একজন মহিলাকে দেখলাম। অন্যদের থেকে একটু দূরে দুই বাচ্চা নিয়ে উবু হয়ে বসেছিলেন। "কেমন আছেন?' আমি জিজ্ঞেস করলাম। হেসে বললেন "ভালো'। কী খুশির হাসি। "বাচ্চা গুলো খুব মিষ্টি তো'। "হ্যাঁ, এই হলো আদভি রামাডু', উনি ছেলেটাকে দেখিয়ে বললেন। আদভি রামাডু? নামটা চেনা চেনা লাগছিলো। তারপরেই মনে পড়ে গেলো। শুনেছিলাম বটে, একজন মহিলা পালিয়ে গেছিলেন লিঙ্গগিরি থেকে। বনের ভেতরে ওঁর বাচ্চাটা জন্মালো। কি যে কষ্টের সময়! বাচ্চাটাকে জড়াবার মত একটা কাপড়ও ছিলোনা এমনকী। সবাই শুনেছে, এখানকার কষ্ট আর দু:খের চরম গল্প।
ভেবেই শিউরে উঠছিলাম যে ওঁর কেমন লেগেছিল সেই সময়ে। ঘন জঙ্গলের ভেতরে ছায়াগুলো লম্বা হয়ে আসছিল। ভয়, ব্যথা, ক্লান্তি। কে জানে ওঁর স্বামী তখন পাশে ছিলেন কিনা? কিম্বা হয়তো সন্ত্রাস থেকে পালানো কোনো অন্য দলের সঙ্গে ছিলেন। হয়তো জানতেও পারেননি এমনটা ঘটছে। যদি একবার খবরটা স্বামীকে দিতেও পারতেন!
বয়স্কা মহিলাগণ জুড়ুমের অত্যাচারের বর্ণনা করছেন
দীপিকা পাড়ুকোনের মুখটা মনে পড়ল। আজকাল বড় বড় সাইনবোর্ডে দেখা যায়। দেশের সব চেয়ে জনপ্রিয় মডেল। সেলফোনে কি একটা এসেমেস দেখে খুশিতে হাসছেন। হয়তো কোন উপহারের খবর। টিফানি থেকে একটা ছোট্ট গয়না। কিম্বা গ্রীসের কোন দ্বীপে ছুটির নেমন্ত¹ন্ন। আমি ভাবছিলাম, আপ্পুর মায়ের যদি একটা সেলফোন থাকতো ....."ওগো, বেঁচে আছো নাকি? দেখোনা, এইমাত্র আমার ছেলে হলো। খুব রক্ত বেরিয়েছে বটে, তবে বেঁচে যাবে হয়তো। আমার ক্লান্ত লাগছে, তবে এমনি ঠিক আছি। আদর নিও'। কিউট, না?...... ভুলে গেছিলাম, উনি তো লিখতেই জানেন না। ভিসিএ'র মিটিংয়ে কতজন গেছিলো তার খাতায় উনি টিপসই দিয়েছিলেন। তারওপরে, দান্তেওয়াড়াতেই সেলফোন ভালো করে কাজ করেনা। আর এ তো সেখান থেকেও অনেক দূরে জঙ্গলের মধ্যে। বাচ্চাটা যেখানে জন্মেছিলো সেই গভীর জঙ্গলে কোনো সেলফোনই কাজ করবেনা। কাজেই থাকলেও তাতে এসেমেস পাঠানো যেতনা। কিন্তু অন্যভাবে ভাবলেই তো হয়। শিশুমৃত্যুর হার নাকি খুব বেশি আমাদের দেশে? কই? এ বাচ্চাটা তো বেঁচেই আছে। হুররে, আমাদের নতুন একজন নাগরিক হলো। তাহলে এই খুশিতে আমরা কমনওয়েল্থ গেমসের হোস্ট হতে পারিনা? কিম্বা অলিম্পিক হলে তো আরো ভালো হয়।
আমি একটা অন্তত ভালো কিছু বলতে চাইছিলাম। তাই বললাম "দেখে তো মনে হচ্ছে ভালই আছে'। উনি বললেন "হ্যাঁ, তা আছে।' কিন্তু মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলেন বলার সময়ে, মনে হলো আমার কথা বিশ্বাস হয়নি। সত্যিই, বাচ্চাটাকে দেখে মোটেই মনে হচ্ছিলো না যে ভালো আছে। ওর ছোট ভাই বরং সে তুলনায় অনেক হাসিখুশি, সুস্থ দেখতে। বড়টি, আদভি রামাডু কি রকম ফ্যালফ্যল করে তাকিয়ে রয়েছিল। মনে হচ্ছিল ওর বুদ্ধির ঠিকমতো বিকাশই হয়নি। ঠিক সময়ে ঠিকঠাক চিকিৎসা হলে, যত্ন পেলে হয়তো ও ভাল হয়ে যেত। কিন্তু কে দায়ী? ওর যদি সত্যিই ঠিক মতো সব কিছু না গড়ে উঠে থাকে তো তার জন্য কে দায়ী? তুমি? আমি? সরকার? জুডুম? না খনির কোম্পানী গুলো?
না:, ও শুধু ঘটনার শিকার। দেশের উন্নতির কাজে যারা বাধা দিচ্ছে তাদেরই অনেকের মতো, ও ও প্রগতির রাস্তায় এসে পড়েছিলো। সরকার যখন রাস্তা, হাসপাতাল, স্কুল,কারখানা বানাতে চাইছে এই ৫০,০০০ নকশাল তাতে এমন ভাবে বাধা দিচ্ছে তো এই সব হবেনা? সব জায়গা থেকে নকশালদের ঝেঁটিয়ে বার করে দিতে পারলে, আর সব মাইনিং কোম্পানীরা নিরুপদ্রবে কাজ করতে পারলেই তো আর এসব ঘটবে না। আরে ও তো বিখ্যাত হয়ে গেছে। ওর জন্মের সময়েই অকথ্য হিংসা আর সন্ত্রাস ওর ওপরে নিজেদের নাম সই করে দিয়েছে।
আদভি রামাডু, জঙ্গলের সন্তান
ফেরার সময় হয়ে আসছিল। এখানের লোকজন যা সময়ের মধ্যে দিয়ে গেছে তারপরেও ওদের মধ্যে উৎসাহ ছিলো দেখলাম। ওরা সামনের দিকে তাকাতে চাইছিল। তার চেয়েও বড় কথা, ওরা আমাদের ওপর আস্থা রে®খেছিল। আমরা যাবার সময়ে সবাই দল বেঁধে কোপার বাইকের চারপাশে এসে ঘিরে দাঁড়ালো। আমি একটু বক্তৃতা না দিয়ে পারলাম না --"কোনো ভয় নেই। আমরা তো আছি। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা তোমাদের পাশে দাঁড়াবো। যখনই যা অসুবিধে হবে আমাদের জানিও। আমরা সাহায্য করব।'
সত্যি কি আর পারব? জুডুম কিছুদিন আগেই হুমকি দিয়ে গেছে। ওরা অভিযোগ করেছিল, কিন্তু ঐ অব্দিই। কদিন আগে জুডুমের কোন একজনকে মাওবাদীরা ধরে নিয়ে গেছিল বলে ওরা এখানে খাবার দাবারও আসা আটকে দিয়েছিল। হিমাংশুজী আর কোপাকে প্রাণ বাঁচানোর জন্য অন্য রাস্তা দিয়ে অন্ধ্রপ্রদেশে পালিয়ে যেতে হয়েছিল। এখানে যদি আবার কিছু হয়, সাহায্য আসতে বহু সময় লেগে যাবে। জুডুম যদি কালই পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়, ওদের বাঁচাতে কেউ আসতেই পারবেনা, অনেকদিন অব্দি। আর সরকারের সহযোগীতা না পেলে এই পুনর্বাসনের কাজও চালানো যাবে না আর। তবে ঐ আর কি, আশা মরতে চায়না।
আপ্পুর মা ওঁর ঐ কষ্টের কথা বলার সময় জিজ্ঞেস করেছিলেন "আর এখানে হামলা হবে না তো?' এমিলি ডিকেনসনের কথা মনে পড়লো --"আশা হলো সেই জিনিষ যা আমাদের আত্মার ভেতরে থাকে'। সেই, তোমাদের আমি সত্যি করে হয়তো আর কিছুই দিতে পারবোনা, কিন্তু আশা দিতে তো পারবো?
সত্যি সত্যিই যদি এখানে আবার কিছু হয় তাহলে গ্রামের লোক আর পালিয়ে যাবেনা বুঝতে পারছিলাম। ওরা মনে মনে ঠিক করে নিয়েছে যে বরং তার থেকে মরা ভালো। এবারে হামলা হলে আর তিন চারজন নকশাল মরবে না, নকশাল মরবে শয়ে শয়ে।
উমি দেওয়াং, জুড়ুমের হাতে নিগৃহীত
আমরা যখন ফিরছিলাম তখন পাহাড় গুলোর পেছনে সূর্য্য ডুবছে। ফেরার পথে কিছু তেমন ঘটলনা। চেকপোস্টের সান্ত্রীরা দেখে হাঁফ ছাড়লো আমরা সন্ধ্যে হবার আগেই ফিরে যাচ্ছি। নাহলে ওদের ভয় ধরে যেতো, কীজানি আমরা আবার রাত্রে অন্ধকারে গ্রামের লোকদের মনে কুবুদ্ধি যোগাচ্ছি কিনা।
সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছিল বনবাসী চেতনা আশ্রমে ফিরতে। "দেখলেন?' হেসে বললেন হিমাংশুজী। আমি কেবল আমার মাথা নাড়াতে পারলাম। এখনো আমি যা দেখেছি, তা সামলে উঠতে পারি নি। এখানে আশ্রমের দাওয়া-তে কয়েকজন বসে আছে। একজন মহিলা, রঙচঙে শাড়ি পরে। তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে কয়েকজন। হিমাংশুজী আমাকে তাকে দেখতে বললেন। "ও গোরকা গ্রাম থেকে এসেছে। ওর কাপড় খুলে নেওয়া হয়েছিল, ধর্ষণ করতে যাচ্ছিল ওকে ওরা। এক মহিলা ওকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।' বলে যাচ্ছিলেন হিমাংশুজী,"ও এখন এখানে এসেছে কেস ফাইল করার জন্য।' "এটা কী করে হয়?' আমি বিশ্বাস করছিলাম না। "আপনি নিজেই ওকে জিজ্ঞেস করুন না।' হিমাংশুজীর অনুরোধে মহিলাটি আমার সামনে চেয়ারে এসে বসলো। হিমাংশুজী আমাকে বলে দিয়েছিলেন, মহিলাটি হিন্দি জানেন, তাই আমার আর দোভাষির দরকার হলো না। আমি তাকে তার গল্প বলতে বললাম। নাম উমি দেওয়াং। পরিষ্কার গলায় গল্প বলার সুরেলা ভঙ্গীতে, যা গোন্ডী ভাষার টানে আছে, সে আমাকে তার অভিজ্ঞতার কথা বলে গেল। ওরা একদিন অনেকে মিলে এসেছিল। সাথে ছিল সিআরপিএফ, মিলিটারি। সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওরা তাকে ঘিরে ফেলল। "ওরা আমার শাড়ি খুলে নিল। পেটিকোট খুলে নিল।' সে থামলো। তারপর বলে চললো, "আমার ম্যাডাম, যাকে আমি বিশ বছর ধরে চিনি, মাঝখানে এসে আমাকে বাঁচিয়ে দিল।' কোনও এক বয়স্কা মহিলা, নিজেকে উদ্যত লালসার ভিড়ের সামনে দাঁড় করিয়ে এই মহিলাকে ধর্ষণ এবং তারপর সম্ভাব্য খুনের হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। তিনি নিজেও মারা যেতে পারতেন। ভারতের সাহসিকতার পুরষ্কার দেওয়ার জন্য ঐ বয়স্কার চেয়ে যোগ্য কারোর কথা আমি আপাতত ভাবতে পারছি না। "তারপর কেস করা হয় নি? আইন কানুন বলে তো একটা ব্যাপার আছে। এতো খুব খারাপ!' আমি অসহায়ভাবে কিছু বলার চেষ্টা করলাম। "কিভাবে কেস করব? মিলিটারি আর পুলিশই তো জুডুমের সাথে ছিল।' "যারা গ্রাম আক্রমণ করল, তাদের কাছে কীভাবে বিচার চাইতে যাবে?' হিমাংশুজী ধরিয়ে দিলেন। "কিন্তু আইনের তো কিছু একটা করা উচিত।' আমি যুক্তি খুঁজতে চাইলাম, পেলাম না। আরো অনেক কিছুই তো হওয়া উচিত। এবং আরো অনেক কিছুই হওয়া উচিত নয়। যখন ছত্তিশগড় নিয়ে কথা বলেছিল যে কয়েকজন খ্যাতনামা অ্যাকাডেমিক, তাদের একজন নন্দিনী সুন্দর এই গোরকা গ্রামে গিয়েছিলেন, ফিরে এসে দেখেন, তার গাড়িটা ভাঙা হয়েছে আক্রমণ করে। ঐ গ্রামে যেতে গেলে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ২০ কিমি হেঁটে যেতে হয়, গাড়ি রেখে। এটাও তো হওয়ার কথা ছিল না, কিন্তু হয়েছে। "হ্যাঁ', হিমাংশুজী হাসলেন, "আমরা একটা এফআইআর করার চেষ্টা করছি, আমাদের এসপিও-র কাছে যেতে হবে, দীর্ঘ প্রক্রিয়া।' একদিন আমাদের আশা, আমরা কেসটা রেজিস্টার করতে পারব। আমরা এমনকি নির্দিষ্ট করে করে মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্তদের বিচারের সামনে জন্য বলছি। কেবল আশা, সরকারের লোকেরা মানুক, অবিচার হয়েছে। এর মধ্যে উমি যদি অভিযোগ না জানিয়ে ফেরত যায়, তাহলে ওর ঝুঁকি বাড়বে। এবার হয়ত ওকে বাঁচানোর জন্য কাউকে পাওয়া যাবে না।
এই কথাটা কোন্তায় যাঁদের ওপর ধর্ষণ হয়েছিলো তাঁদের জন্যও সত্যি। দেখেছিলাম গেটের ঠিক বাইরেই অস্থায়ী ক্যাম্পের খোলা তাঁবু গুলোতে ওঁদের জড়ো করা হয়েছে। হিমাংশুজী বললেন ওঁদের ছবি তোলাটা ঠিক হবেনা, একটু আব্রু রাখা উচিৎ । উনি আমাকে গিয়ে ওঁদের সাথে কথা বলতে বলেছিলেন। কিন্তু যাইনি। কি জিগ্যেস করবো, কি বা শুনবো আর কিই বা বলবো ........ভেবে পাচ্ছিলামনা।
সুপ্রীম কোর্ট এই ধর্ষণের কেসের শুনানি আবার মুলতুবি করে দিয়েছে। সেই থেকেই এঁদের এমনি বাইরে তাঁবুর মধ্যে থাকতে হচ্ছে। তবু এখন অন্তত বেঁচে তো আছেন? গ্রামে ফিরে গেলে হয়তো সেটুকুও আর থাকবেন না।
রাত্রে হিমাংশুজী প্রচুর খাওয়ালেন। তারপর হোটেলে ফিরে গেলাম। আমার সফরের এই শেষ। কাল ভোরবেলাতেই বাড়ি ফেরার জন্য বেরিয়ে পড়তে হবে।
পরের দিন আবার সেই অনেক খানি রাস্তা গাড়িয়ে চালিয়ে যেতে হবে। রাস্তায় একটা ঘটনা ঘটলো। ঘটনাটা ছোট, তবু না বলে পারছি না। আমরা যাচ্ছিলাম, একটা জীপ হঠাৎ রাস্তা পার হতে গিয়ে আমাদের এক্কেবারে সামনে এসে পড়লো! আমাদের ড্রাইভার খুব জোরে ব্রেক কষলেন, তাইতে এক চুলের জন্য গাড়িটা ধাক্কা খাওয়া থেকে বেঁচে গেলো। জীপটা নির্বিকার ভাবে ব্যাক করে একটা গলিতে ঢুকছিলো, সেখানেই দুটো রাস্তা কাটাকুটি হয়েছে। জীপ চালাচ্ছিলো যে তার বয়েস খুব কম, কুড়িও হবে না হয়তো। সে গলির একদিকের দেওয়ালে যাতে ধাক্কা না লাগে সেই নিয়েই ব্যস্ত। অন্য দিকটাতেও যে চোখ রাখতে হবে সেদিকে আর খেয়ালই নেই! দেশে আজ যা হচ্ছে এই ঘটনাটা তার একটা প্রতীক বলা চলে। একদিকে প্রগতি, অর্থনৈতিক উন্নতি, আকাশছোঁয়া বাড়ির সারি, বড় বড় শহর। অন্যদিকে নামহীণ, পরিচয়হীন ভারতের আশি শতাংশেরও বেশি লোক, যাঁরা দিনে আধ ডলারের কম আয়ে জীবন চালান। গরিব, প্রান্তবাসী মানুষ এঁরা। বনজ সম্পদে রীতিমতো সমৃদ্ধ অঞ্চলে থেকেও ।
ভারত সরকারের সমস্ত ধ্যানজ্ঞান এখন শুধু প্রগতি, সেনসেক্স আর জিডিপি'র দিকে। হ্যাঁ, দ্রুত এগোচ্ছে এগুলো, উন্নতির দিকে। কিন্তু এর ফলে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তাদের কথা সরকার একেবারেই ভুলে গেছেন।
মুন্ডার গ্রাম থেকে চলে আসার আগে কোপাকে ঘিরে গ্রামবাসী
কোনো অজ পাড়া গাঁয়ের একটা ব্যস্ত রাস্তা যদি একবার দেখো! কী নেই? মানুষ, গরু, মুর্গী, সব্জিওয়ালা, সাইকেল, খানাখন্দ! এই রাস্তায় কারুর সাথে ধাক্কা না খেয়ে, গর্তে না পড়ে গাড়ি চালানোটা একটা দুরূহ ব্যপার। কিন্তু এমনি রাস্তা দিয়েও খুব জোরেই গাড়ি যায়, ট্রাক যায়। রোজরোজ, অনেক মানুষ, জন্তু, বাচ্চাদের ধাক্কা খাবার ভয় থাকলেও যায়। এত গুলো প্রাণ, যেকোনো মুহুর্তেই চলে যাবার ভয়, তবু কিছু হয়না। এখানে জীবন এমনি ভাবেই চলতে থাকে, এলোমেলো, ক্লান্তিকর ভাবে। যেন কিছুতেই আসে যায়না কিছুই।
মাঝেমাঝে বেপরোয়া ড্রাইভাররা কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে ধাক্কা মারে। ভিড়ের মধ্যে গাড়ি ভিড়িয়ে দেয়। মানুষ, কুকুর, বেড়াল, ছাগল চাপা পড়ে। মাঝেমাঝে রাস্তার মাঝখানে দেখা যায় একটা বাচ্চার রক্তমাখা থ্যাঁতলানো শরীর পড়ে আছে। কিম্বা কোন একজন মানুষ, যার পায়ের ওপর দিয়ে এমন ভাবে গাড়ি চলে গেছে যে উঠে সরে যাবার আর তার ক্ষমতা নেই। পুলিশ আসে অনেক পরে। তবে পুলিশের জন্য অপেক্ষাও করেনা কেউ। নিজেরাই ব্যবস্থা করে নেয়। এরকম ঘটনা ঘটলে তার তিন রকম পরিণতি হতে পারে। কোনোটাই সুবিচার বলা যায়না। তবে এমনি পরিস্থিতিতে হয়তো আর কিছুই করার নেই।
হয় গাড়ি নিয়ে ড্রাইভার পালাইয়ে যায়। পালানোর জন্য আরো লোক চাপা দেয়, কিম্বা অন্ধের মত এখানে ওখানে ধাক্কা দিয়ে কোনমতে জান বাঁচিয়ে উধাও হয়ে যায়। তার থেকেও বেশি যা হয় তা হলো কোথা থেকে কে জানে এক ঝাঁক উন্মত্ত জনতা জড় হয়ে গিয়ে গাড়িটাকে ঘিরে ধরে। ড্রাইভার চেষ্টা করে প্রাণ নিয়ে পালাতে, গাড়ি ফেলে। নয়তো টুক করে ভিড়ের মধ্যে মিশে যায়। রাগী জনতা গাড়ি ভেঙেচুরে জ্বালিয়ে দেয়। আর নয়তো, যদি ড্রাইভার কোনো ভাবে পালাতে না পারে তো এই লোকগুলি ওর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। নির্বিচারে মেরেধরে শেষ করে দেয় লোকটাকে। পুলিশ যতক্ষণে আসে ততক্ষণে মানুষটা একটা রক্তমাখা মাংসের দলা হয়ে গেছে। আর গাড়ি ভাংচুর আর জ্বালানো তো থাকবেই।
ক'বছর আগে কলকাতার ঠিক বাইরে "সিঙ্গুর' বলে এক জায়গায় টাটা মোটর্স "ন্যানো' গাড়ির কারখানা খুলতে চেয়েছিল। বলা হয়েছিল যে এই ন্যানো হবে "জনতার গাড়ি'। কারণ এর দাম হবে ২০০০ ডলারের কম। মধ্যবিত্তের স্বপ্নের গাড়ি হবে ন্যানো, জানবাহনের জগতে নতুন দিগন্ত খুলে দেবে। কিন্তু কারখানা বানানোর জন্য যে জমি বাছা হয়েছিলো তা একেবারেই ঠিক নয়। এই জমিগুলো সব চাষের জমি, তিন-ফসলী উর্বর জমি। অনেক চাষীই জমি দিয়ে দিতে নারাজ ছিলেন। রাজ্যসরকার কারখানা বানানোর জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছিলেন। চাষেদের বলা হয়েছিলো ন্যায্য দাম ধরে দেওয়া হবে (তারপরে টাটার কাছে নামমাত্র দামে জমি বিক্রি করে দেবার কথা হয়েছিলো)। কিন্তু অনেক চাষী জমি আদৌ বিক্রি করতেই রাজী ছিলেন না।
এর প্রতিবাদে পুরো জায়গাটা উত্তাল হয়ে উঠেছিল। সরকার নিরস্ত্র গ্রামবাসীর ওপরে নিজেদের সব রকম শক্তি লেলিয়ে দিয়েছিলেন। শেষ অব্দি প্রতিবাদ আর বিক্ষোভ এত বেড়ে উঠলো যে টাটার কারখানা অন্য রাজ্যে চলে গেল। প্রায় ৮০ ভাগ কাজ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও সমস্ত যন্ত্রপাতি তুলে নিয়ে সেইখানে গিয়ে বসানো হলো।
কিন্তু তাদের এত খোঁড়াখুঁড়ি, নানা রকম দূষণের ফলে যে জমি পড়ে রইলো তাতে আর চাষবাস করাই যাবেনা কোনদিন। ওরা চলে গেলো, পেছনে রেখে গেলো অকেজো সব জমি, আর তাপসী মালিক নামে সাহসী সেই একুশ বছর বয়েসী মেয়েটির পোড়া মৃতদেহ, যে চাষীদের প্রতিবাদে গলা মিলিয়েছিলো। সেই জন্য তাকে নিষ্ঠুর ভাবে ধর্ষণ করে মেরে ফেলা হয়, আর এমন ভাবে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় যাতে লাশ সনাক্ত আর করার উপায় না থাকে। আরো পড়ে রইলো সেই সব জমির দালালরা, যারা ভেবেছিলো এই বেলা আশেপাশের জমি কিনে রাখলে কারখান হবার পর কেল্লা মেরে দেওয়া যাবে। এখন ওদের হাতে রইলো শুধু সেই সব জমি, যা কোনদিনই আর কাজে লাগবেনা।
কোপা আমার জন্য অপেক্ষা করছে
ভারতীয় প্রগতির দানবটা এখন অনেক দূরে ছত্তিশগড়ের জঙ্গলের মধ্যে যেখানে অনেক লোক থাকেন সেইখানে হাজির হয়েছে। বিস্ময়ে স্তব্ধ, হতবাক লোকগুলি এখন একটু একটু করে নিজেদের ভাঙাচোরা জীবনের টুকরো টাকরা গুলো কুড়িয়ে জড়ো করার চেষ্টা করছে। ওদের জীবনে হঠাৎ যে প্রচণ্ড ঝড় নেমে এসেছিল তার সাথে সমঝোতা করার চেষ্টা করছে।
এখন দেখাই যাক, কী হয়।
(সমাপ্ত)
(১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১০)