ছেতি হেমব্রমের তালাবন্দি জীবন
"বিশ্বাস করুন,ছিতে হেমব্রম পাগলি নয় ,ভিখারিও নয়।" বলতে বলতে কথা জড়িয়ে যায় ছেতি হেমব্রমের দাদা বদি হেমব্রমের। দেখে বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, শুধু অভাব,অপুষ্টি ও অযত্নে এই বেহাল দশা ছেতির। দাদার অভাবের সংসারে এক কোনায় পড়ে থাকে ছিতে। এখন খাবার বলতে সারাদিন একমুঠো মুড়ি আর জল। আগের দিন রাতে জুটেছে শুঁটকি মাছের সামান্য গুঁড়ো আর লবন। দিলে খায়। না দিলে খায় না। এদিকে দাদারও মাঠে চাষের মজুরি খাটা বন্ধ হয়েছে অনেকদিন। টানা লকডাউনে বাড়িতেই বসে। বদি হেমব্রম অসহায় হয়ে বলে,"ছেতি জলটাই খায় বেশি।" ডান হাতের চারটে আঙুল অর্ধেক আছে। বাঁ চোখেও সমস্যা। তাই নাকি সরকারের ঘরে ছাপ পড়েনি। দুই বার গিয়েও আঙুলের ছাপ না ওঠায় আধার কার্ড হয়নি। কার্ড না থাকায় ছেতি সব সরকারী সুযোগ সুবিধার বাইরেই থেকে গেছে। বদি আফসোস করে বলে "বাপ লুদু হেমব্রমের মেয়েটার জন্য কিছুই করতে পারলাম না। কিছুই পেল না জীবনে মেয়েটা।"
ছেতির ছবি হবে শুনে তাড়াতাড়ি দুই পায়ে উঠে দাঁড়াল। হাতের পাশেই লাঠি রাখা ছিল। নিজের চেয়ে আধ হাত বড়। অন্যসময় দুই হাতে ভর দিয়েই চলে। মাটিতে হামাগুড়ি দিয়েই আজীবন কেটে গেছে। দাঁড়িয়ে হাঁটতেও পারে না। এত অসহায় যে মানুষের জীবন হতে পারে তা ছেতিদের না দেখলে বোঝা যায় না। শরীর চলে না,খাবার পেটে পড়ে না নিয়মিত। তবু মুখে হাসি থেমে যায়নি। ছেতির দাদা বদি খুব মর্মাহত হয়ে বলে, "আমার বোন অক্ষম। চলতি পারে না। আমি সারাবছর তার খাবার জোগাড় করতেও পারিনা। এখন তো নিজেই খেতে পেছি না । ওর মুখে কি তুলে দেবো।" পরিবারের এক কোনায় নীরবে পড়ে থাকা নিস্তেজ ছেতিকে 'আসছি' বলতেই হাত বাড়িয়ে দেয়। ডান হাতটা বাড়িয়েই কি ভেবে সরিয়ে নেয়। পাশ থেকে বদি বলে ওঠে, "আসলে মাথার ঠিক নেই,পাগলি তো!" আমি কিন্তু নিশ্চিত সাদা মাটা ছেদি হাত বাড়াবেই। ঠিক তাই হল। সবকটা আঙুল যে হাতে আছে সেটা বাড়িয়ে দেয় আমার দিকে। তখনও মুখে হাসির রেশ।দেশ,সংবিধান,গনতন্ত্রের লেন্সে এই হাসি বুঝি ধরা পড়ে না। মাথাটার শুধু গুনতি হয়।
সূর্যের তির্যক কিরণ চার খুঁটির উপর দাঁড়িয়ে থাকা মাটির ঘরটার উপরে পাতার ছাউনিতে পড়ছে। ঘরে শুধু জলের বোতল, বালতি আর জগ ছাড়া কিছুই নজরে পড়ছে না। সত্যি এই বিরাট বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ভরা দুনিয়ায় শুধু জলও মানুষকে কত ঘণ্টা বাঁচিয়ে রাখতে পারে! রান্না হয়নি একথা মুখ ফুটে বলার দরকার হয়না। দেখে বোঝা যায় আর সেটা বোঝার পর শিখে নিতে হয় এই পৃথিবী হয়ত ছেদি হেমব্রমদের জন্য নয়। এদের শরীরটাও মাটিকে কতটা ভারবাহী করে তুলছে। মানুষ ভয় পেয়ে পালাচ্ছে পাগল ভেবে! অভাব ও অনাদর মানুষের শরীরটাকেও কত বদলে দেয়। মানুষে মানুষে অবিশ্বাসের প্রাচীর তুলে দেয়।
ফেরার মুহূর্তে বদি হেমব্রম কে বললাম- লকডাউন উঠে গেলে একবার শহরে আসুন। ছিতের চিকিৎসা দরকার। কার্ডটাও দেখা যাবে। ঘাড়ের গামছা দুই হাতে নামিয়ে এনে করজোরে ভাঙা গলায় বদি বলতে থাকলেন- "বাপ লুদুর মেয়ে ভাল হয়ে যাবে! মরা বাপটা আমার শান্তি পাবে এদ্দিনে!"
সহনাগরিক হিসেবে ছেদি হেমব্রমের কাছে মাফ চাওয়ার কোনোও ভাষা আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। কেমন বিস্বাদ হয়ে যাওয়া মুখ নিয়ে গুলিয়ে যাচ্ছিল শরীর। গ্রাম পেরিয়ে সামনে জনশূন্য শহুরে রাস্তা। পথ ছেড়ে ঘরে বসেছে মানুষ। আমরা সবাই বাঁচতে চাই।ছেদি হেমব্রমও।
সেনাপতি হেমব্রমের লকডাউন যাপন
বাড়ির চালের উপর হাঁড়ি তোলা কেন? সিনাপতি একগাল হেসে বলে, “আজ চাল নাই ,রান্না হবে না! মা কালই হাঁড়ি ধুয়ে বলেছে চাল শেষ।” সিনাপতির মা মাথা নিচু করে বলে, “না, চাল হাঁড়িতে একটু আছে, রোগ এসেছে তো, সবারই অভাব চলছে। বেলা শেষ হতে হতেই জোগাড় হয়ে যাবে কিছু।” সিনাপতি বলে, কাল রাতে শুধু শাক সেদ্ধ দিয়েছে নুন দিয়ে। সিনাপতির মা মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে, হাঁসের ডিম দিয়ে ভাত খাবে বায়না করছে। এখন কি আর জোগাড় করা যায়!” খাবারের টান। একথা বাইরে বলতে সিনাপতির মা যে অস্বস্তি বোধ করছে তা স্পষ্ট। দারিদ্রেরও একটা অহংকার আছে হয়তো। সরকারের দানের ফিরিস্তির বিজ্ঞাপন এদের কাছে নেই। সারাবছর প্রতিদিন খেতে না পাওয়াটাই এদের কপাল বলে স্বীকার করে নিয়েছে হেমব্রম পরিবার।
বাইশ বছরের সিনাপতি কখনও স্কুলে যায়নি। শারীরিক সক্ষমতা না থাকায় বাড়ির বাইরে তেমন যাওয়া হয়ে ওঠে না। একটু হাঁটলেই হাঁপিয়ে যায়। সেনাপতি লকডাউনে কী করছে? জানতে চাইলে বলে, “বনধের সময় বসে আছি। আমার এমনিতে কোথাও যাওয়া হয়না এখন সকলেই যেতে পারছে না। আমার কষ্টটা ভালো করে সবাই বুঝছে।” সিনাপতির মা আঁচলে চোখ মুছে বলে, “গরিব মানুষ আমরা। গেল মাসে চাষের মাঠে একবার কাজ পেয়েছিলাম। এখন তো কাজের কোনও আশা নেই। মেয়েটার লেখা-পড়া হয়নি। আবার বিয়েও হবে না। পেটে না খেলে তো লোক জানতে পারে না! বিয়ে দিতে না পারলে তো বিপদে পড়ে যাব।” চাল বা আলু কি পেয়েছেন? জিজ্ঞাসা করতেই সিনাপতির মা কান্নায় ভেঙে পড়ে বলে, “কত লোক এল। লিস্ট করে নিয়ে গেল। বলল চাল-ডাল দেবে। কেউ আসেনি। কেউ কিছু দিল না। আমাদের কেউ মানুষ ভাবে না।” যাক সরকারের উপর কারও তো একবুক দুঃখ আছে যা এখনও গরিবের চোখে জল ভরে দেয়!
ফোটো নিতে চাইলে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ে সিনাপতি। বলে, “আমি ভালো করে দাঁড়িয়ে মায়ের পাশে হাসি দেব তখন তুলবেন।” কাজ শেষে কিছুদূর এগিয়ে পেছন ফিরতেই দেখি সিনাপতি ইশারা করছে। কাছে যেতেই কানে কানে বলল, “আমায় খাবার পাঠাবেন বনধ পর্যন্ত? মা খুব রাগ করে ভাত চাইলে। বলে, ”বসে বসে আর কত গিলবি? বাড়ির আর সবারও পেট আছে!” আর আমার পা-টা ঠিক হলে আমার বিয়ে হয়ে যাবে। মা খুব কাঁদে আমার বিয়ে হবে না বলে। আপনি যদি সরকারকে বলে আমার পা-টা ঠিক করে দিতে পারেন ভালো হয়।” সিনাপতির বাড়ি পেরিয়ে দ্রুত চার মাথার মোড়ের রাস্তায় এসে ভাবলাম কোন রাস্তা ঠিক সরকারের কাছে পৌঁছয় জানলে এখনই হাঁটা শুরু করতাম। সিনাপতির সোজা করে পা ফেলা খুব জরুরি। ওর বিশ্বাস ফেরানোটাও জরুরি। ওদের পরিবারের কাছে অসহায়ের আর্তি শুনতে আসা সব লোক সরকারের। আর সরকার মানেই এদের কাছে মিথ্যাবাদী ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী।