জোহরা শাহ কে? কেনই বা মরে গেল মাত্র আট বছর বয়সেই। ভাবতে অবাক লাগে ব্যাবসার টিয়া ছেড়ে দিয়েছে—এই অভিযোগে মালিক ডোমেস্টিক স্টাফকে লাথি মেরে মেরে ফেলতে পারে? শুধু তাই নয় চিকিৎসা সূত্রে জানা গেছে মাত্র আট বছরের জোহরার প্রাইভেট পার্টসেও লাথি মারা হয়েছে। মেরে অজ্ঞান করে ফেলে দেওয়া হয়েছে চিকিৎসার নামে। বাচ্চা মেয়ের টিয়াপাখি খাওয়াতে গিয়ে খাঁচা খুলে যায়। উড়ে যায় দামি টিয়া। আর সেই রোষেই পাখি ও সম্পত্তি ব্যবসায়ী মারতে মারতে মেরেই ফেলে জোহরাকে।
৫৮০ কিলোমিটার দূর থেকে মেয়ের থাকা-খাওয়া ও পড়াশোনার শর্তে পরিবার পাঠায় মেয়েকে এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে। কেননা যখনই অভাব, তখনই বাড়ির মেয়ের মাথায় কোপ। মোজাফরগড় থেকে রাওয়ালপিন্ডি সফর কাল হল জোহরার। জীবনটাই চলে গেল। মাত্র চার মাস কাজ করতে পেরেছে। কোনো মাইনে ছিল না। আনপেইড লেবার। যদিও এদের উপর নানা ধরনের অত্যাচার বিশ্বব্যাপী অব্যাহত। পাকিস্থানে চাইল্ড লেবার আইনত নিষিদ্ধ। আইএলও-র তথ্যানুযায়ী সাড়ে আট মিলিয়ন ডোমেস্টিক ওয়ার্কারের মধ্যে মহিলা ও শিশুই বেশি। আমাদের নিজের দেশে শেষ-পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ২.৬ মিলিয়ন মহিলা ডোমেস্টিক ওয়ার্কার।
অর্থনৈতিকভাবে ধনী বা দরিদ্র দেশ এদের মর্যাদা ছিনতাই করে আসছে। অবহেলা ও অবজ্ঞাপূর্ণ আচরণকে স্বাভাবিক মেনে আসছে। শিক্ষিত সমাজের সামনে আয়না ধরার কেউ নেই। তারা অনেকেই জাতিসংঘের ঘোষণাও মুখস্থ রেখেছে। মানব পরিবারের সবার সমান ও অবিচ্ছেদ্য অধিকার তারা স্বীকারও করে হয়তো। কিন্তু বাস্তবে এদের সুরক্ষা বা যত্নের বিষয়ে খুব বেশি গুরুত্ব দেয় না। ডোমেস্টিক ওয়ার্কারের কপাল মালিকের মানবিকতার উপর ছেড়ে দিলে বেনিয়মে জীবন যাবে এভাবেই।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার মতে, শারীরিক শ্রমে নিযুক্ত ১৫২ মিলিয়ন শিশু রয়েছে। এর মধ্যে ৭২ মিলিয়ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে রয়েছে। যদিও আমাদের দেশের লেবার ল ডোমেস্টিক ওয়ার্ককে কখনোই প্রোডাক্টিভ কাজের সমতুল মনে করেনি। ২০১৮-তে লেবার অ্যান্ড স্কিল ডিপার্টমেন্ট দক্ষতা ও স্থান নির্বিশেষে ওয়ার্কারদের ঘণ্টায় ৩১-৩৯ টাকা মজুরি বেঁধে দিয়েছিল। সেটাও তারা আদায় করার অবস্থায় হয়তো নেই।
শিশু শ্রমিকদের জন্যে গৃহপরিচারকের কাজকে মনে করা হয় উপযুক্ত, নিরাপদ ও সুরক্ষিত। প্রতি তিনজন অপ্রাপ্তবয়স্ক গৃহকর্মচারীর মধ্যে দুজনই শিশুকন্যা।
শ্রমের মর্যাদা নিয়ে গলা-ফাটানো সমাজ কিন্তু এদের অধিকারটা বুঝিয়ে দিতে ও কড়ায় গন্ডায় মিটিতে দিতে অপরাগ। তাই জোহরা পাখি উড়িয়ে শাস্তি পেল। প্রতিবাদ হল কোথাও কোথাও। এবং কোবিড বিপ্লবে মাসমাইনে না পেয়ে কেঁদে ফিরল রাস্তায় অগণিত মেইড সারভেন্ট।
বিশ্বজুড়ে একই চিত্র। ইথিওপিয়া থেকে কাজে যাওয়া ৩৭ জন মহিলা ডোমেস্টিক ওয়ার্কারকে লেবাননের রাজধানীতে রাস্তায় নামিয়ে দেওয়া হল কিছুদিন আগেই। তাদের দেওয়া হল না কাজের পয়সা। ফিরিয়ে দেওয়া হল না তাদের পাসপোর্ট। এমনকি ছুরি দিয়ে ভয় দেখানো হল দেশে ফেরার আবদারে। রাস্তায় আশ্রয় নেওয়া মহিলাদের কথা জানাজানি হতেই লেবাননের পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয় যে, এই মেইডদের ঘরে রাখার দায়িত্ব নিয়োগকারীদের। লেবাননে কাফালা নামের এক সিস্টেমের মধ্যে দিয়ে এদের নিয়োগ করার ফলে ডোমেস্টিক ওয়ার্কারদের ভিসা নিয়োগকারীর সঙ্গে যুক্ত থাকে। তাই ওদের ঘরে ফেরাটা মালিকের মর্জির উপর নির্ভর করে। ওদিকে নিজের দেশ ইথিওপিয়াও এদের ফিরিয়ে নিচ্ছে না। এয়ার টিকিট শুধু ডলারে নেওয়া হয় ইথিওপিয়ায়। লেবাননে আর্থিক সংকটের কারণে ডলার অ্যাক্সেস করা সম্ভব হচ্ছে না। দুই দেশের নিয়ম ও ব্যবস্থার ফাঁসে আটকে আছে এতজন ডোমেস্টিক স্টাফের ভাগ্য। দেশে ও দেশের বাইরে কাজের মেয়েরা এভাবেই গভীর সমস্যায় জর্জরিত হচ্ছে। কাজ করেও অপমান ও অনিশ্চয়তার জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে।