অভিবাসী মহিলা শ্রমিকের তালাবন্দি জীবন
পাঞ্জাবের গ্যাসপুরায়,বিজলী দপ্তরের তিন নম্বর গলি। লকডাউনে আটকে পড়েছেন একদল মহিলা শ্রমিক। নিজের ঘর হরিহরপাড়া,মুর্শিদাবাদ থেকে ১৮০০ কিলোমিটার দূরে বসে এদের কান্না থামছেনা। কাছের ষ্টেশন লুধিয়ানা। মাথাপিছু ট্রেনভাড়া নাকি ৭৫০ টাকা। ওদের কাছে ভাড়া নেই। ফিরিয়ে ঘরে নিয়ে আনার কেউ নেই। মহিলারা কেউ ফেলে এসেছে বাচ্চা বাড়িতে। কেউ নিয়েছে সঙ্গে। বছর দুই এর সরফরাজ কেঁদেই চলেছে। খাবার বন্ধ হয়েছে চার দিন। দিনে ষাটবার করে হেল্পলাইনে ফোন করছে ওদের স্বামীরা। কিন্তু কোনও সাড়া নেই। সরকারী লাইন থেকে নাকি বলেছিল যে রেশনের ব্যবস্থা করা হবে। সেটাও করা হয়নি। এখন রোজা করছে এক টুকরো বিস্কুট খেয়ে।
জরিনারা কেউ টায়ার বানানোর সহায়কের কাজ করে। কেউ ফ্ল্যাটবাড়িতে। কেউ করে দেহারি কাজ। দিনে কেউ দুশো টাকা মজুরি পেত । কেউ বা একশো টাকা। ইদের আগে হিসেব করে টাকা নেবে এমনটাই ছিল পরিকল্পনা। কিন্তু লকডাউন হওয়ায় টাকাও মেলেনি। এখন তো ফেরার ভরসাও ক্ষীণ হয়ে আসছে। হাত ফাঁকা। সঙ্গে আছেন স্বামীও। মেয়ে ৩২জন। পুরুষ ৯৮ জন। সবমিলিয়ে মোট ১৩০ জন। ঠিক পাঁচ মিনিট এগিয়ে মহিলা-পুরুষ মিলে আরও ১২০জন। আটকে পড়ে সবাই অসহায়। ফিরতে না পেরে আশঙ্কিত।
রিম্পা বিবির বাচ্চারা পাঁচ ও আট বছরের। গ্রামের বাড়িতে পড়ে আছে। রিম্পা কাজে এসেছে দুই বছর। টায়ার বানাতে সহায়কের কাজ করতেন পাঞ্জাবে। ইদে বাড়ি আসার কথা ছিল। বাচ্চারা নতুন জামার জন্য বায়না করছে। রিম্পা বিবি ফোন ধরে অঝরে কঁদেই চলেছে। বলছেন, " বিষ দিন আপনারা, খ্যায়ে মরে যাই!"
জরিনা বিবি গেছে লকডাউনের দুই মাস আগে কিছু রোজগারের আশায়। নাট বোল্টুর কাজ করতেন। মাসে তিন হাজার টাকাও পেয়েছেন। লকডাউনের জন্য বাকি টাকা আদায় হল না। তবুও ঘরে বসে বসে একদিনের খাবার জুটত। শুধু রুটি। সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে।
সবনম বিবির বয়স কুড়ি। দুই বছরের বাচ্চা নিয়ে জেরবার। স্বামীর হাত ধরে কাজে আসা। ঘরের বিস্কুটও এখন শেষ। বাইরে যাওয়ার উপায় নেই। গেটে সিকিউরিটি।
মমিনা বিবির দুই বাচ্চা বাড়িতে পড়ে। নয় বছর ধরে কাজ করছেন বাইরে। ফ্ল্যাটবাড়িতে কাজ করেন। সাত হাজার টাকাও পেয়েছিলেন আগের মাসে। গত দুই মাসের টাকা পেলেন না। কোনও টাকাও দিতে পারেননি বাড়িতে। আক্ষেপের শেষ নেই। বাচ্চারা ইদের জামার অপেক্ষায়। ওরা পরব চেনে। মমিনা আকুতি করে বলছে, "ও দিদি !একটু নিয়ে চলেন না,বাচ্চাদের দিকে মুখ তুলে একবার দেখুন আপনারা। ওরা তো মায়ের জন্য কেঁদে কেঁদে মরছে।"
পারভিনা বিবির দুই বাচ্চা। পাঁচ ও আট বছরের ছেলে। তিনিও কাজ করছেন প্রায় তিন বছর। ফোনে কাঁদতে কাঁদতে বলেছেন, "আমাদের বাড়ি ফিরিয়ে দেওয়ার কেউ নেই গো! ট্রেনের টিকিট কাটার পয়সা নেই। বাড়ি গেলে আপনাদের টাকাটা যেমন করে হোক শোধ করে দেবো। এবারের মত পার করে দিন।"
সবচেয়ে মুশকিল হল এই মহিলা শ্রমিকদের হাড়ভাঙা খাটুনির কোথাও হিসেব নিকেশ নেই। ওরা শুধু শ্রমিকের বৌ ও শ্রমিকের বাচ্চার মা। ওদের জন্য আলাদা করে কিছু ভাবাই হয় নি। ঘর ছেড়ে,বাচ্চা ছেড়ে মাটি কামড়ে পড়ে রয়েছে ওরা। নিজেস্ব কোনও ইচ্ছা নেই,স্বাধীনতাও নেই। এমন কি অসংগঠিত শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতিটুকুও নেই!
কবিয়াল দুলালী চিত্রকরের লকডাউন
লকডাউনের মধ্যেই করোনা নিয়ে অনেক গান লিখেছেন মহিলা কবিয়াল দুলালী চিত্রকর । কিন্তু শোনার লোক কই! দুলালী বলেন,"আমরা কবিয়ালরা সমাজকে সচেতন করতে পারি কবিগানের মধ্যে দিয়ে! সরকার আমার মত এক মহিলা কবিয়ালকে কাজেই লাগালো না! গ্রামে গ্রামে গিয়ে মাইকে করোনা সচেতনতার গান করতে বললে আমি অবশ্যই যেতাম। নিয়ম মেনেই যেতাম।পুলিশ লাঠি দিয়ে যা পারছেনা আমি গান গেয়ে তা করে দেখাতাম।"
তিরিশ বছরের কবিয়াল জীবন দুলালীর। ত্রিশ দিনও বসে থাকার অভিজ্ঞতা নেই। সরাসরি কলকাতায় ফোন করে দিল খোদ দপ্তরেই। জানতে চাইল শিল্পীদের বাঁচার কি উপায়! জবাব এল "আমরা ভাতা দিয়েছি! আগে তো কেউ কিছুই দিত না আপনাদের!" কবিগানের দাপুটে লোকশিল্পী দুলালী চিত্রকর লকডাউনে নিজেদের অবস্থার বর্ণনা করতে গিয়ে বেশ হতাশ । ফুরিয়ে আসছে রেশনে পাওয়া পাঁচ কেজি চাল। শিল্পীভাতার হাজার টাকা কবেই শেষ। মুখ লুকিয়ে ত্রান নিতে যাওয়ার সাহস নেই। এতবড় শিল্পী হাত পেতে খাবার চাইতে এসেছে! এই লজ্জায় দুলালী বাড়ির কাউকে যেতে দেয়নি। দশ জনের সংসারে এবার মাস পেরিয়ে অভাব উঁকি দিচ্ছে। শেষ গান গাইতে যাওয়া চৈত্র মাসে বর্ধমান গলসী পীড়পাড়ায়। তারপর বাইশটা গানের আসর একে একে আসর বাতিল হল। মোট ৭৫ হাজার টাকার ক্ষতি। আগাম বায়না নেওয়া গানের আসরের টাকাও ফিরিয়ে দিতে হবে। লকডাউনে সব অনুষ্ঠান বাতিল হয়েছে। দুলালী ঘরে বসে মানসিক পীড়ায় দিন কাটাচ্ছেন।
পটুয়াদের পেট চলে গান গেয়ে ও মূর্তিনির্মাণ করে। এখন পট দেখার লোক নেই। ঠাকুর কেনার মানুষ নেই। লকডাউনে ঘরে বসে অনাহারের সঙ্গে লড়াই। আঠান্ন বছরের লড়াকু দুলালী ভেঙে পড়ে বলে, "এমন দিন কখনও আসবে ভাবিনি, পেটের ভাতের চিন্তা এভাবে করতে হবে!" জীবনে সব লড়াইয়ে দুলালী দাপটের সঙ্গে এগিয়েছে। এমনকি পৈতৃক সম্পত্তিও আট বছর ধরে উদ্ধার করেই ছেড়েছে! যদিও গর্ব করে জেলার বিখ্যাত মহিলা কবিয়াল দুলালী বলে, "সারা ভারতে সবচেয়ে সৎ এই চিত্রকরেরা। এদের বিরুদ্ধে কোনও মামলা নেই ইতিহাসে। খেটে খাওয়া জীবন চিত্রকরদের। আজ সেই সমাজটাই ভেঙে পড়েছে।" অভাব,অনটনের সঙ্গে লড়াই জারি ছিল পটুয়াদের। এই লকডাউনে মনের জোর অনেকটাই কমেছে দুলালীদের সঙ্গে থাকা পনেরোটি মনসা মঙ্গল,বাউল,কবিগান শিল্পী পরিবারের।
করোনা নিয়ে অনেক গান লিখেছেন দুলালী। কিন্তু শোনার লোক কই! দুলালী বলে,"আমরা কবিয়ালরা সমাজকে সচেতন করতে পারি কবিগানের মধ্যে দিয়ে! সরকার আমার মত এক মহিলা কবিয়ালকে কাজেই লাগালো না! গ্রামে গ্রামে আমাকে মাইকে করোনা সচেতনতার গান করতে বললে আমি যেতাম। পুলিশ লাঠি দিয়ে যা পারছেনা আমি গান গেয়ে তা করে দেখাতাম।"
আত্মবিশ্বাসী দুলালী বলে, "বন্ধন থেকে লোনের টাকা নিতে আসছে দিদি!লুকিয়ে ঘরে বসে থাকি ! ভাবতে পারেন! গরু,ছাগল কিনেছিলাম লোন করে। সেগুলোই নিয়ে আর এক সংসার। ওদেরকেও দেখতে হয়! অভাবে এরাও ভুগছে আমাদের মতই!""শিল্পীদের সম্মান আদায় করে নিতে চলে গেল জীবনের সিংহভাগ। এবারে পেটের জন্য নতুন লড়াই শুরু। লকডাউন আমাদের খুব সম্মানের মুখে ফেলে দিল। । পেটে খিদের আগুন কি আর ভাইরাসের সতর্কতা বোঝে বলুন !"- মাথার উপর সার দেওয়া পুরষ্কারের সামনে দাঁড়িয়ে আক্ষেপ করে বলেন দুলালী চিত্রকর।
গণকর,মির্জাপুর,মুর্শিদাবাদ
বিড়ি শ্রমিক কালোনের তালাবন্দির দিন
কে জানত লকডাউনের সঙ্গে প্লাস্টিকের এমন গভীর সম্পর্ক! বৃষ্টি হলে মানুষ কি করে? ভিজে যাওয়া থেকে বাঁচতে ঘরে আশ্রয় নেয়। বাইরে ছাতা সঙ্গে নেয়। কালোনরা কি করে? বৃষ্টিতে নাগাড়ে ভেজে। অঝরে চোখের জলের সঙ্গে পাল্লা দেয় বৃষ্টির জলরাশি। দুই হাত তুলে কালোনরা অভিযোগ করে আল্লাহর কাছে- "ম্যাঘ-পানি দিলা তো গরীবের ছাদ কেন দিল্যা না!" কালোনের নেই মাথার ছাদ। নেই একটা ছাতাও। খোলা আকাশ ও নিজের মাথার মধ্যে শুধু পাতলা এক প্লাস্টিকের আড়াল। রাত-দিনের হঠাৎ বৃষ্টিতে প্লাস্টিকের প্যাকেট মাথায় দিয়ে অপেক্ষা। প্রতি বছর একশো টাকায় একটা প্লাষ্টিক কেনা হয়। সেটা ছিঁড়ে গেলে আবার খোলা আকাশ। এবারে সেই প্লাষ্টিক কিনতে বাড়ি বাড়ি ভিক্ষা করতে হবে জানা ছিল না কালনের। বৃষ্টির সঙ্গে অভাবের এই লুকোচুরি কালোনদের জীবনজুড়ে। এই অভাবের মধ্যে নতুন সঙ্গী লকডাউন। লকডাউনে ঘরে নিজেকে বন্দি করার নিরাপদ আশ্রয়টাও নেই। ভাইরাস এসে পড়লেও কঠিন,পালিয়ে যাওয়ার পরেও মুশকিল। কালোনের অবস্থা এখন জলের বাইরে মাছের মত। ছটপটিয়ে কষ্ট পাওয়ার দিন লাগাতার জারি।
সতেরো বছর বিড়ি বাঁধছে কালোন। বিবি থেকে বেওয়া হয়েছেন। এখন তো কালোন চোখেও কম দেখে। এতদিনের বিড়ি শ্রমিক কালোনের নেই কোনও বিশেষ সামাজিক সুবিধার স্বীকৃতি। বিড়ি শ্রমিক হিসেবে রেজিষ্ট্রেশনের বিষয়ে কিছুই জানতে পারেনি আজীবন। কেউ একটা চশমারও ব্যবস্থাও করেনি। কিন্তু নাগাড়ে হাতের কাজ চলছেই। লকডাউনে বন্ধ বিড়িবাঁধা। হপ্তায় সাড়ে তিনশো টাকা উপার্জনের পথও বন্ধ। ছেলে মারা গেছে অনেক আগেই। বৌমা অন্যত্র সংসার বেঁধে নিয়েছে। নিজের মেয়েটাও দুই দিনের বাচ্চা রেখে পৃথিবী ছাড়ল। সেই নাতনিকে নিয়ে কালনের সফর। বয়স হয়েছে । স্বামীর ভিটেতে কয়েকটা কঞ্চি দিয়ে ছিল কাদার দেওয়াল। টালির ব্যবস্থা করে কালন উঠতে পারেনি । জীবন ফুরিয়ে গেল। মাথার উপরে ছাদের স্বপ্নপূরন হল না। এখন তো আবার পেটে টান। নাতনি ও নিজের খাবারের জন্য রেশন ও বিড়ির উপার্জন ছাড়া কিছুই ছিল না।
শাড়ির ছেঁড়া আঁচল ঘুরিয়ে মাথার উলটো দিকে টেনে নেয় কালোন । ভাঙা গলায় বলে, "লোক আসে। অভাব নিয়ে জিজ্ঞাসা করে,চলে যায়। গরীবের কেউ নেই। র্যাশন টুকুই ভরসা।" কালোনের বুক জুড়ে কষ্ট আছে, অভিমানও আছে। রোজার সময় এখন ভোরে শুধু ভাত আর লংকা। ইফতারে নুন ভাত দিয়েই চলছে। মসজিদ থেকে মাঝে মাঝে ইফতার আসছে। নাতনির জন্য সেটা তুলে রাখে কালোন। অভাবের দিনে নাতনিকেও বিড়ি বাঁধতে শেখায় কালন। দুজনে মিলে সংসারের হাল ধরে শক্ত করে। চেয়ে খাওয়ার চেয়ে নিজের উপার্জনেই ভরসা কালোনের। এভাবে যে সব বন্ধ হয়ে যাবে কে জানত! কত বয়সে বিয়ে মনেই নেই কালোনের। স্বামীর অসুখ ও মৃত্যুর পর অনেক রাত কেটেছে কালোনের। একাই সেসব নিজের হাতে মোকাবিলা করেছে। তিন দফার লকডাউউনে কালোন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। দিনের শেষ কিছুতেই হচ্ছে না কালোনের। মাথায় হাত দিয়ে বলে, খোদা বাঁচিয়ে নিলেন, রোজা না আসলে ভুখা পেটে এমনিই থাকতে হত এই ক' টা দিন।"
রাজ্যে এগারো লাখের বেশি মহিলা বিড়ি শ্রমিকের একজন কালোন। বিড়িতে নিয়োজিত কর্মীসংখ্যার নব্বুই শতাংশ মহিলা- শিশুদের একজন। একযুগের বেশি বিড়ি শ্রমিক হিসেবে কিছু পয়সা খেয়ে পড়ে কালোনের হাতে থাকার কথা! সেটা দিয়ে লকডাউনের অভাব সামাল দেওয়া যেতেই পারত। এর মূল কারণ বিড়ির সঠিক মজুরি না পাওয়া। বাতিল হয়ে যাওয়া বিড়ির দাম ও প্রাপ্য মজুরির হিসেবে বোঝপাড়া হয়ে যাওয়া। সেখানে কালনের কিছু করার নেই। শ্রমের সমান মজুরি দাবির অধিকারও নেই। কালোনদের গোটা একটা জীবন পেরিয়ে গেল। আজও সুরাহা হয়নি শ্রমের মর্য্যাদার। অসময়ে নিজের পেট চালানোর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা থাকলে এভাবে কালনকে হাহাকার করতে হত না। ছেঁড়া শাড়ির দৈন্যতা না ঢাকতে পারলেও নুন-ভাতের কোথায় চোখ ভরে আসত না। লকডাউন তার কাছে দূর্ভিক্ষের মত চেহারা নিয়ে হাজির হতে পারত না।
সিনিয়ারার লকডাউন যাপন
মেয়ের স্কুলের মিড ডে মিলের চাল-আলু দিয়ে চলেছে বিশ্বাস পরিবার কিছুদিন। সিনিয়ারার অভাবের সংসারের এ এক চরম বাস্তব। সিনিয়ারা বিড়ি বাঁধে। সংসারের পুরো ভার এখন তার উপর। স্বামী আকবর বিশ্বাসের শিরার অসুখ। রাজমিস্ত্রীর কাজ করত। দুই বছর ধরে বাড়িতে বসে। চেষ্টা করেও লাভ হয়নি। কুর্নি ধরলেই হাত কাঁপে। অগত্যা বেকার হয়ে যাওয়া স্বামী এখন ঘরেই। স্বামী ও দুই মেয়ে নিয়ে ঘর চালাতে সিনিয়ারা জেরবার। মেয়েরাই লকড়ি,পাতা কুড়িয়ে আনে। তাই দিয়েই ঘরের উঠানে মাটির আখা জ্বলে। ভাত কি আর শুধু খাওয়া যায়? আলু তো শেষ হয়ে গেছে কবেই! স্কুল ছুটি তাই মাঝে বেরিয়ে পড়ে দুই মেয়ে শাক-পাতা জোগাড় করতে। গ্রামের মানুষের কাছে লাজনা, পেঁপে চেয়ে আনছে মেয়েরা। তাতেই খাওয়া চলে যাচ্ছে।
লকডাউনের সময় রেশন থেকে ঘরে চাল এসেছে। কিন্তু রান্না করার জ্বালানী নেই। বিড়ি বন্ধ থাকায় সিনিয়ারা আর্থিকভাবে বেকায়দায় পড়েছে। স্বামীর চিকিৎসা বন্ধ হয়েছে। একসময়ে স্বচ্ছল ছিল বাড়ি। কাজ ছিল স্বামীর। উপার্জনও ছিল। সুখের সংসারে হঠাৎ অভাবের কালো ছায়া। সঙ্গে লকডাউন। সিনিয়ারা বলে, "অভাব এসে পড়েছিল আগেই কিন্তু লকডাউনে একদম গরীব হয়ে গেলাম। বিড়ির ইনকামটাই চলে গেল। খাবো কি?"
বছর পচিশের সিনিয়ারার বাল্য বিবাহ। পদ্মাপাড়ে বাপ -মায়ের বাড়ি ভেসে গেছে কবেই। দাম্পত্য প্রায় একযুগ পেরিয়েছে। বিয়ের আগেই বিড়ি বাঁধা শুরু। বিয়ের সময় স্বামীর অবস্থা খারাপ ছিল না। তাই স্বামীর ঘরে এসে বিড়িতে হাত দেয়নি। স্বামী অসুখে পড়ার পর সিনিয়ারা কাজে হাত দেয় নতুন করে। দুই মেয়ের মুখ চেয়ে শুরু করে বিড়ি বাঁধা। বিড়ির উপরেই সংসার ধীরে ধীরে নির্ভর হয়ে পড়ে। লকডাউনে হাত খালি হয়ে গেছে একেবারে। এখন বিকল্প কিছু খুঁজে পাচ্ছে না সিনিয়ারা। রোজা-নামাজ আর আল্লাকে ডাকাই একমাত্র ভরসা সিনিয়ারার। আফশোস করে বলে, "লেখাপড়া বাপ- মায়ে শিখায়নি। কলম এর বদলে হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল বিড়ির গজাল। বই এর বদলে বিড়ির কুলাকেই চিনেছিলাম। আমি সেই এক ভুল করবো না আর। মেয়েদের পড়াশুনা শিখিয়ে বড় অফিসার করব।"
সিনিয়ারারা মেয়েদের জন্য ভরপুর স্বপ্ন দেখে। তারপর একদিন এই মেয়েরাই পরের প্রজন্মের অন্য সিনিয়ারা হয়ে ওঠে। কম বয়সেই সংসারের জোয়াল ঘাড়ে তুলে নেয়! হেঁশেলের অভাবের সঙ্গে লড়তে লড়তে ক্ষয়ে যায়! প্রতিদিন ছেলে-মেয়েদের মুখে দুমুঠো খাবার তুলে দেওয়ার চ্যালেঞ্জের সামনে জীবনের বাকি সব অর্থহীন হয়ে যায়।
দস্তামারা,মুর্শিদাবাদ
রাঁধুনি সাগরিকার লকডাউনের দিন
লকডাউনে রান্নার কাজ বন্ধ হয়েছে সাগরিকার অনেকদিন। আগে রান্নার কাজ করত বাড়িতে। তারপর মাসে দুই হাজার টাকার বিনিময়ে এক বেসরকারি অফিসে রান্নার কাজ ধরে। সাগরিকাকে অভাবের বাইরে তাড়া করে নিয়ে বেড়াচ্ছে অন্য এক সমস্যা। দিনে দিনে তা বেড়েই চলেছে। শোকে-তাপে-চিন্তায় সাগরিকা বাড়িতে এখন শয্যাশায়ী। বিছানাই তাঁর সংসার। আগে তা-ও কিছু মুখে দিচ্ছিলেন। এখন সে সবও বন্ধ। পনেরো বছর আগে, বলা নেই, কওয়া নেই, স্বামী হঠাৎ হারিয়ে গেলেন!সেই ধাক্কা সামলে নিয়েছিলেন সাগরিকা। সন্তানের মুখ চেয়ে। মেয়ের মুখ চেয়ে। স্বামী নেই। সন্তান তো আছে। তাকে আঁকড়েই না হয় কাটিয়ে দেবেন জীবনের বাকি দিনগুলো। মেয়েটাও লেখাপড়ায় বড় ভাল। খুশির হাওয়া ছিল সংসারে। কিন্তু জানুয়ারিটাই যেন নষ্টের মূলে! সেই যে মেয়ে টিউশন নিতে গেল, আর ফিরল না। সাগরিকা প্রথমে ভেবেছিলেন, ভগবান বুঝি শেষ সম্বলটাও কেড়ে নিলেন।
কিন্তু, পরে তিনি জানলেন, ভগবান নয়, মেয়েটাই চলে গিয়েছে। স্বেচ্ছায়, নাকি চাপে তা জানেন না সাগরিকা। তাই তিনি দৌড়ঝাঁপ শুরু করলেন। খুঁজে পেলেন মেয়ের সঙ্গীর ঠিকানা । সেখানেই গিয়ে মেয়ের খোঁজ করলেন। কিন্তু ব্যর্থ হলেন। প্রথমে নিরুদ্দেশের ডায়েরি। তার পরে সেই আইনেরই আশ্রয়। মেয়েটাই তো তাঁর সব। জীবনের শেষ সম্বল।
জানুয়ারি মাস থেকে নেই নেই করে অন্তত ৬০ বার ছুটেছেন নানা দফতরে। না,হন্যে হয়ে খুঁজেও হদিস পেলেন না মেয়ের কোনোও। লকডাউনের গেরোয় কিছুই আর নাকি হওয়ার নেই। জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে মেয়েকে পাওয়া যাচ্ছে না। এই শুনে মায়ের মন কি মানে! জলজ্যান্ত বারো ক্লাসে পড়া মেয়েটা হারিয়ে যাবে? এ কেমন কথা! সাগরিকার একটিই ভয়, এই বিপদের দিনে মেয়েটার যদি কিছু হয়ে যায়? একেই রোগ ছড়িয়ে রয়েছে চারপাশে! অন্যদিকে, মেয়েটারও উচ্চ মাধ্যমিক দেওয়া হল না!
হতাশ সাগরিকা বলছেন, "লকডাউন তো আজ শুরু হয়েছে। মেয়েকে পাচ্ছি না সেই জানুয়ারি থেকে। আমরা গরিব বলে কি মেয়েটা বেঁচে আছে কিনা তা-ও জানতে পাব না?" সাগরিকার বোন দীপিকা কাঁদতে কাঁদতে বলেন ,"দিদির স্বপ্ন ছিল মেয়েকে পড়ানো। নিজে তো ক্লাস সিক্সের পরে আর পড়তে পারেনি। স্বামী হারিয়ে যাওয়ার পরে নয়নের মনি ছিল ওই মেয়েই। সে-ও হারিয়ে গেল। বাবার মতোই!"
সাগরিকার যুদ্ধ জটিল আবর্তে ঘুরপাক খেয়েছে আজীবন। বাবার একটি হাত ছিল না। সাগরিকা ও দীপিকা দুই মেয়েকেই খুব কষ্টে মানুষ করেছেন। বিপদের দিনে মাথায় হাত রাখার কেউ ছিল না। পুরো জীবনটাই লড়াই করে চলা। আজকের কর্মবিরতির যন্ত্রণা সয়ে নিচ্ছে সাগরিকা। কিন্তু মেয়ে হারানোর শোক কী করে ভুলে থাকা যায়! তাই উধাও হয়ে যাওয়া মেয়ের অপেক্ষার প্রহর গোনে যন্ত্রণা। বিরামহীন পদচারণায় ক্লান্তি নেই। সদর থেকে ঘরের কাছের থানায় গিয়ে প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থাকা। হাজার না শুনেও থামে না সাগরিকা। মেয়ের প্রত্যাবর্তনের বিশ্বাস নিয়ে প্রতিদিন আঁচলের পয়সা বেঁধে রিক্সা ঘোরায় থানার দিকে। দাঁড়িয়ে শুধু দাঁড়িয়ে কাটিয়ে দেয় ঘন্টার পর ঘণ্টা।
তথ্য ও সমীক্ষা জানাচ্ছে, এই দেশে গড়ে প্রতিদিন হারিয়ে যান ২৭০ জন মহিলা ও শিশু। কিন্তু তাদের মধ্যে তো কেউ কেউ ফিরেও আসে!পুলিশ নয়, প্রশাসন নয়, বৃথা আশা মরতে মরতেও মরে না জেনেই সেই আশাতে বুক বাঁধছেন সাগরিকা! লকডাউন শেষ হলে হয়ত মেয়ে নিজেই এসে দরজায় কড়া নাড়বে! মেয়ে নিয়ে সব অপমান ,অসম্মান আর অসহায়ত্বের দিন একদিন শেষ হয়ে যাবে।
হরিগঞ্জ,রেজিনগর,মুর্শিদাবাদ
আশা রাখি একদিন এই মেয়েরা আবার উপার্জনে ফিরবেন। যেখানে দ্বিধায় পড়ে যেতে হয় - বিড়ি বানানোর কাজে যুক্ত মেয়েদের নিয়ে। কাজটা না এতে যুক্তদের পক্ষে ভাল না এর উৎপাদনের উপভোক্তাদের পক্ষে; কাজটা উঠে যাওয়া উচিত। অথচ কত কারিগর এর সাথে যুক্ত!
রাস্ট্যের প্রণোদনা (বাংলাদেশে) প্রায় পুরোটাই চলে যায় ধনীদের পকেটে। শ্রমজীবীদের জন্য ঘোষণাটুকুও থাকে না। কিছু শ্রমজীবী হারয়ে যাবে এই ভয়াল মহামারিতে। সবশেষে একদিন তারা ঘুরে দাঁড়াবে, যখন প্রকৃতি শান্ত হবে।