কিছুদিন আগে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে সোনি সোরিকে নিয়ে একটা প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিলো। সোনি বস্তার জেলার দান্তেওয়াড়ার একজন আদিবাসী মহিলা। ছত্তিশগড়ের বস্তার জেলার এই দান্তেওয়াড়া খবরে বহুবার এসেছে। মাওবাদী আর ভারতীয় আরক্ষা বিভাগের সংঘর্ষের জের এই এলাকাতেই সবচেয়ে বেশি পড়েছে। সোনি প্রায় একবছর ধরে জেলে আছেন, জেলের ভেতরে ওঁর ওপর অকথ্য নির্যাতনও করা হয়েছে। কিন্তু ঠিক কোন অপরাধে ওঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তা একবারও খতিয়ে দেখা হয়নি। আরক্ষাবিভাগ ওঁর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ এনে চার্জশীট তৈরী করেছিলো তার সত্যতা কেউই যাচাই করেনি। সোনির স্বামী ফুটানি আর তুতো ভাই লিঙ্গরাম কোদোপীকেও জেলে দেওয়া হয়েছে। লিঙ্গরাম একজন আদিবাসী সাংবাদিক, দিল্লি থেকে জার্নালিজম এর ডিগ্রী করেছেন। ফুটানি ও লিঙ্গ নাকি অভ্দেশ গৌতম বলে কারুর বাড়িতে চড়াও হয়ে হাঙ্গামা করেছিলেন বলে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঘটনাটা নিয়ে ছত্তিশগড়ে অনেক তোলপাড় হয়েছে। কিন্তু কে এই অভ্দেশ গৌতম? আর কেনই বা এই মামলা এত গুরুত্বপূর্ণ?
অভ্দেশ কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত একজন কন্ট্র্যাক্টর। আদতে তিনি উত্তরভারতের লোক, তবে এখন দান্তেওয়াড়ায় এসে থিতু হয়েছেন। সামাজিক আর আর্থিক দিক দিয়ে অভ্দেশ রীতিমত প্রভাবশালী। কিন্তু এই অঞ্চলের স্থানীয় লোকদের সাথে ওঁর সম্পর্কটা খুব একটা ভালো নয়। এর পেছনে কয়েকটা কারণ রয়েছে। প্রথমতঃ অভ্দেশ এখানে এসেই স্থানীয় রাজনীতিকদের ওপর প্রভাব খাটিয়ে এখানকার 'পাব্লিক ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম'এর কলকাঠি নিজের হাতে তুলে নেবার চেষ্টা করেছেন। এমনকি এই ব্যবস্থাও করেছেন যাতে ঐ এলাকার সমস্ত র্যাশন শুধু ওঁর বাড়ির কাছের একটা কেন্দ্র থেকেই সরবরাহ করা হবে। কোথায় কতখানি র্যাশন পাঠানো হবে তাও ওঁরই হাতে থাকবে। স্বভাবতই এতে স্থানীয় লোকেরা খুশি হননি। এই ব্যবস্থার মধ্যে অনেক খানি দুর্নীতি আছে বলেই তাঁদের মনে হয়েছে। দ্বিতীয়ত নিজে 'উঁচু জাত'এর বলে অভ্দেশ নীচুজাতীয় সব আদিবাসীদের দূরে সরিয়ে রাখতে চেয়েছেন। সেটাও সম্পর্ক ভালো না হবার একটা বড় কারণ।
২০১০ সালের এক রাত্রে অভ্দেশের বাড়িতে নকশালরা হানা দিয়েছিলো। হতে পারে এই খারাপ সম্পর্কের জেরেই ঘটনাটা ঘটে। সেরাত্রে অভ্দেশ ও তাঁর দেহরক্ষীদের সাথে হানাদারদের জোর লড়াই হয়, সারা রাত ধরে অনেক গোলাগুলি চলে। অভ্দেশ, তাঁর স্ত্রী, ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে বাড়ির একদিকে লুকিয়ে পড়েন কিন্তু গুলির লড়াইয়ে ওঁর শ্যালক আর একজন কাজের লোক মারা যান।
পরদিন অভ্দেশ থানায় এফ আই আর লেখান। গতরাত্রের হামলায় জড়িত থাকতে পারে এমন লোকেদের নামের একটা তালিকাও উনি পুলিশকে দিয়েছিলেন। তাতে সাতষট্টি জন আদিবাসীর নাম ছিলো। পুলিশকে অভ্দেশ জানান যে গুলির লড়াইয়ের সময় এই লোকগুলির মুখ দেখে উনি চিনতে পেরেছিলেন। তালিকার সবকটি নামই স্থানীয় আদিবাসী রাজনীতির সক্রিয় যুবসভ্যদের।
পুলিশের কাছে অভ্দেশ গৌতমের স্ত্রী, মেয়ে, ছেলে ও আরেকজন কাজের লোক আলাদা আলাদা ভাবে ঐ তালিকার লোকগুলির নামই জানিয়ে আসে। সোনি সোরি ও তাঁর স্বামীর নামও তার মধ্যে ছিলো। সত্যি বলতে কি, যে কেউই ওখানকার সরকারী 'মাথা'দের কখনো বিরাগভাজন হয়েছেন সেই সবার নামই ঐ তালিকায় ছিলো। এমনকি তিনজন এমন লোকের নামও ছিলো যাঁরা সেরাত্রে জেলে ছিলেন, কোনোভাবেই ঐ হামলায় সশরীরে উপস্থিত থাকা তাঁদের পক্ষে সম্ভব ছিলোনা। অবশ্য লিঙ্গ কোদোপীর নামে কোনো এফ আই আর করা হয়নি। দান্তেওয়াড়ার পুলিশ কর্তা এস আর পি কাল্লুরি পরের দিন প্রেস কনফারেন্স ডেকে জানান যে ছত্তিশগড় পুলিশ এতদিনে 'মাওবাদীদের মাথা'কে খুঁজে বার করেছে --তার নাম লিঙ্গরাম কোদোপী। উনি এও বলেন কিছুদিন আগে 'আজাদ' নামে যে দুর্ধর্ষ মাওবাদী নেতা মারা গেলেন তাঁরই উত্তরসুরী এই লিঙ্গ কোদোপী। শুধু তাই নয়, মাওপন্থী লোকজন যেমন হিমাংশু কুমার, মেধা পাটকর, অরুন্ধতী রায়, নন্দিনী সুন্দর ইত্যাদির সাথে কোদোপীর রীতিমতো যোগাযোগ আছে। ছত্তিশগড় পুলিশ দিল্লি গিয়ে কোদোপীকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দান্তেওয়াড়ায় নিয়ে আসবে বলে পুলিশকর্তা জানান। ঐ সময়ে লিঙ্গরাম দিল্লির কাছে নয়ডায় থেকে জার্নালিজম পড়ছিলেন।
দিল্লিতে এই নিয়ে আপত্তির ঝড় ওঠে। সেখানে এক সাংবাদিক সন্মেলনে এই ধরণের ভিত্তিহীণ, জঘন্য অভিযোগের বিরুদ্ধে অনেকেই সোচ্চার হয়ে ওঠেন। প্রশান্ত ভূষণও এই সন্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। স্বামী অগ্নিবেশ সবার সামনে বলেন যে তিনি এর বিরোধিতা তো করবেনই, যেকোনো উপায়ে লিঙ্গকে গ্রেপ্তার হওয়া থেকেও রক্ষা করার চেষ্টা করবেন। এমন গুরুতর অভিযোগে বিচলিত লিঙ্গ নিজেও সন্মেলনে ছিলেন। তিনি ন্যায়বিচারের জন্য আবেদন জানান। দিল্লিতে এতখানি শোরগোল হওয়ায় ছত্তিশগড় পুলিশ অবশ্য এসে ওঁকে গ্রেপ্তার করতে সাহস করেনি। ছত্তিশগড়ের ডিজিপি সাংবাদিকদের প্রশ্নের ঝড়ের মুখে স্বীকার করেছিলেন যে লিঙ্গর বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তার কোনো প্রমাণ ওঁদের কাছে সত্যিই নেই। এই নিয়ে তখনও ওঁরা অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছেন বলেই উনি জানান।
অবশ্য ঐ সাতষট্টি জন আদিবাসীর নামে যে অভিযোগ আনা হয়েছিলো তা পুলিশ বদলায়নি। সোনি সোরির স্বামীকে পুলিশ তুলে নিয়ে যায়। উনি যে ভাড়ার গাড়ি চালাতেন সেটাও বাজেয়াপ্ত করে। পরে সোনিকে পুলিশ একটা ঘরে পুরো একদিন আটকে রেখে প্রচুর অত্যাচার করে এবং জোর জবরদস্তি করে ওঁকে দিয়ে স্বীকার করাতে চায় যে লিঙ্গরাম মাওবাদীদের সাথে যুক্ত। এইভাবে চাপ দিয়ে ওঁকে একটি কাগজে সই করিয়ে নেওয়া হয় যাতে এই সমস্ত স্বীকারোক্তি লেখা ছিলো। তাতে আরো ছিলো যে লিঙ্গ অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে সন্ত্রাসবাদী শিক্ষা নিয়েছেন। মুক্তি পাবার পরে পরেই সোনি তেহেলকার নেওয়া সাক্ষাতকারে খোলাখুলি ভাবে জানান যে কিভাবে জোর খাটিয়ে ওঁকে দিয়ে এই স্বীকারোক্তিতে সই করানো হয়েছে। ছত্তিশগড় সরকার অবশ্য ঐ জোর করে আদায় করা স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে লিঙ্গকে গ্রেপ্তার করার আদেশ দিতে পারেননি। কিন্তু সোনি ও লিঙ্গর ওপরে পুলিশ কড়া নজর রাখতে শুরু করে।
এর মধ্যেই আবার মাওবাদীরা দান্তেওয়াড়ায় সোনির বাবা মায়ের বাড়িতে হামলা করে। লিঙ্গর ঠাকুরদাদার বাড়িতেও চড়াও হয়ে তাঁর পায়ে গুলি করে। ওঁদের সবাইকে মাওবাদীরা শাসিয়ে যায় যে আগামী তিনবছরের মধ্যে ওঁরা কোনো চাষ-আবাদ করতে পারবেন না। অন্যদিকে, অভ্দেশ গৌতমের আনা সমস্ত অভিযোগই বজায় থাকে। অভ্দেশের মেয়েকে মাওবাদী হানার মধ্যে দারুণ সাহস দেখানোর জন্য 'রাষ্ট্রপতির সাহসিকতা পদক' দেওয়া হয়।
এরপরই ঘটলো কালুরির নেতৃত্বে মোরাপল্লী আর তিম্মাপুরম গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা। পুড়ে গেলো তিনশো ঘর, মারা গেলেন কিছু মানুষ, ধর্ষিতাও কয়েকজনে। খুব চেঁচামিচি হোলো মিডিয়ায়, রমন সিং বাধ্য হলেন ঐ সব গ্রামে আসতে, বিলালেন কিছু সাহায্য সামগ্রী (তা, সে-ও, তিনি চলে গেলেই স্থানীয় পুলিশে আবার কেড়েকুড়ে নেয়)।স্বামী অগ্নিবেশ একটি এইড কনভয় নিয়ে যেতে গেলে কোনটা-সুখমা রোডে তাকে আটকে দেয় কর্তাম সুরাইয়া (সে-ও আবার খুব রহস্যজনক ভাবে খুন হয়ে যায় এর কিছুদিন পরেই)। খবর শুনে দিল্লি থেকে ছুটে আসেন লিঙ্গরাম, সেই সব গ্রামে গিয়ে তুলে আনেন প্রত্যক্ষদর্শীর ভিডিও আর সেগুলো তুলে দেন ইন্টারনেটে। এর পর পরই পুলিশ এসে লিঙ্গকে গ্রেফতার করে তার ঠাকুর্দার বাড়ী থেকে, মানে সোনি সোরির বাড়ী থেকে।
লিঙ্গরামের গ্রেফতারের সময় সেখানে সোনি সোরি উপস্থিত ছিলেন। তিনি জানতে চান কারা এই পুলিশ যারা লিঙ্গকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে কিন্তু তারা কোনো উত্তর দেয় নি বা এটাও জানায় নি যে লিঙ্গকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সোনি সারা সন্ধ্যা ও রাত্রে লিঙ্গকে খুঁজতে ব্যস্ত থাকেন, এমন কি স্থানীয় পুলিশ থানাতেও যান। সেখানেই জানতে পারেন লিঙ্গকে স্থানীয় পুলিশ ধরে নিয়ে যায় নি। এর পরের দিনে সোনি খবর পান দান্তেওয়ারা পুলিশ স্টেশনে লিঙ্গকে ধরে রাখা হয়েছে আর সোনিকেও গ্রেফতার করতে পুলিশ শিগগিরই আসবে। এটা শুনে সোনি পালাতে চেষ্টা করেন কিন্তু সিজি ফোর্সের গুলিতে আহত হয়ে পড়েন জঙ্গলের মধ্যে। যা হোক, ঐ ভাবেই তিনি কোনোক্রমে দিল্লি পৌঁছন। পুলিশ তাঁর খোঁজ পেয়ে ঐ দিল্লি থেকেই তাঁকে অ্যারেস্ট করে।
আর তারপরে সোনি সোরির কপালে কী ঘটেছিল, সে তো আমরা সকলেই জানি।
লিঙ্গকে এস্সার মামলার একজন আসামী হিসেবে দেখায় পুলিশ, এ ছাড়াও তাকে অভদেশ গৌতম মামলাতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়(যদিও সেই ঘটনাটি ঘটেছিল প্রায় এক বছর আগে)। চার্জশীট যখন দাখিল করা হল তখন বোঝা গেল যে সাক্ষ্য প্রমাণের উপর নির্ভর করে লিঙ্গের বিরুদ্ধে মামলা আনা হয়েছে সেটি একটি টাইপ করা কাগজ যেটাতে নাকি অভ্দেশ গৌতমের সই রয়েছে। তো, ঐ বয়ানে লেখা আছে তার বাড়ীতে হামলা হবার কিছুদিন পরে তিনি নাকি "শুনতে" পান যে কিছু পার্টিকর্মী, যারা আরো দূরের গাঁয়ে থাকে, তারাও নাকি কোথাও শুনেছে যে ঐ হামলার মুল মাথা ছিল লিঙ্গ। এবং এই লিঙ্গই নাকি হবে মাও পার্টীর ভবিষ্যত মুখপাত্র। শুধুমাত্র এই একটিই "প্রমাণ" রয়েছে পুলিশের কাছে। একটি টাইপ করা কাগজ। এবং সেটি যদি জেনুইন বলেই ধরে নেওয়া যায়, তাহলেও একেবারেই কোনো মামলায় ফাঁসানোর জন্য গ্রাহ্য হতেই পারে না। কারন খালি একটা "গুজবে"র কথাই বলা হয়েছে এতে।
এই অভদেশ গৌতমের মামলা নিয়ে একটু খুঁটিয়ে জানতে গেলেই এটা স্পষ্টই বোঝা যায় যে পুলিশ শুধু আদিবাসীদের প্রতিবাদকে বুজিয়ে রাখার বাহানাই খোঁজে। অন্যায়ের বিচার করা ও দোষীকে শাস্তি দেওয়াটা নয়, উদ্দেশ্য শুধু আদিবাসীদের কণ্ঠস্বর যেন বাইরে না পৌঁছয় সেটা বহাল রাখা।
অনুবাদঃ কৃষ্ণকলি রায়, দীপ্তেন