বেশিরভাগ লোক বাজারে গেছে। ক্যাম্প তাই প্রায় ফাঁকা। প্রসাদ ক্যাম্পে বসবাসকারী কয়েকজনকে জড়ো করে, তারা আমাদের তাদের গল্প শোনায়। বেশিরভাগ গল্পই প্রায় এক ধাঁচের। সালওয়া-জুডুমের হাত থেকে বাঁচতে তাদের এই পালিয়ে আসা। আমার পড়া সেইসব বিবরণের সাথে আদ্যন্ত মিলওয়ালা সব কাহিনি, পার্থক্য শুধু আমার পড়া রিপোর্টে ছিল লোকেদের নকশালের হিংসায় ঘর ছেড়ে পালিয়ে আসবার কাহিনি, এখানে আদতে সেটা সালওয়া-জুডুম। আমার সঙ্গে কথা বলা ক্যাম্পের প্রতিজনের কাহিনি অভিন্ন।
এই ক্যাম্পের লোকেরা বিভিন্ন গ্রাম থেকে এসেছে। মোটের উপর এটা কোনও গ্রাম নয় যেখানে যুগ যুগ ধরে গ্রামের প্রতিটা পরিবারের একে অপরের প্রতি সৌহার্দ্যের সম্পর্ক; একটা গ্রাম যেটা জীবন্ত প্রতিজন গ্রামবাসীর নিঃশ্বাসে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দময় চলমান দিনের গতিবিধিময় প্রতিচ্ছবি; এটা একটা ক্যাম্প। শরণার্থীদের আশ্রয়ের জন্য এই ক্যাম্প, এখানে মানুষ অপেক্ষা করে থাকে পুরাতন জীবনে ফিরে যাওয়ার, অথবা নতুন কোনও জীবন শুরু করার। এই সবের মাঝে দায়গ্রস্ত এরা শিখে নিয়েছে একে অপরের সাথে মিশে থাকার।
গ্রামের কাছাকাছি হওয়ার জন্য অন্তত এই ক্যাম্পের লোকজনের সম্ভাব্য ছুটকো কোনও কর্মসংস্থানের একটা উপায় ছিল। জঙ্গলের অন্তর্বর্তী ক্যাম্পগুলোর অধিবাসীদের সেই সুযোগ ছিল না।
এক দম্পতিকে দেখি যারা তাদের ঝুপড়ির পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি তাদের ডেকে নিই। কথা বলি তাদের সঙ্গে। জানতে পারি তাদের জীবন।
“তো আপ কেয়া করতে হ্যায়?” আমি জিজ্ঞেস করি।
“কুছ মজদুরি করতা হুঁ, ধান কাটনেকা – কাম মিলতা তো দিন মেঁ ষাট রুপয়া মিলতা হ্যায়”।
ষাট টাকা প্রতিদিন ন্যূনতম কামাই ১০০ টাকার নীচে। হু কেয়ারস! এইসব লোকেরা এমনিতেই “অবৈধ”।
“তো উস মেঁ খানে কো হো জাতা হ্যায়?” আমি জিজ্ঞেস করি।
“দিন মেঁ একবার খানা হোতা হ্যায় উস সে”, লোকটা উত্তর দেয়।
ঠিক তখুনি, জীন্স আর টি-শার্ট পরনে কেউ একজন বাজার থেকে হাতে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ নিয়ে আসে। মুখে একটা চওড়া হাসি নিয়ে সে বলে, দ্যাখো আমি কী এনেছি – “আদা, রসুন। মাত্র কুড়ি টাকা।”
দিনে ষাট টাকা এই পরিবারকে মাত্র একবেলার খাবার যোগায়। আর্থিক ফাটকাবাজি এবং আংশিক পরিবেশগত বদলের জন্য এবছর মূল্যবৃদ্ধির হারের রেকর্ড ১৭.৫%।
ওর কেনাকাটায় পেঁয়াজ ছিল না। বাজারের চাপে আর পশ্চিমঘাট পাহাড়ে অসময়ের বৃষ্টির কারণে পেঁয়াজের দাম আকাশছোঁয়া। ৮০ টাকা প্রতি কেজি দামের জন্য সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাই ভরসা শুধু আদা আর রসুনের উপর, অথবা শুকনো ফুল।
রান্নায় ব্যবহৃত ফুল
আর খাবারের পরে সঞ্চয়ের জন্য কি কিছু বাঁচে? কিছু ভালো কাজের দিনেও? হয়ত ১০ টাকা?
নিউ দিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধী ইন্টারল্যাশন্যাল এয়ারপোর্টে মেন হলঘরে রিয়্যাল এস্টেটের একটা বড় বিজ্ঞাপন চোখে পড়েছিল, দিল্লির বাইরে বাংলোর খরিদারি। বিজ্ঞাপনের কাট আউটে সাক্ষাৎ রাজকুমারের মত এক ভারতীয় ক্রিকেটার, দামি জামাকাপড় পরনে, সহাস্যে আপনার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। বাংলোর দাম শুরু সাড়ে আটচল্লিশ লাখ টাকা থেকে। আ গ্রেট বারগেইন! আর একটু বেশি দিলে রেডিয়াস কর্পোরেশন ইন্ডিয়া লিমিটেড-এর তৈরী বাঁশের ফ্লোরওয়ালা ইকো-ভিলা পেয়ে যাবেন। এই সেই রেডিয়াস কর্পোরেশন যারা ফ্লোরিং-এর কাজকর্মের জন্য ছত্তিসগড়ের শিউনাথ নদী কিনে নিয়েছে। ভারতবর্ষে শিউনাথই প্রথম ব্যক্তিমালিকানাধীন নদী। এই ক্রয়ের ফল হয় ভয়াবহ যা নদীর নিম্নগতিতে বসবাসকারী সম্প্রদায়গুলিকে একধাক্কায় শেষ করে দেয় কারণ তাদের আর এই নদী ব্যবহার করার অধিকার ছিল না।
বাদবাকি ভারতবর্ষ ছত্তিসগড়বাসীদের দেখতে না পেলেও ওই অঞ্চল থেকে আসা জিনিসপত্র নিশ্চিতভাবে ব্যবহার করে।
আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল, এই অর্দ্ধভুক্ত লোকটাকে যদি প্রতিদিন ১০ টাকা সঞ্চয় করে ওই বাংলোটা কিনতে হয়, বাংলো কেনার অনেক আগে শুধু ডাউন পেমেন্ট করার জন্য ওই লোকটাকে কয়েকশ বছর কাজ করতে হবে।
দুর্ভাগ্যবশতঃ, লোকটা ষাট বছরের বেশি বাঁচবে না। আমি এই ক্যাম্পের ডেমোগ্রাফি দেখেছি। আমি ভাবছিলাম, ষাট বছর এবং তার বেশি এই বয়ঃসীমার গ্রুপে লোকের সংখ্যা কেন এত কম! এই ক্যাম্পের ডেমোগ্রাফি বস্তারের জীবনযাত্রার মানের প্রত্যক্ষ প্রতিফলন।
ছত্তিসগড়ে কয়েক দশক কাটিয়ে যাওয়া মানবাধিকার সংস্থার সক্রিয় সদস্য ডাঃ বিনায়ক সেনের মত অনুসারে, আজকের দিনে দুটি স্বতন্ত্র ভারতবর্ষ বিদ্যমান। তার একটিতে মাত্রাহীন ধনী, আর অদূর পৃথিবীর অন্যটিতে চূড়ান্ত দারিদ্র, অনটন, অভাব। এই সেই ধনী ভারত যা অন্য অনুজ্জ্বল ভারত ও ভারতীয়ের নিজস্ব অধিকার এবং তার রসদের উপর সরাসরি নির্ভরশীল।
আশেপাশে আরও কিছু লোক জড়ো হয়েছিল। তাদের একজন আঙুল তুলে নিজের পিছনদিকে একটা ঝুপড়ির দিকে দেখাল। একজন মহিলা একলা থাকত সেখানে। একা মা। খাবারের জন্য নিরুপায় সে ওই পিছনের পাহাড়ের গায়ে জঙ্গলের মধ্যে যায়, যদি কিছু ফল এনে বাজারে বিক্রি করে কিছু টাকা পাওয়া যায়। এক টহলরত পুলিশের জীপ তাকে তুলে কোন্টা পুলিশ স্টেশনে নকশাল সন্দেহে একমাস আটক রাখে। ক্যাম্পের বাসিন্দাদের উপর্যুপরি অনুরোধে যে ওই মহিলাকে না ছাড়লে তার ছেলে না-খেয়ে মরে যাবে সেই শুনে এবং অবশেষে ওই মহিলার আসল পরিচয় জানতে পেরে পুলিশ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
সম্ভবত ওই মহিলাকে ল্যাপটপ বিষয়ে কোনও প্রশ্ন করা হয়নি। ঘটনা যাই হোক না কেন, জঙ্গলে কোনওরকম “বিজনেস” ছাড়া আপনি হয় নকশাল নইলে তাদের সমব্যথী। আপনি আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত কেউ, যিনি ওখানে অনেক প্রজন্ম বসবাস করছেন, সেটাও আপনার পক্ষে যথেষ্ট যুক্তিকর হবে না।
এর পরে আমাদের পরের গন্তব্য পরবর্তী ক্যাম্প, যেটা আসলে একটা খাদ্য সরবরাহ কেন্দ্র। প্রসাদ বললেন এটা একটা খাওয়ানোর জায়গা। যদি এই পর্যন্ত পড়ে আপনারা ভেবে থাকেন এখানে গোরু বা শূকর খাওয়ানো হয়, ভুল ভাবছেন। এখানে আদিবাসীদের খাওয়ানো হয়। অপুষ্টিতে ভোগা শিশু, গর্ভবতী মহিলা, স্তন্যদায়ী মা-দের এখানে দিনে একবেলা খাবার দেওয়া হয়।
IDPদের সাহায্য করার জন্য এবং ASDSএর মূল প্রয়াস হিসেবে গঠিত এই কেন্দ্রগুলো। এগুলো ছাড়া এইসব ক্যাম্পের অনেক মহিলা ও শিশু আজ বাঁচত না।
এই খাদ্যকেন্দ্রে বাচ্চাদের জন্য স্কুলের ব্যবস্থা রয়েছে। তেলুগু ভাষার প্রাথমিক শিক্ষা। আর ছিল কাপড় মেলার দড়ি থেকে ঝুলন্ত কাগজে আঁকা বাইরের পৃথিবীর ছবি।
একই সঙ্গে ঝুলছিল আর একটা চার্ট। বিশ্বের প্রতিনিধিদের। গান্ধী, প্রিন্স চার্লস, মাও সে তুং আর হিটলার। একসাথে সব্বাই। ক্যাম্পের অধিকাংশ মেম্বারই জানে না কে তাদের আদর্শবাদী লীডার। এদিকে ভারতবর্ষের আপামর উচ্চ ও মধ্যবিত্তশ্রেণী মনে করে আদিবাসী মাত্রেই মাওবাদী। অদৃষ্টের এ কী পরিহাস! আরও একটা চার্ট ছিল। বিভিন্ন ইলেকট্রিকাল অ্যাপ্লায়েন্সের ছবি তাতে। এদিকে ক্যাম্পে ইলেকট্রিসিটি নেই। বেশিরভাগ লোক কখনও বৈদ্যুতিক কোনও যন্ত্রাংশ চোখেই দেখেনি, আর আদৌ কোনওদিন দেখতে পাবে তারও আশা কম, ব্যবহার করা অনেক দূরের কথা। কেন তাদেরকে নিজেদের বসত থেকে উৎখাত করা হয়েছে, অন্তত সেটা দেখতে পাবে।
একদিকের দেওয়ালে একটা চার্ট ঝুলছিল। এই খাদ্যকেন্দ্রে যেই মহিলাদের সাহায্য করা হয়, এই চার্টে তাদের শারীরিক ওজন এবং উচ্চতার রেকর্ড রাখা। এমন একজনের নাম চোখে পড়ল – নামঃ মদকম মাসাইয়া; বয়সঃ ছাব্বিশ; ওজনঃ আটত্রিশ কেজি; অন্তঃস্বত্ত্বা।
আটত্রিশ কেজি? গর্ভবতী? বিএমআই কত, ১৫ কি ১৬?