ইনবক্স উপচে পড়া ইদ মুবারক। সকলকে আদর। ভালবাসা। শুভেচ্ছা। কিন্তু যত মুবারক আসছে ততই স্মৃতির ভারে চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে! এই ইদ এলে কত সংকুচিত থেকেছি একদিন। মনে পড়ছে সেই অতীতভেজা নীচু চোখ। তখন ইদের উৎসব সারা স্কুলে একা আমাকেই লজ্জিত করত। নত মাথা কারও একটা শক্ত হাত খুঁজে বেড়াত। যে বলবে " ইদ! দারুন মজা! আমরা সবাই তোর বাড়ি যাবো খেতে একসাথে।" না, সেটা হয়নি। উল্টে ইদের দিন আমাকে এড়িয়ে চলা হত। মুসলমানদের পরবে একটা অন্য কিছু হয়ত থাকে! দূর থেকে নেমতন্ন চাওয়া গেলেও কিন্তু গ্রহণ করার বিষয়ে অনেকের অনেকরকম বাধা থাকে। যদিও ক্ষতে তখনও মলম পড়্ত! "কি রে! জানালি না তো! যেতাম তবে!" না, ইদ আর সেলিব্রেশন করি না। যা শুধু আমাদের মানে মুসলমানদের, বাঙালির নয় তা বহন করে বেড়ানোয় কী বা গর্ব! অন্যরা পালন করুক। আমি করিনা। এই দিন সারাজীবনই গৃহবন্দি করে রেখেছি নিজেকে। নতুন জামা শেষ কবে পড়েছি মনে নেই।
তখন আমাদের ছুঁয়ে ফেললে জামা ছাড়তে হত। হ্যাঁ, একদম এই দেশের কথা। আমার দেশ ভারতের গর্বিত বাঙালির প্রিয় পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম অধ্যুষিত মুর্শিদাবাদ জেলার সদর শহরের আশপাশের কথা। নামের পাশে ইসলাম থাকলেও ধর্মের সার কোরানে নয়, মানুষে খুঁজেছি। নামাজে নয়, পূজোর মন্ডপে ঠাকুর প্রণাম করেও জেনেছি মানুষ কে ভালোবাসতে গেলে গীতা,বাইবেল,জেন্দ আবেস্তা কিছুই বাধা নয়। হিন্দু ছেলেকে বিয়ে করে দেখেছি আমার মায়ের কোরান ঠিক জায়গায় আছে। নানীর তসবিও একইভাবে ঝুলছে। ধর্ম মানুষকে যদি না মেলাতে পারে তবে তা ধারণ করা কেন! সহাবস্থান যদি মানুষকে উদারতা না শেখায় তবে আমরা প্রথম শ্রেণির বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন জীব কেন?
যাক, যা বলছিলাম ৯ নং, রানী মন্দির লেন খাগড়ায় তখন পাড়ার মস্তান দাদারা হাত চিহ্নের লোক। ব্যাপক রোয়াব তাদের। ভিন পাড়ার ছেলের এ পাড়ার মেয়েদের প্রেম করার পারমিসনটাও চায়ের দোকানের পাশে দোতালা বাড়ির ডি. দার কাছে নিতে হত। মানে পাড়ার দাদাই নেতা ও সমাজসেবক। ডি.দার ব্যক্তিগত এক যুব বাহিনী ছিল। তারাই নজর রাখত পাড়ার বেলাদের উপর। বেপাড়ার ছেলেদের ঠ্যাঙ ভাঙার কাজ তারা মাথায় তুলে নিয়েছিল । এমনকি পাড়ার ড্রেন বা রাস্তা নিয়ে ঝামেলা হলে পুলিশ নয় দাদাই আসত সালিশির জন্য। মানে থানার ভিতর থানা। ইদের দিন বলাই থাকত সেমোই ও লাচ্ছা যেন ডি.দার ঘরে চলে যায়। আসলে তখন সামাইকে সামাই বলতে না পারার এক অমুসলিমোচিত গর্ব ছিল। "ওই যে তোরা খাস না! দুধ দিয়ে ল্যাছা না কি করে! ওই যে ......।" এই গর্বিত গর্বকথা শুনে পাশের কেউ মুচকি হাসি দিত! মানে উচ্চারণ না করতে পারার মধ্যেও যে অকৃপণ কৌতুক সেটা বুঝে সামনের অহিন্দুটি লজ্জিত লাল। আর এই দুই দেখে যার পিত্ত জ্বলে যেত সেই ছোঁড়াটাই আজকের লিবারাল! ইদ ও অষ্টমী ওর এক পাতের আয়োজন।
সেই রানিমন্দির লেন তখন স্যাফ্রন সাম্রাজ্য থেকে অনেক দূরে। কোথাও গোরুর মেধায় সোনার চারা দিতে ব্যস্ত। দেওয়ালজুড়ে শুধু হাতুড়ি আর হাতের বিপ্লব । বাড়িটা ছিল দ্বীপের মত। হিন্দু পরিবেষ্টিত এক মুসলিম বাড়ি। পাড়ার সকলে, কি আশ্চর্য! বিজেপি না হয়েও, আমাদের ঘৃণা করত। পাকিস্থানি বলত। এমনকি আমাদের ছুঁয়ে যে কাপড় ছাড়তে হয় এই রেওয়াজ সংক্রমিত হচ্ছিল। আমি ও দাদাকে প্রথম প্রথম কেউ খেলা নিত না ওই ভয়ে ৷ কিন্তু ভালোবাসা তো মাখন। কোথায় কখন গলতে শুরু করে তাপমাত্রাও টের পায় না! জাত-ধর্ম সব সেখানে নেল ডাউন। আমাদের ভাড়া বাড়ির পেছনে লুকিয়ে চলত ব্যাডমিন্টন খেলা। দাদার বন্ধু মাধব দার বাড়িতে পাড়ার কুকুর আলাউড কিন্তু পাড়ার মুসলমান নয়! তাতে কি! মাধব দা লুকিয়ে আমাকে আর দাদাকে পার করে নিয়ে যেত বাগানে। মাধব দার মা এলে আমি ও দাদা লুকিয়ে পড়তাম। কেউ জানতে পারত না দুই মুসলমান প্রানি বাড়ি অপবিত্র করে দিয়েছে! আবার ইদের সময় মাধবদা জানালা দিয়ে সামুই নিতে আসত। খেয়ে মাথায় হাত মুছে পালাত। মানে মাধব দার কাছে সামুই ছিল ইদ নামক পূজোর প্রসাদ। অনেক মহাপুরুষের চেয়ে মাধবদাকে সম্মান করি আজও। মানুষকে জয় করার বড় অস্ত্র ভালোবাসা। সেটা পাড়াতে কোনঠাসা মরিয়া দুই ব্রাত্য শিশুকে শিখিয়েছিল মাধব দা। সেখানে হাজার পূজো -পার্বন -ইদ - বড়দিন ফিকে।
ইদের দিন খুব ভয় লাগত আমাদের । আবার সেই "তোদের আর তোরা কি যেন খাস....ওই যে...." এসব মনভাঙা কথা চলে আসত। সমষ্টিতে বাঁচতে চাওয়া দুই শিশু আবার একঘরে হয়ে যেত। হাসাহাসি হবে খাবার নিয়ে, উৎসব নিয়ে। বেজায় লজ্জিত হয়ে কুঁকড়ে বসে থাকতে হত দিন দুয়েক। মা খুব মনোযোগ দিয়ে পাড়ার কাকিমাদের সঙ্গে ভিড়তে চেষ্টা করত। তার জন্য সিঙ্গার কোম্পানীর টকটকে গুড়ো লাল রংটাই মাথায় দিত। মানে সিঁদুর দিলে জাত যাবে। আর লাল রং দিয়ে জাতে ওঠা যাবে। আসলে.... "ও আপনিও সিদুঁর পড়েন?" এই বাঁধ ভাঙা আবেগের মধ্যে এক মুসলমান মহিলাকে ভীষণ করে কাছে টেনে নেওয়া যায়! মায়ের সেই কাছে যাওয়ার টান ছিল। প্রয়োজনও ছিল। নিজের সন্তানদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে তুলতেই মা সকলের মাঝে আমাদের মিলিয়ে দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন। মুসলমান মায়ের সিঁদুর দেখে যদি তার ছেলে মেয়েদের খেলা নেয় সবাই,যদি তাদের ঘৃণা করে দূরে সরিয়ে না দেয় সেটাই তো আসল কথা।
মায়ের স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল। দিকে দিকে গুজব ছড়িয়ে গিয়েছিল মা আসলে হিন্দু ঘরের মেয়ে। বাবাটাই মুসলিম। এরপর ধীরে ধীরে চন্দ্র বাড়ি থেকে চ্যাটার্জি বাড়িতে আমাদের ঠাঁই হতে শুরু করেছিল। আমরা সবার বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম। পাড়ায় একমাত্র টিভিওয়ালার বাড়িতে বেশ কয়েক হাত দূরে ঢোকার দরজার সামনে আমাদের বসার অনুমতি মিলেছিল। মা খুব সহজ করে বলত, কি হয়েছে তাতে? বাবার এক কলিগের বাড়ি গিয়ে মাকে অনেক দূরে দাঁড়িয়ে উলের ডিজাইন নিতে হত। মা কাচুমাচু করে বলত, বৌদি একটু হাতে দেবেন সোয়েটার টা? দেখেই কেঁচে দিচ্ছি এখুনিই! মায়েরা এমন অস্পৃশ্যতাকে নিজেদের ভাগ্য বলে মেনে নিয়েছিল। কোনোদিন সাহস দেখায় নি কাউকে ছুঁয়ে বলার - এই যে ছুঁয়ে ফেললুম! মানুষ কে মানুষ ছুঁলে কি হয়! যাক ধীরে ধীরে সেইসব ইতিহাস হয়ে গেল। আমরা মুসলমান এই বৃত্তের গ্লানির ছটপটানি পেরিয়ে বৃহত্তর সমাজের মানুষ হয়ে গেলাম। মানুষ যা পারেনি মাত্র পনেরো টাকার সিঙ্গার সেই ম্যাজিকে করে দেখাল। তারপরে অস্তিত্ব খুঁজে বেড়ানোর সংগ্রামে পেরিয়েছে অনেক পথ।
আজ এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। এন আর সি, করোনা, সব বিচ্ছিন্নতার মুখে ঝামা ঘষে মানুষ আবার এক হয়েছে। ধেয়ে চলেছে সুন্দরবনকে সুন্দর করে তুলতে। খুশির ইদ ঘরে বসে পালনের সময়টা আজ বাঙালির মন খারাপের রোদ্দুর হয়ে গেল। ইদ আজ সব বাঙালির আমপানের মত ধ্বংসলীলার বিরুদ্ধে লড়াই এর প্রতিজ্ঞার মত পালন হল। মানুষের মুখে হাসি ফেরানোর মরিয়া চেষ্টার দিন হিসেবে স্মৃতিতে গেঁথে রইল। দুই দিন আগেই দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার পরিবেশ বদলে আজ মাটি আঁকড়ে পড়ে নিজেদের সামলে রাখার লড়াই হয়ে থাকল। সব গুনাহ মাফ করে নেকি ভাগের দিন আজ। আত্মীয়-বন্ধু-অবন্ধু ,জেহাদি -বিজেপি, দেশভক্ত- আন্টি ন্যাশনাল সকলকে,
ইদ মোবারক।