প্রথম জ্ঞানোন্মেষণ হয়েছিল ক্লাস সিক্সে। বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ে সেবার একটা নাটকের দলে জায়গা পেয়েছিলাম। অনুষ্ঠানের দিন নাটকের সব মেয়েচরিত্ররা বাড়ি থেকে আলতা পরে হাজির। আমি বাদে। আগের দিন এনিয়ে ভারপ্রাপ্ত শিক্ষিকা কিসব নির্দেশ দিয়েছিলেন। এদিকে আমার বাড়িতে বড় হওয়ার পরে আমি আলতা পরার খুব তেমন একটা চল দেখি নি। ফলে আমার মাথা থেকে পুরো ব্যাপারটা বেরিয়ে গিয়েছিল। এদিকে এই অপরাধে সেদিন বছর তিনেকের এক সিনিয়র ছাত্রীর চোখ কপালে তুলে আর্তনাদ! “সধবার রোলে নাটক করবি আর আলতা পরিস নি! তোর বাড়ীতে মা জ্যেঠিরা আলতা পরে না? এ আবার কেমনধারা বাড়ী!”
ভবভূতির উত্তররামচরিতে সীতা ও তার সখীরা কেন আলতা পরবে, অযোধ্যা বা মিথিলার মেয়েদের আলতা পরাটা মাস্ট কিনা সেটা নিয়ে একটু তর্ক করেছিলাম। তবু ওই দিদির মুখের 'কেমনধারা বাড়ী' কথাটা সেদিন খুব মনে গেঁথে গিয়েছিল। সধবা হলেই আলতা পড়তে হবে? এটাই নাকি নিয়ম? ‘সমাজের নিয়ম’ ?
পরে আস্তে আস্তে পিতৃতান্ত্রিকতা শব্দটার সঙ্গে পরিচয় হল। বুঝলাম, রবি ঠাকুর থেকে শুরু করে কবি সাহিত্যিকরা যতই মিলনের রোম্যান্টিকতার ছবি আঁকুন না কেন, বিয়ে নামক মিলনের সমাজ-স্বীকৃত পথটি আদতে পিতৃতন্ত্রের মেয়েদের তাঁবে নিয়ে আসার অন্যতম রাস্তা। আর সেই বিয়েতে পাওয়া সম্পত্তিটিকে চিহ্নিত করে দেওয়ার ইচ্ছে থেকেই আদতে শাঁখা-সিঁদুরের জন্ম। এই বোঝার ঢেউ এসেছিল আমাদের আগের প্রজন্মেই, আমাদের প্রজন্মে বোঝাটা একটু বেশি জোরদার হল। অনেকেই বর্জন করলেন বিবাহের চিহ্ন। অনেকে নিলেন মধ্য পন্থা – কিছু বর্জন, কিছু রেখে দেওয়া, নিজের ইচ্ছা মত। একের দেখাদেখি আরও অনেকে। অনেকক্ষেত্রে ছেলেরাও মেয়েদের পাশে এসে দাঁড়ালেন। ক্রিটিক্যাল মাস জোগাড় হয়ে গেল – তারপর আর চাপিয়ে রাখা গেল না। নেট ফলশ্রুতি আজকের শহরাঞ্চলে, হিন্দু বিবাহিত মেয়েদের রোজকার জীবনে, বিশেষতঃ মধ্যবিত্ত বাড়িতে, শাঁখা-পলা দেখা যায় খুবই কম, সিঁদুর প্রায় অদৃশ্য – চুলের আড়ালে একটু ছোঁয়া থাকে বা থাকে না। আলতা অবসোলিট হয়ে গিয়েছিল প্রথম ধাক্কাতেই। তবে লোহাটা হাতে থাকে বেশির ভাগ সময়েই। সুন্দর কারুকার্য করা, সোনায় মোড়া। অলঙ্কারকে অলঙ্কার, স্বামীর সৌভাগ্য ধারণও বটে কখনো সখনো – বহু প্রজন্মলালিত সংস্কার কি অত সহজে ছাড়া যায়?
বিভিন্ন স্ট্রাকচারাল অসাম্যের কারণে এই ঢেউটা কিন্তু শহর ছাড়িয়ে খুব একটা ছড়িয়ে পড়তে পারল না। গ্রামের দিকে, এমনকি শহুরে নিম্নবিত্ত পরিবেশেও ব্যাপারটা আগের মতই রয়ে গেল। সেখানে জ্বলজ্বলে সিঁদুর চিহ্ন এখনো মাস্ট। সিঁথির সিঁদুরের রেখার দৈর্ঘ্য প্রস্থ মেপে বলে দেওয়া যায় কতদিন বিয়ে হয়েছে। হাতেও শাঁখা পলা নোয়া সবই থাকে। আগে বরং সমস্যা ছিল, ঘরের কাজে শাঁখা ‘বেড়ে’ যেত মাঝে মাঝেই – সব জায়গায় তো পাওয়া যেত না ভালো শাঁখা। নতুন জোড়া পরতে তাই দেরী হত। এখন প্ল্যাস্টিকের শাঁখা পলা এসে গিয়ে আর সে সমস্যা নেই। ‘এয়োতি চিহ্ন’ আজও সৌভাগ্যের চিহ্ন, মেয়েরা সগৌরবে ধারণ করে। এমনকি স্বামী পরিত্যাগ করলেও, সে চিহ্ন ধারণের থেকে রেহাই মেলে না। এটাই সেখানকার ‘সমাজের নিয়ম’।
এদিকে আমাদের বিয়ের সিস্টেমটাও বেশ গোলমেলে। এখানে ধর্মনিরপেক্ষ স্পেশ্যাল ম্যারেজ আক্টের পাশাপাশি বিরাজ করে ধর্মভিত্তিক বিয়ের কানুন। বেশির ভাগ হিন্দুরই এখনো বিয়ে হয় ধর্ম মেনে। হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্ট অনুযায়ী। সেখানে বিয়ের রীতিকানুন নিয়ে কি বলছে?
Ceremonies for a Hindu marriage.-(1) A Hindu marriage may be solemnized in accordance with the customary rites and ceremonies of either party thereto. (2) Where such rites and ceremonies include the saptapadi (that is, the taking of seven steps by the bridegroom and the bride jointly before the sacred fire), the marriage becomes complete and binding when the seventh step is taken.
‘কাস্টমারি রাইটস এন্ড সেরিমনিজ অফ আইদার পার্টি’ কথাটাকে আমি বোল্ড করলাম, কারণ কথাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ধর্ম মেনে হওয়া বিয়ে নিয়ে যখন কোন দ্বন্দ্ব বাঁধে, তখন বিয়ে ভ্যালিড কিনা তা প্রমাণ করতে মূল প্রশ্ন হয় বিয়ের সাক্ষী কোথায়, সব আচার মেনে বিয়ে হয়েছিল কিনা ইত্যাদি। আর পূর্বভারতের বাঙালী হিন্দুর বিয়ে কি সিঁদুর দান ছাড়া হয়? হয় না বলেই জানি। অবশ্য বিয়েতে সিঁদুরদান করা হয় বলেই, সেটা বিয়ের পরেও পরতেই হবে এমন কথা আইনে বলা নেই। তবে সমাজের কথা মানতে হলে, সেটাই নিয়ম। অন্ততঃ সংখ্যাগুরুর জন্য।
এই সামাজিক প্রেক্ষিতে এবার আসামের সদ্য ঘটে যাওয়া ঘটনাটা দেখা যাক। একটি ডিভোর্সের মামলা। ডিগবয়ের ভাস্কর দাসের সঙ্গে রেণু দাসের বিয়ে হয় ২০১২ সালে হিন্দু নিয়ম মেনে। বিয়ের অল্পপর থেকেই তিনি স্বামীকে নিয়ে আলাদা সংসারের দাবী জানাতে থাকেন। কিছুদিন আলাদা থাকলেও তাঁরা আবার ভাস্করের বাড়ীতে ফিরে আসেন। বিয়ের বছর দেড়েকের মাথায়, রেণু বাপের বাড়ী চলে যান। স্বামী ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে ৪৯৮(এ) ধারায় নালিশ করেন। এই খানে রেণুর দাবী, সেই কেস তুলে নেওয়ার জন্য ভাস্কর তাঁর সঙ্গে ডিল করেন যে তিনি বাড়ী ভাড়া করে আলাদা রেণুকে নিয়ে থাকবেন আর বাড়ির লোকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন না। কিন্তু যেই কেস তুলে নেওয়া হয়, অমনি ভাস্কর চুক্তি-টুক্তি ভুলে যান, রেণুকেও আর ফেরত নেন না। এরপর ২০১৪ সালে ভাস্কর ডিভোর্স চাইলে, রেণু তাতে রাজী হন না। ডিব্রুগড় ডিসট্রিক্ট জাজের কোর্ট ডিভোর্সের আবেদন খারিজ করেন। ভাস্কর আবার হাইকোর্টে মামলা করলে গত ১৯ শে জুন গুয়াহাটি হাইকোর্ট নিষ্ঠুরতার ভিত্তিতে ডিভোর্সের পক্ষে রায় দেয়। রেণুর অ্যালিমনির ব্যবস্থাও করে। এই পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। গোল বাধালো রায়ের কিছু অংশ।
বিচারক সৌমিত্র শইকিয়া বললেন যে “Under the custom of Hindu Marriage, a lady who has entered into marriage according to Hindu rituals and customs, and which has not been denied by the respondent in her evidence, her refusal to wear ‘sakha and sindoor’ will project her to be unmarried and/or signify her refusal to accept the marriage with the appellant.”
সেই রায় পড়ে কেউ বললেন “স্ত্রী শাঁখা-সিঁদুর পরতে অস্বীকার করায় স্বামীকে বিবাহবিচ্ছেদের অনুমতি দিল আদালত!” (NDTV) আবার কেউ বললেন “হিন্দু এয়োস্ত্রী মানেই যে সিঁথিতে সীমান্তরাগ, হাতে শাঁখা, পলা, লোহা— সেই ধারণাতেই আইনি সিলমোহর দিলেন গৌহাটি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি অজয় লাম্বা ও বিচারপতি সৌমিত্র শইকিয়া।“ (আনন্দবাজার) কেউ আবার এই সুযোগে কেন বিবাহিত মহিলারা শাঁখা সিঁদুর পরেন সেই নিয়ে নতুন করে থিওরী নামাতে শুরু করলেন।
পুরো রায়টা পড়লে কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক এরকম ঠেকে না। রায়ে উল্লেখ করা আছে যে মামলায় রেণু নিজে বলেছেন যে সে ওই স্বামীকে স্বামী বলে মানে না বলেই শাঁখা সিঁদুর পরে না। “That I am not wearing/putting sindoor right now because I don’t consider him as my husband.” তিনি আরও জানান যে হয় ভাস্কর তাঁকে নিয়ে ডিব্রুগড়ে বাসা ভাড়া করে থাকুন নাহলে তার দাবীমত টাকা দিয়ে ডিভোর্স নিন।
রেণুর বক্তব্য থেকে পরিষ্কার যে তিনি কিন্তু শাঁখা-সিঁদুর ধারণ করাকে বিবাহিত জীবনের অংশ বলেই ভাবেন। বিবাহচিহ্ন ধারণ না করার প্রগতিশীলতা তাঁকে স্পর্শ করে নি।
বিচারপতির বক্তব্য তাঁর ব্যক্তিগত মতামত বিধৃত করেছে কিনা বা তিনি এই জেনারালাইজড স্টেটমেন্টটি আরও অন্য ভাবে বলতে পারতেন কিনা সে প্রসঙ্গে যাচ্ছি না। কিন্তু যে সাক্ষ্যের প্রেক্ষিতে এই মন্তব্য করা বা রেণূর মত এদেশের যে কোটি কোটি মেয়েরা বিশ্বাস করেন যে শাখা-সিঁদুর বা অন্য যে কোনরকম বিবাহচিহ্ন শরীরে ধারণ করা অবশ্য কর্তব্য, তাঁদের প্রেক্ষিতে এই স্টেটমেন্ট কি সত্যিই খুব গণ্ডগোলের? শাঁখা সিঁদুর লোহা মঙ্গলসুত্র ইত্যাদি - কজন মেয়ে এখনো কোনরকম বিবাহ চিহ্ন ছাড়া থাকার কথা ভাবতে পারেন? শাঁখা-সিঁদুর না পরার কারণে অন্য মেয়েদের থেকেই শুনেছি কিন্তু ‘আহারে, শ্বশুরবাড়ীতে নেয় না বুঝি !’ রেণুর নিজের সাক্ষ্যই তো প্রমাণ দিচ্ছে যে তিনি ‘হিন্দু এয়োস্ত্রী মানেই যে সিঁথিতে সীমান্তরাগ, হাতে শাঁখা’ এমনটাই ভাবেন।
একটাই সমস্যা বলা যায় যে, ভারতীয় বিচার প্রিসিডেন্সের ভিত্তিতে চলে। কাজেই আজ এক রেণুর পরিপ্রেক্ষিতে কথাটা বলা হলেও, কাল যে সেটা যারা এসব মানে না সেই অন্যদের ক্ষেত্রেও কাজে লাগানো হবে না তার কি গ্যারান্টি? সেটা একটা সমস্যা হয়ত, তবে অতটা সহজও না। কারণ স্পেশাল ম্যারেজ act মেয়েদের কিছুটা জায়গা দিয়ে রেখেছে। প্রগতিশীলতার খাতিরে শাঁখা সিদুরের কথা নিয়ে আপত্তি থাকলে বরং
আমরা ভাবি বিয়ের মত একটা আদ্যন্ত পিতৃতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে ধর্মের আওতায় রেখে দিয়ে দেশে আমরা কোন ধরণের প্রগতির কথা বলছি? ধর্ম কিভাবে অন্ততঃ আমাদের দেশে পিতৃতন্ত্রের হাত শক্ত করে সে কি আমাদের এখনো বুঝতে বাকী আছে? কার সঙ্গে কার বিয়ে হতে পারবে না পারবে, বিয়ের হাজার গন্ডা নিয়ম-কানুন, বিয়ের সঙ্গে জড়িত সতীত্বের ধারণা, সধবার পালিত নিয়মকানুন, স্বামীর বেঁচে-থাকা মারা-যাওয়া নিয়ে সধবা-বিধবার মত সামাজিক ক্লাস তৈরি করে মেয়েদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করা, বৈধব্যের হাজারটা নিয়মকানুন – বিয়ের সঙ্গে জড়িত সব কিছুতেই ধর্মের মুখ দিয়ে আদতে পিতৃতন্ত্র কথা বলে।
বিয়ের মত একটা ফান্ডামেন্টাল বিষয় যতদিন ধর্মের আওতায় থাকবে, ততদিন সে বিষয়ে বিভিন্ন প্রগতিশীল কথা শুধুই টোকেন হয়ে থাকবে। কিছুদিন আগেই রাজস্থানে ভোটপ্রার্থী নেতাদের বলতে শোনা গিয়েছিল, ভোটে জিতলেই তারা আবার মেয়েদের বিয়ের বয়স কমিয়ে মানুষকে গৌরীদানের পুণ্য পাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবেন। যে দেশে পাপ-পুণ্যও ভোটের রাজনীতিতে ব্যবহৃত হয় আর সেই ফোকটে পুণ্য পাইয়ে দেওয়ার জন্য আজও মেয়েদের জড়বস্তু হিসেবে দেখা হয় আর বিয়ে হয় সেই পুণ্যের বাহন, সে দেশে সত্যিই প্রগতিশীলতার ঢেউ আনতে গেলে বোধহয় আগে বিয়ে ব্যাপারটাকে ধর্মের আওতার বাইরে আনতে পারলে ভাল হয়। আর স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট কিন্তু একেবারে সেই সুযোগটা দিয়ে রেখেছিল। তাহলে আমরা কেন এই দাবী তুলব না যে আলাদা আলাদা করে হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্ট, মুসলিম ম্যারেজ অ্যাক্ট সব বাতিল হয়ে বিয়ে হোক শুধু স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট অনুসারে? একটু ভেবে দেখা যায়?
ইতিমধ্যে অবশ্য এই রায় নিয়ে আমার অনেক বেশি সমস্যা মনে হল অন্যত্র। বলা হয়েছে ছেলেটিকে আলাদা বাড়ী করে থাকতে বলাটা, পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখতে বলাটা নাকি তার পরিবারের প্রতিপালনে বাধার সৃষ্টি করেছে। সেটা আদালতের মতে মেয়েটির তরফ থেকে নিষ্ঠুরতা। পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে না বলাটা অবশ্যই উচিত হয় নি। কারণ সন্তান হিসেবে ছেলেটির পরিবার প্রতিপালনের দায়িত্ব থাকে। কিন্তু আলাদা বাড়ীতে থাকতে বলাটা কেন মেয়েটির তরফ থেকে নিষ্ঠুরতা? একটি ছেলে বাড়ীর থেকে আলাদা থাকলে পরিবারের প্রতিপালন করতে পারে না? এই একই যুক্তিতে তো তাহলে মেয়েদের শ্বশুরবাড়ী যাওয়াও বন্ধ করা উচিত। কারণ বাবা-মার প্রতিপালনের সমান দায় তো মেয়েদেরও থাকে। আর সেক্ষেত্রে তো দুজনে আলাদা বাড়ী করে থাকা ছাড়া গতি দেখি না। এই আলাদা বাড়ীতে থাকার কথাটা এই ক্ষেত্রে আরও উঠছে কারণ আদালতের মতে স্বামী ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের কেস ঠোকা এবং তারপর প্রমাণ না করতে পারা মেয়েটির নিষ্ঠুরতার অংশ। নিষ্ঠুরতার দাবীতে এই ডিভোর্সের আবেদন মেনে নেওয়া হয়েছে। এইখানে দ্বন্দ্ব জাগে। আদালত কি ভুলে গেলেন যে পারিবারিক অত্যাচার প্রমাণ করা কতটা কঠিন? ভুলে গেলেন কি, এদেশের মেয়েদের উপর কতটা চাপ থাকে সবকিছু সয়েও বিবাহিত থাকার? আর আমরা এও জানি যে সবক্ষেত্রে না হলেও অনেক সময়ই বাড়ির লোকের নাক গলানোর ফলে স্বামী-স্ত্রীর অশান্তি মিটতে জায়গা পায় না। এই সব ভাবনার প্রেক্ষিতে ছেলেটিকে আলাদা বাড়ি করে থাকতে বলাটা কেন আদালতের নিষ্ঠুরতা বলে মনে হল, এটাই খুব জানতে ইচ্ছে করছে।
https://www.livelaw.in/news-updates/refusal-to-wear-sakha-sindoor-signify-a-womans-refusal-to-accept-her-marriage-gauhati-hc-allows-divorce-petition-read-order-159081
সম্পূর্ণ একমত। তবে আলাদা থাকার জন্য চাই আত্মসম্মানবোধ ও জীবনে সংগ্রাম করার মতো মনোবল। আজকাল প্রায়ই দেখি কলকাতার বাঙালী ছেলেমেয়েরা বিয়ের পর মেয়েটির বাড়িতে থাকছে। মেয়ের মা পরমানন্দে পরিশ্রম করছেন তাঁর চিরপ্রতিদ্বন্দী ‘ছেলের মা’কে হারিয়ে দিয়ে জিতে যাওয়ার আনন্দে। নিজেদের জীবন কষ্ট করে নিজেরা গড়ে নেওয়ার মানসিকতা যুবসমাজের কোথায়! আশা করি এই উলটপুরানটি antithesis, শীঘ্রই synthesis হবে।
ভাস্কর দাসই তো ডিভোর্স পাবার চেষ্টা করছিলেন বলে শোনা গেছে। লোয়ার কোর্ট তা মঞ্জুর করেনি। স্বামী বলে মান্যতা না দিলে ডিভোর্সে রেণুর আপত্তি থাকবে কেন পরিষ্কার হয়নি।
সুন্দর লেখা স্বাতীদি। তবে যুক্তিবাদী মায়ের একটা মজার প্রশ্ন মনে পড়ে গেল আমার এক প্রগতিশীল বান্ধবীককে।
সিঁদুর যদি নাই পড়বে তাহলে বাবামার পয়সা খরচ করে অগ্নি সাক্ষী বিয়ে করলে কেন?
সুন্দর লেখা স্বাতীদি। তবে যুক্তিবাদী মায়ের একটা মজার প্রশ্ন মনে পড়ে গেল আমার এক প্রগতিশীল বান্ধবীককে।
সিঁদুর যদি নাই পড়বে তাহলে বাবামার পয়সা খরচ করে অগ্নি সাক্ষী বিয়ে করলে কেন?
স্বাতীদির লেখা যথারীতি চমৎকার হয়েছে। এই রায়টা নিয়ে কয়েকদিন ধরে যখন জলঘোলা হচ্ছিল তখন আমারও মনে হচ্ছিল আদতে যেমনটা ঘটেছে মিডিয়া হেডলাইন করেছে তার উপর অনেকটা রং চড়িয়ে এবং মানুষের প্রতিক্রিয়াও তদনুরূপ। স্পেশাল ম্যারেজ এক্ট থাকা সত্ত্বেও সম্প্রদায় ভিত্তিক ম্যারেজ এক্টগুলো ভারতীয়দের দুর্ভাগ্য। এমনকি লিবারেল স্পেসেও সম্প্রদায় নিরপেক্ষ ম্যারেজ এক্টের পক্ষে সমর্থন জোগাড় করা কঠিন - এটা আরও একটা দুর্ভাগ্য। পরিস্থিতির শিকার আর্থসামাজিক ভাবে পিছিয়ে থাকা মেয়েরা। ধর্ম নিরপেক্ষে।
স্বাতীদি, ভার্ডিক্টটা পড়ে দেখো।
১. মেয়েটির শর্ত ছিল, শুধু আলাদা থাকাই নয়, ছেলেটিকে তার সৎ মায়ের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হবে। যেটা Maintenance and Welfare of Parents and Senior Citizens Act, 2007 আইনের বিরুদ্দ্ধ।
২. মেয়েটি ৪৯৮-এ ধারায় বধূনির্যাতনের মামলা করেন, যেটা আগের আদালতে ভুয়ো বলে প্রমাণিত হয়। এইধরনের ভুয়ো ফৌজদারি মামলা সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুসারে নিষ্ঠুরতা ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
গুয়াহাটি হাইকোর্ট এই দুটি বিষয়কেই নিষ্ঠুরতা বলে অভিহিত করেছেন, যে দুটি বিষয় পূর্বতন ফ্যামিলি কোর্ট অগ্রাহ্য করেন।
শাঁখা-সিঁদুর না পরার যুক্তি হিসেবে মেয়েটিই বলেন, তিনি ছেলেটিকে স্বামী হিসেবে স্বীকার করেন না বলেই শাঁখা-দিঁদুর বর্জন করেছেন (আগে পরতেন কিন্তু)। আদালত সেই কথাটাই অবজার্ভেশনে উল্লেখ করেছেন - কোনো নির্দেশিকা অর্থে বলেন নি।
আমি শাঁখা-পলা-সিঁদুর ইত্যাদি কোনোকিছুরই পক্ষে নই। আমার বিয়েও হিন্দু বিবাহ আইন অনুসারে নয়। কাজেই, এসব সমর্থনের প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু, বিবাহে নারী ও পুরুষের সমান অধিকারের কথা বলার মুহূর্তে অ্যালিমনির দায় একা পুরুষেরই কেন থাকবে, এই কথাটাও তোলা উচিত, বিশেষ করে মেয়েটি যখন উপার্জন করে, তারপরেও। যাবতীয় আর্থিক দায় পুরুষ একা বহনে সক্ষম, এই বয়ানও অনিবার্যভাবে পুরুষতান্ত্রিক - কিন্তু, সেই দিকটা নিয়ে কথা হয় না একেবারেই।
মোক্ষম। স্বাতীদির সাথে আগেই কথা হয়েছিল এবং রায়ের এই ব্যখ্যাই আমার কাছেও প্রতিভাত হয়েছে। অনেকেই বিচারবিভাগের সাম্প্রতিক বিভিন্ন রায়ের প্রসঙ্গ টেনেছেন - এবং এই রায়ও সেই প্রবণতার বাইরে নয় বলে অভিযোগ করেছেন। আমিও মনে করি যে এই রায় সেই প্রবণতার বাইরে নয় - কিন্তু রায়ের সমস্যার জায়গাটা ভুল ধরা হচ্ছে। সমস্যা ওইটাই যে এই "আলাদা থাকতে চাওয়া"টাকে আদালত "নিষ্ঠুরতা" আখ্যা দিচ্ছে - এটা একদেশদর্শী এবং পুরুষতান্ত্রিক। রেণু যেখানে নিজেই শাখা সিঁদুর পরা কে "স্বামী হিসাবে মেনে নেবার অভিজ্ঞান হিসাবে আখ্যায়িত করছেন সেখানে বিচারকের সেই উদ্ধৃতিটা নয়। এটা খুব পরিষ্কার করে বুঝে নেওয়া প্রয়োজন। স্বাতীদির সাথে ১০০% একমত।
"একটাই সমস্যা বলা যায় যে, ভারতীয় বিচার প্রিসিডেন্সের ভিত্তিতে চলে। কাজেই আজ এক রেণুর পরিপ্রেক্ষিতে কথাটা বলা হলেও, কাল যে সেটা যারা এসব মানে না সেই অন্যদের ক্ষেত্রেও কাজে লাগানো হবে না তার কি গ্যারান্টি?"
এটা করা যাবে না, যদ্দুর বুঝেছি। কারণ এটা কোনো আইনের ব্যখ্যা নয়। আইনজীবীরাই বলছেন।
কেসটা ভারী মজার। আমরা সবাই মিলে নিজেদের মতো করে ভাস্কর দাস, রেণু দাসের বিবাহ বিচ্ছেদ মামলার মিডিয়া ট্রায়াল শুরু করেছি। কে বেশী নিষ্ঠুর? এবং এখানে না হোক, অন্যত্রে দেখেছি, এই কেসের বিশ্লেষণে ছেলেরা ছেলেদের পক্ষে, মেয়েরা মেয়েদের। মাঝখানে গুলিয়ে যাচ্ছে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি, যার জেনারালাইজড অভিঘাত দাঁড়ায় যে হিন্দু রিচুয়াল মেনে বিয়ে করলে শাঁখা সিঁদূর না পড়াটা কি বিবাহিত মহিলাকে অবিবাহিত হিসাবে প্রজেক্ট করবে? আর কোনও মহিলা শাঁখা সিঁদূর পড়ে যদি বলতেন এই লোকটিকে আমি স্বামী হিসাবে মানি না তবে আদালত কী বলবেন? স্বাতী রায় অনেকগুলি প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। যেগুলির আদালত গ্রাহ্য মীমাংসা জানা প্রয়োজন।
হিন্দু রিচুয়াল মেনে বিয়ে করলে শাঁখা সিঁদুর না-পরা অবিবাহিত হিসেবে প্রজেক্ট করবে কি না!
না, করবে না।
জেনারালাইজড।
আদালত প্রেক্ষিতে কথা বলেছে মনে হয়। যে প্রেক্ষিতে আমি স্বামী মনে করি না, তাই শাঁ-সিঁ পরি না, এই প্রেক্ষিতে। যেখানে মহিলা নিজে এই ব্যবস্থা মেনে নিয়ে, তা থেকে বেরোনোর চিহ্নগুলো প্রত্যাখ্যান করার কথা জানিয়েছেন।
ক্রুয়েল্টি প্রসঙ্গ। বাড়িতে মাকে ঢুকতে না দেয়া, ক্রুয়েল্টি। ভাড়া বাড়ি বা নিজের বাড়ি, আপন মা না সৎ মা, সেটা ইরেলিভ্যান্ট।
প্রেক্ষিত হিসেবে যদি দেখি, একজন বয়স্কা মহিলাকে বাড়িতে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না, কিন্তু তাঁর খোরপোশ ঠিক সময়ে পৌঁছে যাবে, এমনটা ভাবা বরং একটু ফার ফেচেড।
সিনিয়র সিটিজেনদের সুরক্ষা দেবার জন্য যে আইন তৈরি হয়েছিল, তখন ইনগ্রেডিয়েন্টস এ ওয়েলফেয়ার কথাটা ছিল
Welfare- means provision for food, healthcare, recreation centers and other amenities necessary for senior citizens.
আদার অ্যামেনিটিজ বাদ দিলে হবে না। আদার অ্যামেনিটিজ নির্দিষ্ট নয়। তার জন্য দেখা করা প্রয়োজন।
এই আলোচনার সুবাদে একটা ব্যাপার উঠে এল, কোডেড নিয়ম, যাকে আমরা আইন বলি, তা থেকে কোড বিয়ন্ড এক্সপেক্টেশন। এইটা কোডকে চেঞ্জ করতে সাহায্যকারী হয়। আইন ব্রড হয়। শুভেন্দুদা এপিডিআর এর মুখপত্রতে এ নিয়ে লিখেছিলেন। সেইটা এই মামলার সাপেক্ষে ফের মনে পড়ে গেল এই বা কম কী?
আর আমরা প্যাট্রিয়ার্কি বা পিতৃতন্ত্রের কথা জানতাম। পুরুষতন্ত্র কি নতুন কোনও বিন্যাস?প্রায় সবাই ভুল বলছে, এরম ভাবার কথা কল্পনা করতেই শিউরে উঠতে হয়। পুতন্ত্রটা যদি কেউ রেফারেন্স সহ ব্যাখ্যা দেন, সুবিধে হয়।
লেখাটা নিয়ে ফেসবুকে খুব তর্কাতর্কি (বা ঝগড়া) হচ্ছিল। অনেকে বলল, কথাগুলো এখানে রাখতে - যাতে পরবর্তীতে সূত্রগুলো পাওয়া যায়।
কিন্তু, কথার পিঠে কথার মধ্যে খানিকটা হঠাৎ করে কপি করে অন্যত্র দিলে একটু খাপছাড়া লাগে। তবুও দিলাম এইখানে।
@প্রতিভাদি
খুব ঠিক কথা। লেখাটা খুবই ভালো।তা নাহলে তো এত কথায় যেতামই না।
@Prativa Sarker
খুব ঠিক কথা। লেখাটা খুবই ভালো।তা নাহলে তো এত কথায় যেতামই না।
< > - এর ভেতর পেস্ট করলে চলে আসবে।