শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের "মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি"তে আমাদের পরিচয় হয়েছিল মনোজের বাবার পিসিমা শুচিবায়ুগ্রস্ত আদ্যশক্তিদেবীর সঙ্গে। তাঁর সকাল হত সারা বাড়িতে গোবরজল ছড়া দিয়ে। বাড়ি পাছে অশুচি হয় তাই দারোগা চোর ধরতে এলে পর্যন্ত তিনি সেপাইদের জুতো খুলে ঘরে ঢোকার ফরমান জারি করেছিলেন। করোনার কল্যাণে আমরা এখন যেন ঘরেবাইরে নব অবতারে এই বাতিকগ্রস্ত আদ্যাশক্তিদেরই আবাহন করে আনছি। আজকের দিনে হলে গোবরজলের বদলে তাঁর হাতে নিশ্চয়ই থাকত সাবান আর স্যানিটাইজার! একদিকে যখন সামাজিক দূরত্ব ক্রমশ মানসিক দূরত্বে পর্যবসিত হচ্ছে অন্যদিকে তখন পরিচ্ছন্নতার বিধিগুলি বাড়তে বাড়তে মানসিক বিকারের চেহারা নিচ্ছে। দুনিয়া জুড়ে সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক দিনযাপনে এবং মুখের বুলিতে কিছু শব্দ এখন মন্ত্রের মতো উচ্চারিত হয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত -- ফেস মাস্ক, ফেস শিল্ড, গ্লাভস, কোভিড-১৯, করোনাভাইরাস, স্যানিটাইজার, সামাজিক দূরত্ব, কোয়ারেন্টাইন বা নিভৃতবাস, অ্যাসিম্পটোম্যাটিক, কনটেনমেন্ট জোন, পি পি ই ইত্যাদি। গত পাঁচ মাস ধরে আমাদের শয়নে স্বপনে জাগরণে ঘুরপাক খাচ্ছে এক শব্দবন্ধ এস এম এস। না, এটা বহু-পরিচিত "শর্ট মেসেজ সার্ভিস" নয়, মহামারীর 'নিউ নর্মালে' এর নতুন ব্যাখ্যা -- "সোশ্যাল ডিস্ট্যানসিং, মাস্ক, স্যানিটাইজার।" ভেবে অবাক লাগে, অদৃশ্য এক ক্ষুদ্র ভাইরাস এবং তাকে কেন্দ্র করে প্রচারের ঢক্কানিনাদে এই তিনটি জিনিস আমাদের অজান্তে কখন যেন একেবারে অবচেতনে শেকড় গেড়ে বসেছে। চার্লি চ্যাপলিনের 'মডার্ন টাইমসে'র সেই শ্রমিকের মতো আজকের মানুষও এক বিবশ চেতনার যান্ত্রিকতায় দৈনন্দিন জীবন যাপনে এই এস এম এস-এর গোলকধাঁধাতেই সম্পূর্ণ আটকে রয়েছে। মহামারী মোকাবিলায় সারা বিশ্ব যেদিকে ছুটছে তার সঙ্গে আচমকা তাল মেলাতে গিয়ে আমরা ভুলেই গিয়েছি, বিশেষ কোন রোগ ঠেকাতে বাইরে থেকে আরোপিত কিছু নয়, বরং ব্যক্তিগত এবং সামাজিক শুচিতা ও পরিচ্ছন্নতার বোধ শ্বাশ্বত ভারতীয় সংস্কৃতিতে অনায়াস পারিবারিক শৃঙ্খলার মধ্যেই জড়িয়ে ছিল। বিশ্ব পরিভ্রমণ করে ফিরে এসে স্বামী বিবেকানন্দ তাই স্পষ্ট লিখতে পেরেছেন --
"দুনিয়ায় এমন জাত কোথাও নেই যাদের শরীর হিঁদুদের মত সাফ। হিঁদু ছাড়া আর কোন জাত জলশৌচাদি করে না। তবু পাশ্চাত্যদের, চীনেরা কাগজ ব্যবহার করতে শিখিয়েছে -- কিছু বাঁচোয়া। স্নানও নেই বললেও হয়। ... যারা স্নান করে -- সে সপ্তায় একদিন -- সে দিন ভেতরের কাপড় আন্ডার-ওয়ার বদলায়। ... আমেরিকরা একটু বেশি! জর্ম্মান কালেভদ্রে, ফরাসি কস্মিনকালেও না!!! স্পেন, ইতালি অতি গরম দেশ, সে আরও নয় -- রাশীকৃত লসুন খাওয়া দিন-রাত ঘর্ম্মাক্ত, আর সাত জন্মে জলস্পর্শও না। সে গায়ের গন্ধে ভূতের চৌদ্দপুরুষ পালায় -- ভূত তো ছেলেমানুষ।
আমাদের রান্নার মত পরিষ্কার রান্না কোথাও নেই। ... আমাদের রাঁধুনি স্নান করেছে, কাপড় বদলেছে, হাঁড়িপত্র উনুন সব ধুয়ে মেজে সাফ করেছে, নাকে মুখে গায়ে হাত ঠেকলে, তখনি হাত ধুয়ে তবে আবার খাদ্যদ্রব্যে হাত দিচ্ছে। বিলাতি রাঁধুনির চোদ্দ পুরুষে কেউ স্নান করে নি, রাঁধতে রাঁধতে চাখছে, আবার সেই চামচে হাঁড়িতে ডোবাচ্ছে।
রুমাল বার করে ফোঁৎ করে নাক ঝাড়লে, আবার সেই হাতে ময়দা মাখলে। শৌচ থেকে এল -- কাগজ ব্যবহার করে সে হাত ধোবার নামটিও নেই -- সেই হাতে রাঁধতে লাগল। কিন্তু ধপধপে কাপড় আর টুপি পরেছে। হয়ত একটা মস্ত কাঠের টবের মধ্যে দুটো মানুষ উলঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে রাশীকৃত ময়দার উপর নাচছে -- কি না ময়দা মাখা হচ্ছে। গরমী কাল -- দরবিগলিত ঘাম পা বেয়ে সেই ময়দায় সেঁদুচ্ছে। তারপর তার রুটি তৈয়ার যখন হল, তখন দুগ্ধফেননিভ তোয়ালের উপর চীনের বাসনে সজ্জিত হয়ে পরিষ্কার চাদর বিছানো টেবিলের উপর, পরিষ্কার কাপড়-পরা কনুই পর্যন্ত সাদা দস্তানা পরা চাকর এনে সামনে ধরলে! কোন জিনিস হাত দিয়ে পাছে ছুঁতে হয়, তাই কনুই পর্যন্ত দস্তানা।
চাই কি? -- পরিষ্কার শরীরে, পরিষ্কার কাপড় পরা। ঘর পরিষ্কার চাই। রাস্তাঘাটও পরিষ্কার চাই। পরিষ্কার রাঁধুনি, পরিষ্কার হাতের রান্না চাই। পরিষ্কার, মনোরম স্থানে পরিষ্কার পাত্রে খাওয়া চাই। ওলাউঠা, এত মহামারী ম্যালেরিয়া কার দোষ? আমাদের দোষ। আমরা মহা অনাচারী।"
ভিড় থেকে সংক্রমণ। এই ভিড়েই যে মিশে রয়েছে কত টাইফয়েড মেরি! ১৯২৩ সালে লাইফবয়ের বিজ্ঞাপন।
১৮৯৮ সালে কলকাতায় যখন প্লেগ ছড়িয়ে পড়ে তখন বিবেকানন্দের নির্দেশে নিবেদিতা যে প্লেগ ম্যানিফেস্টো তৈরি করেছিলেন তাতেও মানুষকে আতঙ্কিত না হয়ে জামা-কাপড়, বিছানাপত্র, ঘরদোর ও চারপাশ পরিচ্ছন্ন রাখতে বলা হয়েছিল। আজ যখন করোনা ঠেকাতে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে তখন স্মরণ করা যেতে পারে, বিবেকানন্দের পরামর্শ ছিল কেউ যেন বাসি, পচা খাবার না খেয়ে টাটকা, পুষ্টিকর খাবার খায়। কারণ, দুর্বল শরীরে রোগ হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
ময়লা পোশাক পরিবর্তন করে সাবানে কাচা পোশাক নেবার জন্যে প্রতীক্ষারত মার্কিন সেনা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্রান্সের একটি সেনা শিবিরে। -- লাইব্রেরি অব কংগ্রেস
আজকের পরিস্থিতিতেও সমান প্রাসঙ্গিক বিবেকানন্দের এই ভাবনায় ভারতের শ্বাশ্বত চেতনারই প্রতিফলন রয়েছে। বেদ, উপনিষদ, স্মৃতি ও ধর্মশাস্ত্র থেকে জানা যায়, প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতায় প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের ছিল ওতপ্রোত সম্পর্ক। চারপাশের পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যকর রাখার জন্যে প্রকৃতির আরাধনা এবং বসুন্ধরাকে মাতৃরূপে বন্দনার পিছনে কাজ করত পরিবেশ সংরক্ষণের নীতিবোধ। মানুষের এই সংস্কার গড়ে উঠেছিল তার ইতিহাস, আঞ্চলিক সংস্কৃতি, ধর্মবোধ ও বৈদিক দর্শনের ভিত্তিতে। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র সহ প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে সুস্পষ্ট ভাবে বলা রয়েছে, চারপাশের পরিবেশ স্বাস্থ্যসম্মত রাখা মানুষের অবশ্য কর্তব্য। অন্যান্য সংস্কৃত পুঁথিতেও জলাশয়ে স্নান করা, হাত-মুখ ধোয়া সহ নানা ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখার গুরুত্বের কথা তুলে ধরা হয়েছে। মানুষের মল-মূত্র, রক্ত বা অন্য বর্জ্য পদার্থে যাতে জল দূষিত না হয় সে বিষয়ে বলা হয়েছে সাবধানতা গ্রহণের কথা। জল কিভাবে দূষিত হয় তার বিবরণ রয়েছে চরকসংহিতায় --
বসুধাকীটসর্পাখুমলসংদূষিতোদকাঃ।
বর্ষাজলবহানদ্যঃ সর্ব্বদোষসমীরণাঃ।।
....
পিচ্ছিলং ক্রিমিলং ক্লিন্নপর্ণশৈবালকর্দ্দমৈঃ ।
বিবর্ণং বিরসং সান্দ্রং দুর্গন্ধি ন হিতং জলম।।
-- চরকসংহিতা, সূত্রস্থানম, ২৭ অধ্যায় ২১৩ ও ২১৪ শ্লোক
অর্থাৎ বর্ষাকালে নদীর জল দূষিত হয়। কারণ, সে সময় মাটি, কীট, সাপ ও ইঁদুর ইত্যাদি পচে গিয়ে জল দূষিত হয়। পাতা, শ্যাওলা, কাদার মিশ্রণে জল পচে পিচ্ছিল, কৃমিবহুল, ক্লেদযুক্ত, বিবর্ণ ও দুর্গন্ধ বিশিষ্ট হয়। তাই সেই জল উপকারি নয়।
মনুসংহিতার নানা শ্লোকেও নদী, পুকুর বা চাষের জমি দুষিত না করার নির্দেশ রয়েছে –
নাপ্স মুত্রং পুরীষং বা ষ্ঠীবনং বা সমুৎসৃজেৎ।
অমেধ্যলিপ্তমন্যদ্বা লোহিতং বা বিষাণি বা ।।
-- মনুসংহিতা, চতুর্থ অধ্যায়, ৫৬ শ্লোক
জলে মল-মূত্র কিংবা থুথু, কফ ফেলবে না, মলমূত্রযুক্ত কাপড় কাচবে না এবং রক্ত বা কোন ধরনের বিষ নিক্ষেপ করবে না।
ভারতের সনাতন ধর্মের গভীরে সুপ্ত রয়েছে জীবনের পবিত্রতার ধারণা। সমস্ত সৃষ্টি ও জীবজগতের নিয়ন্ত্রক হিসেবে চিন্তা করা হত সর্বশক্তিমান ঈশ্বরকেই। কাজেই প্রকৃতির ওপর মানুষের কর্তৃত্ব কায়েম করার কথা সনাতন ধর্ম স্বীকার করে না। সমগ্র সৃষ্টিকে একসূত্রে বেঁধে নেওয়ার পিছনে দৈব শক্তির এই মহিমা অসাধারণ ভাবে ফুটে উঠেছে যজুর্বেদের ৩২ অধ্যায়ের অষ্টম শ্লোকে --
বেনস্তৎ-পশ্যন্নিহিতং গুহা সদ্যত্র বিশ্বং ভবত্যেকনীড়ম্ ।
তস্মিন্নিদং সং চ বি চৈতি সর্বংস ওতঃপ্রোতশ্চ বিভুঃ প্রজাসু ।।
সে সময়কার স্যানিটাইজার জেজ ফ্লুইড।
জলের পবিত্রতা রক্ষা করার বর্ণনা রয়েছে মহাভারতেও। নদী, পুকুর, হ্রদ, দীঘি সহ জলের যাবতীয় উৎস দূষিত করার কাজকে তখন রীতিমতো অপরাধ হিসেবে দেখা হত। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে জানা যায়, সমকালীন সমাজে সেজন্যে শাস্তির বিধান ছিল।
পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার জন্যে চীনের স্বাস্থ্য দপ্তরের প্রচারপত্র। -- ওয়েলকাম কালেকশন।
কিন্তু শিল্প বিপ্লব ও প্রযুক্তির প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক যুগে আমরা বৈদিক দর্শনের মাহাত্ম্য ও উপযোগিতার কথা বিস্মৃত হয়েছি। মৃত্যুর কিছুদিন আগে ব্রিটিশ দার্শনিক ও ঔপন্যাসিক অলডাস হাক্সলি প্রকৃতির বিরুদ্ধে মানুষের ধ্বংসাত্মক আচরণ এবং তার ভয়ানক পরিণতির ব্যাপারে গভীর আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। সেই প্রসঙ্গটি তুলে ধরে বিশিষ্ট মার্কিন ঐতিহাসিক লিন হোয়াইট জুনিয়র ১৯৬৭ সালে 'সায়েন্স' পত্রিকায় প্রকাশিত " দ্য হিস্টরিক্যাল রুটস অব আওয়ার ইকোলজিক্যাল ক্রাইসিস" শীর্ষক প্রবন্ধ লেখেন। তাতে গোটা পাশ্চাত্য দুনিয়ায় তোলপাড় শুরু হয়। কারণ, প্রযুক্তির সর্বগ্রাসী প্রভাবের বিরোধিতা করে তিনি স্পষ্ট লিখেছিলেন, পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের সঙ্কট নিরসন করতে হলে অবশ্যই বদলাতে হবে সেই দৃষ্টিভঙ্গি যার মূল কথাই হল, মানুষের সেবায় ব্যবহৃত হওয়া ছাড়া প্রকৃতির অস্তিত্ব অর্থহীন।
চাহিদা ও যোগানের গুরুতর প্রশ্ন। স্প্যানিশ ফ্লুর সময় সাবানের বাড়তি চাহিদা মেটাতে আফ্রিকা ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপে নতুন কারখানা থেকে সানলাইট সাবানের যোগান। -- গার্ডিয়ান পোস্ট।
বহু যুগ আগে হাক্সলি বা হোয়াইট যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন আজ এই করোনা মহামারীর সময়েও বিশেষজ্ঞরা তারই প্রতিধ্বনি করছেন। গত ১৮ মার্চ 'সায়েন্টিফিক আমেরিকান' পত্রিকায় প্রকাশিত নিবন্ধে "স্পিলওভার: অ্যানিমাল ইনফেকশনস অ্যান্ড দ্য নেক্সট প্যান্ডেমিক" বইয়ের লেখক ডেভিড কোয়াম্মেনের বক্তব্যটি খুব প্রাসঙ্গিক -- “We invade tropical forests and other wild landscapes, which harbour so many species of animals and plants — and within those creatures, so many unknown viruses. We cut the trees; we kill the animals or cage them and send them to markets. We disrupt ecosystems, and we shake viruses loose from their natural hosts. When that happens, they need a new host. Often, we are it.” এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিদ্যা বিভাগের ডিজিজ ইকোলোজিস্ট টমাস গিলেসপির মন্তব্যও খুব গুরুত্বপূর্ণ এই নিরিখেই -- প্যাথোজেন বা রোগ-জীবাণু জৈব প্রজাতির কোন সীমারেখা মানে না। অর্থাৎ প্রাকৃতিক পরিবেশ দূষিত হলে, জীবজন্তু বা গাছপালার স্বাভাবিক আবাসভূমি ধ্বংস হলে প্রকৃতির রোষে মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হবে। মহামারীর কোপে পড়ে সৃষ্টির পিছনে দৈব মহিমা আজ উপলব্ধি করতে পারছে পাশ্চাত্য সমাজও। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক ও সাড়া জাগানো বই, "এপিডেমিকস অ্যান্ড সোসাইটি"র লেখক ফ্র্যাঙ্ক স্নোডেন তাঁর সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, "এই মহামারী সমাজের সামনে একটি আয়না ধরেছে। জীবনের উদ্দেশ্য কী? ঈশ্বরের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কী? সর্বশক্তিমান ঈশ্বর যদি থাকবেনই তাহলে দুনিয়া জুড়ে এই মৃত্যলীলার কারণ কী? এসব প্রশ্নের উত্তর আমাদের খুঁজতে হবে। জনবিস্ফোরণে কাহিল বিশ্বে আজ মানুষের সীমাহীন লোভ। প্রতিনিয়ত ধ্বংস হচ্ছে প্রকৃতি। কাজেই তার মাসুল দিতে হচ্ছে সকলকে।"
টাইফয়েড মেরি। হাত না ধুয়েই রান্না। -- ২০ জুন, ১৯০৯ 'দ্য নিউ ইয়র্ক আমেরিকান'-এ প্রকাশিত পোস্টার।
বিশ্বায়নের যুগে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সোপান হিসাবে গাছ-পালা, বন-জঙ্গল সাফ করে গড়ে তোলা হচ্ছে মহাসড়ক, অত্যাধুনিক বিমানবন্দর, বেসরকারি পুঁজি টানতে প্রত্যন্ত পাহাড়ি অঞ্চল বা বিস্তীর্ণ বনভূমি তার চরিত্র হারাচ্ছে শিল্প স্থাপন বা খনিজ পদার্থ তোলার জন্যে। আপন বেগে প্রবাহিত নদীর গতিপথ রোধ করে গড়ে তোলা হচ্ছে কংক্রিটের অতিকায় বাঁধ। আর এভাবেই ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। প্রকৃতি ও আধুনিকতার সংঘাতের কুফল আজ হয়ত মানুষ কিছুটা হলেও বুঝতে পারছে। তাই কান পাতলে শোনা যাচ্ছে কিছু আত্মসমীক্ষা। মহাসঙ্কট থেকে পরিত্রাণের হদিস দিতে কোন কোন বিবেকবান মানুষের কণ্ঠস্বরে ফুটে উঠছে সতর্কবার্তা -- বেলাগাম ছুট অনেক হয়েছে। এবার একটু ধীরে চল -- 'স্লো ডাউন'। প্রশ্ন হল, দুনিয়া কি শিক্ষা নেবে?
পাঁচ হাজার বছর আগে ঋকবেদের ঋষিরা বনের অধিষ্ঠাত্রী দেবী 'অরণ্যানী'র বন্দনা করেছেন। যিনি একদিকে মায়ের মতো স্নেহশীলা আবার অন্যদিকে সংহারকর্ত্রী। মানুষ তার জীবনধারণের রসদ আহরণ করে চলেছে মমতাময়ী প্রকৃতির কাছ থেকে কিন্তু সেই অরণ্য বা তার আশ্রিত জীবজন্তুদের ওপর যদি আঘাত হানা হয়, বাস্তুতন্ত্র যদি বিনষ্ট হয় তাহলে প্রকৃতিও তার প্রতিশোধ নেবেই। ঋকবেদের দশম মন্ডলের ১৪৬ অধ্যায়ের ৩-৬ সূক্তে এই সতর্কতা উচ্চারিত হয়েছে। আর বেদের সেই সাবধানবাণীর সত্যতা আমরা এ যুগে দেখতে পাই মার্কিন বিজ্ঞান পত্রিকা 'নেচার'-এ ২০০৮ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে। ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডনের (ইউ সি এল) ইকোলজি ও বায়োডাইভার্সিটি বিভাগের প্রধান অধ্যাপিকা কেট জোনস সেখানে ১৯৪০ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়া ৩৩৫টি সংক্রামক রোগের উৎস বিশ্লেষণ করে অভিমত প্রকাশ করেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রকৃতির ধ্বংসই বয়ে এনেছে মহামারী। যে রোগগুলিকে তিনি শ্লেষাত্মক ভাবে ‘hidden cost of human economic development’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। প্রকৃতির সংহার প্রসঙ্গেই মনে পড়ে যাচ্ছে নোবেলজয়ী, পরিবেশপ্রেমী প্রাক্তন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যাল গোরের মন্তব্য, “couldn't you hear what Mother Nature was screaming at you?"
সংস্কৃত সাহিত্যে পরিবেশের যে পরিচ্ছন্নতা মেনে চলার কথা বলা হয়েছে, বিবেকানন্দ যে ভাবধারার কথা লিখেছেন, সেই একই আদর্শের গভীর অনুসারী ছিলেন মহাত্মা গান্ধী। ব্যক্তিগত শুচিতা অবলম্বনকে যিনি আধ্যাত্মিকতার পর্যায়ে উন্নীত করেছিলেন। পাশ্চাত্য ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলতে পেরেছিলেন, শৌচাগারও হতে হবে বৈঠকখানার মতো পরিষ্কার। দক্ষিণ আফ্রিকায় তিন বছর কাটিয়ে পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে যাবার জন্যে যখন দেশে ফিরলেন তখন রাজকোটেও দেখা দিয়েছে প্লেগ। চারপাশে অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ। সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজেই নেমে পড়লেন সাফাইয়ের কাজে। সুস্থ সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে তিনি মনে করতেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রয়োজনীয়তা স্বাধীনতা অর্জনের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। ক্রমে তাই গান্ধীবাদী জীবন দর্শনের অন্যতম মূল বাণীই হয়ে উঠেছিল, “Cleanliness is next to Godliness.” গান্ধীজির বিশ্বাস ছিল, রোগ উপশমের চেয়ে ঢের বেশি জরুরি রোগ প্রতিরোধ করা। আর সেই কারণেই দেহ, মন ও প্রতিবেশকে শুদ্ধ ও পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
"সানলাইট স্ট্রিট ইজ দ্য গ্রেট হাইওয়ে অব হেলথ --
ইট ইজ এ থরোফেয়ার অব থরো ক্লিনলিনেস।"
অস্বীকার করার উপায় নেই, পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবে আমরা যেমন সমৃদ্ধ হলাম, তেমনই পাশ্চাত্যের অনুকরণ করতে গিয়ে আধুনিকতার নামে আমরা সনাতন শুচিতার বোধ থেকে সরে এলাম। যে কারণে দিনে একাধিকবার স্নান করা, নিয়ম করে হাত-পা ধোয়া, বারবার জামাকাপড় বদলানোর মতো সু-অভ্যাসকে আমরা শুচিবায়ুর তকমা লাগিয়ে ব্রাত্য করে দিলাম। সেই কারণেই আজ মহামারী ঠেকাতে সাবান-স্যানিটাইজারের এই দুনিয়া-জোড়া বাণিজ্য-চক্র রাতারাতি গ্রাস করে ফেলেছে আমাদের। করোনা-আতঙ্কে ঘরে-ঘরে এখন সাবান, স্যানিটাইজার আর জীবাণুনাশক কেনার হুড়োহুড়ি চলছে গত পাঁচ মাস ধরে। প্রত্যেকের সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে উঠেছে স্যানিটাইজার। ক্রমেই বেড়ে চলা চাহিদার সঙ্গে যোগানের তাল না মেলায় দোকানে-বাজারে মাঝে-মধ্যেই সেগুলি অমিল। বিপুল মুনাফার সম্ভাবনায় মওকা বুঝে নামি-অনামি বহু দেশি-বিদেশি সংস্থা রাতারাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছে এই ব্যবসায়। লকডাউন, কোয়ারেন্টাইনের জেরে জীবন জীবিকার যখন দফারফা, অর্থনীতির হাল যখন সঙ্গীন, একের পর এক ব্যবসা যখন মুখ থুবড়ে পড়ছে তখন চমকপ্রদ ভাবে ফুলে ফেঁপে উঠছে সাবান, স্যানিটাইজার আর জীবাণুনাশকের ব্যবসা। 'জেল', 'ফোম', 'স্প্রে', 'ওয়াইপস' -- ক্রেতার চাহিদা পূরণে নানা রূপে বাজারে আবির্ভুত হচ্ছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার।
গায়ের গন্ধের জন্যে যদি একঘরে হতে না চান।
আন্তর্জাতিক বিপণন সমীক্ষক গ্র্যান্ডভিউ রিসার্চের সাম্প্রতিক হিসেবে দেখা যাচ্ছে, ২০১৯ সালে সারা বিশ্বে এই স্যানিটাইজার বিক্রির মোট পরিমাণ ছিল ২৭০ কোটি মার্কিন ডলার। ২০২০ থেকে ২০২৭ সাল পর্যন্ত এর বাজার বার্ষিক ২২.৬ শতাংশ হারে বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। করোনার প্রকোপে শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই গত মার্চ থেকে জুলাইয়ের মধ্যে স্যানিটাইজার বিক্রি হয়েছে ২০ কোটি ডলার মূল্যের। আগের বছরের তুলনায় যার বৃদ্ধি ৪৬৫ শতাংশ। চলতি বছরের নভেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ভোট কর্মী ও ভোটদাতাদের সুরক্ষা সুনিশ্চিত করতে মার্কিন কংগ্রেস ইতিমধ্যে ইলেকশন অ্যাসিস্ট্যান্স কমিশনকে ৪০ কোটি ডলার বরাদ্দ করেছে স্যানিটাইজার, মাস্ক ইত্যাদি কেনার জন্যে। আর একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা টেকন্যাভিও নজর রেখে চলেছে ভারতের বাজারের দিকে। তাদের সমীক্ষায় স্পষ্টই বলা হচ্ছে, মহামারীর কল্যাণে আগামী চার বছরে অর্থাৎ ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে হ্যান্ড স্যানিটাইজারের ব্যবসা তুঙ্গে উঠবে যার বৃদ্ধির পরিমাণ হবে ৪১ কোটি মার্কিন ডলারের কাছাকাছি। স্বভাবতই ভারতের বাজার ধরার জন্যে পাল্লা দিচ্ছে থ্রি এম, ডাবর, ইমামি, গোদরেজ কনজিউমার প্রোডাকটস, গোজো ইন্ডাস্ট্রিজ ইনকরপোরেটেড, আই টি সি, ম্যারিকো, রেকিট বেনকাইজার, হিমালয়া ড্রাগ ও ইউনিলিভার গ্রূপের মতো একঝাঁক ডাকসাইটে সংস্থা। নিয়েলসেনের সমীক্ষা বলছে, বিভিন্ন শ্রেণীর ফাস্ট-মুভিং কনজিউমার গুডস (এফ এম সি জি)-এর মধ্যে ভারতে সেরার সেরা হয়ে উঠেছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার -- ২০১৯ সালের নভেম্বর থেকে ২০২০ সালের জানুয়ারির মধ্যে যার বাজার ছিল মাত্র ১১ শতাংশ পরমুহূর্তেই তা রাতারাতি ৫৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যবসা বৃদ্ধির আকর্ষণীয় হাতছানিতে আই টি সি হিমাচল প্রদেশে তাদের সদ্য স্থাপন করা পারফিউম প্ল্যান্টটিকে দ্রুত কৌশল বদলে পরিণত করে দিয়েছে 'স্যাভলন-হেক্সা' ব্র্যান্ডের স্যানিটাইজার উৎপাদন কেন্দ্রে। শ্যাম্পুর স্যাশে প্রথম চালু করেছিল যারা সেই কেভিনকেয়ার 'শিক' ব্র্যান্ডে স্যাশেতে ভরা স্যানিটাইজার এনেছে পথ চলতি মানুষের ব্যবহারের সুবিধার কথা ভেবে। শুধু তাই নয়, পেরনড-রিকার্ড, ডিয়াগিও ও বাকার্ডির মতো মদের (অ্যালকোবেভ) কারবারে যুক্ত নামি সংস্থাও এখন স্যানিটাইজার ব্যবসায় নেমে পড়েছে। বাকার্ডি ঘোষণা করেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে তারা ২ লক্ষ ৬৭ হাজার গ্যালনেরও বেশি হ্যান্ড স্যানিটাইজার সরবরাহ করবে। 'জনি ওয়াকার' ও 'স্মারনফ' প্রস্তুতকারক ডিয়াগিও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ভারত সহ বিভিন্ন দেশে চাহিদা অনুযায়ী ৮০ লক্ষ বোতলেরও বেশি স্যানিটাইজার উৎপাদনের জন্যে তারা ২০ লক্ষ লিটার অ্যালকোহল দান করবে। বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার উপযুক্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং ভ্যাকসিন না থাকায় স্যানিটাইজারের চাহিদা বেড়েই চলেছে কারণ সংক্রমণ ঠেকাতে হাতের স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখা প্রতিটি মানুষের কাছে এখন বিরাট গুরুত্বপূর্ণ। তবে সুযোগ বুঝে মুনাফা লুঠতে তৎপর অসাধু ব্যবসায়ীরাও। স্যানিটাইজারে তারা মিশিয়ে দিচ্ছে মিথানলের ভেজাল। যে সব নেশাড়ু আগে মদের পাশাপাশি কাফ সিরাপ, হোয়াইটেনার এবং ওই ধরনের জিনিস ব্যবহার করত, তারাও এখন অনেকে অ্যালকোহলের টানে স্যানিটাইজার খেতে শুরু করেছে। আর তাতেই বিপত্তি। অন্ধ্রপ্রদেশে ইতিমধ্যেই মৃত্যু হয়েছে ১৮ জনের। কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গে এখনও স্যানিটাইজার পানে মৃত্যুর খবর না মিললেও ১৪০০ লিটার ভেজাল স্যানিটাইজার বাজেয়াপ্ত হয়েছে। আমেরিকার অ্যারিজোনা ও নিউ মেক্সিকোতে গত মে ও জুন মাসে এভাবে ১৫ জনের শরীরে বিষক্রিয়া হয়েছে। মারা গেছে চার জন। ইউ এস ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ইউ এস এফ ডি এ) ইতিমধ্যে ৭৫ টি ব্র্যান্ডের স্যানিটাইজার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।
দুপুর একটাও বাজেনি। কিন্তু কত সহজেই কাচা হয়ে গেল সব জামাকাপড়। বিশ্বে সর্বাধিক বিক্রিত সানলাইট সাবানের বিজ্ঞাপন। -- দ্য ইলাস্ট্রেটেড লন্ডন নিউজ
ভেবে বসবেন না এ হেন স্যানিটাইজার হাল আমলের আমদানি। খ্রিষ্টপূর্ব ২৮০০ সালে ব্যাবিলনের অধিবাসীরা প্রথম সাবানের প্রচলন করলেও ঐতিহাসিক নথিপত্র বলছে, স্যানিটাইজারের ব্যবহার শুরু হয় ঊনবিংশ শতকের একেবারে শেষের দিকে অ্যান্টিসেপটিক হিসেবে। কেউ কেউ আবার দাবি করেন, ক্যালিফর্নিয়ার নার্সিং ছাত্রী লিউপ হার্নান্ডেজ ১৯৬৬ সালে স্যানিটাইজার উদ্ভাবন করেছিলেন। রোগীদের পরীক্ষার আগে প্রতিবার সাবান ও জল দিয়ে হাত ধোবার মতো সময় না থাকায় হার্নান্ডেজ ডাক্তারদের ব্যবহারের জন্যে অ্যালকোহল ও জেল মিশিয়ে ওই স্যানিটাইজার বানিয়ে দিয়েছিলেন। তবে সেই ছাত্রীটির নামে কোন পেটেন্ট পাওয়া যায় নি। প্রায় একই সময়ে জার্মান সংস্থা হার্টম্যান বিশ্বে প্রথম বিক্রয়যোগ্য অ্যালকোহল-ভিত্তিক স্যানিটাইজার নিয়ে আসে 'স্টেরিলিয়াম' ব্র্যান্ড নামে। আবার আর এক আকর্ষণীয় কাহিনী রয়েছে ওহায়োর মার্কিন দম্পতি গোল্ডি ও জেরি লিপম্যানকে ঘিরে। ১৯৪৬ সালে তখন চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। গোল্ডি কাজ করতেন মিলার টায়ার কোম্পানিতে আর জেরি গুডইয়ার এয়ারক্রাফট প্ল্যান্টে। দিনের শেষে দুজনে যখন ঘরে ফিরতেন তখন তাঁদের হাতে এবং জামা-কাপড়ে চিটচিটে কালিঝুলি। রাবার কারখানার শ্রমিকেরা এইসব কালি ওঠানোর জন্যে বেনজিন ও অন্যান্য ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার করতেন। গোল্ডি আর জেরি তখন কেন্ট স্টেট ইউনিভার্সিটির রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ক্ল্যারেন্স কুকের সহায়তায় হাত পরিষ্কার করার জন্যে উন্নত ধরণের এক তরল পদার্থ উদ্ভাবন করেন এবং নিজেদের নামের আদ্যাক্ষরের সঙ্গে মিলিয়ে নাম দেন গোজো। সেটি এমনই জনপ্রিয় হয়ে উঠল যে যুদ্ধ থামার পর দুজনে চাকরি ছেড়ে গোজো ইন্ডাস্ট্রিজ প্রতিষ্ঠা করলেন। এরপর ১৯৯৭ সালে তাঁদের তৈরি পিউরেল ব্র্যান্ডের স্যানিটাইজার আন্তর্জাতিক বাজারে পরিচিতি পেল।
প্রকৃতি ধ্বংসের বিরুদ্ধে জনমত গড়তে সাড়া জাগানো বই।
স্বাস্থ্যবিধি ও জীবাণু-প্রতিরোধের প্রসঙ্গ উঠলে অবশ্যই উল্লেখ করতে হয় ব্রিটিশ নার্স ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের কথা। ১৮৫৩ সালে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ শুরু হলে আরও ৪০ জন প্রশিক্ষিত নার্সকে সঙ্গে নিয়ে আহত সৈনিকদের শুশ্রূষা করার সময় তিনি লক্ষ্য করলেন, প্রায় চার হাজার নিহত সেনার মধ্যে মাত্র দশ শতাংশের মৃত্যু হয়েছে যুদ্ধক্ষেত্রে জখম হওয়ায়। কিন্তু বাকি সকলে মারা গেলেন বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ থেকে। পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে তিনি ডাক্তার ও নার্সদের মধ্যে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া সহ দশ দফা স্বাস্থ্যবিধি চালু করেন। তাঁর সেই উদ্যোগ পরিণত হল বৈপ্লবিক স্বাস্থ্য আন্দোলনে। দেখা গেল, প্রায় তিন বছর ধরে চলা যুদ্ধের সময় এই নিয়মগুলি সকলে মেনে চলায় সৈনিকদের মৃত্যর হার ৪২ শতাংশ থেকে কমে মাত্র দুই শতাংশে নেমে এসেছে। যুদ্ধক্ষেত্রে ফ্লোরেন্সের অসামান্য অবদানের কাহিনী অবিস্মরণীয় হয়ে রয়েছে মার্কিন কবি হেনরি ওয়াডসোয়ার্থ লংফেলো রচিত 'সান্টা ফিলোমেনা' কবিতায় যেখানে তিনি লিখলেন -- Lo! in that house of misery / A lady with a lamp I see / Pass through the glimmering of gloom / And flit from room to room. আর ফ্লোরেন্স বরাবরের জন্যে কিংবদন্তিতে পরিণত হলেন, The “lady with a lamp” নামেই।
যে বই লিখে সম্প্রতি মহামারী নিয়ে অনেক দার্শনিক প্রশ্ন উস্কে দিয়েছেন মার্কিন ঐতিহাসিক স্নোডেন।
১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লু মহামারীর সময় হাত ধোয়া ও সাবান ব্যবহারের অভ্যাসকে জনপ্রিয় করে তুলতে বিলেত আমেরিকার সংবাদপত্রে নানান আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপনের দেখা মেলে। সুস্থতা বজায় রাখতে ও প্রাণ বাঁচাতে রোগ জীবাণুর বিরুদ্ধে তখনই প্রথম সাবানকে হাতিয়ার করার কথা ফলাও করে প্রচারিত হয়েছিল। সেই বিজ্ঞাপনগুলির ছবি ও বক্তব্যের সঙ্গে এখনকার করোনা পরিস্থিতির প্রচুর মিল রয়েছে। লাইফবয় সাবানের একটা বিজ্ঞাপনের শিরোনাম ছিল, "ভিড় থেকেই সংক্রমণ ছড়ায়।" তাতে বলা হয়েছিল, "জানেন কি, এই ভিড়ের মধ্যে কতজন ‘টাইফয়েড মেরি’ আছে?" ঘটনা হল, জন্মসূত্রে আইরিশ, মেরি ছোটবেলাতেই চলে এসেছিল আমেরিকায়। থাকত কাকা-কাকিমার সঙ্গে। জন্মের সময় থেকেই তার শরীরে টাইফয়েড রোগ বাসা বেঁধেছিল। কিন্তু তার রোগ লক্ষণ প্রকাশ পায় নি। অসুস্থও হয়নি সে। বিভিন্ন ধনী মার্কিন পরিবারে সে রান্নার কাজ করত। আর কাজ নেওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই সেসব বাড়িতে টাইফয়েড দেখা দিত। মারাও যেত কেউ কেউ। কিন্তু রোগের কারণ খুঁজে পাওয়া যেত না। অবশেষে এক স্যানিটেশন ইঞ্জিনিয়ারের রীতিমতো গোয়েন্দা তদন্তে ধরা পড়ে নিজের অজান্তেই মেরি ছিল টাইফয়েডের বাহক। শোনা যায়, মেরির মাধ্যমে নানা সময়ে মোট ৫৩ জন সংক্রমিত হয়েছিল। জেরায় সে জানিয়েছিল, রান্না করার সময় তার হাত ধোয়ার বালাই ছিল না। বাকি জীবনটা কার্যত তার কোয়ারেন্টাইনেই কেটে যায়। ওই বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে লোকের মনে সংক্রমণের ভয় ঢুকিয়ে সাবান দিয়ে হাত ধোয়াকে অভ্যাসে পরিণত করে তুলতে চেয়েছে লাইফবয়।
তখন সাবানের ব্যবসায় দুনিয়াজোড়া প্রতিপত্তি ছিল লিভার ব্রাদার গোষ্ঠীর। লাইফবয়, সানলাইট সবই তাদের উৎপাদন ছিল। স্কুলের একরাশ ছেলেমেয়ের সঙ্গে বাড়ির গেটে দাঁড়ানো প্রতীক্ষারত মায়ের ছবি দিয়ে আর একটি বিজ্ঞাপন ছিল, হাসি-খুশি স্বাস্থ্যোজ্জ্বল বাচ্চারাই তো আসলে সূর্যের আলো! এ রকম আরও অনেক বিজ্ঞাপন ছিল যেগুলির জন্যে সাবানের বিক্রি হু হু করে বেড়ে যায়। বাড়তি সাবানের যোগান দিতে সংস্থাটিকে আফ্রিকার পশ্চিম উপকূলে ও প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপে বিস্তীর্ণ এলাকায় জমি কিনে যন্ত্রপাতি বসিয়ে নতুন কারখানা গড়তে হল। সেই সাবান সরবরাহ করার জন্যে নতুন জাহাজও কিনতে হয়েছিল। সানলাইটের বিজ্ঞাপনে প্রচারিত হয়েছে সেকথাও।
লাইফবয় শুধু সাবান নয়, জীবাণুনাশকও বটে। স্প্যানিশ ফ্লুর সময় সাবানের বিজ্ঞাপন।
এখন আর কাউকে ঠিক এ ভাষায় সাবান-স্যানিটাইজারের উপযোগিতা বোঝানোর দরকার হয়না। করোনার দাপটে এগুলির চাহিদা তুঙ্গে। কিন্তু প্রশ্ন হল, আতঙ্কিত হয়ে ঘন ঘন এগুলির যথেচ্ছ ব্যবহার সত্যিই কতটা উপযোগী? করোনা রুখতে চারপাশে আদ্যশক্তিদেবীর মতো শুচিবায়ুর বাড়াবাড়ি দেখতে দেখতে অনেক সময় মনে হয়, আমাদের সহজাত প্রতিরোধ ক্ষমতার কিছু কি আর অবশিষ্ট আছে? পরিচ্ছন্নতা নিয়ে এত বাতিক যে ভালো নয় তা বোঝা যাচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) এবং জনস হপকিনস ইউনিভারসিটির সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য থেকে। তাতে বলা হচ্ছে, যাঁদের বসবাস ততটা স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে নয়, তাঁদের মধ্যে কিন্তু কিছু কিছু রোগের তীব্রতা তুলনামূলকভাবে কম। চন্ডীগড়ের পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউট অব মেডিকেল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের ইমিউনোলজির অধ্যাপক সুনীল অরোরা বলেছেন, "ছোঁয়াচে রোগ এড়াতে অল্পদিন দিন ধরে নিয়মিত হাত ধুলে ক্ষতি নেই। কিন্তু এটা যদি পাকাপাকি ভাবে আমাদের মজ্জায় ঢুকে যায় তাহলে আরও অনেক নতুন সংক্রমণে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যাবে।" ছোটবেলায় গ্রামেগঞ্জে থাকার সময় তো দেখেইছি, ছেলেপুলে পথের পাশে দিব্যি বসে ধুলোবালি ঘাঁটছে, কই গ্রামের মানুষকে তো এমন কথায় কথায় কঠিন রোগে ধরে নি। তাঁদের নিজস্ব প্রতিরোধ ক্ষমতা কিন্তু অনেক বেশি। করোনা নিয়ে এই সর্বগ্রাসী আতঙ্ককে কি আমরা এতটাই প্রশ্রয় দিয়ে চলব?