এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক

  • মহামারী, কোয়ারেন্টাইন ও দেশকাল - পর্ব ৫

    দীপঙ্কর দাশগুপ্ত
    ধারাবাহিক | ৩১ জুলাই ২০২০ | ২৮১২ বার পঠিত
  • রোগ ভয় এবং লৌকিক দেবদেবীর তালিকায় নবতম সংযোজন করোনা মাতা

    “বৃহস্পতি। হে সৌম্য, তেত্রিশ কোটি দেবতাতেও কি ইন্দ্রলোক পূর্ণ হয় নাই? আরো কি নূতন দেবতা আমন্ত্রণের আবশ্যক আছে?...

    ইন্দ্র। হে জ্ঞানিশ্রেষ্ঠ,… যেমন পুষ্প হইতে সৌরভ উত্থিত হয় তেমনি মর্তের ভক্তি হইতেই স্বর্গ উর্ধ্বলোকে উদ্বাহিত হইতে থাকে; সেই ভক্তিপুষ্প যদি শুষ্ক হইয়া যায় তবে, হে দ্বিজসত্তম, তেত্রিশ কোটি দেবতাও আমার এই পারিজাতমোদিত নন্দনবনবেষ্টিত স্বর্গলোক রক্ষা করিতে পারিবে না। সেই কারণে, মর্তের সহিত যোগপ্রবাহ রক্ষা করিবার জন্য মাঝে মাঝে নরলোকের নবনির্বাচিত দেবতাগুলিকে সাদরে স্বর্গে আবাহন করিয়া আনিতে হয়।…”

    রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'স্বর্গীয় প্রহসনে' দেব-দেবীর উদ্ভব নিয়ে যে আমুদে আখ্যানের অবতারণা করেছিলেন তার বিশদ আলোচনা আপাতত মুলতুবি থাক। এখানে এটুকুই বলার যে ইন্দ্রের তালিকায় অধুনা নবতম সংযোজন করোনা দেবী। তিনি ঝরিয়ার রূপান্তরকামী নির্মলা কিন্নরকে এই সেদিন স্বপ্নাদেশ দিয়েছেন। গত ৬ জুন নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকা নির্মলার স্বপ্নের বিবরণ তুলে ধরেছে -- "করোনা মাঈ আমাকে স্বপ্নে দেখা দিলেন। প্রথমে গো-মাতা রূপে, তারপর কখন জানি তিনি আবির্ভুত হলেন এক নারী রূপে। বললেন, দেশের মানুষ যদি করোনা মাতার পুজো শুরু করেন তাহলে মারণ ভাইরাস করোনা যেখান থেকে এসেছিল সেখানেই আবার ফিরে যাবে। সঙ্কট থেকে মুক্তি পাবে ভারতবাসী। সকলের কল্যাণের জন্যে তাই আমরা করোনা মাতার আরাধনায় শামিল হয়েছি।" লকডাউন উঠে যেতেই রাস্তাঘাটের চেহারা দেখার পর সকলকে বলতে শোনা যাচ্ছে, এখন তাহলে ভগবানই ভরসা! সংক্রমণের রেখচিত্র থিতিয়ে আসার বদলে বরং আশঙ্কাজনকভাবে ঊর্দ্ধমুখী। রোগ-প্রতিরোধ বা নিরাময়ের হদিশ এখনও অধরা। অভূতপূর্ব সঙ্কট থেকে উদ্ধার পেতে তাই শেষ আশ্রয় সব অগতির গতি ভগবান। তেত্রিশ কোটি দেবতাতেও যদি অকুলান হয় তো বিপদ কাটাতে ভক্তের ভগবান দেখা দিচ্ছেন নবতর রূপে। কাজেই শুধু ঝরিয়া নয়, ঝাড়খণ্ডের রাঁচি, জামশেদপুর, বিহারের বিভিন্ন অঞ্চল, উত্তরাখন্ড এবং আমাদের এই বাংলার কাঁচরাপাড়া ও রায়গঞ্জেও বিপুল উদ্যমে শুরু হয়ে গেছে করোনা মাতার পুজো। মানুষের বিশ্বাসের সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে, রাখে হরি, মারে কে?


    বিহারের গ্রামে করোনা মাতার পুজোর আয়োজন।


    প্রধানত নিম্নবর্গীয় লোকসমাজ থেকে সৃষ্ট এই ধরণের দেবদেবীই কিন্তু অতীতের মঙ্গলকাব্য আলো করে রয়েছেন। পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে ব্রাহ্মণ্য অনুশাসন ও পৌরাণিক প্রভাবে এই কাব্যের অনেক দেবদেবীর আর্যায়ন ঘটেছে। পাশাপাশি এই সব লৌকিক দেবদেবীর মাহাত্ম্য প্রচারেই জনপ্রিয় হয়েছে গ্রামীণ পালাগান। লৌকিক দেবদেবী কেন্দ্রিক পালাগানগুলির মধ্যে বিশেষ জনপ্রিয় ওলাবিবির পালা। তবে গ্রামবাংলার লোকায়ত সংস্কৃতিতে একাধিক বিবির পরিচয় মেলে। কেউ বলেন, ওলাবিবির সাত বোন। ওলাবিবি, ঝোলাবিবি, দরবারবিবি, আসানবিবি, মড়িবিবি, ঝড়িবিবি ও দুধবিবি। এঁরা সকলেই কাল্পনিক লৌকিক বিবি বা দেবী। ওলাবিবিকে সপ্তমাতৃকার একজন বলে মনে করা হয়। পুরাণে সপ্তমাতৃকার পরিচয় হল -- গর্ভধারিনী, ধাত্রী, গুরুপত্নী, ব্রাহ্মণী, রাজপত্নী, পৃথিবী ও গাভী। গ্রামীণ পালাগানে এঁরা প্রত্যেকেই মানুষের রোগের আসানকর্ত্রী হিসেবে চিত্রিত। এঁদের কৃপায় মানুষ যেমন পার্থিব সুখ সমৃদ্ধি লাভ করেন তেমনি দেবী রুষ্ট হলে ধনে-প্রাণে মারা পড়েন। এঁরা রোগ-শোকে জর্জরিত নিরুপায় আর্ত মানুষের কল্পিত দেবী। বাংলার পশ্চিম সীমান্তে আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে সপ্তমাতৃকার প্রভাব অপরিসীম। এঁরা সেখানে সাতবহিনী বা সাতভগিনী বলে পরিচিতা। এঁদের নাম শীতলা, বাসুলী, মনসা, চন্ডী, রঙ্কিনী, শঙ্খিনী ও চমকিনী। বিশেষত বসন্ত রোগ নিবারণের দেবী হিসেবে শীতলার পুজো প্রচলিত হলেও পালাগানে তিনি গলগন্ড, কোরন্ড, সান্নিপাত, পীলে, ফোঁড়া, বাত ও উদরী সহ চৌষট্টি ব্যাধির অধিশ্বরী।


    বৌদ্ধ তন্ত্রে পর্ণশবরীর সঙ্গে শীতলা দেবীর তুলনা করেছেন পন্ডিতেরা


    মধ্যযুগের জার্মান নর্স পুরাণে বর্ণিত বিশাল কল্পবৃক্ষ ইগড্রাসিলের পাদমূলে বসা ভাগ্যনিয়ন্তা তিন দেবীর সঙ্গে নিম গাছের নিচে বসা শীতলাদের সাত বোনের তুলনা করেছেন ভগিনী নিবেদিতা। তিনি তাঁদের আখ্যা দিয়েছেন The Dread Seven বলে। দেবী মাহাত্ম্যের কথা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নিবেদিতা সাত সংখ্যার বিশেষ তাৎপর্যের কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন কারণ বেদে সাত সংখ্যাটির গুরুত্ব ও পবিত্রতা অসীম। নিম গাছের সঙ্গে শীতলা দেবীর সংযোগের বিষয়টিও গভীর ভাবে প্রতীকী কারণ বসন্তরোগীর ত্বকের জ্বালা প্রশমনের জন্যে তার হাতে তুলে দেওয়া হয় নিমের ডাল। রোগ থেকে সেরে উঠলে তাকে প্রথম স্নান করানো হয় নিমের জলে। নিমের গুন বর্ণনা করতে গিয়ে পরম শ্রদ্ধায় নিবেদিতা লিখছেন -- “Only in India the ancient thought lives on. Here, still, the women hush their voices and bow their heads as they pass before the tree of healing called the Neem.” ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখা যায়, ২০০০ বছর ধরে ভারতীয় চিকিৎসা শাস্ত্রের প্রাচীন গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে 'মসূরিকা'র যে শব্দের উৎপত্তি কমলা রঙের ডালের দানা 'মসুর' থেকে। এর অর্থ বসন্তরোগ, পাপরোগ, রক্তবটি, মসূরি। পাপগ্রহ রাহু ও শনির কুদৃষ্টি, দূষিত বাতাস ও জল থেকে এই রোগের সৃষ্টি হয়। মসূরিকা সম্পর্কে বলা হয়েছে, "দেব্যা শীতলয়াক্রান্তা মসূর্য্যেবহি শীতলাজ্বর" অর্থাৎ দেবী শীতলার দ্বারা আক্রান্ত মসূরিই শীতলা জ্বর। 'পূর্ববঙ্গ গীতিকা'য় বসন্তরোগই শীতলা -- "শীতলায় মারা গেল গোয়াইলের গরু"। অথর্ববেদে যে সব রোগের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তার মধ্যে 'মসূরিকা' না থাকলেও এটির কথা পাওয়া যায় চরক ও সুশ্রুতে। পরবর্তী কালে 'মসূরিকা'ই পরিচিতি পায় গুটি বসন্ত নামে। ষোড়শ শতকে ভবামিশ্র শীতলাষ্টকস্তোত্র প্রচার করেন তাঁর 'ভাবপ্রকাশে'র মাধ্যমে। শীতলাদেবীর বন্দনা-সূচক স্তোত্রটির প্রথম উল্লেখ দেখা যায় স্কন্দপুরাণের কাশীখণ্ডে।
    বন্দেহহং শীতলাং দেবীং রাসভস্থ্যাং দিগম্বরীম।
    যামাসাদ্য নিবর্তত বিস্ফোটকভয়ং মহৎ।।
    শীতলে! শীতলে! চেতি যো ব্রহ্মাদ্দাহপীড়িতঃ।
    বিস্ফোটকভয়ং ঘোরং ক্ষীপ্রং তস্য প্রণশ্যতি।।
    যস্তামুদকমধ্যে তু ধ্যাত্বা সম্পুজয়েন্নরঃ।
    বিস্ফোটকভয়ং ঘোরং কুলে তস্য ন জায়তে ।।
    শীতলে! জ্বরদগ্ধস্য পূতিগন্ধগতস্য চ ।
    প্রণষ্টচক্ষুষঃ পুংসস্ত্বামাহুঃ জীবিতৌষধম ।।
    নমামি শীতলাং দেবীং রাসভস্থ্যাং দিগম্বরীম।
    মার্জনী কলসপেতাং সূর্পালংকৃত মস্তকাম ।।
    শীতলে! তনুজান রোগান নৃণাং হরসি দুস্তরাণ।
    বিস্ফোটকবিশীর্ণানাং ত্বমেকামৃতবর্ষিণী।।
    গলগণ্ড, গ্রহরোগং যে চান্যে দারুণা নৃণাম ।
    ত্বদনুধ্যানমাত্রেণ শীতলে! যান্তি তে ক্ষয়ম।।
    ন মন্ত্র্যং নৌষধং কিঞ্চিৎ পাপরোগস্য বিদ্যতে।
    ত্বমেকা শীতলে! ধাত্রী নান্যাং পশ্যামি দেবতাম।।

    যাঁকে স্মরণ করলে বিস্ফোটকভয় নাশ হয়, সেই বিস্ফোটকভয়নাশিনী শীতলাদেবীকে আমি বন্দনা করি। যে ব্যক্তি দাহ-পীড়িত হয়ে শীতলাদেবীর স্তব করেন তাঁর রোগ ভয় দূর হয়। হে শীতলে, জ্বরদগ্ধ ও দুর্গন্ধবিশিষ্ট এবং নষ্টচক্ষু মানুষের একমাত্র পরিত্রাণ হিসেবে ঋষিরা আপনাকে বর্ণনা করেছেন। আপনি মানুষের কঠিন রোগ নাশ করে থাকেন এবং বসন্তরোগাক্রান্ত ব্যক্তিদের ওপর আপনিই কেবল অমৃতবর্ষণকারিণী। হে শীতলে! মানুষের গলগন্ড ও অন্যান্য কুগ্রহজাত নিদারুণ সব রোগও আপনার চিন্তামাত্রেই দূর হয়। এইসব পাপরোগের অন্য ওষুধ বা মন্ত্র আর কিছু নেই। হে শীতলে! কেবল আপনিই পারেন এর থেকে ত্রাণ করতে। আপনি ছাড়া অন্য দেবতা আর দেখি না।

    শীতলাদেবীর মাহাত্ম্যের কথা প্রচার করেছিলেন কমলাকরভট্ট ১৬১০ সালে বারাণসীতে রচিত তাঁর 'নির্ণয়সিন্ধু'তে। জনপ্রিয় সেই লোকগাথাতেও উল্লেখ করা হয়েছে শীতলা সহ মোট সাত বোন এবং এক ভাইয়ের কথা। ভাইটির তেমন প্রসিদ্ধি না থাকলেও নানা ধরণের জ্বরের অধিষ্টাত্রী দেবী হিসেবে মাসানী, বাসন্তী, মহামতী, পোলামদে, লঙ্কারিয়া ও আগুয়ানীর বর্ণনা মেলে। মধ্যযুগের কবি কৃষ্ণরাম দাস ১৬৮৬ সালে রচনা করেছিলেন রায়মঙ্গল কাব্য। পরে দেবী মাহাত্ম্য প্রচারে তিনিই আবার রচনা করেছিলেন শীতলামঙ্গল। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকলেরই শীতলা-বন্দনায় শামিল হওয়ার ঐতিহ্য রয়েছে।


    বসন্তরোগের অধিষ্ঠাত্রী দেবী শীতলা


    প্রাক-আর্য যুগের দেবী শীতলার পুজো মূলত বঙ্গ, অসম, বিহার ও ওড়িশার উপজাতিদের মধ্যে প্রচলিত হলেও ক্রমে তা প্রসিদ্ধি পায় সমাজের অন্যান্য শ্রেণীর মধ্যেও। দাক্ষিণাত্যে শীতলাম্মা নামে এক দেবীর পাথরের নুড়ি পুজোর প্রচলণ রয়েছে যার সঙ্গে শীতলা নামের মিল পাওয়া যায়। বাংলায় বিভিন্ন প্রান্তে শীতলার নুড়ি ও মূর্তি দুই পুজোর প্রচলন থেকে অনুমান করা যায় আর্যেতর সমাজ থেকে ক্রমশ দেবীর উত্তরণ ঘটেছে। কারণ, নুড়ি পুজো আর্যেতর সমাজেরই সংস্কার। বৃক্ষ প্রতীকে পূজিতা শীতলার পরিচয় 'গাছ শীতলা'। মার্কন্ডেয় পুরাণ, স্কন্দপুরাণ, পিচ্ছিলাতন্ত্র ও স্তবকবচমালায় দেবীর ধ্যানমন্ত্র আছে যার সঙ্গে ওড়িশার ময়ূরভঞ্জে ধর্মের মন্দিরে খোদিত শীতলা মূর্তির সাদৃশ্য আছে। মার্কন্ডেয় পুরাণে জ্যেষ্ঠা দেবীর মাহাত্ম্যে দেবীকে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী অলক্ষ্মী বলা হয়েছে এবং তাঁর অস্ত্র ঝাঁটা ও বাহন গাধা। নেপালের বহু ধর্মচৈত্যে শীতলার মূর্তি রয়েছে। বাংলাদেশের বিক্রমপুরে পাওয়া পর্ণশবরীর মূর্তির সঙ্গে বসন্ত রোগ ও গাধার অস্তিত্ব থাকায় পর্ণশবরী ও শীতলা একই বলেও কারও কারও ধারণা। সংক্রামক এই রোগের হাত থেকে রক্ষা পেতে অতীতের মানুষ বসন্ত রোগ বিনাশক দেবতার কল্পনা করেছিল। শুধু আমাদের দেশেই নয়, অন্যান্য দেশের সমাজেও নানা নামে সেই দৈব অস্তিত্ব রয়েছে -- চিনে তাউ-শেন নিয়াং-নিয়াং, জাপানে তামেতোমো, নাইজেরিয়া, বেনিন, টোগো অঞ্চলে সোপনা, গ্রিসে সাঙ্কোরমিন। বাংলার লৌকিক দেবী হিসেবে শীতলা জনপ্রিয় হলেও মহারাষ্ট্র, গুজরাত, পঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, বিহার, ওড়িশা ও অসমে শীতলার পুজো হয়। ওড়িশায় দেবীর নাম ঠাকুরাণী। অসমে আই অর্থাৎ মা। এই দেবীর মহিমা বিষয়ক অসমের লোকগীতি বা 'আই নাম'-এ শীতলার পৌরাণিক রূপ বর্ণিত হয়েছে।
    "কাষে কুম্ভ মাথে শূর্পা হাতে সমার্জনী।
    গর্দভ বাহনে আসে শীতলা গোঁসানী।।"
    অসমীয়া কবি জয়রাম দাসের পাঁচালির নাম 'শীতলা পুঁথি'। অসমের জনমানসে প্রচলিত বিশ্বাস শীতলা কৈলাসবাসিনী। কামাক্ষ্যা থেকে লুইত (ব্রহ্মপুত্র) নদীপথে উজানে যাত্রা করে দেবী শদিয়ায় আসন পেতেছেন।
    "কৈলাসত আছিলা আই ভগবতী।
    শদিয়াত পাতিছা থান।"


    মধ্যযুগের জার্মান নর্স পুরাণে বর্ণিত কল্পবৃক্ষ ইগড্রাসিলের পাদমূলে বসা ভাগ্যনিয়ন্তা তিন দেবীর সঙ্গে নিম গাছের নিচে বসা শীতলাদের সাত বোনের তুলনা করেছেন ভগিনী নিবেদিতা।


    ঐতিহাসিক ভাবে বসন্তরোগের প্রাবল্যের কথা প্রথম জানা যায় অসমে ১৫৭৪ সালে। এরপর ১৭৭০ সালে বঙ্গে বসন্তের ভয়ানক সংক্রমণের তথ্য লিপিবদ্ধ করে গেছেন চুঁচুড়ায় এক ওলন্দাজ নৌ এডমিরাল স্ট্যাভরিনাস। সে সময় বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। পরাক্রান্ত মুঘলদের রাজনৈতিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ব্রিটিশদের শাসন ক্ষমতা দখল, মারাঠা বর্গী হানা, ১৭৬৯ সালের খরা, ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষ সব মিলিয়ে চূড়ান্ত সামাজিক অস্থিরতা এবং বাস্তুচ্যুত মানুষের দুর্দশার মধ্যেই পূর্ব ভারতে প্রবল পরাক্রমে হানা দিয়েছিল বসন্তরোগ। তার দাপট এমনই ছিল যে প্লেগ ও কলেরা মহামারীর মোট আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যাকেও ছাপিয়ে গিয়েছিল একাই বসন্তরোগীর সংখ্যা। এডওয়ার্ড জেনার ১৭৯৬ সালে বসন্তরোগের টিকা আবিষ্কার করলেও খোদ বিলেতেও তার স্বীকৃতি মিলতে এবং তা জনপ্রিয় হতে বহু দশক লেগেছিল। ১৮০২ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট জেনারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়ে তাঁকে ১০ হাজার পাউন্ড সাম্মানিক দেয়। ভ্যাকসিনের আগে প্রচলিত ভেরিওলেশন প্রক্রিয়া বিলেতে নিষিদ্ধ হয় ১৮৪০ সালে। এই প্রেক্ষাপটে ঔপনিবেশিক আমলের ভারতের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। ঊনবিংশ শতকে ভারতীয় চিকিৎসকেরা নিজেরাই মনে করতেন, বসন্তরোগের কোন নিরাময় নেই এবং তার চিকিৎসা তাঁদের ক্ষমতার বাইরে। ব্রিটিশ প্রশাসক জেমস ওয়াইজ লিখেছেন, "রোগ নির্ণয় হওয়া মাত্র কবিরাজ বিদায় নিতেন আর তলব পড়ত শীতলার সেবক-পূজারি মালাকারদের।" ১৮৫০ সালে কলকাতায় স্মলপক্স কমিশনে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে রামচন্দ্র মল্লিক স্পষ্টই বলেছিলেন, হিন্দুদের বিশ্বাস এই রোগ চিকিৎসার ঊর্ধে এবং রোগীর ভাগ্য পুরোপুরি মা শীতলার দয়ার ওপর নির্ভরশীল। ১৮৩১ সালে রাজা রাধাকান্ত দেব অষ্টাঙ্গহৃদয় সংহিতার উল্লেখ করে বলেছিলেন, ঝাল, অম্ল, লবনাক্ত খাবার এবং মাছ ও দুধের অসম সমাহারে বসন্তরোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। আগের খাবার হজম হওয়ার আগেই আবার খাওয়া, দূষিত বায়ু এবং দূষিত পানীয় জলও রোগ সংক্রমণের পথ সুগম করে। বিচক্ষণ বৈদ্যরা বসন্তের গুটি দেখে রোগের সঠিক চরিত্র নির্ণয় করতেন এবং রোগীকে জোলাপ খাইয়ে ও শীতল খাবার গ্রহণের নিদান দিয়েই কর্তব্য সারতেন।

    ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সার্জন এবং ফোর্ট উইলিয়ামের কুখ্যাত 'ব্ল্যাক হোল' কাণ্ডে চমকপ্রদ ভাবে রক্ষা পাওয়া জে জেড হলওয়েল ১৭৬৭ সালে লন্ডনের কলেজ অব ফিজিশিয়ানসে বঙ্গে বসন্তরোগের করুণ পরিস্থিতি এবং 'গুটিকা ঠাকুরাণী' অর্থাৎ শীতলা দেবীর পুজো-পার্বনের প্রতি মানুষের অগাধ আস্থা ও নির্ভরতার বিবরণ দেন। তবে একই সঙ্গে প্রাক-ভ্যাকসিন যুগের ভারতে বসন্তরোগ প্রতিরোধে প্রচলিত ভেরিওলেশন প্রক্রিয়ার কথাও তুলে ধরেন। ১৭২১-২২ সালে লেডি মেরি মন্টেগু ভেরিওলেশন প্রথার সূচনা করলেও বিলেতে তখনও এই ইনকিউলেশন প্রক্রিয়া জনপ্রিয়তা পায় নি। কাজেই ভারতের দৃষ্টান্ত দিয়ে হলওয়েলের উদ্দেশ্য ছিল দেশের মানুষের মনে আস্থার সঞ্চার করা। রোগাক্রান্তের শরীরের গুটি থেকে বসন্তের জীবাণু সুস্থ মানুষের দেহে ঢুকিয়ে রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ শক্তি বাড়িয়ে তোলাই ছিল ভেরিওলেশন বা ইনকিউলেশন। বঙ্গে সেই ভেরিওলেশন প্রক্রিয়া পর্ব ছিল রীতিমত ধর্মীয় আচার ও শীতলা স্তবের আবহে ঘেরা। কারণ, বসন্তরোগ নিরাময়ের জন্যে পুজো, হোম, দান ইত্যাদি করারও বিধান আছে। হলওয়েলের বিবরণ থেকেই জানা যায়, ভেরিওলেশনের প্রক্রিয়ার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত ছিলেন বিশেষ এক শ্রেণীর ব্রাহ্মণ। বসন্তরোগের মরসুমি প্রাদুর্ভাবের আগাম হিসেব মতো এঁরা বৃন্দাবন, এলাহাবাদ ও বারাণসী থেকে প্রতি বছর ফেব্রূয়ারি মাসের গোড়ায় বিশেষত বঙ্গে আসতেন। তাঁরা দোরে দোরে ঘুরে টিকা দিতেন। টিকা গ্রহণের প্রস্তুতি হিসেবে গৃহস্থেরা এক মাস বাড়িতে মাছ, মাংস, দুধ, ঘি খাওয়া থেকে বিরত থাকতেন। হাতের যেখানে টিকা দেওয়া হবে সেই জায়গাটা শুকনো কাপড় দিয়ে আট-দশ মিনিট ধরে খুব করে ঘষে নেওয়া হত। তারপর সেখানে নরুণ জাতীয় ধারালো কিছু দিয়ে গোল করে অল্প চিরে দেওয়া হত। বিন্দু বিন্দু রক্ত বেরোত। তারপর সেই ব্রাহ্মণ নিজের কোমরে গোঁজা রোগ-জীবাণু মিশ্রিত ছোট একটি কাপড়ের টুকরো বের করতেন। তাতে তিন ফোঁটা গঙ্গা জল ফেলে সামান্য ভিজিয়ে নিয়ে ওই চিরে দেওয়া জায়গায় সেঁটে দেওয়া হত। তারপর পুরো জায়গাটা একটা ব্যান্ডেজ বেঁধে রাখা হত ছয় থেকে আট ঘন্টা। ওই সময়ে হাত নড়ানো চলবে না। পরদিন থেকে প্রতিদিন ভোরে টিকা-গ্রহীতাকে চার ঘটি ঠান্ডা জলে স্নান করানো হত। সাধারণত ছ-দিনের দিন জ্বর আসত। আর তার দিন তিনেকের মধ্যে শরীরে অল্প-স্বল্প গুটি দেখা যেত। ঘরে একেবারে বন্দি থাকা চলত না। গায়ে খোলা হাওয়া লাগানোর নিয়ম ছিল। গুটি শুকিয়ে রঙ বদলালে গাছের কাঁটা দিয়ে সেগুলিকে খসিয়ে দিতে হত। রোগ সারলে কৃতজ্ঞতা-জ্ঞাপক পুজো-আর্চার মাধ্যমে শীতলা স্তুতির দস্তুর ছিল। শীতলাদেবীর স্তোত্র পাঠ করলেও রোগ প্রশমিত হয় -- "স্তোত্রঞ্চ শীতলাদেব্যাঃ পঠেৎ শীতলিনোহন্তিকে"। সব কিছু সমাধা হলে টিকা পিছু দক্ষিণা বাবদ ব্রাহ্মণ পেতেন এক পেনির সমতুল অর্থ। সকাল থেকে রাত অবধি ঘুরে ব্রাহ্মণেরা বাড়ি পিছু আট-দশ জনকে টিকা দিতেন। হলওয়েল এই ব্রাহ্মণদের কোন উপাধি উল্লেখ না করলেও ১৮৩১ সালে ব্রিটিশ ডাক্তারদের কাছে পেশ করা প্রতিবেদনে রাজা রাধাকান্ত দেব ব্রাহ্মণদের 'টিকাদার' হিসেবে পরিচিতি দেন। তাঁর বিবরণে জানা যায়, টিকা দেওয়ার জন্যে এঁরা এক টাকা বা দু-টাকা করে পেতেন। তবে তিনি জানান, সব ব্রাহ্মণ যে অত দূর থেকে আসতেন তা নয়। বরং তাঁরা আসতেন বর্ধমান, হুগলি বা নদীয়া থেকে। তাঁদের মধ্যে আচার্য, জ্যোতিষী, কুমোর, শাঁখারি, নাপিত সহ নানা জাতের লোকও ছিলেন। বৈদ্য বা দেশীয় কবিরাজরা রক্ত বা পুঁজ স্পর্শ করতেন না বলে একাজে তাঁরা কখনও আসতেন না। ব্রিটিশ চিকিৎসক-প্রশাসক বুকাননের বক্তব্য অনুযায়ী স্থানীয় মুসলমান চাষী বা নাপিতও টিকাদানের কাজে যুক্ত ছিলেন। অন্যান্য কিছু বিবরণে জানা যায়, টিকাদানের ন্যূনতম দক্ষিণা ছিল দু-তিন টাকা আর সর্বোচ্চ ১৬ টাকা ও সেই সঙ্গে একটি শাল।


    ‘ব্ল্যাক হোল’ থেকে আশ্চর্যজনক ভাবে রক্ষা পাওয়া ব্রিটিশ সার্জন হলওয়েল। বিলেতে ফিরে তিনি বঙ্গে দেশীয় পদ্ধতিতে বসন্তরোগের টিকাদানের উপযোগিতার কথা বর্ণনা করেন।


    ১৮০৪ সালে লর্ড ওয়েলেসলি প্রথম চেষ্টা করেন কলকাতা শহরে এই টিকাদান পদ্ধতি বন্ধ করতে। কিন্তু নির্দিষ্ট আইনের অভাবে সেই প্রয়াস অচিরেই দুর্বল হয়ে পড়ে। অবশেষে ১৮৬৫ সালে আইন করে এই প্রথা বন্ধ করা হয়। ব্রিটিশরা তখন ভ্যাকসিনের সূচনা করার মাধ্যমে পশ্চিমি চিকিৎসা পদ্ধতির প্রসার ঘটানোর চেষ্টা করতে থাকেন। কিন্তু ১৮৯০ থেকে ১৯৪০ সালের খতিয়ান নিলে দেখা যায় ভারতীয় ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থায় তখন সমন্বয়ের বিরাট অভাব। ব্রিটিশ আমলাদের মধ্যে স্বার্থের সংঘাত, বিভিন্ন দপ্তরের রেষারেষি,অর্থ বরাদ্দের অপ্রতুলতা -- সব মিলিয়ে পরাধীন মানুষের মধ্যে আধুনিক যুগের ভ্যাকসিনকে জনপ্রিয় করে তোলার উদ্যোগ ধাক্কা খেয়েছে পদে পদে। ইন্ডিয়ান মেডিকেল সার্ভিসের ডঃ ক্যামেরনের রিপোর্ট ও মেডিকেল বোর্ডের রেকর্ড থেকে জানা যায়, ১৮২৮ সালে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে ভ্যাকসিন দেওয়ার মোট ৩০টি কেন্দ্র ছিল। প্রতিটি কেন্দ্রের জন্যে সরকারি বরাদ্দ ছিল মাসিক ২৬০ টাকা। পরে আবার সরকারি সিদ্ধান্তে স্থির হয় ১৬টি কেন্দ্রে খরচ কমিয়ে করা হচ্ছে প্রতিটির জন্যে মাসিক ১২০ টাকা এবং মাসিক ৬০ টাকা বরাদ্দে খোলা হবে নতুন আরও ১৮টি কেন্দ্র। কিন্তু কলকাতা, ঢাকা ও পাটনা কেন্দ্রের বরাদ্দে কাটছাঁট হবে না। তবে সাধারণ মানুষ টাকা খরচ করে সন্দেহজনক, অজানা ভ্যাকসিন গ্রহণে অনিচ্ছুক ছিল। গরুর বাঁট থেকে এই ভ্যাকসিনের উৎপত্তি জানার পর হিন্দুদের মধ্যে ধর্মীয় বাধাও ছিল প্রতিরোধের পিছনে গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণ। ধনী ব্যক্তিরা ইউরোপীয় শিক্ষায় আলোকিত না হলে ইউরোপীয় ডাক্তারদের প্রেসক্রিপশনের তুলনায় নিজস্ব হেকিম বা বৈদ্যদের পরামর্শকেই অনেক বেশি গুরুত্ব দিতেন। কলকাতার ভ্যাকসিনেশন সুপারিন্টেন্ডেন্টের অফিসের মুখ্য সহকারি গোপাল চন্দ্র মজুমদার ১৮৭২ সালে স্পষ্ট জানিয়েছিলেন, জনগণ ভ্যাকসিনের ব্যাপারে অত্যন্ত সন্দিহান কারণ তাঁরা এ সম্পর্কে কিছুই জানেন না। তার আগে ১৮৫৭ সালে রামনারায়ণ বিদ্যারত্ন ভট্টাচার্য অবশ্য দেশীয় টিকাদানের উপযোগিতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে ইউরোপীয় ভ্যাকসিনের সপক্ষে সওয়াল করেছিলেন। নিজে একজন কবিরাজ হয়েও হারাধন বিদ্যারত্ন ১৮৬৮ সালে স্বীকার করতে দ্বিধা করেন নি যে বসন্তরোগে বৈদ্যদের চিকিৎসা অচল এবং সে কারণেই লোকে এত নিরুপায় হয়ে দৈবের শরণাগত। তা সত্ত্বেও ভ্যাকসিনের প্রসার ঘটানো মোটেই সহজ ছিল না। প্রথম দিকে এমন গুজবও রটিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে, সরকারের টিকাদানের আসল উদ্দেশ্য হল, শরীরে একটা চিহ্ন দিয়ে দাগিয়ে দেওয়া যাতে পরে অন্য কোন ব্রিটিশ উপনিবেশে তাদের কুলি হিসেবে চালান দেওয়া যায়। আবার আর একটি প্রচলিত গুজব ছিল টিকার চিহ্ন এঁকে ঔপনিবেশিক সরকার আদমসুমারির মাধ্যমে পিটুনি কর বসাতে চায়। ব্রিটিশ প্রশাসকদের ভ্রান্ত ধারণা ছিল, গো-মাতার প্রতি ভক্তিমান ভারতীয়রা মানবকল্যাণের জন্যে প্রস্তুত ভ্যাকসিনটি কৃতজ্ঞচিত্তে গ্রহণ করবে। কিন্তু ১৮০৪ সালে সুপারিন্টেন্ডেন্ট জেনেরাল অব ভ্যাকসিনেশন ডেভিড স্কুলব্ৰেড ভ্যাকসিনের প্রতি মানুষের প্রচন্ড বিরোধিতার কথা স্বীকার করতে বাধ্য হন। তীব্র সমালোচনা করে তিনি বলেন, হিন্দুরা যে কোন উদ্ভাবনের বিরোধী – “naturally averse to all innovation”. তবে ব্রিটিশরা যাই বলুন না কেন, আধুনিক ভ্যাকসিনের বিরুদ্ধে মানুষের প্রধান আপত্তির কারণই ছিল, ভেরিওলেশনের মতো এখানে কোন ধর্মীয় অনুষঙ্গ ছিল না। খাবার দাবারের বিষয়ে কিছু নিয়ম মানার ব্যাপার নেই, শীতলা দেবীর পুজো বা স্তব নেই, গঙ্গা জলের শোধন নেই, তাহলে দৈব আশীর্বাদ আসবে কোথা থেকে? সুতরাং এক কথায় এটি অধার্মিক ব্যাপার এবং মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাসে অবৈধ হস্তক্ষেপ। শুধু বঙ্গেই নয়, পঞ্জাবের প্রধান ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ও এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে বলল, ভ্যাকসিন গ্রহণ মানে ব্রিটিশদের বশ্যতা স্বীকার করা। কলকাতায় বাবু রসময় দত্তের মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিও মনে করতেন বসন্তরোগের কোন চিকিৎসা নেই। আর্তজনের কাছে একমাত্র ভরসা শীতলা দেবীর কৃপা। মুষ্টিমেয় শিক্ষিত মানুষের কাছে ইউরোপীয় চিকিৎসার কদর থাকলেও তৎকালীন সমাজে জনপ্রিয় দেশজ চিকিৎসা-সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল আয়ুর্বেদিক, ধর্মীয় ও লৌকিক উপাদানের সমন্বয়ে।


    ভ্যাকসিন নেওয়ার পর পুরুষ ও নারীর শরীরে গজিয়ে উঠছে গরুর দেহাংশ। ১৮০২ সালের ব্যঙ্গচিত্র। সমাজে ভ্যাকসিন-বিরোধী মনোভাবের প্রতিচ্ছবি।


    ব্রিটিশ চিকিৎসকেরা তদন্ত করে দেখেছিলেন, ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি বঙ্গের অন্তত ৭০ শতাংশ মানুষের ভেরিওলেশন সম্পূর্ণ। প্রজন্মান্তরে প্রচলিত বিশ্বাস গড়ে উঠেছিল যে জীবনের কোন না কোন সময়ে এই টিকাকরণ হিন্দুদের ধর্মীয় কর্তব্য এবং তার অবহেলা অপরাধের শামিল। বিষয়টি ব্রিটিশদের কাছে এতই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল যে ১৮৫০ সালে গঠিত কমিটি অন স্মলপক্স ইনকিউলেশন এ ব্যাপারে বিশদ মতামত চেয়ে নদীয়া, বারাণসী, সংস্কৃত কলেজ ও সদর দেওয়ানি আদালতের পন্ডিতদের কাছে একগুচ্ছ প্রশ্ন পাঠিয়েছিল। বারাণসীর পন্ডিতরা জানিয়েছিলেন, শাস্ত্রে টিকা নিয়ে নির্দিষ্ট বিধান না থাকলেও এর মাধ্যমে প্রাণ রক্ষা পেলে তার প্রশস্তি কর্তব্য এবং বসন্তের গুটি বেরোলে শীতলার পুজো এবং ব্রাহ্মণ ভোজন বিধেয়। সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপকরা বললেন, বসন্তের অধিষ্ঠাত্রী দেবী শীতলা, কাজেই তাঁর অর্চনা তো করতেই হবে। দেওয়ানি আদালতের পন্ডিতেরা বিধান দিলেন, ভ্যাকসিন দিলেও তার সঙ্গে পবিত্র চিত্তে শীতলা দেবীর স্তব ও পুজো করতে হবে। এ থেকে বোঝা যায় রোগমুক্তির জন্যে সমাজে ধর্মীয় বিশ্বাসের গভীরতা কতটা ছিল। তবে সব কিছু ছাপিয়ে শীতলার পুজোয় যেটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ সেটির উল্লেখ করেছেন ভগিনী নিবেদিতা। তিনি লিখছেন – “The oldest worships are connected with libations, the pouring out of water before God, but in the worship of Sitala the idea of a sanative cleanliness is very prominently brought forward.” আজকের অতিমারীর এই পরিস্থিতে পরিচ্ছন্নতার এই ভাবনাটা বিশেষ জরুরি বলে বোধ হয়।


    শোভাবাজার রাজবাড়ির রাজা রাধাকান্ত দেব। বসন্তরোগের টিকাদানকারী ব্যক্তিদের যিনি ১৮৩১ সালে ‘টিকাদার’ হিসেবে সামাজিক স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।


    বসন্তরোগ লক্ষণ দেখা দিলে ধরে নেওয়া হত সেটি দেবীরই মাহাত্ম্য -- 'মায়ের দয়া' এবং প্রচলিত বিশ্বাস ছিল গৃহের যাবতীয় অশুচি, মালিন্য, অসুখ ও গ্লানি ধুয়ে-মুছে সাফ করার জন্যেই দেবী দয়া করে আবির্ভুতা হয়েছেন। এই বিশ্বাসের যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায় দেবীমূর্তির কাঁখের কলসি এবং হাতে সম্মার্জনী বা ঝাঁটায়। সংক্রমণ যাতে না ছড়ায় সেইজন্যে রোগীকে পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে যথোচিত পরিচ্ছন্নতার মধ্যে রাখা হত। রোগীর সেবা যিনি করতেন তিনিও স্নান করে, পরিষ্কার কাপড় পরে তবেই রোগীর কাছে যেতে পারতেন। ২১ দিনের এই কোয়ারেন্টাইন বা নিভৃতবাসের বিধান ছিল বসন্ত, হাম জাতীয় সংক্রামক ব্যাধির ক্ষেত্রে। সংক্রমণের আতঙ্ক ঘরোয়া পরিচর্যার এই পারিবারিক চিত্রে সবসময় সীমাবদ্ধ থাকত না। অনেক ক্ষেত্রে রোগ-ভয় বদলে যেত রোগীর প্রতি অমানবিক নির্মমতার বিভীষিকায়। রবীন্দ্রনাথের 'অভিসারে' সন্ন্যাসী উপগুপ্ত রোগজর্জর নগরীর নটীকে খুঁজে পেয়েছিলেন পথের ধারে পরিত্যক্ত অবস্থায় --
    "নিদারুণ রোগে মারী-গুটিকায় ভরে গেছে তার অঙ্গ।
    রোগমসী ঢালা কালী তনু তার
    লয়ে প্রজাগণে, পুর-পরিখার
    বাহিরে ফেলেছে, করি' পরিহার বিষাক্ত তার সঙ্গ।।"


    বসন্ত রোগাক্রান্ত গোয়ালিনীর লসিকা গ্রন্থি থেকে প্রস্তুত টিকা দিলেন ব্রিটিশ চিকিৎসা বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড জেনার শিশুটির শরীরে। গরুর বাঁট থেকে সংগৃহীত দেহরস ব্যবহার করেও একই সাফল্য পেয়েছিলেন তিনি। গুটি বসন্তের টিকা আবিষ্কার করে ইমিউনোলজির জনক হয়ে ওঠেন জেনার।


    পরবর্তীকালে সংক্রামক রোগীকে সমাজ-বিচ্ছিন্ন রাখার জন্যে চালু হয়েছিল কোয়ারেন্টাইন প্রথা। তার জন্যে রোগীকে রাখা হত লোকালয়ের বাইরে কোন কোয়ারেন্টাইন হাউজে। চিকিৎসা বা শুশ্রূষার পরিবর্তে সেখানে যে কী অমানবিক আচরণ জুটত তার বরাতে তার প্রমাণ মেলে অসমের বরাক উপত্যকায় শিলচরের এক পুরনো বিবরণে। কলেরা রোগীকে কোয়ারেন্টাইন হাউজে নিয়ে আসার সময় ও সুযোগ হত না। কলেরায় আক্রান্ত রোগী অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংক্রমণের ২৪ ঘন্টার মধ্যে মারা যেত। কিন্তু গুটিবসন্তের আক্রমণ হলে রোগীকে কয়েকদিন ভুগতে হত। গুটিবসন্তে আক্রান্ত কোন বেওয়ারিশ রোগী পেলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তৎক্ষণাৎ ওই রোগীকে কোয়ারেন্টাইন হাউজে পাঠিয়ে দিতেন। সাধারণত গুটিবসন্তের রোগী রাখা হত বলে ঘরটার নামই হয়ে গেল 'গুটিঘর'। শহর থেকে মিজোরামের দিকে লুসাই পাহাড়ে যাবার সড়কের ধারে পরিত্যক্ত এক জলার পাশ দিয়ে পায়ে-চলা পথ ধরে অনেকটা ভিতরের গুটিঘরে যেতে হত। রোগাক্রান্ত ব্যক্তিকে ঠেলাগাড়ি করে সেখানে নিয়ে যাওয়া হত। যে রোগীকে গুটিঘরে নিয়ে যাওয়া হত তার দায়দায়িত্ব পুরোপুরি বর্তে যেত একজন জমাদারের ওপরে। না কোন ডাক্তার, না কোন কম্পাউন্ডার সেখানে যেতেন। জমাদারটি দিনে একবার আসত। তার হাত দিয়েই ওষুধ পথ্য পাঠানো হত। সারাদিনের সঞ্চিত মলমূত্র কিছুটা পরিষ্কার করে, সম্ভব হলে রোগীকে ওষুধপত্র খাইয়ে নয়ত রোগীর পাশে ফেলে রেখে সে তার ডিউটি শেষ করে চলে যেত। জনমানবহীন জলার মাঝখানে অবস্থিত গুটিঘরে অসহায় ওই রোগীর খোঁজখবর নিতে রাতে আর কেউ আসত না। পরদিন কাক-শকুনের হুল্লোড় দেখে বোঝা যেত রোগী মারা গেছে। শীঘ্র নতুন রোগী আর না এলে দু-চারদিন লাশটি সেখানেই পড়ে থাকত। বেওয়ারিশ লাশটি যখন সৎকারের জন্যে নিয়ে যাওয়া হত তখন মৃতদেহের কতটা অংশ যে কাক শকুন আর শেয়াল কুকুরের পেটে গেল আর কতটা অংশই বা অবশিষ্ট রইল কেই বা তার হিসেবে করত। বিজ্ঞান চেতনার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে এই নারকীয় ব্যবস্থা দূর হলেও সমাজ কিন্তু সংক্রমণের ত্রাস থেকে এখনও বহু ক্ষেত্রেই সামাজিক বয়কটের মাধ্যমে মানবিকতার সীমা লঙ্ঘন করে চলেছে। তারই প্রতিফলন করোনা রোগী ও তাঁর স্বজন এবং স্বাস্থ্য কর্মীদের প্রতি প্রতিবেশীদের সহানুভূতি ও সহমর্মিতার অভাবে। রোগকে যখন বলা হত 'মায়ের দয়া' তখন আমাদের সহজাত পবিত্রতা,পরিচ্ছন্নতা বোধ এবং ধর্মীয় লোকাচারের মাধ্যমে রোগীকে সুস্থ করা ছিল শুধু পরিবারের নয়, গোটা পাড়া বা গ্রামের দায়িত্ব। কোন পরিবারে বসন্তরোগ দেখা দিলে সন্ধ্যায় হরিনামের দল বাড়ি বাড়ি 'নাম দিয়ে' বেড়াত। লোকবিশ্বাস ছিল হরিনাম সংকীর্তনে মা শীতলা শীতল হয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে যান এবং রোগীর রোগযন্ত্রণা লাঘব হয়। দিন যত এগিয়েছে রোগী ও তাঁর পরিবারের সামাজিক অন্তর্ভুক্তিকরণ বা social inclusion-এর এই চেহারাটা গেছে বদলে। তাই একদিকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের বিপুল উন্নতি হলেও লোকায়ত ধর্মীয় আচারগুলিকে কুসংস্কারের তকমা দিয়ে পিছনে ঠেলে দেওয়া হয়েছে এবং শিক্ষা ও বিজ্ঞান চেতনার প্রসার সত্ত্বেও সমাজের চোখে সংক্রামক রোগী ও তাঁর স্বজন হয়ে উঠেছে সমাজের চোখে ব্রাত্য।


    (এরপর আগামী সংখ্যায়


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ৩১ জুলাই ২০২০ | ২৮১২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল প্রতিক্রিয়া দিন