আসামে যা ঘটে গেল তা আমাদের কাছে কেমন এক হঠাৎ হিংসার মতো চমক নিয়ে এলো। আদতে শুধু আসাম নয়, গোটা উত্তর-পূর্ব ভারত সম্পর্কেই দেশের বাকি অংশ বড়ো কম জানে, জানতে চায়। সাম্প্রতিক হিংসার প্রেক্ষাপটে অপার বাংলার এই অংশটি নিয়ে এবারের বুলবুলভাজায় রইল এক গুচ্ছ লেখা।
বহুদিন ধরে নেলীর সাথে বসবাস করছি। ঝাপসা মনে পড়ে আসাম ট্রিবিউনের প্রথম পাতায় ছাপা নেলীর সাদা কালো ছবি। তখনকার দিনের খবরের কাগজের ছবি যেরকম হত, কনট্রাস্ট বেশি, অস্পষ্ট। ছবির বিষয়বস্তু হল শীতের ধানখেতে সারি সারি লাশ।
সে ছিল ফেব্রুয়ারি ১৯৮৩। গোটা রাজ্য তিন বছরের বেশি ধরে বিক্ষোভ, বনধ, হত্যা, কার্ফিউয়ের ঘুর্ণীতে লাট খেয়ে যাচ্ছে। ইন্দিরা গান্ধীর কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করেছে ফেব্রুয়ারিতে একসাথে বিধানসভা আর লোকসভা নির্বাচন করতে হবে। অসমিয়া জাতীয়তাবাদী সংগঠণ আসু (All Assam Students’ Union), অসম গণসংগ্রাম পরিষদ (All Assam Gana Sangram Parishad) আসাম আন্দোলনে (১৯৭৯-১৯৮৫) নেতৃত্ব দিচ্ছিল, তারা ভোট বয়কটের ডাক দিল। কারণ ভোটার লিস্টে নাকি বহু অবৈধ বিদেশী নাগরিক রয়েছে। ইতিমধ্যে ১৯৮০ সালে একই বিবাদের ফলে আসামে লোকসভা নির্বাচন করানো যায় নি। ভারতের কোনো রাজ্যের পক্ষে এরকম প্রথম ঘটনা। ১৯৮৩-র ভোটকে অন্যান্য দলগুলো কিন্তু স্বাগত জানিয়েছিল, কিছু বাঙালি ও বোড়ো গোষ্ঠীও। ফেব্রুয়ারির আগেই রাজ্যজুড়ে সংঘাতের ঘটনা আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল। ফ্রেব্রুয়ারিতে পরিস্থিতি চরমে পৌঁছেছে।
আসামের ট্রিবিউনের কথায় খবরের কাগজের কথা মনে পড়ল। খবরের কাগজ পাওয়া তখন রীতিমত ঝকমারির ব্যাপার। চার-পাঁচ দিনের কাগজ হয়তো এক লপ্তে শহরে এলো। কার্ফিউ চলত যখন লোকজন বিকেলের কার্ফিউ রিল্যাক্সেশনের সময় বেরুত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্তর চাল, ডাল, ডিম, দুধ কিনতে। আর তখন কাগজ নিয়ে আসত। খবরের আর বিশেষ উৎস ছিল না, রেডিও সিগন্যাল ভয়ানক বিচ্ছিরি, টিভি বিরল। কার্ফিউ রিল্যাক্সেশনের জিনিসপত্তর কেনা নিতান্ত সহজ ছিল না। কার্ফিউ আর বনধ সাধারনত একসাথে হয়; যখন রাজনৈতিক দল বনধ ডাকে ঝামেলার আশঙ্কায় প্রশাসন কার্ফিউ ঘোষণা করে দেয়। বনধের দিনে যদি দোকান খোলা রাখেন দোকানের সুরক্ষার গ্যারান্টি কেউ দেবে না। আমাদের চৌমাথার বাজারের দোকানদাররা মধ্যপন্থা অবলম্বন করেছিল। দোকানের পাট নামিয়ে ভেতরে নিঃশব্দে বসে থাকত, গ্রাহক পাশের ছোট্ট দরজাতে টোকা দিলে সন্তর্পনে মাল বেচাকেনা চলত।
এইসবের মধ্যে নেলী ঘটে গেল। নেলী গুয়াহাটির পূর্বদিকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি ছোট শহর। ফেব্রুয়ারির ১৮ তারিখে নেলীর কাছাকাছি ১৪টি গ্রামের বাঙালি মুসলমানদের পরিকল্পিতভাবে ঘিরে ফেলা হয়। তারপর হত্যা চলে। ঘটনার আগে উস্কানিমূলক গুজব শোনা গেছিল ওই অঞ্চলের উপজাতি শিশুদের মুসলমানরা তুলে নিয়ে মেরে ফেলেছে। আসল কারণ হয়তো অন্য। ১৪ তারিখে ভোট হয়েছিল। শোনা গিয়েছিল অঞ্চলের মুসলমানরা বড় সংখ্যায় ভোট দিয়েছে। এরকমও সন্দেহ করা হয় রাষ্ট্রীয় সয়ংসেবক সংঘের ক্যাডাররা আসুতে ঢুকে পড়েছিল, তাদের হাত থাকতে পারে। (১)
তবে অন্যান্য লোকজনের সাহায্য থাকা বিচিত্র নয়। ঘটনার তিনদিন আগে কাছের একটি থানা থেকে মেসেজ ওপরমহলে যায়, “one thousand Assamese villagers [are] getting ready to attack…with deadly weapons”। মেসেজটি উপেক্ষা করা হয়। মূলত, লালুং উপজাতির লোকেরা আক্রমণ চালায়, সাথে কিছু অসমিয়া ছিল। সরকারি হিসেবমতে মৃতের সংখ্যা ১৮১৯। অ-সরকারিমতে তিন হাজারের ওপর। হত্যার জন্য সাবেক হাতিয়ার তরোয়াল, বর্শা, দা, লাঠি, বন্দুক ব্যবহার করা হয়েছিল। মৃত ও আহতদের মধ্যে একটা বড় সংখ্যা শিশু আর মহিলাদের। যেন উদ্দেশ্য ছিল অবৈধ বিদেশীদের ভবিষ্যত প্রজন্ম নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে।
নেলীর জন্য আজ পর্যন্ত কাউকে দোষি সাব্যস্ত করা হয় নি, শাস্তি দূরস্থান। পুলিশ চার্জশীট বানিয়েছিল, পরে সেগুলো বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। ১৯৮৩ সালে তিওয়ারি কমিশন নিযুক্ত করা হয়। ১৯৮৪ সালে তার রিপোর্ট সরকারের কাছে দাখিল করা হয়। তাতে কী লেখা আছে পরের কোনো রাজ্য সরকার জানায়নি। গোপনীয়তার ঐতিহ্য আজ পর্যন্ত চলছে। ২০০৪ সালে এক জাপানী গবেষক গুয়াহাটির অমিয় কুমার দাস ইন্সটিটিউটে নেলীর ওপর পেপার পড়তে গেলে রাজ্য সরকার তাঁকে আটকে দেয়।
এই ছোট্ট বর্ণনার পর ১৯৮৩ ফেব্রুয়ারির আমাদের শহরে ফেরা যাক। নেলী ছাড়া অন্যান্য চাঞ্চল্যকর ঘটনা কানে আসছিল। এক রাতে এক পরিচিত কংগ্রেসি নেতাকে খুন করা হল। আরেক রাতে কলেজের ছাত্ররা শহরের বাইরের মুসলমান অঞ্চলে আক্রমণ চালাতে গেলে তাদের নেতা উলটে খুন হয়ে গেল। শহীদ বেদী, মূর্তি, স্মারক, দেওয়াল লিখনের সংখ্যা বাড়তে লাগল। ঘরবাড়ি দোকানপাটে আগুন দেওয়া চলল। সেই সময়ের একটি স্লোগান আমাদের ভারী প্রিয় হয়ে উঠেছিল, 'এই জ়ুই জ্বলিছে, জ্বলিব জ্বলিছে। এই আগুন জ্বলছে, জ্বলবে জ্বলছে।' নামঘরের বাদ্যযন্ত্র সহকারে রাতে শহরের রাস্তা দিয়ে লম্বা মিছিলে বেরুত। বেশিরভাগ স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রী, হাতে হাতে মশাল। আমাদের উত্তেজনায় আরো ইন্ধন যোগাতে বিএসএফের একটি পল্টন ইস্কুলে ক্যাম্প বানিয়ে বসে পড়ল। অনির্দিষ্টকালের জন্য ইস্কুল বন্ধ। দুঃখের বিষয়, বাবা-মা’রা সচরাচর এরকম রোমাঞ্চকর ঘটনাবলীর কদর বোঝেন না। বাড়িতে তালা মেরে আসাম ছেড়ে একটা লম্বা ভ্রমণে বেরিয়ে পড়তে হল। এরপর ৪০০০ মানুষের হত্যা হয়ে গেলে পরে রাজীব গান্ধী আন্দোলনের নেতাদের সাথে ১৯৮৫ সালে আসাম চুক্তিতে সই করবেন।
তো, নেলী আমাদের সাথেই আছে, অনেক দিন ধরে আছে। নেলী, মানে নেলী নামের অঞ্চলটি, আসামের আর পাঁচটা ছোট মফস্বলের মতই। ঘন সবুজ ধানখেত, দিগন্তে মেঘালয়ের কালো পাহাড় দেখা যাচ্ছে, দুএকটা জায়গায় সেগুনগাছ-ঝোপঝাড়, ব্যস্ত বাজার, দূর্গাপূজার মন্ডপ, আর জামাকাপড় থেকে বড়সড় মুসলমানদের জনসংখ্যা অনুমান করা গেল। ১৯৮৩-র দিনটিতে কী হয়েছিল তার কোনো স্মারকচিহ্ন খুঁজে পাওয়া গেল না।
তবে এরকমই তো হওয়ার কথা ছিল। দিল্লী ১৯৮৪ বা গুজরাট ২০০২-হত্যাকান্ডকে রাষ্ট্র ন্যূনতম বিচারের মাধ্যমে জবাব দিয়েছে, তার কারণ তাদের প্রেতাত্মারা ফিরে ফিরে আসে। আর নেলী দেশের দূরের কথা, রাজ্যের রাজনীতিতেও এক বিস্মৃত অধ্যায়। গরিব, পাড়াগেঁয়ে মুসলমানরা মরেছে এরকম এক গণহত্যা কে মনে রাখে। দ্বিতীয়ত, যারা মরেছে মরেছিল অবৈধ বিদেশীদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময়। ফলে তাদের সুবিচারের দাবি আরেকটু নড়বড়ে হয়ে যায় বইকি। দিল্লী বা গুজরাটের মৃতদের ঠিকঠাক ধর্ম ছিল না, কিন্তু তারা যে ভারতীয় নাগরিক, অনুপ্রবেশকারী নয় এই নিয়ে সন্দেহের বিশেষ অবকাশ নেই। তৃতীয়ত, হত্যাকান্ড ঘটেছে এক প্রান্তিক প্রদেশে, ভারতীয় মূলভূমি থেকে অনেক দূরে। তাই আমাদের জাতীয় যৌথ বিস্মৃতি ঘণ হয়ে ওঠে। সংক্ষেপে, নেলীর কথা কেউ শোনে না। একটি হত্যাকান্ডের পরোক্ষ বৈধতার জন্য যখন আগের একটিকে খাড়া করা হয়, নেলীর নাম তখনো আসে না। কেননা নেলীর মধ্যে পরবর্তী কোনো হত্যাকান্ডকে বৈধতা দেওয়ার মূল্যটুকু নেই। দেশের যৌথ স্মৃতির কাছে নেলী ঘটেইনি।
কাউকে যদি নেলীর অশরীরীরা আজও জ্বালিয়ে থাকে তারা মনেহয় রাজ্যের বামমহল। নেলী তথা আসাম আন্দোলনের পরে রাজ্যে বামদলগুলো অবস্থা ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়েছে। একটি তথ্য দিলে ব্যাপারটা পরিস্কার হবে। ১৯৭৮ সালে বিধানসভা নির্বাচনে সিপিআই মোট ভোটের ৪.৩% পায়, ১২৬-র বিধানসভায় ৫টি আসন। সিপিএম পায় ৫.৬% ভোট, ১১টি আসন। বামদলগুলো ক্রমে শক্তিশালী হয়ে উঠছিল। আসাম আন্দোলন শুরু হল ১৯৭৯ সালে। তারপর থেকে বামদলগুলোর ক্রমে শক্তিহানি হয়েছে। সাম্প্রতিকতম ২০১১-এর ভোটে সিপিআই ও সিপিএম পেয়েছে যথাক্রমে ০.৫২% ও ১.১৩% ভোট। যদি সাবেক বামদলগুলোর থেকে চোখ ফেরাই নতুন বাম দলগুলোর দিকে, তারাও দাঁত ফোটাতে পারছে না। শোনা যায় মাওবাদীরা উজানি আসামে বিশেষত চা উপজাতিদের মধ্যে সংগঠন তৈরি করছে। তবে এর মধ্যে কতটা সত্যতা আছে তা সন্দেহের। সম্প্রতি চারজন মাওবাদী ক্যাডারকে এনকাউন্টারে মারা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর মতে এতে প্রমাণ হয় মাওবাদীরা আসামে সক্রিয়। তবে ওই এনকাউন্টার আদৌ সত্যিকারের না ভুয়ো, লোকগুলো আদৌ মাওবাদী কিনা এইসব প্রশ্ন উঠেছে। (২)
১৯৮৩ সালে নেলীতে তথাকথিত বহিরাগতদের সাথে আর কী ধ্বংস করা হয়েছিল? বামদলগুলো আগের মত জনসমর্থন আর কেন আকর্ষণ করতে পারছে না? যদি এই প্রশ্নের জবাব না পাওয়া যায় আসামে বাম আন্দোলন কখনো শক্ত জমি খুঁজে পাবে বলে মনে হয় না।
নেলীর মত ঘটনা কেন বিশ্লেষণ করা জটিল, ফলে চটজলদি রাজনৈতিক অবস্থান নেওয়া দুরূহ, তার উত্তর সম্ভবত এই যে বহু রাজনৈতিক, সামাজিক প্রবাহের তার এরকম ঘটনার সাথে জড়িয়ে থাকে। অনেকে মন্তব্য করেছেন জাতিসত্তার লড়াইয়ের ক্ষেত্রে সাবেক বামদলগুলোর অবস্থানে অস্পষ্টতা রয়েছে । অস্পষ্টতার কি কোনো বৈধ কারণ আছে? নেলীকে ভাবতে গেলে কী ধরনের জটিলতার সন্মুখীন হতে হয় এক এক করে খতিয়ে দেখে নেওয়া যাক।
প্রথমত, নেলীর হতাহতরা বেশিরভাগ চাষি বা খেতমজুর। সাধারণভাবে, এ বিষয়ে খুব সন্দেহ নেই যে আসাম আন্দোলনের বেশিরভাগ “বহিরাগত” হতাহতদের রোজগার তাদের শ্রমের থেকে আসত। মূলত অদক্ষ (unskilled) শ্রম। বাম রাজনীতির প্রথম নীতি বলছে যে এদের জীবন ও জীবিকার প্রতি সমর্থন থাকা উচিত।
দ্বিতীয়ত, হতে পারে নেলীর অনেকে বাংলাদেশ বা পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রব্রজন করেছিলেন । অর্থাৎ দেশের সীমা লঙ্ঘণ করেছিলেন। এখানে উল্লেখ্য যে বাম দলগুলোর দস্তাবেজে রাষ্ট্রের ভৌগোলিক অখন্ডতা ও সীমাকে প্রধান গুরুত্ব দেওয়া হয়। (৩) তাহলে কী দাঁড়াল? শ্রমজীবী মানুষের জীবন ও জীবিকার অধিকারের প্রতি সমর্থনের প্রশ্ন তাদের দেশের বৈধ নাগরিক হওয়ার প্রশ্নের সাথে মিশে সামান্য জটিল রূপ ধারণ করল।
তৃতীয়ত, আন্দোলনকারীদের বক্তব্য কী? তারা নিজেদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে চাইছে। উত্তরপূর্বের বিভিন্ন জাতি উপজাতিগুলো যে বিভিন্ন ধরনের শোষণের শিকার এতে অনেকে একমত হবেন। অত্যাচার কখনো আর্থিক শোষণের রূপ নেয়, কখনো প্রাকৃতিক সম্পদ লুটের, কখনো রাষ্ট্রীয় দমনের। বামদলগুলোর দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেখলে প্রব্রজনী শ্রমিকের অধিকার রক্ষার প্রশ্ন আরো জটিলতা ধারণ করছে কেননা প্রব্রজন জাতীয়তাবাদী স্বার্থের প্রতিকূলে কাজ করে। কখনো স্থানীয় অধিবাসীরা ও প্রব্রজকরা একই প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর অধিকার কায়েম করতে চায়। সেরকম বিবাদের মীমাংসা সুদূরপরাহত মনে হতে পারে।
চতুর্থত, জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম অনেক সময় বিচ্ছিন্নতাবাদী রূপ নেয়। এই রাজনৈতিক ভাষ্যে সাম্রাজ্যবাদী ভারতীয় রাষ্ট্রের কাছে উত্তরপূর্ব একটি উপনিবেশ যার ভারতের কাছে উপযোগিতা আর্থিক বা সামরিক কারণে। স্থানীয় গোষ্ঠীগুলোর প্রকৃত আর্থিক বা সামাজিক উন্নয়ন হতে পারে তখনই যদি তারা ভারতের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এখন স্মরণ করুন যে সাবেক বাম দলগুলোর কাছে ভারতীয় রাষ্ট্রের সীমারেখা কিন্তু পাক। জাতিসত্তার অধিকার খুব ভাল কথা কিন্তু তাকে সাংবিধানিক পরিসীমার মধ্যে নমনীয় করে নিতে হবে। জাতিসত্তার অধিকারের আন্দোলনের দিক থেকে দেখলে বামপন্থীদের এই অবস্থান তাদের সন্দেহজনক করে তোলে। অনেক বামপন্থী সমর্থককে আসাম আন্দোলনের সময়ে ভারত সরকার চর হওয়ার অপবাদ সহ্য করতে হয়েছিল। এর একটা কারণ বামদলগুলো ১৯৮৩-র ভোটে অংশগ্রহণ করেছিল। কিন্তু আরেকটি প্রচ্ছন্ন কারণ হয়তো এই যে বামপন্থীরা সেরকম জাতিসত্তা আন্দোলনের কল্পনা করতে অক্ষম, বা নারাজ, যা ম্যাপের গন্ডির ভেতরে বাঁধা থাকে না।
শেষ করার আগে এক জোড়া স্পষ্টীকরণ দিয়ে রাখি। প্রথমত, উত্তরপূর্বের রাজনীতির আবর্তের জটিলতা নিরশন করা এই নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধটির উদ্দেশ্য ছিল না। উদ্দেশ্য ছিল অন্তত কয়েকটি জটিলতা বোঝা। জটিলতাগুলোর মধ্যে আছে শ্রমজীবীদের আন্তর্জাতিক প্রব্রজন, জাতীয়তাবাদী আন্দোলন , আত্মরক্ষার স্বার্থে রাষ্ট্রের ক্ষমতার খেলা, তার সাথে পুঁজির জোয়ার-ভাঁটা, ধর্ম, ভাষা, এথনিসিটির বিভিন্ন মাত্রা ইত্যাদি। প্রাথমিকভাবে মনে হয়, জাতিসত্তার লড়াইকে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের আতশ কাঁচ দিয়ে দেখা বামদলগুলোর পক্ষে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছে। দেশের সীমানাকে অলঙ্ঘনীয়তার মর্যাদা দিয়ে বামপন্থীরা নিজেদের জাতিসত্ত্বার লড়াই ও প্রব্রজক শ্রমিক দুই পক্ষ থেকেই দূরে সরিয়ে নিয়েছে।
দ্বিতীয়ত, প্রবন্ধে প্রব্রজন ও উত্তরপূর্ব নিয়ে আলোচনা হয়েছে। প্রব্রজন কিন্তু উত্তরপূর্বের সব রাজ্যে তত বড় বিষয় নয় যতটা আসামে। আসামেও দেখা যাচ্ছে গত কয়েক দশকে জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার কমছে। বর্তমানে আসামের হার সারা ভারতের বৃদ্ধির হারের থেকে সামান্য কম। এর থেকে হয়তো বলা যায় প্রব্রজন কমে আসছে । তবে মনে রাখা ভাল যে ১৯৮০-র দশকের প্রথমার্ধে রাজ্য রাজনীতি একটা বড় পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছে যা বাম রাজনীতির কোমর ভেঙে দিয়েছে। যে সামাজিক-রাজনৈতিক ইস্যুগুলোকে ব্যবহার করা যেত রাষ্ট্রের শোষক চরিত্রকে তুলে ধরতে সেগুলো বিভিন্ন পরিচয়বাহী রাজনীতির (identity politics) দলগুলো কবজা করে নিয়েছে। নেলীর সেই হাজারকয়েক চাষি ও খেতমজুর, যাদের লাশ বাম রাজনৈতিক ভাষ্য এই তিরিশ বছরে ছোঁয়নি, আসামের সমাজকে নতুনভাবে ও সততার সাথে বোঝার চেষ্টা করে বামপন্থীরা তাদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতে পারে।
(কৃতজ্ঞতাঃ ইন্ডিয়া টুডে ম্যাগাজ়িনের একটি পুরনো সংখ্যার ছবির স্ক্যান ব্যবহার করা হয়েছে। অশোক প্রসাদের কয়েকটি প্রশ্নের জন্য ধন্যবাদ জানাই। প্রবন্ধটি প্রথমে ইংরিজিতে বেরিয়েছিলঃ http://sanhati.com/excerpted/5221/)
তথ্যসূত্রঃ
Anju Azad and Diganta Sharma (2009) “Nellie 1983” TwoCirclesNet, February 18, http://twocircles.net/special_reports/nellie_1983.html
Sanjib Baruah (1986) “Immigration, Ethnic Conflict, and Political Turmoil – Assam, 1979-1985,” Asian Survey, Vol. 26, No. 11 (November, 1986), pp. 1184-1206.
Teresa Rehman (2006) “The Horror’s Nagging Shadow” Tehelka, September 30 http://www.tehelka.com/story_main19.asp?filename=Ne093006the_horrors.asp
Myron Weiner (1983) “The Political Demography of Assam’s Anti-Immigrant Movement,” Population and Development Review, Vol. 9, No. 2 (June, 1983), pp. 279-292.
ফুটনোটঃ
1. http://twocircles.net/2009feb20/who_responsible_nellie_massacre.html
2. http://sanhati.com/articles/5054/, http://sanhati.com/articles/5062/
3. আসামের পরিপ্রেক্ষিতে সাবেক বামদলগুলোর ব্যর্থতা অধ্যাপক হীরেন গোঁহাই এই সাক্ষাৎকারে আলোচনা করেছেনঃ http://sanhati.com/excerpted/2208/