তামাশার বাড়বাড়ন্ত এমনই ছিল যে 'হার্টলেস জোকস' বা 'নেজাল জোকস' নামে রসিকতার দুনিয়ায় এক ভিন্ন ধারারই সঞ্চার হল। আবার এর পাল্টা হিসেবে চালু হয়েছিল 'নো নোজ' জোকসও।



    ব্রিটিশ চিত্রকর উইলিয়াম হগার্থের আঁকা ছবি --"আ হার্লটস প্রগ্রেস।" সিফিলিসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর মুখে মুখ্য চরিত্র মল।



    পঞ্চদশ শতকের শেষ দিকে আমেরিকা আবিষ্কার করে ফেরার সময় কলম্বাসের সহযাত্রী নাবিকদের মধ্যে যে যৌনরোগের সংক্রমণ ঘটে ক্রমে তা মহামারীর আকারে ছড়িয়ে পড়ে ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি, ব্রিটেন, ডেনমার্ক, স্পেন, পর্তুগাল, তুরস্ক, রাশিয়া ও পোল্যান্ড সহ বিভিন্ন দেশে। তার ঢেউ আছড়ে পড়ে উত্তর আফ্রিকা, এমনকি আমাদের ভারতেও। ছোঁয়াচে এই রোগ এক দেশ থেকে আর এক দেশে ছড়িয়ে পড়ত জাহাজের নাবিক ছাড়াও সৈন্য সামন্ত এবং ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে। রোগটির উৎস সন্ধানে পারস্পরিক দোষারোপের ঝড় উঠল। ইতালি, জার্মানি, ব্রিটেন বলল, এটা "ফ্রেঞ্চ পক্স"; ফরাসিরা রোগটিকে দেগে দিল "নেপোলিটান ডিজিজ" নামে। কেউ নাম দিল, "কভেন্ট গার্ডেন এগু", "লেডিজ ফিভার" বা স্রেফ 'ক্ল্যাপ' বা 'পক্স'।
    ইতালিয়ান চিকিৎসক, কবি ও গণিতজ্ঞ গিরোলামো ফ্রাকাসতোরো ১৫৩০ সালে রচিত মহাকাব্যে লিখেছিলেন রাখাল বালক সিফিলাসের কথা। গ্রিক দেবতা অ্যাপোলোকে অপমান করায় তার ওপর নেমে এসেছিল ভয়ানক রোগের অভিশাপ। সেই থেকেই রোগটির নাম সিফিলিস। ষোড়শ শতকের উপকথায় বলা হয়েছে, স্পেনের এক পতিতার সঙ্গে কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত কারও যৌন সংসর্গের মাধ্যমে রোগ সংক্রমণের প্রথম সূচনা। তবে রোগের উৎস বা নাম যাই হোক না কেন, রাজা থেকে ফকির, সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি থেকে আমজনতা, ধনী-নির্ধন, শ্রেণী ও লিঙ্গ নির্বিশেষে সর্বগ্রাসী এই রোগের সংক্রমণ থেকে নিস্তার পান নি কেউই। কয়েক শতক ধরে যা মহামারীর চেহারায় দাপিয়ে বেড়িয়েছে নানা দেশে, সমকালীন সমাজ ও সংস্কৃতিতে তার প্রভাব পড়েছে বিচিত্র ধারায়। চোখের সামনে উঠে এসেছে প্রচলিত ধ্যানধারণা, ধড়িবাজ হাতুড়ে ও মূর্খদের কীর্তিকলাপ কিংবা মানুষের অসততার কিস্যা। কালের গতিকে কোনও সমাজে যৌনরোগ যদি হয় কারও কাছে লজ্জা ও কলঙ্কের চিহ্ন, কারও শরীরে সেই ক্ষত আবার ছিল শৌর্য্যের প্রতীক।



    আমাদের সুখে-দুঃখে, জীবনের যে কোনও ওঠাপড়ায় আমরা যেমন আশ্রয় খুঁজি রবীন্দ্রনাথে, তেমনই বোধহয় হেন বিষয় নেই যা নিয়ে লিখে যাননি শেক্সপীয়ার। তাঁর রচনা মানেই তো রাজা-রানি, হুরি-পরী, প্রেম-প্রতারণা, যুদ্ধ! কিন্তু মহামারির ইতিহাস ঘাঁটতে গিয়ে আধুনিক পন্ডিতেরা একেবারে গোয়েন্দা-পারদর্শিতায় ছেঁচে তুলেছেন এমন কিছু সাক্ষ্য যা থেকে আমরা জানতে পারি, শেক্সপীয়ারের লেখায় সিফিলিস বা যৌনরোগের ভুরি ভুরি প্রসঙ্গই শুধু আসেনি, তিনি নিজেও সম্ভবত এই রোগে ভুগেছিলেন। বস্টনের ক্যারিটাস সেন্ট এলিজাবেথস মেডিকেল সেন্টারের চিকিৎসক ডঃ জন রসের একটি গবেষণা-পত্র বছর পনেরো আগে প্রকাশিত হয়েছিল ইনফেকশাস ডিজিজেস সোসাইটি অব আমেরিকার জার্নালে। তাতে রস লিখেছেন, এই রোগের যাতনা যে কী তা শেক্সপীয়ার নিজে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন। তাঁর লেখা নাটক "ট্রয়লাস এন্ড ক্রেসিডা", "এজ ইউ লাইক ইট" ছাড়াও বেশ কিছু সনেটে রোগের প্রসঙ্গ এসেছে। তবে তাঁর ক্ষেত্রে রোগটি হয়ত তেমন মারাত্মক হয়নি। তবু যেটুকু পারদ-চিকিৎসা তাঁকে নিতে হয়েছিল তার প্রভাবেই নিজের উইলে সই করার সময় হাত কেঁপে গেছে, চুল পড়ে গিয়ে বেরিয়ে পড়েছে মাথাজোড়া টাক, জীবনের শেষ দিকে নিজেকে বেশ কিছুটা গুটিয়েও নিয়েছিলেন।



    সিফিলিসে আক্রান্ত মহিলার বিকৃত নাসিকা। সেন্ট বার্থোলোমিউ মেডিকেল স্কুল, ১৮৯৪। ওয়েলকাম ইমেজেস / উইকিমিডিয়া কমনস



    শেক্সপীয়ার তাঁর ১৫৪ নম্বর সনেটে যখন লেখেন, “Love’s fire heats water" তখন স্পষ্ট বোঝা যায় যৌন সংক্রমণের জন্যে প্রস্রাবে জ্বালার কষ্ট তিনি ভোগ করেছিলেন। আবার ঠিক তার আগের ১৫৩ নং সনেটে “seething bath” এবং “strange maladies” এর উল্লেখে "অদ্ভুত রোগ" উপশমে পারদ চিকিৎসার ইঙ্গিত মেলে। যৌনরোগের বিভীষিকা তাঁর নাটকের চরিত্রও উপলব্ধি করেছিল। "ট্রয়লাস এন্ড ক্রেসিডা" নাটকের অন্তিম অংশে প্যান্ডারাস গণিকালয় অধ্যুষিত থিয়েটার পাড়ার দর্শকদের উদ্দেশে বললেন, মৃত্যুর পর তিনি রেখে যাচ্ছেন যৌনরোগের উত্তরাধিকার -- Till then I'll sweat and seek about for eases, / And at that time bequeathe you my diseases. এছাড়া “pox,” “malady of France,” “infinite malady,” কিংবা “hoar leprosy” শব্দগুলিও শেক্সপীয়ারের লেখায় ঘুরেফিরে এসেছে।



    ইতালির প্রবাদপ্রতিম শল্য চিকিৎসক গ্যাসপার তাগলিয়াকোজি বা তালিয়াকোতিয়াসের উদ্ভাবিত নাসিকা পুনর্গঠন প্রক্রিয়া। ষোড়শ শতক।



    অষ্টাদশ শতকের ব্রিটেনে সিফিলিসের ব্যাপকতা এত বেড়ে গিয়েছিল যে ড্যানিয়েল ডিফো, হেনরি ফিল্ডিং, টোবিয়াস স্মলেট সহ তখনকার বিশিষ্ট লেখক-কবি-ঔপন্যাসিকদের লেখায় আকছার রয়েছে এর উদাহরণ। স্মলেট তো নিজেই ছিলেন একজন চিকিৎসক। বিশেষত তাঁর "রোডেরিক রেন্ডম" উপন্যাসে মিস উইলিয়ামসের চরিত্র চিত্রণের মাধ্যমে তিনি মর্মান্তিক ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন পতিতাবৃত্তি, মদের নেশা, সিফিলিস এবং অবশেষে সর্বস্বান্ত হওয়ার করুণ কাহিনী। আবার মানুষের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে যৌনরোগের চিকিৎসার নাম করে দ্রুত অর্থ কামানোর এক রাস্তাও তৈরি হয়েছিল। তাতে সামিল হতে হাতুড়ে ঠগ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কেউই বাকি ছিল না। এসব কথাও স্মলেট লিখে গিয়েছিলেন "ট্রাভেলস থ্রু ফ্রান্স এন্ড ইতালি"তে।



    আ নাইট উইথ ভেনাস, আ লাইফটাইম উইথ মারকারি" -- পারদ-বাষ্প কুঠুরিতে সিফিলিসের রোগী। তার কেবল মাথাটুকুই দেখা যাচ্ছে। এক সহযোগী জ্বালানির ব্যবস্থা করছে। আর এক সঙ্গী ফায়ারপ্লেসের সামনে দাঁড়িয়ে তোয়ালে গরম করছে। জাঁক ল্যানিয়ে রেসেউইল দ্য প্লাসের এনগ্রেভিং। প্রবাদের চিত্ররূপ। প্যারিস। ১৬৫৯-১৬৬৩।



    ব্রিটিশ রাজনীতিক লর্ড চেস্টারফিল্ড তাঁর অবৈধ পুত্রকে জীবনবোধের পরামর্শ দিয়ে সরস ভঙ্গিতে যে সব চিঠি লিখেছিলেন তার বিখ্যাত সংকলন, "লেটার্স টু হিজ সন"। বাবা হয়েও সেখানে তিনি ছেলেকে সতর্ক করতে দ্বিধা করেননি যে পতিতালয়ে যাওয়ার অবশেষ পরিণতি কিন্তু নিজের নাক খোয়ানো (৮৫, ৮৭, ১৩৩, ১৬৪, ১৮৪ ও ১৮৭ নং চিঠি দ্রষ্টব্য)। ব্রিটিশ প্রাবন্ধিক রিচার্ড স্টিলও তাঁর "ট্যাটলার" পত্রিকায় সতর্ক করে দিয়েছিলেন একই কথা বলে -- "I shall close this paper with an admonition to the young men of this town, which I think the more necessary because I see several fresh coloured faces that have made their first appearance in it this winter. I must therefore assure them that the art of making noses is entirely lost, and in the next place not to follow the example of our ordinary town rakes who live as if there was a Taliacotius to be met with at the corner of every street. . . . The general precept I shall leave with them is to regard every town woman as a particular kind of syren, that has a design upon their noses, and that amidst her flatteries and allurements, they will fancy she speaks to them in that humorous phrase of old Plautus. "Keep your face out of my way or I will bite off your nose."

    আশ্চর্য হতে হয় এই ভেবে যে অষ্টম শতাব্দীতে আমাদের দেশের চরক সংহিতায় বর্ণিত শল্যবিদ্যা আরবি ভাষায় অনূদিত হয়ে ক্রমে ইতালি অবধি পৌঁছয়। সেই বিদ্যার চর্চা করেই আবার ষোড়শ শতকে ইতালির শল্য চিকিৎসক গ্যাসপার তাগলিয়াকোজি বা তালিয়াকোতিয়াস নাসিকা পুনর্গঠনের পথিকৃৎ হয়ে ওঠেন। সিফিলিস-আক্রান্ত রোগীরা জীবনে নতুন আশার আলো দেখতে পান। তালিয়াকোতিয়াসের খ্যাতি, পসার ও জনপ্রিয়তা এমন তুঙ্গে ওঠে যে তিনি পরিচিতি পান "লাভ ডক্টর" হিসেবে। "ট্যাটলার"-এ স্টিল নিজের বক্তব্য প্রকাশ করতে গিয়ে তাঁর কথাই উল্লেখ করেছেন।

    সাহিত্যে যৌনরোগের প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনার জন্যে ১৯৩৪ সালে এক অভিনব সম্মেলনের আয়োজন করেছিল ব্রিটিশ মেডিকেল সোসাইটি। সেখানে এক দিগ্দর্শী ভাষণ দিয়েছিলেন রয়্যাল সোসাইটি অব মেডিসিনের তিনটি শাখার সভাপতি ডঃ জন ডেভি রোলস্টন। সংক্রামক রোগের বিশেষজ্ঞ ছাড়াও তিনি ছিলেন একজন তন্নিষ্ঠ লোককাহিনী-সংগ্রাহক। নিজের উপস্থাপনায় তিনি বাইবেলের যুগ থেকে শুরু করে আধুনিক কাল পর্যন্ত সাহিত্যে যৌনরোগের প্রসঙ্গ বিশ্লেষণ করেন। তাঁর আগে সম্ভবত আর কেউই বিষয়টির ওপর এমন ভাবে আলোকপাত করেন নি। তবে উপস্থিত শ্রোতাদের মধ্যে সেদিন মোক্ষম প্রশ্নটি করেছিলেন চিকিৎসাশাস্ত্রের বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ স্যার ডার্সি পাওয়ার। তিনি জানতে চেয়েছিলেন, যৌনরোগ কবে থেকে সমাজে কলঙ্কিত বলে গণ্য হল। রোলস্টন তখন এর সঠিক জবাব দিতে পারেন নি। এর বহু বছর পরে স্যার ডার্সি নিজেই একটি সমীক্ষার মাধ্যমে অভিমত প্রকাশ করেছিলেন যে যৌনরোগের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সমাজের নীতিবোধ জেগে ওঠে অষ্টাদশ শতকে। স্মলেট, চেস্টারফিল্ড বা স্টিলের লেখায় তার আন্দাজ পাওয়া যায়। কিন্তু তার আগে সপ্তদশ শতকের লঘুচিত্ত সমাজে যৌন সংক্রমণকে দেখা হত হালকা ভাবেই। তাতে নীতিবোধ বা অনুশোচনার বিন্দুমাত্র বালাই ছিল না।

    এই বিষয়ে গত বছর রয়্যাল কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অব এডিনবরায় "The Nose Knows” শিরোনামে অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক ভাষণ দিয়েছেন ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপিকা ডঃ নোয়েল গালাঘার। যিনি মাত্র ৩৩ বছর বয়সে নিজেই যৌন সংক্রমণে মারা যান সপ্তদশ শতকের সেই কবি ও সেকেন্ড আর্ল অব রচেস্টার জন উইলমটের কবিতার উদাহরণ দিয়ে গালাঘার দেখালেন যুদ্ধক্ষেত্রে আহত সৈনিকের আঘাতের সঙ্গেই তুলনা করা হত যৌনরোগের ক্ষতকে -- তা ছিল পৌরুষের মর্যাদার প্রতীক (ব্যাজ অব অনার)। কিন্তু পরবর্তী শতকেই চেহারাটা আমূল পাল্টে যায়। তখন এই যৌন সংক্রমণকে ঘিরে সঞ্চারিত হয়েছিল সর্বব্যাপী আতঙ্ক। সামাজিক কলঙ্ক ঢাকতে বিকৃত নাসার অস্ত্রোপচার ছাড়াও ফরাসি মুখোশের ঢালাও ব্যবহার শুরু হল ব্রিটেনের অভিজাত সমাজে। শুধু তাই নয়, যৌনরোগের চিকিৎসা গোপন রাখার চেষ্টাও শুরু হল। ২০১৩ সালে প্রকাশিত ক্রিস্টি সুমিচের লেখা "ডিভাইন ডক্টরস এন্ড ড্রেডফুল ডিস্টেম্পারস" বইয়ে এমন এক রোগীর কথা জানা যায় যিনি নিজের চিকিৎসার জন্যে এক হাতুড়েকে দিয়েছিলেন ২৫ গিনি যার মধ্যে ১০ গিনি রোগ নিরাময়ের জন্যে আর বাকি ১৫ গিনি পরিচয় গোপন রাখার জন্যে। চিকিৎসা করাবার মতো সংস্থান যাঁদের ছিল তাঁরাই আবার নিজেদের পরিচয়ের গোপনীয়তা নিশ্চিত করতে কোনও কার্পণ্য করতেন না। তবে সব সময় যে তা কাজে আসত তা নয়। সেই হতভাগাদের ক্ষেত্রে নির্মম সত্যি হয়ে উঠত সেই পুরনো প্রবাদটি -- "ভেনাসের সঙ্গে এক রাত্তির আর পারদের সঙ্গে সারা জীবন!" কারণ হাতুড়েদের চিকিৎসায় পারদের উষ্ণ বাষ্প শ্বাসের সঙ্গে নিতে গিয়ে রোগীর প্রাণান্তকর অবস্থা। আর তারই মধ্যে পরিবারে সংক্রমণ ঠেকাতে তাদের অজান্তে বৌ-ছেলেমেয়েদের খাওয়ানো হত পারদ মেশানো চকোলেট পানীয়।

    নাকের ক্ষত ব্রিটিশ সমাজে এমন এক প্রতীক বয়ে এনেছিল যে কোনও আঘাত আর রোগের অভিঘাতে সেই পরিণতির তাৎপর্য ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাই লেখার শুরুতে যে ট্রিস্ট্রামের কথা বলেছি সেই উপন্যাসে একটি অধ্যায়ের শুরুতেই ঘোষণা করা হয়েছে --

    “For by the word Nose, throughout all this long chapter of noses, and in every other part of my work, where the word Nose occurs,—I declare, by that word I mean a Nose, and nothing more, or less.”
    ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখা যায় মিশরের রাজা তুতানখামেন, কার্ল মার্কস, সিমোন বলিভারের মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, জন কীটসের মতো কবি, সমারসেট মম, ফ্রানজ কাফকা, এডগার এলান পো, জর্জ অরওয়েলের মতো সাহিত্যিক, নীটশের মতো দার্শনিক, শোপ্যাঁ কিংবা বাখের মতো সঙ্গীতশিল্পীর জীবনও যৌন সংক্রমণে ঝাঁঝরা হয়েছে।

    মহামারির ইতিহাস আমাদের তাই এই শিক্ষাই দেয় যে রোগের বিরুদ্ধে এবং জনস্বাস্থ্য বিষয়ে নিরন্তর সচেতনতা ও সতর্কতাই পারে আমাদের সকলকে রক্ষা করতে এবং চারপাশের সমাজকে নীরোগ রাখতে।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ১৮ জুলাই ২০২০ | ৩৫৮৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Prativa Sarker | ২২ জুলাই ২০২০ ১২:০৮95419
  • নাক কোভিডেও খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। গন্ধ না পেলেই অতিমারির ছায়া। 

    সেক্সপিয়ারের নানা এক্সপ্রেশনের নানা ব্যাখ্যা। সনেটগুলোর আরাধ্য ব্যক্তি বা নারী, পৃষ্ঠপোষক সব নিয়েই ঝুড়ি ঝুড়ি গবেষণা। 

    আর সাহিত্য তো ওপেন এন্ডেড। কোনো ব্যাখ্যাই এখানে ধ্রুব নয়।

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে প্রতিক্রিয়া দিন