এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  শনিবারবেলা

  • মহামারী, কোয়ারেন্টাইন ও দেশকাল - পর্ব ৬

    দীপঙ্কর দাশগুপ্ত
    ধারাবাহিক | ০৭ আগস্ট ২০২০ | ২৬৬৩ বার পঠিত
  • কুবলাই খানের ভোজসভা, দ্য ভিঞ্চি, প্লেগ কস্টিউমের সুগন্ধি এবং আজকের মাস্ক

    “No one reveals himself as he is; we all wear a mask and play a role.”
    -- Schopenhauer

    ইংরেজ কবি কোলরিজ আফিমের ঘোরে স্বপ্ন দেখে কুবলা খানের বিলাসবহুল রাজধানী জানাডু নিয়ে কবিতা লিখেছিলেন। তারও অনেক আগে ত্রয়োদশ শতকে তুখোড় জ্ঞানসম্পন্ন ইতালির পর্যটক মার্কো পোলো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে লেখেন তাঁর চীন ভ্রমণের কাহিনী। সেখানে তিনি চেঙ্গিজ খানের নাতি ও চীন দেশ বিজয়ী ইউয়ান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা কুবলাই খানের এলাহি ভোজসভার এক আকর্ষণীয় বিবরণ দিয়েছেন। কোলরিজের 'কুবলা খান'ই এই কুবলাই খান। কিংবদন্তীতুল্য সেই মোঙ্গল সম্রাটের দরবারে আমন্ত্রিত দেশি-বিদেশি অভ্যাগতদের মহার্ঘ পানভোজনের তদারকি ও পরিবেশনে যে অমাত্য ও ভৃত্যরা নিযুক্ত ছিলেন তাঁদের নাক ও মুখ ঢেকে রাখতে হত সোনার জালি দেওয়া সূক্ষ্ম রেশমের রুমাল বা মাস্কে যাতে তাঁদের শ্বাস-প্রশ্বাসে খাদ্য ও পানীয়ের স্বাদ বা সুঘ্রাণ বিনষ্ট না হয়। মাস্ক তখন ছিল রাজদরবারের বিলাসী উপকরণ।


    ১৬৩০ সালে বিখ্যাত ফরাসি চিত্রকর নিকোলা পুস্যাঁর আঁকা "দ্য প্লেগ অব অ্যাশডড"।


    আবার ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকের ইংল্যান্ডের রাজদরবারে বিনোদনের জন্যে কাব্য, নৃত্য ও গীত সমন্বয়ে যে অভিনয়ের পালা মঞ্চস্থ হত তারও নাম ছিল মাস্ক (masque)। নিছক বিনোদন ছাড়াও রূপকের আড়ালে নানা পৌরাণিক কাহিনী, সামাজিক ন্যায়-নীতির কূট প্রশ্ন কিংবা সমসাময়িক রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ তুলে ধরার জন্যে মাস্কে অভিনয়ের ক্ষেত্রে প্রকৃত চরিত্র গোপন রাখার জন্যে মুখোশ ব্যবহারের চল ছিল। এডমান্ড স্পেন্সারের "দ্য ফেয়ারি কুইন"-এ মাস্কের মাধ্যমেই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে "সেভেন ডেডলি সিনস"-এর অমোঘ বার্তা। "দ্য টেম্পেস্ট" বা "এ মিডসামার্স নাইটস ড্রিম" সহ শেক্সপিয়ারের অন্তত পঁচিশটি নাটকে কাহিনীর জটিলতা আবর্তিত হয়েছে মুখোশের আড়ালে চরিত্রের ছদ্মবেশে। তবে প্রথম মাস্কটি ১৫৯৪ সালে অভিনীত হয়েছিল ইংল্যান্ডের গ্রেজ ইন-এ রানি এলিজাবেথের সম্মানে। সেটি ছিল ফ্রান্সিস ডেভিসনের লেখা এবং টমাস ক্যাম্পিয়ন সুরারোপিত "দ্য মাস্ক অব প্রোটিয়াস অ্যান্ড দ্য অ্যাডাম্যান্টাইন রক"। পরবর্তীকালেও সাহিত্যে মাস্কের ভূমিকা অপরিসীম। ঊনবিংশ শতকের ফরাসি লেখক আলেকজান্ডার দুমার "ম্যান ইন দ্য আয়রন মাস্ক" উপন্যাসের পটভূমি গড়ে উঠেছিল সিংহাসন নিয়ে সম্রাট চতুর্দশ লুই ও তাঁর অবৈধ ভ্রাতার টানাপোড়েনকে কেন্দ্র করে। শোনা যায়, অন্যায় ভাবে সিংহাসনের দখল বজায় রাখার জন্যে চতুর্দশ লুই লোকচক্ষু থেকে পরিচয় গোপন করতে তাঁর ওই ভাইকে লোহার মুখোশের আড়ালে দীর্ঘ তিরিশ বছর বাস্তিলের কারাগারে বন্দি করে রেখেছিলেন। আর ওই খবরটি প্রথম পাঁচ কান করে দিয়েছিলেন দার্শনিক ভলতেয়ার। দুমা সেই কাহিনীর ভোল পাল্টে দিয়ে সম্রাটের সেনাবাহিনীর তিন মাস্কেটিয়ারের সাহায্যে অত্যাচারিত ভাই কিভাবে অন্যায়ের প্রতিশোধ নিয়ে সম্রাটকে গদিচ্যুত করে অবশেষে নিজে ক্ষমতাশালী হন সেটিকেই উপজীব্য করেছিলেন।


    পাখির ঠোঁট ওয়ালা প্লেগ ডাক্তারের পোশাক উদ্ভাবন করেছিলেন ফরাসি চিকিৎসক চার্লস দ্য লোর্মে।


    করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় পারস্পরিক শ্বাস-প্রশ্বাস থেকে সংক্রমণ ঠেকাতে আজ মাস্ক পরার ঢালাও দাওয়াই জারি হয়েছে। ভেবে বিস্মিত হতে হয়, মামুলি ব্যবহারিক উপযোগিতার বাইরেও তার সঙ্গে জড়িত রয়েছে কত বিচিত্র ঐতিহাসিক বৃত্তান্ত, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, প্রতীকী বিশ্লেষণ ও দার্শনিক ব্যাখ্যা। মনে পড়ে যাচ্ছে শরৎচন্দ্রের শ্রীনাথ বহুরূপীকে। আধো অন্ধকারে হঠাৎ বারান্দায় লাফ দিয়ে পড়ল বাঘ। মেজদা তখন তাঁর ভাইদের নিয়ে পিলসুজ জ্বেলে পড়তে বসেছেন। আর বাঘ লাফিয়ে পড়তেই মেজদা পিলসুজ উল্টে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। সড়কি লাও, বন্দুক লাও— আওয়াজ উঠল। পশ্চিমি দারোয়ান বন্দুক তাক করতেই সেই বাঘ মানুষের গলায় কেঁদে উঠল, ‘‘আমি বাঘ নই। ছিনাথ (শ্রীনাথ) বহুরূপী।’’ বহুরূপীদের জীবনযাত্রা নিয়ে কয়েক বছর আগে একটি সিনেমাও হয়েছিল। সেখানে শ্রীনাথ বহুরূপীর মতোই বাঘের সাজে পাড়ায় পাড়ায় খেলা দেখাত “বাঘ বাহাদুর”। চৈত্রের গাজনের সময় বহুরূপীর দল পাড়ায় পাড়ায় শিব, কালী, কৃষ্ণ সেজে সকলকে আমোদিত করে আর মুখে মুখে ছড়া কাটে। তাতে নির্দিষ্ট বক্তব্যও লুকিয়ে থাকে। মুখোশকে ঘিরে এটি আমাদের নিজস্ব লোকসংস্কৃতি। ছৌ বা কথাকলির মতো ঐতিহ্যপূর্ণ নৃত্যকলাতেও মুখোশ ব্যবহারের অসীম গুরুত্ব। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্দশ শতকে মিশরের ফারাও তুতানখামেন, ত্রয়োদশ শতকে পেরুর সমৃদ্ধ ইনকা সভ্যতা এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গেও ওতপ্রোত ভাবে জড়িত রয়েছে মুখোশের বৈচিত্র্য। হাল আমলে হ্যালোউইন উৎসব পালনের হিড়িকে কিম্ভূতকিমাকার মুখোশের বাণিজ্য আকাশ ছুঁয়েছে। আর অপরাধী তার পরিচয় গোপন করতে মুখোশের আড়াল তো চিরকালই ব্যবহার করে এসেছে। সেই কারণেই এখন করোনা রুখতে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক হলেও সোনার দোকানে ঢুকলে ক্রেতাকে পুলিশের নির্দেশ অনুযায়ী একবার অন্তত মুখাবরণী খুলতেই হবে। অশান্ত পৃথিবীর রাসায়নিক যুদ্ধে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করতে হয় বিশেষ ধরণের গ্যাস মাস্ক। সপ্তদশ শতকের ইংল্যান্ডে সংসদ ভবন উড়িয়ে দেওয়ার 'গানপাউডার প্লটে’র সঙ্গে জড়িত গাই ফক্সের মুখোশও হয়ে উঠেছে আধুনিক রাজনীতিতে প্রতিবাদের প্রতীক। আবার আমেরিকায় বর্ণ বিদ্বেষের সঙ্গে কু ক্লাক্স ক্ল্যানের শ্বেত সন্ত্রাসের ক্রিয়াকলাপও ঘটে মুখোশেরই আড়ালে। অর্থাৎ রাজনীতিতেও রয়েছে মুখোশের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব।


    'বিক ডক্টর' -- 'পি পি ই'-র পূর্বসূরি প্লেগ কস্টিউম। পাখির ঠোঁটে ভরা থাকত ৫৫ রকমেরও বেশি সুগন্ধি। সপ্তদশ শতকের ফ্রান্স।


    তবে এ সবই হল বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে মাস্কের ব্যবহার ও বিবিধ তাৎপর্যের ইতিবৃত্ত। স্বাস্থ্য সুরক্ষা বা রোগ মোকাবিলার সঙ্গে যার কোন যোগ ছিল না। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ও দূষণ থেকে শ্বাসযন্ত্র বাঁচাতে মাস্ক ব্যবহারের প্রথম প্রচলন হয়েছিল হাজার দুয়েক বছর আগে। রোমান দার্শনিক ও প্রকৃতিবিজ্ঞানী প্লিনি (২৩-৭৯ সাল) ছাগল ও ভেড়ার মূত্রস্থলী থেকে একরকম স্বচ্ছ মাস্ক উদ্ভাবন করেছিলেন। বিষাক্ত খনিজ মারকিউরিক সালফাইড চূৰ্ণ করে সিঁদুরে রঙের প্রসাধনী তৈরির কাজে যুক্ত শ্রমিকেরা সেগুলি ব্যবহার করতেন। প্রতিরোধমূলক মাস্ক ব্যবহারের পিছনে শিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির (১৪৫২-১৫১৯) অবদানও স্মরণীয়। রঙ ও প্লাস্টারের আস্তরণের ক্ষতিকারক রাসায়নিক গন্ধ থেকে ফুসফুসকে রক্ষা করতে তিনি জলে কাপড়ের টুকরো ভিজিয়ে মুখে চাপা দিতেন। কোথাও আগুন লাগলে ধোঁয়া থেকে বাঁচতে বিশেষ এই কার্যকরি পদ্ধতি আজও অবলম্বন করা হয়। কলকারখানায় শ্রমিক সুরক্ষাতেও পরবর্তী কালে মাস্কের ব্যবহার সুপ্রচলিত। অবশ্য এগুলিও মাস্কের সীমিত ব্যবহার।


    ১৯১১-র 'পি পি ই' -- চীনের মাঞ্চুরিয়ায় চিকিৎসক উ লিয়েন তে-র পরিকল্পিত ডাক্তারদের পোশাক।


    কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে মুখ ঢাকার প্রবণতা প্রথম লক্ষ্য করা গেল চতুর্দশ শতকের গোড়ায় ইউরোপে প্লেগ মহামারী বা 'ব্ল্যাক ডেথ'-এর প্রাদুর্ভাব ঘটায় । এরপর সপ্তদশ শতকে দ্বিতীয় দফায় আবার হানা দিল কালান্তক প্লেগ। ১৬১৯ সালে সেই মহামারী একেবারে ছারখার করে দিল ফ্রান্সের রাজধানী শহর প্যারিসকে। বাড়িতে রোগ ঢুকলে আর রক্ষা নেই -- সাক্ষাৎ মৃত্যুর পরোয়ানা। পরিস্থিতি এমনই শোচনীয় যে সংক্রমিত সন্তানকে ফেলে বাবা পালাচ্ছে। স্বামী-স্ত্রী কেউ কাউকে দেখছে না। চারিদিকে মৃত্যুর মিছিল। ডাঁই হয়ে পড়ে থাকছে শবের পাহাড়। মৃতদেহে পচন ধরে দুঃসহ দুর্গন্ধে এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে নারকীয় অবস্থা। এক সময় ঘোড়ায় টানা ঠেলাগাড়ি এসে সরিয়ে নিচ্ছে মৃতদেহের স্তুপ। ১৬৩০ সালে আঁকা বিখ্যাত ফরাসি চিত্রকর নিকোলা পুস্যাঁর (Nicholas Poussin) "দ্য প্লেগ অব অ্যাশডড" ছবিতে বিধ্বংসী প্লেগের এই ভয়াবহতার রূপ অসাধারণ ভাবে ফুটে উঠেছে। মেঝের ওপর দিয়ে ছুটছে ইঁদুর, আতঙ্কিত মানুষ যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে। রোগ থেকে বাঁচতে কেউ কেউ নাক ঢাকছে, সংক্রমণ থেকে রক্ষা করতে মৃতা স্ত্রীর বুক থেকে সন্তানকে ছিনিয়ে নিচ্ছে স্বামী। সে এক মর্মন্তুদ চিত্র। ওই সঙ্কটের সময় ফরাসি রাজ দরবারের চিকিৎসক চার্লস দ্য লোর্মে প্লেগ মহল্লায় যাবার জন্যে ডাক্তারদের সুরক্ষা দিতে উদ্ভাবন করলেন এক অভিনব পোশাক -- যার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে হাল আমলের বহু-চর্চিত পার্সোনাল প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই)-র। আজ যেমন পিপিই পরা কাউকে দেখলেই সমগ্র এলাকায় মুহূর্তে ত্রাস আর আতঙ্কের সঞ্চার হয়, সকলে ভাবতে শুরু করেন, একেবারে বাড়ির দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে করোনা মহামারী, তেমনই আজ থেকে চারশ বছর আগে ইউরোপের বিভিন্ন শহরের রাস্তায় ফ্যাকাশে সাদা, লম্বা পাখির ঠোঁট বিশিষ্ট কালো জোব্বা পরা, মাথায় টুপি, পায়ে বুট আর হাতে লাঠি উঁচিয়ে ডাক্তারকে টহল দিতে দেখলেও শঙ্কিত মানুষ বুঝে যেত মৃত্যুর শমন জারি হয়ে গেছে। পাখির ঠোঁট-ওয়ালা উদ্ভট ওই পোশাকের থেকেই তাঁদের পরিচিতি হয়েছিল 'বিক ডক্টর' হিসেবে -- সাধারণ লোকের কাছে সাক্ষাৎ যমদূত! কারণ, তাঁদের তো আর চিকিৎসা করার ক্ষমতা ছিল না। সারা শরীরে ফোস্কা-পড়া, পুঁজ-রক্তে যন্ত্রণা-কাতর বিউবোনিক প্লেগ-আক্রান্তদের দেহে লাঠি ঠেকিয়ে নাড়ি পরীক্ষা করে দেখা হত তারা তখনও বেঁচে আছে না মরে গেছে। সঙ্গে থাকত লগবুক। মৃত্যুর খতিয়ান নথিভুক্ত করা হত তাতে। প্লেগ তো ধনী-নির্ধন মানত না। মরণাপন্ন রোগীর সম্পত্তির হিসেব, তার বাঁটোয়ারা, উইলে সাক্ষ্যদান এসব কাজও তথাকথিত প্লেগ ডাক্তারদের করতে হত। তবু সুস্থ সমাজের কাছে তাঁরা ছিলেন ব্রাত্য যাঁদেরকে চিরজীবন কাটাতে হত কোয়ারেন্টাইনে। পরিবারের গুরুতর বিপদে ছাড়া তাঁদের বাড়ি ফেরারও উপায় ছিল না। বিশেষ এই পোশাকের কৌতূহলোদ্দীপক বর্ণনা মেলে ১৭২১ সালে জেনিভায় প্রকাশিত সুইস চিকিৎসক ও লেখক জঁ জ্যাকুইস ম্যানগেটের "ট্রিটাইজ অন দ্য প্লেগ" বইটিতে।


    প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মেসোপটেমিয়ার রণাঙ্গনে গ্যাস-মাস্ক পরিহিত ভারতীয় সেনা। -- ব্রিটিশ মিউজিয়াম।


    প্লেগ রোগটি যে ব্যাকটেরিয়া-ঘটিত, সপ্তদশ শতকের চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের কাছে তা ছিল অজানা। কারণ, রোগজীবাণু বিষয়ে বিজ্ঞানের আবিষ্কার হয়েছে অনেক পরে। ১৮৬১ সালে ফরাসি রসায়নবিদ ও মাইক্রোবায়োলোজিস্ট লুই পাস্তুর বাতাসে ভাসমান রোগসৃষ্টিকারী 'প্যাথোজেন' বা জীবাণুর হদিস পান, যা 'জার্ম থিওরি' হিসেবে পরবর্তীকালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনে। পাস্তুরের আবিষ্কারের গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে ব্রিটিশ শল্য চিকিৎসক জোসেফ লিস্টার এবং জার্মান চিকিৎসক ও কলকাতায় বসে কলেরার ব্যাক্টেরিয়া চিহ্নিত করার কৃতিত্বের অধিকারী রবার্ট কখের অবদানও বিরাট। তার আগে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বিশ্বাসী ছিলেন 'মিয়াসমা তত্ত্বে' যাতে মনে করা হত পচাগলা শবদেহ, আবর্জনা বা দূষিত পদার্থের পূতিগন্ধ থেকেই রোগ ছড়ায়। শুধু ইউরোপে নয়, চীনেও মনে করা হত 'বিষাক্ত বাতাস'ই বয়ে নিয়ে আসে প্লেগ, ম্যালেরিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জা বা কলেরার মতো মহামারী। কাজেই লোর্মের উদ্ভাবিত 'প্লেগ কস্টিউম' তৈরি হয়েছিল এমন ভাবে যাতে বাইরের বাতাস শরীরে ঢুকতে না পারে। মোম পালিশ করা মরক্কো চামড়ায় তৈরি গাউনে ঢাকা পড়ত মাথা থেকে পায়ের গোড়ালি অবধি। তার ভিতরে পরতে হত পাজামা, ওপরে একটা জামা। পায়ে পুরোপুরি ঢাকা চামড়ার জুতো। তবে সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ব্যাপার ছিল ছয় ইঞ্চি লম্বা পাখির ঠোঁট-ওয়ালা মাস্ক যার দুদিকে নাসারন্ধ্রের কাছে থাকত ছোট্ট দুটো ফুটো। দু-চোখের সামনে মাস্কের ওপর থাকত কাচের আবরণ। পরিচয় জানাবার জন্যে মাথায় থাকত মর্যাদা-সূচক কালো টুপি আর হাতে লম্বা ছড়ি। চমকপ্রদ ব্যাপার ছিল লম্বা ওই ঠোঁটের ভিতরে ঠাসা থাকত সুগন্ধি মশলা ও ভেষজ দ্রব্য যার অধিকাংশ রপ্তানি হত ভারত থেকে। সুইস চিকিৎসকের বিবরণ থেকে জানা যাচ্ছে, সেগুলির মধ্যে ছিল পুদিনা, ল্যাভেন্ডার, দারুচিনি, গোলমরিচ, রসুন, কর্পূর, মধু এবং ৫৫ টিরও বেশি ভেষজ সামগ্রীর একটি যৌগ যাকে বলা হত 'থেরিয়াক'। লোর্মে মনে করতেন, রোগের মহল্লার নারকীয় পরিবেশে গেলে মাস্কের ভেষজে-ঠাসা ঠোঁট থেকে প্লেগ ডাক্তারের নাক দিয়ে ফুসফুসে ঢুকবে সুগন্ধিদ্রব্যে জারিত বাতাস। সেটিই হবে তাঁর সংক্রমণ ঠেকানোর উপায়। সন্দেহ নেই লোর্মের এই প্রয়াস তাঁকে খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছে দিয়েছিল এবং বিশেষ এই পোশাক ও মাস্ক ক্রমে ইউরোপীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাসে মহামারীর অবিস্মরণীয় এক প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত হল। কিন্তু পুরনো বিবরণ থেকে এও জানা যায়, পেশাগত কস্টিউমের নাটকীয় সুরক্ষা সত্ত্বেও প্লেগ ডাক্তাররা মারা গিয়েছিলেন দলে দলে। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের এমেরিটাস অধ্যাপক ফ্রাঙ্ক এম স্নোডেন তাঁর সাম্প্রতিক বই, "এপিডেমিকস এন্ড সোসাইটি: ফ্রম ব্ল্যাক ডেথ টু দি প্রেজেন্ট"-এ স্পষ্ট লিখেছেন, “the therapeutic strategies of early modern plague doctors did little to prolong life, relieve suffering or effect a cure.” আজ এই করোনা মহামারীর সময় পিপিই, এন ৯৫ মাস্ক, ফেস শিল্ড, সার্জিক্যাল ক্যাপ, গ্লাভস, শ্যু-কভার ইত্যাদি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত যে অনবরত বদলে চলেছে, যে বিপুল বাণিজ্য চলছে এবং সাধারণ মানুষের মনে ক্রমেই যে বিভ্রান্তি দানা বাঁধছে তাতে সঙ্গত ভাবেই প্রশ্ন জাগে, ভবিষ্যতে প্রমাণিত হবে না তো যে প্লেগ কস্টিউমের মতো এগুলিও আসলে রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে ছিল মূলত অর্থহীন?


    স্প্যানিশ ফ্লু দমনে মার্কিন সরকারি পদক্ষেপ সংবাদপত্রের শিরোনামে। -- শিকাগো স্বাস্থ্য দপ্তর।


    লক্ষণীয় ব্যাপার হল, পাস্তুরের 'জার্ম থিওরি' যথেষ্ট মান্যতা পেলেও কার্যক্ষেত্রে সেই জ্ঞানের প্রয়োগ ঘটেছে অনেক পরে। ১৮৭০ এর শেষের দিকে রক্তমাখা অ্যাপ্রোন পরে অপারেশন থিয়েটারে প্রবেশে কোন অস্বাভাবিকতা ছিল না। তার দু-দশক পরেও ১৮৯০ সালে সার্জনদের অস্ত্রোপচার করতে দেখা গেছে মাস্ক বা সার্জিক্যাল ক্যাপ ছাড়াই। এরপর ১৯০৫ সালে শিকাগোর চিকিৎসক এলিস হ্যামিলটনের গবেষণায় দেখা গেল, ধুম জ্বর আর সারা গায়ে লাল চাকা চাকা দাগ সহ স্কারলেট ফিভারে আক্রান্তদের কাশি বা শিশুদের কান্নার মাধ্যমে বাতাসে ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে পড়ে। ডাক্তার ও নার্সদের থেকেও সংক্রমণ যে ছড়াতে পারে, সেকথা জানিয়ে তিনিই প্রথম অস্ত্রোপচারের সময় মাস্ক ব্যবহারের সুপারিশ করেন। তখন থেকে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে মাস্কের প্রচলন শুরু হয়।


    বস্টন শহরে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় তৈরি হচ্ছে গজ ও কাপড়ের মাস্ক। ১৯১৯ সালের মহামারীর সময়।


    তবে মহামারী থেকে রক্ষা পেতে সকলের মুখে এখন যে ধরণের মাস্ক দেখা যাচ্ছে তার পথপ্রদর্শক হলেন বিলেতে শিক্ষিত তরুণ চীনা চিকিৎসক উ লিয়েন তে। চীনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে যা তখন পরিচিত ছিল মাঞ্চুরিয়া নামে সেখানে ১৯১০ সালে নিউমোনিক প্লেগের সংক্রমণ বাগে আনতে গিয়ে তাঁর চমকপ্রদ পর্যবেক্ষণ ছিল ইঁদুর নয়, সংক্রমণের মূলে রয়েছে বাতাস-বাহিত জীবাণু। তিনি তাঁর সব সহকর্মী ডাক্তার, নার্স ও স্যানিটারি কর্মীদের গজ ও কাপড় দিয়ে বানানো মাস্ক পরতে বললেন। বিশিষ্ট এক ফরাসি ডাক্তার তো তাঁকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে মাস্ক না পরেই রোগী দেখলেন এবং শোচনীয় ভাবে কয়েকদিনের মধ্যে মারা গেলেন। যে জার্মান ও অন্যান্য ইউরোপিয়ান চিকিৎসক আগে লিয়েন তে-কে ঠাট্টা করেছিলেন, তাঁরা চুপ করে গেলেন। যে সংক্রমণে ১০০ শতাংশ মৃত্যু হার, কড়া ব্যবস্থা অবলম্বন করে চীনা নববর্ষের আগেই সেই রোগকে ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলপথের সুবাদে বিখ্যাত রাজধানী শহর হার্বিন থেকে তিনি নির্মূল করে দিলেন। আর আন্তর্জাতিক ভাবে পরিচিতি পেয়ে গেল গজ ও কাপড়ে তৈরি সেই মাস্ক।


    মাস্ক না পরার জন্যে ট্রামে উঠতে দেওয়া হচ্ছে না যাত্রীকে। ১৯১৮ সালের সিয়াটল। -- লাইব্রেরি অব কংগ্রেস।


    এর কয়েক বছরের মধ্যেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯১৮ সালে বিভিন্ন দেশে মহামারী হয়ে ছড়িয়ে পড়ল 'স্প্যানিশ ফ্লু'। সে বছরেই ৪ মার্চ কানসাসের ফোর্ট রাইলি সেনা শিবিরে আমেরিকায় প্রথম এক মার্কিন সেনার শরীরে সংক্রমণ দেখা দিল। সেনাবাহিনী ও দেশের জনগণের মনোবল অটুট রাখার চেষ্টায় আমেরিকা ও যুদ্ধে অবতীর্ণ কিছু দেশ প্রাথমিক ভাবে মহামারীর খবর চেপে দিয়েছিল। নিরপেক্ষ স্পেনের সংবাদমাধ্যম রোগের খবর প্রথম দিয়েছিল বলেই তা দুনিয়া জুড়ে পরিচিতি পেল 'স্প্যানিশ ফ্লু' নামে। এই মহামারীতে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ বা ৫০ কোটি মানুষ সংক্রমিত হয়েছিলেন আর ১৯১৮ সাল থেকে ১৯২০ সাল অবধি কালান্তক ভাইরাসের প্রকোপে মৃত্যু হয়েছিল দুই থেকে পাঁচ কোটি লোকের। শুধু আমেরিকাতেই মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৬ লক্ষ ৭৫ হাজার। দুই বিশ্বযুদ্ধ মিলিয়ে মোট মৃতের সংখ্যার চেয়েও যা ছিল বেশি।


    কানাডার 'ক্যালগেরি হেরাল্ড' পত্রিকায় প্রকাশিত মাস্ক-বিরোধী কার্টুন। ২৬ অক্টোবর, ১৯১৮।


    মাঞ্চুরিয়ার ঘটনার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে মহামারী ঠেকাতে নাগরিকদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং মাস্ক পরার নির্দেশ দিয়েছিল আমেরিকা। ম্যাসাচুসেটস স্টেট ডিপার্টমেন্ট অব হেলথ রোগ জীবাণু সংক্রমণের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা বাড়াতে যে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল সেটি ১৯১৮ সালের ২ অক্টোবর প্রকাশ করেছিল গ্লস্টার ডেলি টাইমস পত্রিকা। কলকাতা বা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে করোনা সংক্রমণের উর্ধমুখী রেখচিত্রে সকলে যখন দিশেহারা, এখনও যখন দফায় দফায় লকডাউন চলছে তখন সেই সময়কার মার্কিন বিজ্ঞপ্তিকে আজও আমাদের দেশে স্বচ্ছন্দে স্লোগান হিসেবে ব্যবহার করা যায়! --
    "To keep well, keep clean.
    Wash your hands before each meal.
    Don't go to crowded places. Avoid the person who sneezes.
    Smother your cough in your handkerchief..."


    সানফ্রানসিস্কো শহরে ১৯১৯ সালের ২৫ জানুয়ারি 'অ্যান্টি মাস্ক লিগে'র জনসমাবেশের ডাক।


    সেই মারণ রোগে এখনকার মতো সেই সময়েও স্কুল, কলেজ, সিনেমা, থিয়েটার, ব্যবসাপত্র সব ছিল বন্ধ। বাড়িতে অতিথির আনাগোনা বা কারও বাড়িতে যাওয়া আসা করা বন্ধ ছিল। গৃহস্থদের সতর্ক করে নগর কর্তৃপক্ষের তরফে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল --
    "Allow no visitors, and do not go visiting...
    Keep away from crowded places, such as movies, theaters, street cars..."


    'কোভিডিয়ট'


    আর গণ-পরিবহনের বদলে চাকুরিজীবীদের হেঁটে অফিসে যেতে উৎসাহ দেওয়া হয়েছিল। হাঁচি-কাশি এড়িয়ে চলতে, পারলে গায়ে রোদের তাপ লাগাতে এবং হাত-মুখ মোছার জন্যে অন্য কারও তোয়ালে ব্যবহার না করার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শও প্রচারিত হয়েছিল।
    "Walk to work if possible.
    Avoid the person who coughs or sneezes...
    Make full use of all available sunshine.
    Do not use a common towel, it spreads diseases."


    ছত্তিসগড়ের বস্তারের প্রত্যন্ত গ্রামে গাছের পাতা দিয়েই মাস্ক বানিয়ে নিয়েছেন আদিবাসী রমণীরা। -- এন ডি টি ভি।


    তবে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করার সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে এক শ্রেণীর মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছিল তীব্র অসন্তোষ ও প্রতিবাদ। ব্যক্তি স্বাধীনতার পূজারি মার্কিন সংস্কৃতি রোগ ঠেকাতে মাস্ক ব্যবহারের আরোপিত বিধিকে কোনকালেই মেনে নেয়নি। শতবর্ষ আগে বা পরে মাস্ককে কেন্দ্র করে মার্কিন সমাজ ও রাজনীতি সমান উত্তপ্ত। প্রথম প্রথম যদিওবা কিছু নাগরিক কয়েকটি রাজ্যে নির্দেশিকা মেনে মাস্ক পরলেন, আন্তর্জাতিক রেডক্রস যুদ্ধকালীন তৎপরতায় চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মাস্ক তৈরির ব্যবস্থা করল, ১৯১৮ সালের শেষার্ধে ভাইরাসের আণুবীক্ষণিক অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়তে মাস্ক-বিরোধী মনোভাবও প্রবলতর হল। 'দ্য ফ্লোরিডা টাইমস-ইউনিয়ন' কাগজের সম্পাদকীয় নিবন্ধে মন্তব্য করা হল, "দুটি গরাদের মধ্যে দু-মাইল ফাঁক থাকলে যেমন অপরাধীকে কয়েদ করার মানে হয়না তেমনই মুখে একটা মাস্ক লাগালেই ইনফ্লুয়েঞ্জার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাসকে রোখা যায় না।" সেবছরই ডিসেম্বরে শিকাগোয় আয়োজিত আমেরিকান পাবলিক হেলথ অ্যাসোসিয়েশনের সম্মেলনে যোগদানকারী ডাক্তাররা মাস্ক ও মাস্ক-বিরোধী শিবিরে কার্যত দু-ভাগ হয়ে গেলেন। ডেট্রয়েটের পাবলিক হেলথ কমিশনার মাস্ক পরার বিষয়টিকে 'নির্ভেজাল ধাপ্পা' বলে উড়িয়ে দিলেন।


    মাস্কের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিবাদ। সম্প্রতি মার্কিন শহরে।


    আবার সান ফ্রানসিস্কো শহরের মেয়র জেমস রলফ, হেলথ অফিসার ডঃ উইলিয়াম হ্যাসলার ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষ যখন ১৯১৮ সালের ২৪ অক্টোবর রোগ প্রতিরোধে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করে নির্দেশিকা জারি করলেন, যুদ্ধের আবহাওয়ায় নাগরিকেরা সেই অভ্যাস পালন করাকে জীবন-মরণের প্রশ্ন হিসেবে দেখে দেশাত্মবোধের সমার্থক বিবেচনা করলেন। মাসখানেক কড়াকড়ির পর মহামারীর দাপট কেটে গেছে ভেবে মেয়র মাস্ক অর্ডিন্যান্স প্রত্যাহার করতেই উৎফুল্ল জনগণ যাবতীয় মুখাবরণ জলাঞ্জলি দিল। সেই স্বস্তির রেশ মিথ্যা প্রমাণ করে মহামারীর ঢেউ আবার আছড়ে পড়ল। মেয়র তখন জানুয়ারি মাসে নতুন করে অর্ডিন্যান্স জারি করলেন ঠিকই কিন্তু স্বাধীন ভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে অভ্যস্ত মানুষ আর মাস্ক পরতে চাইল না। মাস্কের বিরুদ্ধে ক্ষোভ এমন জায়গায় পৌঁছল যে আইনজীবী, নাগরিক অধিকার রক্ষা কর্মী এবং সান ফ্রানসিস্কোর প্রথম মহিলা ভোটার এমা হ্যারিংটনের নেতৃত্বে গড়ে উঠল অ্যান্টি মাস্ক লিগ। প্রথম সমাবেশে সামিল হল দু-হাজারেরও বেশি মানুষ। মাস্ক পরার নির্দেশ অমান্য করায় পুলিশের গুলিতে আহত হলেন দুজন, শতাধিক বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করা হল। কিন্তু শুধু সান ফ্রানসিস্কোই নয়, ব্যক্তি স্বাধীনতা খর্ব করার বিরুদ্ধে সারা আমেরিকা জুড়ে বিভিন্ন শহরে অ্যান্টি মাস্ক লিগের ছত্রচ্ছায়ায় জোরাল হয়ে উঠল গণ-আন্দোলন। দেশ-জুড়ে মাস্ক ব্যবহারের সুপারিশ করলেও ক্যালিফোর্নিয়া, ওয়াশিংটন বা কলোরাডো সহ গুটিকয়েক রাজ্য ছাড়া আর কোথাও অর্ডিন্যান্স জারি হয়নি। ফ্লোরিডার বাণিজ্য শহর টাম্পার মেয়র অর্ডিন্যান্স জারি করতে গিয়েও শেষে পিছিয়ে আসেন। চিত্রটা শতবর্ষ পরেও প্রায় একই রয়েছে। টাম্পারই একটি কাউন্টিতে মাস্ক অর্ডিন্যান্স জারির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। আমেরিকায় করোনা ভাইরাসে মৃতের সংখ্যা দেড় লাখ ছাড়ালেও গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজি গ্রূপের সমীক্ষায় দেখা গেছে প্রতি পাঁচ জন মার্কিন নাগরিকের মধ্যে প্রায় একজন মাস্ক-বিরোধী। বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ, প্রতিবাদ, সমাবেশ লেগেই রয়েছে। যাঁরা মাস্ক পরছেন, তাঁদের কেউ সেটা রাখছেন নাকের বা চিবুকের নিচে। শিকাগো সান টাইমসের কলমচি ফিল ক্যান্ডার এঁদের নাম দিয়েছেন 'নোজ কমান্ডো'। অনেকে ঠাট্টা করে ধূমপান করার জন্যে মাস্কে একটা ফুটো করে নিচ্ছেন। মাস্ক নিয়ে এমন তামাশার নজির শুধু আমেরিকা নয়, ফ্রান্স, ব্রিটেন সর্বত্র। এদেরকে বলা হচ্ছে 'কোভিডিয়ট' (কোভিড+ইডিয়ট) বা 'মাস্ক স্ল্যাকার'। আমেরিকায় মাস্ক-বিরোধী মনোভাব গড়ে ওঠার আর একটি কারণ হল ১৫টি রাজ্যে বহু আগে থেকেই রয়েছে 'অ্যান্টি মাস্ক ল'। সেখানে প্রকাশ্যে মুখ ঢেকে চলাটাই অপরাধ। বাড়িওলা-ভাড়াটে বিবাদ ঠেকাতে ১৮৪৫ সালে নিউ ইয়র্কে প্রথম তৈরি হয়েছিল মাস্ক-বিরোধী আইন। পরবর্তী কালে অন্যান্য রাজ্যে যখন একই আইন জারি হয় তখন তার সঙ্গে জুড়ে গেছে গভীর রাজনৈতিক তাৎপর্য। বিশ শতকের মাঝামাঝি সাদা কাপড়ের 'হুড' দিয়ে মাথা-মুখ ঢাকা কু ক্লাক্স ক্ল্যান (কে কে কে) গোষ্ঠীর সদস্যদের হিংসাত্মক কার্যকলাপ রুখতে এই আইনকে হাতিয়ার করা হয়। আর এই একুশ শতকেও 'অকুপাই মুভমেন্ট' বা 'অ্যানোনিমাস' কর্মসূচিতে সামিল হওয়া গাই ফক্স মুখোশ-আঁটা রাজনৈতিক সক্রিয়বাদীদের প্রতিবাদ দমনেও অন্যতম ভরসা এই একই আইন। সুতরাং সমালোচকরা যাই বলুন না কেন, ব্যক্তি-স্বাধিকারের প্রশ্নের বাইরেও এ হেন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রেক্ষিতে তিনি ট্রাম্পই হন বা অন্য কেউ -- কোন মার্কিন প্রেসিডেন্টের পক্ষেই দেশ জুড়ে বাধ্যতামূলক ভাবে মাস্ক ব্যবহারের নির্দেশিকা জারি করা সহজ নয়। কারণ, তার একটা প্রতীকী রাজনৈতিক ব্যাখ্যা রয়েছে। তেমন কোন ফতোয়ার বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের কোন কোন দেশে ইতিমধ্যেই সরব প্রতিবাদীদের স্লোগান হল, মাস্ক পরিয়ে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কণ্ঠরোধের চক্রান্ত নিপাত যাক।


    লস এঞ্জেলেস শহরে 'গাই ফক্স' মাস্ক পরে 'অ্যানোনিমাস' গোষ্ঠীর প্রতিবাদ কর্মসূচি।


    মহামারীর আবহে মামুলি এক মাস্ককে ঘিরে যে বহুমাত্রিক তাৎপর্য সেটিও আমাদের কাছে ক্রমেই স্পষ্টতর হয়ে উঠছে। শতবর্ষ আগের নিছক গজ আর কাপড়ের মাস্ক আজ বিপণনের অমূল্য সামগ্রী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, তাবড় জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, সংবাদমাধ্যম, সোশ্যাল মিডিয়া আর সর্বজ্ঞ হিতৈষীদের প্রতিনিয়ত উপদেশ ও পরামর্শের ঠেলায় এবং 'ইনফরমেশন প্যানডেমিকে'র দাপটে সাধারণ মানুষ আজ দৃশ্যতই বিভ্রান্ত। আর মানুষের মনের এই বিভ্রান্তি ও আতঙ্ককে মূলধন করেই দুনিয়া জুড়ে পসরা বসেছে নানা ধরনের মাস্কের। শুধু স্বাস্থ্য সুরক্ষার তাগিদে নয়, সমাজের বিভিন্ন স্তরের চাহিদা, প্রয়োজন, মর্যাদা, ও মানসিকতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে রকমারি মাস্ককে অনবরত বাণিজ্যিক ভাবে তুলে ধরা হচ্ছে 'কালচারাল' বা 'ফ্যাশন স্টেটমেন্ট' হিসেবেও। অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, মধ্যপ্রদেশ বা ছত্তিসগড়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র চেঞ্চু, গোন্ড বা শবর আদিবাসীরা সরকারি সাহায্যের ভরসা না করে ওষধি গুণসম্পন্ন গাছের পাতা দিয়ে নিজেরাই মাস্ক বানিয়ে নিয়েছেন। আবার পুণে বা কটকের ব্যবসায়ীর তিন লাখি বা সাড়ে তিন লাখি সোনার মাস্ক মুখে আঁটার মধ্যে রয়েছে স্থুল দেখনদারি। মুখে মাস্ক-আঁটা শহুরে নাগরিক যখন 'ফেস আই ডি'র মাধ্যমে বহুমূল্য স্মার্টফোন চালু না করতে পেরে হতাশ হচ্ছেন তখন সমস্যা মেটাতে হাজির 'সফটওয়্যার আপডেট'। মুখ ঢেকে যায় মুখোশে বলে যাঁরা আক্ষেপ করছেন, ওষ্ঠের অভিব্যক্তি দেখতে না পেয়ে যাঁরা মনস্তাত্ত্বিক সঙ্কটে কাতর তাঁদের জন্যে সুখবর বয়ে আনছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি। আমেরিকার মিশিগানের একটি সংস্থা হাজির করেছে সম্পূর্ণ স্বচ্ছ এন ৯৯ ও হেপা ফিল্টার যুক্ত 'লিফ মাস্ক' যা পরলে মুখের আসল সৌন্দর্য ঢাকা পড়বে না। সেটির দক্ষিণাও স্বভাবতই কম নয়। তবে ওষ্ঠরঞ্জনীর বাজার গেল বলে আশঙ্কিত প্রসাধন সংস্থাগুলি এই খবরে নিশ্চয়ই নতুন উদ্যমে আরও নতুন 'শেডে'র লিপস্টিকের চটকদার বিজ্ঞাপনে বাজার মাতাবে। এক মহামারী যে কতভাবে সামাজিক শ্রেণীবৈষম্যকে প্রকট করে!


    মুখোশের আড়ালে মিসিসিপিতে ১৮৭২ সালে গ্রেপ্তার হওয়া কু ক্লাক্স ক্ল্যানের তিন সদস্য। -- লাইব্রেরি অব কংগ্রেস।


    মহামারীর গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভাইরাস, জীবাণু, বায়ুদূষণের কবল থেকে সাধ্যমতো নিজেকে সুরক্ষিত করতে হলে আগামীদিনেও আমাদের মুখ ঢেকে রাখতে হবে মাস্কে। অনেকে বলছেন, সমাজে বাস করতে গেলে মাথার হেলমেট বা গাড়ির সিটবেল্টের মতো মাস্ককেও আমাদের অনায়াস যাপন-সঙ্গী করতে হবে। জ্ঞান হবার পর থেকে আমৃত্যু একটি অদৃশ্য মুখোশ তো আমাদের নিত্য সহচর। তার ওপরে আরও একটা মাস্ক পরার সমাজতাত্ত্বিক জটিলতার মূল্যায়ণ কি কোনদিন হবে? 'আনমাস্ক' করার কাজটা আরও কঠিন হল। গোড়াতেই জার্মান দার্শনিক শোপেনহাওয়ারকে স্মরণ করেছি। শেষ করি কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিন কবি পল লরেন্স ডানবারের কবিতা দিয়ে --
    “We wear the mask that grins and lies,
    It hides our cheeks and shades our eyes,—
    This debt we pay to human guile;
    With torn and bleeding hearts we smile,
    And mouth with myriad subtleties…”


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ০৭ আগস্ট ২০২০ | ২৬৬৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খারাপ-ভাল মতামত দিন