382। 22 তারিখে ভারতে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা। ড্যাশবোর্ড এ দেখাচ্ছে। এদিকে অজানা সোর্সের থেকে আক্রান্তের সংখ্যাটা ক্রমশ: লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। আজকের দিনে তেমন মানুষের সংখ্যা 47 জন। সোর্স : covidout.in.
চিন্তার ব্যাপার তো বটেই। তারই মধ্যে চিন্তা বাড়াচ্ছে একটা অন্য তথ্য। টেস্ট না হলে তো জানা যাবে না , করোনা কি করোনা নয়। সেই টেস্টিং এর ব্যবস্থাটা কি রকম?
WHO র থেকে বলা হয়েছে, We have a simple message to all countries -test, test, test.
এদিকে ICMR এর এখনো অবধি যে guideline (20 তারিখের) রয়েছে, সেই অনুযায়ী যাঁরা গত 14 দিনের মধ্যে বিদেশ থেকে এসেছেন কিন্তু যাদের কোন উপসর্গ নেই, তাদের শুধুই গৃহবন্দি হয়ে থাকার নির্দেশ। কোন উপসর্গ দেখা দিলে তবেই টেস্ট করতে হবে। কনফার্মড আক্রান্তের পরিবারের লোকেদের জন্যও সেই একই গৃহবন্দি থাকার নির্দেশ। টেস্ট করা হবে শুধু নীচের লোকদের:
1) বিদেশ ফেরত যাদের উপসর্গ দেখা গেছে
2) কনফার্মড আক্রান্তের সংস্পর্শে আসার পরে যাদের উপসর্গ দেখা দিয়েছে তাঁদের,
3) উপসর্গ দেখা দিয়েছে এমন স্বাস্থ্যকর্মীদের
4) তীব্র শ্বাসযন্ত্রের কষ্ট ওলা হাসপাতালের রুগীদের
5) কনফার্মড রোগীর সরাসরি সংস্পর্শে আসা লোকদের ( তার পরিবারের লোক বা যে স্বাস্থ্যকর্মী তাকে পরীক্ষা করেছেন তারা) , উপসর্গ থাকুক আর নাই থাকুক।
এখনো অবধি আমাদের দেশে প্রতি মিলিয়ন মানুষে মাত্র 10 জনের টেস্ট করা হয়েছে। (তুলনাটা বোঝানোর জন্য বলছি শুধু, ইতালির ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা প্রতি মিলিয়নে 3500 জন।)
WHO র মাথারা বলছেন যে সব সন্দেহভাজন লোকের টেস্ট করাটাই ভালো। এমনকি হালকা জ্বর আর কাশি হলেও। ভারত এখনো এ পথ নেয় নি। ফলে অনেকের অনুমান আসল অসুস্থের সংখ্যাটা হয়তো আর বেশি। কে জানে!
তাঁরা এও মনে করছেন যে জনগোষ্ঠীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়া ঠেকানোর জন্য আরো অনেক বেশি সংখ্যায় টেস্ট হওয়া দরকার ছিল। কিন্তু সরকার দেশের বিভিন্ন জায়গার 51 টি হাসপাতাল থেকে 826 জন ফ্লু বা শ্বাসকষ্টের রোগীদের স্যাম্পল নিয়ে টেস্ট করিয়েছেন। কোনটাতেই করোনা ভাইরাস পান নি। ফলে তারা আরো বেশি সংখ্যায় টেস্টের প্রয়োজন দেখছেন না। এটা অবশ্য দুদিন আগের খবর। এই 47 জন অজানা সোর্সের থেকে আক্রান্তের খবর আসার পরে তাদের প্রতিক্রিয়া এখনো পাওয়া যায় নি।
এখানেই ভয়টা লুকিয়েও থাকতে পারে। উপসর্গ না থাকলেও রোগ ছড়াতে পারে। বিশেষ বিশেষ দেশ থেকে না আসলেও একজন রোগের বাহক হতে পারেন। গগনদীপ ক্যাঙের মত বিশিষ্ট বিজ্ঞানীরা বলছেন যে উপসর্গওলা সব লোকেরই পরীক্ষা হওয়া দরকার।
এদিকে লোকজনের প্রতিক্রিয়া বিবিধ রকমের। কেউ কেউ যেমন এই সব পরীক্ষা নিরীক্ষার থেকে পালাতে চাইছেন, কেউ কেউ আবার ফ্লুর মতো উপসর্গ দেখে বা নিজের অজান্তেই আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এসেছেন ভেবে টেস্ট করিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চাইছেন। কিন্তু টেস্ট করাতে চাইলেই করানো হচ্ছে না। ICMR এর শর্ত না পূরণ করলে টেস্টও হবে না। আর কাদের টেস্ট হবে সেটা ডাক্তাররাই বলবেন। ফলে হালকা ক্ষোভ ছড়াচ্ছে।
আরো বেশি পরীক্ষা করার সমস্যাটা কি? প্রথমত: সরকারী পরীক্ষাগারের অপ্রতুলতা। শুরুর থেকেই 72 টা সরকারী পরীক্ষাগারে টেস্ট করা যাচ্ছিল। সব মিলিয়ে দিনে 9000 টা টেস্ট করা সম্ভব। পশ্চিমবঙ্গে যেমন মাত্র দুজয়গায় হচ্ছিল এই পরীক্ষা। এখন দুটো আরো বড় টেস্টিং ল্যাব করা হয়েছে। এতে দিনে আরো 2800 টি টেস্ট বেশি করা যাবে। অবশ্য সম্প্রতি সরকারী, বেসরকারী মিলিয়ে আরো 111 টি জায়গায় পরীক্ষা করা যাবে বলে জানানো হয়েছে। দিন দশেকের মধ্যেই তারাও কাজ শুরু করবে।
সমস্যা টেস্টিং কিটেরও। আসলে গোটা টেস্টিং এর প্রক্রিয়াটি জটিল। করোনা ভাইরাস একটা RNA ভাইরাস। তাকে পাকড়ানোর জন্য সম্ভাব্য রোগীর নাক গলার থেকে সোয়াব নিয়ে প্রথমে তার থেকে RNA আলাদা করা হয়। তার থেকে DNA তৈরি করে, প্রোবের সাহায্যে তার থেকে বার করা হয় স্যাম্পলে ভাইরাস আছে কিনা। অনেকটা সময় লাগে পুরো প্রক্রিয়াটা শেষ হতে। টেস্টটা করতে অনেক কিছু লাগে। তার মধ্যে বাকী সব দেশে মিললেও প্রোবটি আনাতে হয় বিদেশ থেকে। সরকার খোলসা করে জানান নি যে তাদের হাতে কত কিট আছে। তবে আপাতত নাকি 1 মিলিয়ন প্রোব জার্মানী থেকে আনা হচ্ছে। WHO র থেকেও আরো কিছু নেওয়া হবে।
নম্বরের ঘাটতি হয়তো কিছুটা এভাবে মেটান যাবে। যদিও আমাদের জনবিস্ফোরণের দেশে তাতে কতটা প্রয়োজন মিটবে তা জানা নেই। দামের ব্যাপারটা তো আছেই। সরকারী ল্যাবে এই টেস্ট বিনা পয়সায় হয়। খোলা বাজারে এ টেস্টের দাম সব মিলিয়ে হাজার দশ টাকা। কে বইবে এই বিপুল খরচের ভার? একবার দেশ স্টেজ 3 তে ঢুকে গেলে ভাইরাস যখন আমজনতার মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে, তাদের কত শতাংশ এই দাম দিয়ে টেস্ট করাতে পারবেন? দামের উর্দ্ধসীমা টাকায় বেঁধে দেওয়ার কথা হচ্ছে। সরকার অবশ্য বেসরকারী পরীক্ষাগারেও টেস্ট বিনাপয়সাতে করানোর জন্য অনুরোধ করেছে। অনুরোধে কতটা কাজ হবে জানা নেই। ইতালির স্কেলে টেস্টিং এর পরিষেবা মানুষকে দিতে হলে, তার মোট অর্থনৈতিক দায় কি হবে সেটা ভাবতেই ভয় হচ্ছে।
অথচ যে হারে অজানা সোর্সের থেকে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, তাতে সরকারের টেস্টের শর্তের পরিধি বাড়ানো দরকার অবিলম্বে। এখন প্রতিটি মুহূর্ত অসম্ভব দামী। এখনো যা কিছু সংক্রমণের খবর, সে সবই মূলত শহরাঞ্চলের ধারে কাছে। প্রত্যন্ত গ্রামের থেকে খবর আসে নি এখনো। একবার সে খবর আসতে শুরু করলে তা সামাল দেওয়া হবে কি ভাবে তা জানা নেই। নিদেন টেস্টটুকুনিও করিয়ে ওঠা যাবে তো? সে করতেও তো সেই শহরেই আনতে হবে। সম্ভব হবে তো? আমরা আমজনতা ভয়ে মরি।
আশার কথা শোনাচ্ছেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা। নতুন এক পরীক্ষা বার করেছেন তাঁরা। এতে PCR মেশিনের মত জটিল দামী মেশিনের দরকার পড়বে না। মাত্র তিরিশ মিনিটেক সময়ে টেস্ট হয়ে যাবে। বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন যে এই নতুন টেস্ট অনেক বেশি এক্যুরেটও। ফলে সংক্রমণের প্রথম ধাপেই ভাইরাসের উপস্থিতি ধরা যাবে। সব থেকে বড় কথা এর ফলাফল বোঝা যাবে খালি চোখেই। ফলে গ্রামের দিকে ব্যবহার করা সহজ হবে। ওঁরা চেষ্টা করছেন বাড়িতে ব্যবহারের জন্য টেস্ট কিট বানানোর।
অবশ্য আমেরিকাতেও ক্যালিফোর্নিয়ার একটি কোম্পানি ৪৫ মিনিটে করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি ধরতে পারা যাবে এমন একটি র্যাপিড ডায়াগনোস্টিক টেস্ট বার করেছেন। FDA approval ও পেয়েছে। এতে হাসপাতালেই পরীক্ষা সেরে ফেলা যাবে, এখনকার নিয়মমত আর কেন্দ্রীয় পরীক্ষাগারে পাঠাতে হবে না। এই দু:সময়ে এই কথাগুলোই অল্প হলেও স্বস্তি দেয়।
অবশ্য আরো স্বস্তির খবর এল আজকেই। আই আই টি দিল্লির বিজ্ঞানীরা একটি কোভিড-১৯ ভাইরাসকে শনাক্ত করার উপায় বার করেছেন যাতে RT-PCR পদ্ধতিতে ওই প্রোবের আর দরকার পড়বে না। এদের এই পরীক্ষার পদ্ধতিটি এখন National Institute of Virology র অনুমোদনের অপেক্ষায়। এই পদ্ধতিতে পরীক্ষার খরচ অনেক কমে যাবে। বিদেশ থেকে প্রোব আমদানি করার ঝামেলাও থাকবে না।
তবে কিনা , "মারে হরি, রাখে কে"? এমনিতেও আমাদের দেশে এতদিন কতটা সতর্ক হয়ে দেশের বিভিন্ন প্রবেশপথে স্ক্রিনিং হয়েছে তা নিয়ে সন্দেহ আছে। এয়ারপোর্টের স্ক্রিনিং অব্যবস্থার কথা বাদই দিলাম। অনেক নেটিজেনই জানাচ্ছেন কদিন আগেও অনেক প্রবেশপথেই অত্যন্ত দায়সারা গোছের স্ক্রিনিং এর কথা। কোয়ারণটাইন কেন্দ্রের থেকে মানুষ পালিয়েও যাচ্ছেন । এতই খারাপ দশা। একটি রেলওয়ে স্টেশনের স্ক্রিনিং এর ভিডিও চোখে পড়ল। মোবাইলে কথা বলতে বলতে স্ক্রিনিং কর্তা আনমনে চলে যেতে বলছেন। এদিকে একটি কর্পোরেট হাসপাতালে দেখা গেছে রিসেপশনের মেয়েটি মাস্ক গলায় ঝুলিয়ে মুখে হাত চাপা দিয়ে হেঁচে কেশে অস্থির। তারপর সেই হাতেই কম্পিউটারের কীবোর্ড দাবানো। এরপর ভরসা করা খুব মুশকিল। এখনো যদি আমরা সকলে মিলে সতর্ক না হই, বিধিনিষেধ মেনে না চলি তাহলে সমূহ বিপদ।
এমনিতে সাধারণ কমবয়সীদের এই ভাইরাস থেকে মৃত্যুর সম্ভাবনা কমই। বয়স্ক বা অসুস্থ জনেদের বিপদ অনেকগুন বেশি হলেও আমাদের দেশে বৃদ্ধদের সংখ্যা তুলনামূলক ভাবে কম। কিন্তু তাতেও আমরা স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলতে পারছি কই! আমাদের প্রায় ভেঙে পড়া সরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কি সেই চাপটুকুও নিতে পারবে? একেই তো সেখানের ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীরা "ঢাল নেই , তরোয়াল নেই নিধিরাম সরদার" হয়ে শুধু অসীম মমতা, সাহস আর মেধা নিয়ে লড়ছেন। নিতান্ত ব্যক্তিগত নিরাপত্তার সামগ্রীটুকুও তাদের সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া যায় নি। অবশ্য সে সমস্যা বেসরকারী ক্ষেত্রেও একই রকমের হচ্ছে শুনেছি।
তবু লড়াই চলছে। একটাই ভরসার কথা। চেন্নাই এর ইনস্টিটিউট অফ ম্যাথেমেটিকাল সায়েন্সের দুই বিজ্ঞানী জানিয়েছেন যে ভারতে কোভিড 19 এর একজন আক্রান্তের থেকে 1.7 জন মানুষ সংক্রমিত হচ্ছেন। এই রেট টা ইরান বা ইতালির তুলনায় কম, যাদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা ক্রমান্বয়ে 2.73 আর 2.34. এই সংখ্যাটা অবশ্য পরিবর্তনশীল, আগামীতে বদলাতে পারে। আর কেন তুলনায় কম তারও কোন নিশ্চিত ব্যাখ্যাও এখনো মেলে নি। তবু এই কম থাকাটাই অনেকটা স্বস্তির।