সিদ্ধার্থ মিত্র গত সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে ছত্রিশগড়ের দান্তেওয়াড়া গিয়েছিলেন, সালওয়া জুডুমের অত্যাচারে গ্রামছাড়া হওয়া মানুষদের গ্রামে ফিরে আসার পর সেই গ্রামগুলোকে সরেজমিনে দেখতে। ফিরে এসে তিনি লেখেন,
"An account of the trip to rehabilitated villages near Dantewada".
বাংলায় অনুবাদ করেছেন শমীক সরকার ও কৃষ্ণকলি রায়।
-----------------------------------------------------------------
বললাম "ছোপ'।
আসলে দাগগুলোর কথা বলতে চাইছিলাম, কিন্তু "ছোপ' বললেই সহজে বোঝানো যাবে মনে হল।
ও খুব নির্বিকার ভাবে বলে দিল ""এ তো চায়ের দাগ''। খুব একটা ভেবেচিন্তে বলল বলে মনে হয় না। তাও ভাল অন্তত উত্তরের শেষে একটা "হুজুর' জুড়ে দেয়নি।
আমার ঠিক বিশ্বাস হল না। বললাম ও তা। ও আর কোন কথা না বলে চাদরটা তুলে নিয়ে চলে গেল। মনে হয় পাল্টাতেই নিয়ে গেল।
এই একটু আগেই আমি "মধুবন' হোটেলে এসে উঠেছি। দান্তেওয়াড়ায় থাকার এই একটাই মাত্র জায়গা আছে। হোটেলে যখন পৌঁছলাম তখন বেশ সন্ধ্যে হয়ে গেছে। আমরা জয়পুর বলে একটা শহর থেকে ড্রাইভ করে এসেছি। সে এখান থেকে প্রায় একশো কিলোমিটার দূরে। ওখানে আমরা কাল রাত্রে ছিলাম। দান্তেওয়াড়ায় পৌঁছে আমি প্রথমেই "বনবাসী চেতনা আশ্রমে' (ভিসিএ) গেছিলাম। এঁরা এখানকার আদি অধিবাসীদের নিয়ে কাজ করছেন। সমাজ সেবার কাজ। এই আশ্রমই এখন হিমাংশু ভার্মার বাড়িঘর। এখানের সবাই ওঁকে হিমাংশুজী বলে। এই কদিন আগে তো আশ্রমের সতেরো বছরের পুরোনো বাড়িটা পুরো ধ্বসে গেছিল। এখন হিমাংশুজী'র বাড়ির উঠোনে ছাদ লাগিয়ে অস্থায়ী তাঁবু ফেলে আশ্রমের নতুন চত্বর হয়েছে।
তারপরে গেলাম "মুন্দের' বলে একটা গোন্ডী গ্রামে। বছর খানেক আগে এখানে পুনর্বাসনের কাজ হয়েছে। কয়েক বছর আগে সালওয়া জুডুমের অত্যাচারে গ্রামের লোক সব পালিয়ে গেছিলেন, গত বছর আবার ওনারা ফিরে এসেছেন। ভিসিএ তে ফিরে আসার পরে হিমাংশুজী আর ওঁর স্ত্রী বীনার সাথে রাত্রের খাবার খেলাম। ওঁরা অনেক বার করে ওঁদের বাড়িতেই থেকে যেতে বলছিলেন । কিন্ত আমি হোটেলেই চলে এলাম। পরের দিন "লিঙ্গগিরি' বলে আরেকটা পুনর্বাসিত গ্রাম দেখতে যাব ঠিক করেছি। দেড়শো কিলোমিটার দূরে সেটি। কোপা কুঞ্জম বলে একজন ভিসিএ কর্মী আমার সাথে মুন্দেরে গেছিল। সে বলল যে সকাল সকাল বেরোতে হবে। ও আমাকে সাড়ে ছটায় তুলে নেবে।
হোটেলে দেখি বিছানার চাদর দাগে ভর্তি। এই নিয়েই ছেলেটাকে বলছিলাম। ওইই মনে হয় এ ঘরের বেয়ারার কাজ করে। তা সে খানিক পরে নতুন চাদর এনে দিল। এতেও প্রচুর দাগ, অন্য প্যাটার্ণের যদিও। দেখে মনে হচ্ছিলো যেন "রোরশাক টেস্ট'! তবে এ নিয়ে আর তর্কাতর্কি করে কোন লাভ হবে বলে মনে হল না। আমি ভাবলাম "দুত্তোর যা আছে আছে, শুয়ে তো পড়ি'। নতুন চাদর পেতে শুয়েই পড়লাম। বেয়ারাটি চলে গেল।
তো এই হলো "মধুবন' হোটেল। দান্তেওয়াড়ায় রাত কাটাতে হলে এখানেই থাকতে হবে। থাকতে হবে। হ্যাঁ, থাকার একটা জায়গা তো বটে? একটা ঘর, মাথার ওপরে ছাদ বিছানা, এমনকি ফ্যানও আছে। জঙ্গলের মধ্যে কিম্বা একটা ত্রিপলের ছাউনী খাটিয়ে থাকার থেকে তো অনেক ভাল। এই একই রাত আজ ঐ ভাবেই কাটাতে হচ্ছে হাজার হাজার মানুষকে, এই এখানেই। তাহলে আমি কোন মুখে নালিশ করব?
অবশ্য ঐ চাদরের ছোপ ছাপের জন্যে ঘুমের কোন অসুবিধে হয়নি। হল, মশার জন্যে। ঘরের জানলায় জাল লাগানো ছিল। কিন্তু আলো নেভাতেই কোথা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে মশা এসে জুটলো। কয়েক ঘন্টা ধরে মশা মারতে মারতেই একটু ঘুমোতে চেষ্টা করলাম। শেষটা সে আশা ত্যাগ করতে হল। হাল ছেড়ে দিয়ে আলো জ্বালিয়ে হিমাংশুজী যে "রেডসান' ব'লে বইটা দিয়েছিলেন সেই নিয়ে বসলাম।
রাত্রে পড়ব বলে যখন বইটা হিমাংশুজী'র থেকে ধার নিই, উনি হাসতে হাসতে বলেছিলেন "দেখবেন, কাল যেন আবার কেউ আপনার হাতে এই বই না দেখে'। "আরে না না', আমি ওনাকে আশ্বাস দিলাম। আজকাল রাজনীতির যা বাজার, নকশালপন্থা নিয়ে আলোচনা করলেই আপনাকে দাগী নকশাল বলে লোকে সন্দেহ করবে। এই বইটা অবশ্য শুধু নকশাল আন্দোলনের বিবর্তন কেমন করে হলো সেই নিয়ে লেখা। দিল্লীর একজন সাংবাদিক, সুদীপ চক্রবর্তী লিখেছেন। কিন্তু এ বই আপনার হাতে দেখলেও অনেকেই ভুরু কোঁচকাবেন। বিশেষ করে যে সব এলাকায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সেখানে এই বই নিয়ে ঘোরাফেরা করা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
বইটা খুব ইন্টারেস্টিং লাগছিল। নকশাল আন্দোলনের শুরু থেকে ২০০৭ সালে যখন বইটা বেরোলো তখন অব্দি কী রকম ভাবে কী হয়েছে সেই নিয়ে লেখা। আমাদের প্রধানমন্ত্রী আর গৃহমন্ত্রী দুজনেই কিছুদিন আগে বলেছেন যে আজ অব্দি দেশকে যত রকম সিকিউরিটি থ্রেটের সামনে পড়তে হয়েছে তার মধ্যে নকশাল আন্দোলন সবচেয়ে বড়। বইয়ের প্রথম অধ্যায়টাই ছত্তিশগড় নিয়ে, বিশেষ করে এই দান্তেওয়াড়া নিয়েই, যেখানে হানাহানি হয়েছে সবচেয়ে বেশি।
নকশাল আন্দোলনের শুরু হয়েছিলো ষাটের দশকে। গরিব, সর্বহারা, ভূমিহীন মানুষরা এই সশস্ত্র আন্দোলনকে শক্তি জুগিয়েছিল। অবশ্য অনেক বুদ্ধিজীবি মানুষও এই আন্দোলনে নেমে তাদের জন্য লড়েছিলেন। আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিলো গরিবদের সাহায্য করার জন্য ধনী জমিদারদের কাছ থেকে জমি ছিনিয়ে নিতে হবে; দরকার হলে এমনকী এই "শ্রেণীশত্রু'দের খুনও করতে হবে। এর শুরু হয়েছিলো পশ্চিমবঙ্গের নকশালবাড়ীতে (সেখান থেকেই আন্দোলনের নামটা এসেছে), তারপরে অন্যান্য রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ল। অন্ধ্রপ্রদেশে, পাঞ্জাবে। খুব তাড়াতাড়ি এটা একটা হিংসাত্মক আন্দোলন হয়ে দাঁড়িয়েছিল, পরে একে ভয়াবহ ভাবে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। বাংলায় বহু নকশালকে অত্যাচার করে মেরে ফেলা হয়, তার মধ্যে বুদ্ধিজীবিরাও ছিলেন। এর পরে নকশালরা চলে যান পূর্বভারতের জঙ্গল এলাকায়, সেখান থেকে আবার ছড়িয়ে পড়েন বিহার, উড়িষ্যয়,ঝাড়খণ্ডে, দক্ষিণে অন্ধ্রপ্রদেশে। ওঁদের দাবী এখনও ওঁরা গরিব, দলিতদের জন্যই লড়ছেন। অবশ্য এখন জঙ্গলের ছোট ছোট এলাকায় বিচ্ছিন্ন ভাবে আন্দোলনটা চলছে। এঁদের কর্মসূচীতে স্থানীয় বনজ- সম্পদের ব্যবসা কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে তাও আছে। সেভাবে দেখতে গেলে এই সব অঞ্চলের গরিব লোকেরা এঁদের সমর্থনই করেন। কিন্তু আবার কেউ এঁদের মত না মানলে, বাধা দিতে গেলে তাঁদের ওপরে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছে, অত্যাচার হয়েছে এমন নজিরও দেখা গেছে।
যে এলাকাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভারতের সেই অংশগুলোকে মনে হয় সরকার স্বাধীনতার পরে পঞ্চাশ বছর অব্দি ভুলেই গেছিলেন। দলিতরা, নীচু জাতির লোকেরা, আদিবাসীরা ভারতের মোট জনসংখ্যা¡র প্রায় ২৫ ভাগ, কিন্তু ভারতের মূল জনসমাজে এদের কোনভাবে মিশতে দেওয়া হয়না। দলিতদের যাও বা কয়েকজন প্রতিনিধি আছেন, আদিবাসীদের তো তাও নেই।
কখনো সখনো ভারত সরকার জঙ্গল থেকে নকশালদের খেদিয়ে বার করতে চেষ্টা করেন। অন্ধ্রপ্রদেশে তো একবার সাধারণ মানুষদের অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে এর জন্যে তৈরী করা হয়েছিল, একটা দল গড়া হয়েছিল, তার নাম গ্রে-হাউন্ড। কিছু কিছু জায়গায় গ্রে-হাউন্ড সাফল্য পেয়েছিল কিন্তু বেশির ভাগ নকশাল ঘাঁটির কোন ক্ষতি কেউ করতে পারেনি।
কিন্তু গত কয়েক বছরে হানাহানি ভয়ানক ভাবে বেড়ে গেছে। নকশাল আন্দোলন ও খুব শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। পূর্ব-ভারতের বন অঞ্চলে এখন সব মিলিয়ে প্রায় ৫০,০০০ সশস্ত্র নকশাল আছেন। বছরের পর বছর ধরে সরকারী উপেক্ষা আর উদাসীনতা গরীব মানুষকে আজ এইখানে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তার ওপরে নানা রকম উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য যে এই সব এলাকার ক্ষতি হচ্ছিল তার প্রতিবাদও আছে। এখন বিভিন্ন নকশাল দলগুলো এক হয়ে গরিব মানুষদের ওপর এই যে অন্যায্য ঘটনা ঘটছে তার প্রতিকার করার উদ্দেশ্য নিয়ে নেমেছেন।
"রেডসান' বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে লেখক খুব বিস্তারিত লিখেছেন দান্তেওয়াড়ায় ওঁর নিজের অভিজ্ঞতার কথা। এই দান্তেওয়াড়া তো হিংসাত্মক কার্যকলাপের নতুন কেন্দ্রস্থল। এই রকম প্রচণ্ড উগ্রতার একটা কারণ হলো সালওয়া জুডুমের ক্রিয়াকলাপ। আগে যে গ্রে-হাউন্ড আন্দোলনের কথা বললাম, সেরকমই একটা আন্দোলনকে মদত দেবার জন্য ছত্তিশগড়ে তৈরী হয় এই সালওয়া জুডুম।
গত বছরে এই কার্যকলাপের জেরে চৌষট্টিটা গ্রামের প্রায় তিন লাখ মানুষ বাস্তুহারা হয়েছেন। এর মধ্যে চল্লিশ হাজার এখন থাকছেন উদ্বাস্তু ক্যাম্পে, আর বাকিদের জন্য তো কোথাও জায়গাই নেই। এর মধ্যে কয়েকটা ক্যাম্পের অবস্থা খুবই ভয়ানক। সেগুলো সালওয়া জুডুমের তৈরী।
লেখক সালওয়া জুডুমের ক্যাম্পে ওঁর অভিজ্ঞতার কথা, স্থানীয় পুলিশের সাথে আলোচনার কথা লিখেছেন। সালওয়া জুডুমের বিশেষ পুলিশের কথাও লিখেছেন। এঁরা আসলে সাধারণ মানুষ, এঁদের অস্ত্রশস্ত্র দেওয়া হয়েছে, মানুষ মারার লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে, আর সাথে দেওয়া হয়েছে ঐ বিশেষ পদের তকমা।
সালওয়া জুডুমের সন্ত্রাস আজ সারা এলাকায় ছেয়ে গেছে। নকশালদের ঘাঁটি ধ্বংস করার বদলে বরং জুডুম নকশাল আন্দোলনকে আরো জোরদার করে তুলেছে। দিনের আলোয় দু পক্ষ থেকেই গুলি গোলা চলছে, নকশালরা পুলিশের ওপর, মিলিটারির ওপরে হামলা করেছে। আইইডি দিয়ে গাড়ি উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কিছু কিছু রাস্তায় চলাফেরা করা এখন খুবই বিপজ্জনক।
সুদীপ চক্রবর্তী লিখেছেন ""খুব মরিয়া হলেই তবে কেউ আজকাল দান্তেওয়াড়া থেকে সরাসরি পশ্চিমে বিজাপুর যাবার পথ ধরেন''। এই রাস্তা দিয়েই তো কাল আমাদের যাবার কথা। মরিয়া? হ্যাঁ, তা মশার চোটে মরিয়া আমি হয়েছি বই কি। দু চারটে কফির কাপ ছুঁড়ে ভেঙে দেবার মত মরিয়া। কিন্তু এ মরিয়া ঠিক ঐরকম নয়!
লেখক বেশ বর্ণনা দিয়েছেন কিভাবে ঐ রাস্তায় নকশালরা আইইডি দিয়ে প্রচুর গাড়ি উড়িয়ে দিয়েছে। বেশির ভাগই মিলিটারিদের গাড়ি, তবে কয়েকটাতে সাধারণ মানুষরাও ছিলেন। পরে অবশ্য নকশালরা আম মানুষের গাড়ি ওড়ানোর জন্য ক্ষমা চেয়ে প্রতিবেদন পাঠিয়েছে। কিন্তু তাতে তো আর যারা গেছে তারা ফিরে আসবেনা?
খাটের ওপর এদিক ওদিক একটু গড়িয়ে দেখার চেষ্টা করলাম যে আমি কতটা ভারী। আমরা দুজন আর বাইকটা, এতটা কি ওজন হবে যে আইইডির ওপর পড়লে উড়ে যাবে? ঐ রাস্তায় হয়তো এমনিতেই আইইডি থাকবে, তার লক্ষ্য আমরা হই বা না হই। কী জানি রে বাবা! মনে কোনদিক থেকেই ঠিক ভরসা পেলাম না।
এরপরে আর কেমন যেন বইটা পড়ার আর উৎসাহ রইলনা। বন্ধ করে এক পাশে রেখে দিলাম। আলো নিভিয়ে ভাবলাম আরেকবার ঘুমের চেষ্টা করেই দেখা যাক। কিন্তু মনটা চঞ্চল হয়ে ছিল। আজ যা যা দেখেছি সেই সব কথা মনে পড়ছিল। মুন্দের। গোন্ড গ্রাম মুন্দের। বিকেলে যেখানে গেছিলাম। আপাত শান্তির মরুদ্যানের মধ্যে কী ভয়ানক সন্ত্রাস!
আমরা ঠিক করলাম গাড়িতে যাব, কোপা বলেছিল গাড়িতে বেশিরভাগটাই যাওয়া যাবে। যদিও পরে দেখেছিলাম, সেটা ঠিক না। রাস্তার প্রথম অংশটা গাড়িতে যাবার যোগ্য, পাথর আর মাটি দিয়ে ঠাসা। সদ্য বৃষ্টি চারপাশের নিসর্গের সৌন্দর্যকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। নিরক্ষীয় বনানী উপচে পড়ছে সবুজে। টলটলে জলের ধারা বয়ে যাচ্ছে রাস্তার মাঝ দিয়ে, নীচ দিয়ে। মিলিয়ে যাচ্ছে কোথায়। কিছুক্ষণ পরেই আমরা পেরিয়ে গেলাম একটা ঘন জঙ্গল। তারপর এল চাষজমি। করাল চিহ্নের মতো ছেয়ে থাকা বাইলাডিলা পর্বতমালা তৈরি করেছে যার পটভূমি। বাইলাডিলা কথার অর্থ ষাঁড়ের কুঁজ। পর্বতশ্রেণীটির চূড়াগুলো ওরকমই দেখতে, আর তাই এই নাম। এই পর্বতশ্রেণীটি, যার মুখ ঢেকে আছে দণ্ডকারণ্য অরণ্যের অংশ, বছরের পর বছর ধরে পালনপোষণ করেছে গোন্ডী উপজাতিদের। এই পাহাড়ের গায়ে বা পাদদেশে থেকেছে তারা। পাহাড়ের গা দিয়ে নেমে এসেছে অনেক নদী, জলের ধারা। আশ্রয় পেয়েছে বন্য জন্তু জানোয়ার, যাদের শিকার করে খাবার সংগ্রহ করেছে স্থানীয় গোন্ডীরা। আর আছে বিবিধ গাছ পালা, জীব, আছে ভেষজ গাছড়া।
দূরে বায়লাডিলা পাহাড়
কিন্তু এই পাহাড় এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে আশেপাশে বসতি করা মানুষের কাছে এক অভিশাপের মতো। কারণ বাইলাডিলা কোনও সাধারণ পাহাড়শ্রেণী নয়। পাহাড়ে চোদ্দটি জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে লৌহ আকরিক, যার পরিমাণ দাঁড়াবে মোট তিরিশ হাজার লক্ষ টন। যার মধ্যে বারো হাজার লক্ষ টন "উচ্চ শ্রেণীর'। এনএমডিসি-র খনি কর্তাদের মতে, বাইলাডিলা বিশ্বের লোহা আকরিকের বাজারে একটা নাম, এর উচ্চ শ্রেণীর কারণে। এখানকার আকরিকে লোহার পরিমাণ ৬৬ শতাংশ, গন্ধক বা অন্য কোনও বেজাতের মিশেল নেই, স্টিল তৈরিতে এর জুড়ি মেলা ভার। আর এখানে থাকে মূলত গোন্ডীরা, ভারতের পূবের দিকের জঙ্গলেই যাদের আদি বাস। বাইলাডিলা যে জেলায়, সেই বস্তার-এ আদিবাসী জনসংখ্যা ৭০ শতাংশ, যা ভারতের আদিবাসী জনঘনত্বে বেশ উপরের দিকে। এই বাইলাডিলার লোহার আকরিক এখানকার গোন্ডীরা ব্যবহার করে যুগ যুগ ধরে, তাদের সুন্দর সুন্দর ধাতব কারুশিল্পে। আজ ভারতের বৃহত্তম খনি কোম্পানিগুলির নজর পড়েছে এই আকরিকে। আজ অনেক বছর ধরেই এখানে খনন হচ্ছে, কিন্তু পড়ে আছে অনেক এখনো, আরো ৩০-৪০ বছরের মতো। ন'য়ের দশকের শেষাশেষি ভারত সরকারের ন্যাশনাল মিনারেল ডেভেলপমেন্ট কমিশন বা এনএমডিসি-র ভেঙে পড়ার সাথে সাথেই প্রাইভেট মাইনিং কোম্পানিগুলির সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়েছে। আর ২০০০ সালে তৈরি হওয়া ছত্রিশগড় সরকারের আকর্ষণীয় প্রস্তাবের লোভে তারা হাজিরও হয়ে গেছে চটজলদি। ২০০৫ সালের জুন মাসে টাটা স্টীল ছত্রিশগড় সরকারের সাথে একটা মেমোরান্ডাম অফ আন্ডারস্ট্যান্ডিং সই করে। টাটা স্টীলের প্রকল্পটি দশ হাজার কোটি টাকার, যা প্রাথমিকভাবে ২০ লক্ষ টন এবং তারপর ৩০ লক্ষ টন লোহা তুলতে সক্ষম। এর এক মাসের মধ্যে ছত্রিশগড় সরকার এসার গ্রুপের সাথে আর একটি চুক্তি সাক্ষর করে, যার জেরে এই কর্পোরেটটি প্রথমে ১৬ লক্ষ টন ও তারপর ৩২ লক্ষ টন লোহা তুলতে সক্ষম হবে। বেশিরভাগ লোহার আকরিকই ধুয়ে এখান থেকে পাইপে করে পাঠানো হবে বিশাখাপত্তনম-এ। সেখান থেকে অর্ধেক যাবে জাহাজে করে জাপানে। এর জন্য ২৬৭ কিমি লম্বা পাইপলাইন এখনই আছে বাইলাডিলা ও বিশাখাপত্তনম-এর মধ্যে, যা বোধহয় বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম। অবশ্যই এই আকরিকের ধোয়ার ফলে পরিবেশের ওপর প্রভাব পড়বে। বস্তার জেলার দুটি নদী, শঙ্খিনী এবং দঙ্খিনীর তামাটে লাল জল এই ধরনের মাইনিং-এর পরিবেশগত কুপ্রভাবের প্রমাণ।
গন্ডি গোষ্ঠীর তৈরী ধাতুর শিল্প
কিন্তু এই পরিবেশের ক্ষতি এখানকার মাইনিং বাদশাদের মূল চিন্তার বিষয় নয়। যতদিন এখানে নকশালরা সক্রিয় আছে, আর যতদিন এখানকার ভূমিপুত্ররা সম্ভÁ¡ব্য মাইনিং ক্ষেত্র তাদের আবাসভূমি ছেড়ে চলে না যাচ্ছে, ততদিন এই খননকার্য এগোবে না। আইন মোতাবেক, যাদের সরাসরি উচ্ছেদ হতে হবে জমি থেকে সেই গ্রামবাসীদের কাছ থেকে সম্মতি পেলে তবেই অঞ্চলটি মাইনিং কোম্পানিগুলির হাতে ছাড়া যাবে। কিন্তু চাষিদের মধ্যে বিক্ষোভ, এবং গ্রামবাসীদের মধ্যে থেকে এই সম্মতি না মেলার আশঙ্কায় রাষ্ট্র তড়িঘড়ি মাঠে নেমে পড়ে। টাটা স্টিলের জন্য জমি অধিগ্রহণের জনশুনানি পরিণত হয় প্রহসনে। শুনানিতে যাওয়ার জন্য গ্রামবাসীরা যখন জড়ো হচ্ছিল, সালওয়া জুডুম তাদের ভয় দেখায়, আর দান্তেওয়ারা পুলিশ জনশুনানিতে আসার পথে ব্যারিকেড করে, আসা আটকানোর জন্য। এমতাবস্থায় জনশুনানিতে গ্রামবাসীদের বক্তব্য বড়ো একটা শোনা যায়নি। কিন্তু নকশাল সমস্যাটি আলাদা রকমের। ওখানে দুটি রাস্তা আছে নকশাল বিতাড়ণের। ওখানে দীর্ঘমেয়াদীভাবে উন্নয়নমূলক কর্মসূচী নেওয়া, যা দা¢রদ্র দূর করবে (দেখতে গেলে যা কিনা এই নকশাল আন্দোলনও চায়)। আর অন্যটা হলো "ভিয়েতনামের কায়দা'। গ্রামবাসীদের এবং উপজাতিদের নির্দিষ্ট কিছু ক্যাম্পে সরিয়ে দাও এবং জমিতে এবং আকাশ থেকে তীব্র সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়ে জঙ্গল থেকে মাওবাদীদের বের করে দাও। মৌ-এর ফাঁস গলায় আটকে ছত্রিশগড় সরকার নিল এই দ্বিতীয় পথটাকে। জন্ম নিল সালওয়া জুডুম (গোন্ডী ভাষায় যার অর্থ "পরিশুদ্ধিকরণ'), সশস্ত্র নজরদারী গোষ্ঠী, নকশালদের সাথে লড়াই করার জন্য। বেশির ভাগ জুডুম সদস্যই স্থানীয় উপজাতি এবং দলিত। কিন্তু এর নেতারা সব স্থানীয় শহরের ব্যবসায়ীরা, যারা বেশ মুশকিলে পড়েছিল জঙ্গলের জিনিস নকশালদের কব্জায় থাকায়। তৈরি হবার পর থেকেই এই জুডুমের সদস্যরা মিলিটারি এবং স্থানীয় পুলিশ সাথে নিয়ে গ্রামকে গ্রাম ঘুরে ঘুরে গ্রামবাসীদের ক্যাম্পে তাড়িয়ে নিয়ে যেতে লাগলো। গ্রামবাসীরা ছাড়তে চায়নি তাদের পূর্বপুরুষের বসত, কিন্তু তারা আর কিই বা করতে পারতো। জুডুম রা মুন্দেরে এসেছিল বছর চারেক আগে। তার পরেই গ্রামবাসীরা পালায়। তারপর আস্তে আস্তে হিংসা একটু কমলে, এবং সুপ্রিম কোর্ট সরকারকে সমস্ত গ্রামবাসীদের গ্রামে ফেরানোর নির্দেশ দিলে বছর খানেক আগে তারা আবার গ্রামে ফেরে।
৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১০
(আগামী সংখ্যায় দ্বিতীয় কিস্তি)