করোনা দুর্যোগের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের তাণ্ডব। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূল জেলা সাতক্ষীরার বেড়িবাঁধ ভেঙে পানির তোড়ে ভেসে গেছে গ্রামের পর গ্রাম। তাই দোরগোড়ায় ঈদ এলেও সবকিছু ছাপিয়ে পানিবন্দি মানুষের এবারের লড়াইটা বহুমুখী। পানির হাত থেকে নিজের শেষ সম্বলটুকু বাঁচাতে প্রাণপণ চেষ্টা করছেন শ্যামনগর জনপদের বাসিন্দারা। স্বেচ্ছাশ্রমে চলছে ভাঙা বেড়িবাঁধ মেরামতের চেষ্টা। সংক্রমণ এড়াতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ইত্যাদি স্বাস্থ্যবিধি এখানে অবান্তর।
খবরে প্রকাশ, শুধু সাতক্ষীরা নয়, সুন্দরবন সংলগ্ন খুলনা, বাগেরহাট থেকে শুরু করে বরিশাল, পটুয়াখালি, ভোলা, নোয়াখালিসহ দক্ষিণ-পশ্চিমের উপকূলবাসীর ঈদের খুশি কেড়ে নিয়েছে সুপার সাইক্লোন। বাঁধ ভেঙে জলমগ্ন শত শত গ্রামের বাসিন্দা। ঘরবাড়ি, গাছপালা, জমির ফসল, মাছের ঘের সব লণ্ডভণ্ড, তছনছ। সরকারি হিসাবে প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমান প্রায় ১১ শ’ কোটি টাকা। ২০মে ঝড়ের তাণ্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত ২৬টি জেলার অধিকাংশ জনপদে চারদিন পরেও সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ সাহায্য তেমন কিছুই পৌঁছেনি। লাখ লাখ মানুষ খোলা আকাশের নীচে মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন অর্ধাহার-অনাহারে। পাশাপাশি রয়েছে গবাদী পশু খাদ্যেরও তীব্র সংকট। এই চরম পরিস্থিতিতে মহামারির সতর্কতা হাস্যকর।
বেসরকারি হিসেবে ঝড়ে প্রাণনাশ হয়েছে ২১ জনের। আশ্রয়কেন্দ্র ও নিরাপদ স্থানে আগেভাগে সরিয়ে নেওয়ায় মৃত্যু এড়ানো গেছে অনেকটাই। এছাড়া সিডরের চেয়েও মহা দাপটশালী আম্ফান যে শক্তি নিয়ে উপকূলে আঘাত হানার কথা ছিল, তার অনেকটাই এবারো সয়েছে সুন্দরবন। এবারো এই বাঁদাবন বুক দিয়ে আগলে রক্ষা করেছে দক্ষিণাঞ্চলের বাসিন্দাদের। ঘণ্টায় মাত্র ৮০ কিলোমিটার বেগের মাঝারি মাপের ঝড়ের শক্তিতে শেষমেষ ফেরৎ গেছে আম্ফান।
এরআগে, করোনার ক্রান্তিতে গত ২৬ মার্চ, স্বাধিনতা দিবস থেকে সারাদেশে গণছুটি ও গণপরিবহণ বন্ধ রেখে দফায় দফায় বাড়ানো হয় লকডাউন। সবশেষ ঈদের কেনাকাটার জন্য ১০ মে থেকে আংশিক লকডাউন শিথিল হলো। দোকান-পাট, মার্কেট ও শপিং মল সকাল আটটা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত খোলা রাখার ঘোষণা এলো। সরকারের পক্ষ থেকে সবখানে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মানার নির্দেশনা দেওয়া হলেও বাস্তবে দেখা যায়, করোনাকে মোটেই কেয়ার করছে না বাঙালি। দোকান-মার্কেট-শপিং মলে ঘেঁসাঘেষি আর ঠেসাঠেসি করেই চলছে কেনাকাটা। গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও বেরিয়ে এলো প্রচুর ব্যক্তিগত যান, সিএনজি চালিত অটো-রিকশা, অবৈধ ইঞ্জিন রিকশা, রিকশা, ভ্রাম্যমান হকার ও সাধারণ মানুষ। আইন-শৃংখলা বাহিনীও সরিয়ে নিলো তাদের টহল ও নজরদারি।
এদিকে, নিত্য আয়ের মানুষ, বিত্তহীন ও ছিন্নমূলদের ভাত-কাপড়ের নিশ্চিত ব্যবস্থা না করেই টানা দুমাসের লকডাউন আসলে এই শ্রেণির মানুষের জন্য লকআপ কী না, নানা মহলে সে প্রশ্ন বার বার এসেছে। সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য বিনামূল্যে খাদ্য সাহায্য, এক কোটি মানুষকে ১০ টাকা কেজিতে চাল সরবরাহসহ নানা প্রণোদনা ও প্রতিশ্রুতির কথা বলা হয়েছে। বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে করোনা-দুর্গতদের জন্য ত্রাণ সাহায্যের খবরা-খবরের পাশাপাশি সরকারি দলের নেতাকর্মীদের কিছু চাল চুরির খবরও পাওয়া যাচ্ছিল।
এ পরিস্থিতিতে মিডিয়ায় প্রকাশিত ও নিউ মিডিয়ার ভাইরাল একটি ছবি কাঁপিয়ে দেয় দেশ। ছবিতে দেখা যায়, ঝাঁ চকচকে পোশাকের সার সার ম্যানিকুইনের মাঝে লাঠিতে ভর দেওয়া মাস্ক পরা এক বৃদ্ধা বাড়িয়ে দিয়েছেন ভিক্ষার হাত। এই একটি ছবিই যেন চুপসে দেয় বিবিধ বক্তৃতা আর খোয়াবনামার বেলুন। ফেসবুকের নিউজ ফিড উপচে পড়ে মন্তব্য আর প্রতিমন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায়।
অন্যদিকে, ঈদে ঢাকা ছাড়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা কঠোরভাবে অনুসরণে মহানগরীর বহির্গমন পথগুলোতে বাসানো হয় পুলিশের চেকপোস্ট। ট্রাকে, পিক-আপ ভ্যানে বা ভাড়ার গাড়িতে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন হচ্ছে কি না, কেউ বিনা কারণে নগর ছাড়ছেন কি না, তা যাচাই করা হয় নিয়মমাফিক। কিন্তু এর দুদিন পর হঠাৎ শুক্রবার ইউটার্ন নিল পুলিশ প্রশাসন। ২২মে মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হলো, নিজস্ব পরিবহনে ঈদের ছুটিতে বাড়ি ফেরা যাবে, তবে গণপরিবহন চলবে না।
ওইদিন রাত থেকেই হাজার হাজার মানুষ ভাড়ার গাড়ি, অটোরিকশা, ইঞ্জিন রিকশা, অন্যান্য যানবাহনে ও হেঁটেই ঢাকা ছাড়েন। মাওয়া, দৌলদিয়া, পাটুরিয়া ফেরিঘাটগুলোতে নামে ঘরমুখি মানুষের ঢল। এখানেও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ করোনা স্বাস্থ্যবিধি অচল। তিনদিন বন্ধ থাকার পর সেদিনই চালু হয় সবগুলো ফেরি। নদী পারাপারে যানবাহন বাদে জনমানুষ পারাপারে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও কোথাও তা মানা হয়নি।
বলা ভালো, ঘরমুখি এসব মানুষের অধিকাংশই গার্মেন্টস শ্রমিক নারী-পুরুষ। চরম অব্যবস্থাপনায় গণপরিবহন বন্ধ রেখে, কারখানা খোলা রাখার ঘোষণায় যাদের এক দফা বৈশাখের রোদ মাথায় নিয়ে শত শত মাইল হেঁটে ঢাকায় আসতে বাধ্য করা হয়েছিল। আবার সমালোচনার মুখে কারখানা বন্ধ করে গার্মেন্টস মালিকরা হাজার হাজার নারী-পুরুষ শ্রমিককে হেঁটেই ঢাকা ছাড়তে বাধ্য করেন। কিছুদিন আগে আবারো কথিত অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে অনেক গার্মিন্টস খুলে দেওয়া হয়। সে দফাতেও শ্রমিকরা আবারো খররোদ মাথায় নিয়ে অবর্ণনীয় দুর্ভোগে ঢাকা ও এর উপকণ্ঠ সাভার, আশুলিয়া, টঙ্গী, গাজিপুরের কারখানাগুলোতে যোগ দিয়েছিলেন।
করোনাকালে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে এবার সংক্রমণ, তথা জন সমাগম এড়াতে ঈদগাহ ও খোলা মাঠে ঈদের নামাজ পড়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। মসজিদে সীমিত পরিসরে ঈদের জামাত করার কথা বলা হলেও জুড়ে দেওয়া হয়েছে কয়েক দফা শর্ত। এরমধ্যে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক ব্যবহার, বাসা থেকে ওজু করে আসা, নিজস্ব জায়নামাজ ও টুপি ব্যবহার, করমর্দন ও কোলাকুলি না করা ইত্যাদি রয়েছে।
তবে সৌদি আরবের সঙ্গে মিল রেখে ২৪ মে দেশের বিভিন্ন স্থানের আগাম ঈদ উদযাপনে দেখা গেছে, এসব স্বাস্থ্যবিধি মোটেই মানা হচ্ছে না। মুসুল্লিরা ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করতে গিয়ে যথারীতি কোলাকুলি করছেন।
এদিন সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে দেশবাসীকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে ঘরে থেকেই ঈদের আনন্দ করার আহবান জানিয়েছেন। পাশাপাশি বলেন, সরকারের আগাম ব্যবস্থাপনায় আম্ফানের ক্ষতি অনেকটাই এড়ানো গেছে। দুস্থদের সয়াহয়তায় বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহবান জানান তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সবশেষ নিউজ বুলেটিন অনুযায়ী, ঈদের একদিন আগে দেশে করোনাভাইরাসে ২৪ ঘণ্টায় রেকর্ড ২৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। মোট মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে ৪৮০ জন দাঁড়িয়েছে, আর মোট আক্রান্তের সংখ্যা হয়েছে প্রায় ৩৪ হাজার। বলা ভাল, সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ ঘটেছে ঢাকা জেলায়। এরপরেই আরেক ঘনবসতিপূর্ণ নগরী নারায়নগঞ্জ রয়েছে। এ অবস্থায় আশংকা দেখা দিয়েছে, ঈদের ছুটিতে প্রধানত ঢাকা থেকে সারাদেশে ঘাতক ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার।
সংযুক্ত : করোনা পরিস্থিতি নিয়ে সদ্যনির্মিত আসমা বীথির স্বল্পদৈর্ঘ প্রামাণ্যচিত্র-- ইনসাইড আউট। ছবিতে ভাত-কাপড়ের রিপিটেড শটের ব্যবহার লক্ষ্যণীয়।
মানুষের যে কী দুর্দশা ! লেখা ও সাদাকালো ছবিটিতে তা পরিস্ফূট।
বিষণ্ণতার ছায়া পড়েছে ঈদে। তবু সুদিনের প্রত্যাশায় ঈদের শুভেচ্ছা! ঈদ মুবারাক!
ভালো লাগল
প্রতিভা দি,
এক কথায় সব বলে দিলে। তুমিই প্রথম পাঠক।
ইশরাত,
আবারও সাথে থাকার জন্য অনেক ধন্যবাদ। বিবর্ণ ঈদ শুভেচ্ছা
সুশান্ত দা,
অনেকদিন পর গুরুতে এলেন। শুভ