নেটে লেখালেখিঃ
এ ভারী অদ্ভুত জায়গা।
জ্ঞান হওয়ার পর থেকে পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয় দিয়ে হাঁচোড়পাঁচোড় করে যা যা শিখে এসেছি সব কেমন বদলে যাচ্ছে। প্রথমবার ইস্কুলে গিয়ে মনে আছে প্রথম কয়েকজন যারা বন্ধু-টন্ধু হয়ে গেছিল তাদের সবার সঙ্গেই আলাপ হয়েছিল সম উৎকন্ঠাজনিত ভয় থেকে। তাতে শব্দ ছিল, স্পর্শ ছিল চেনা হয়েছিল চোখের দেখায়, কে জানে, হয়তো চেনা গন্ধও থেকে থাকবে বোধ হয়। সেই চেনা বেশ পোক্ত ছিল এই সম্যক ধারণা আমার হয় যখন তাদের সঙ্গে দেখা হয়। আজো।
একটা বয়সের পর মানুষ লম্বায় আর বাড়ে না। কেউ কেউ বহরে বেড়ে কমে থাকেন বটে, তাতে উচ্চতার কোনো হেরফের ঘটে না। সেখানে অ্যাঙ্গেল অফ ভিসন (দৃষ্টিকোণ কি ঠিক বাংলা? )একই থাকে বলেই বোধ হয় দৃষ্টিভঙ্গীও আর বদলায় না। বয়সজনিত অভিজ্ঞতার কারণে সেই দৃষ্টিভঙ্গীর প্রতি বিশ্বাস দৃঢ় হতে থাকে বেশিরভাগের ক্ষেত্রে। আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কমতে থাকে তার নতুন কিছু আত্মস্থ করার ক্ষমতা, যেটা কিনা অনুবাদিত হয় অনিচ্ছা হিসেবে। কিন্তু এর ব্যতিক্রমও আছে, সেটা আপাতত দেখব না। এর ফলে যেটা হয় সেটা আমি প্রত্যক্ষ করি, মানে “হাড়ে হাড়ে টের পাই” আর কি!
চারপাশের জীবন পালটে যাচ্ছে দ্রুত। বেশ কিছু বিশ্বাস বদলে নিয়েছে তাদের – যতটা পারে। নিজেকেও এর সঙ্গে তাল মেলানর জন্য ছুটতে হচ্ছে। পুরোন অভ্যাস কিছু ছাড়তে হয়েছে, নতুন অভ্যাস কিছু এসেছে কিন্তু তার সঙ্গে আর চট করে মেলাতে পারছি না – ওই যে নমনীয়তা কমে গেছে যে। চারপাশের পরিবেশে আর খুঁজে পাই না চেনা শব্দমালা তত বেশি – যতটা পেলে যথেষ্ট মনে করা যেত। তাই খোঁজা শুরু হয়। এসে পড়ি এই অন্য জগতে – এই লেখার শুরুর বাক্যটিতে – “এ ভারী অদ্ভুত জায়গা”।
শতরঞ্চি পেতে সেখানে জমজমাট আড্ডা চলছে – যারা খানিক আগেই পৌছেছে সেখানে। সেই সব চেনা গল্পগাছা সেই সব চেনা শব্দমালা – যাদের উচ্চারণের অবকাশ না পেয়ে হেদিয়ে যাচ্ছিলাম। “আরে দাদা”, “ওরে ভাই” বলে টলে জায়গা করে নি। সজ্জন মানুষজন সব। এ হেন অভাজন আশ্রয়প্রার্থীকেও অতিথির মর্যাদা দিয়ে হুঁকো কলকে এগিয়ে দেন। আড্ডায় দিনরাত রাজা উজির মারা পড়েন। আমরা সামান্য উলুখাগড়াগণ আস্ফালনে সাড়া ফেলে দি। ফাঁক ভরাট হতে থাকে আর তাতেই আরো কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়। আর তার পরেই দেখি সবই তো আগের মতোন – সেই একই রকম মানুষ – সেই একই রকম কথাবার্ত্তা – তবু কেমন যেন সুর কাটছে কোথাও – কিন্তু কেটে যাওয়া সুর তো আগে অনায়াসে মিলে যেত, এখানে তেমন ত হচ্ছে না, এটা কেন হল এইসব নানান প্রশ্ন ওঠে – এই লেখার প্রস্তাবনা হয়।
পাঁচের জায়গায় এক নিয়ে খেলা এইখানে। শুধু কয়েকটা অক্ষর দিয়ে সাজানো শব্দ – কিছু শব্দ বন্ধ করা বাক্য, ব্যস। ওতেই সব কিছু আঁটানো এইখানে। এই আগের দুটি বাক্য বুঝতে আমার কয়েক বছর গিয়েছে। এই লেখার ধৈর্যশীল পাঠককে আমি অনুরোধ করি এগিয়ে যেতে আর একটু।
এই নতুন জায়গাটা আমায় নিয়ে যায় প্রায় ইস্কুলের প্রথম দিনটাতে। আর সেই নিজের মনে করা নতুন পাওয়া বন্ধুদের নিয়ে মেতে উঠি ছোটবেলাকার মতো। তার থেকে শুরু হয়ে যায় প্রত্যাশা। আরো বেশির প্রত্যাশা। কিন্তু ফাঁক থেকে যাওয়ার কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখি প্রধান ফারাক ওই পাঁচের জায়গায় এক।
আগে মানুষ চিনেছে দেখে, তার কথা শুনে, তার বাচনভঙ্গী, তার ব্যক্তিত্ব এইসব পরখ করে। নিজেকে চিনিয়েছিও এইসব করে। তাতে কেউ বেশি চেনা হয়েছে কেউ কেউ হয়ে উঠেছে খুব কাছের কেউ কেউ বা অপঅরিহার্য। আর এখানে ওই দেখা, শোনা, বাচনভঙ্গীগত ধারণা নেওয়া, ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে অবহিত হওয়া শুধু তার লেখা কিছু শব্দ দিয়ে – কিছু শব্দ বন্ধ করা বাক্য নিয়ে এর বেশি কিছু জানা নেই। আমি, আমার নীতি, আমার বিশ্বাস, সেই বিশ্বাসের নমনীয়তা – এই পুরো আমিটা আমিও পুরে দিতে থাকি কিছু অক্ষরে – তার থেকে তৈরী হওয়া শব্দে, ব্যস।
এখন আমি সেখানে কতখানি লুকিয়ে রাখবো বা কাউকে চেনার সময়ে তার কোন শব্দকে কতটা প্রাধান্য দেব সেটা তো জানার উপায় নেই। আর সেইখান থেকে ফাঁক থেকে যাচ্ছে এইসব চেনাশোনায়। যখন প্রত্যাশা মিটছে না, নিজের বানানো ধারণা (যদিও জানি সেটা যথেষ্ট তথ্য নিয়ে পোক্ত হয় হয় নি) ভুল সেটা মেনে নিতেও অসুবিধা হচ্ছে তখন এক অক্ষম রাগ হতে থাকছে। ফাঁক বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাই বলে আমি তো এটা আর ছেড়ে দিয়ে নিজের খুপরিতে ফিরে যেতে পারিনা – তাই আলোচনা করি পরের অধ্যায়ের – বৈধতা ও এক্তিয়ার।
বৈধতা ও এক্তিয়ার
ইস্কুলের চেনা মানুষেরা বন্ধু থেকে আরো বন্ধু, প্রাণের বন্ধু অপরিহার্য হতে থাকে – সেই সময়টা পায় বলে। সেই চেনাটা থাকে সবকিছু দিয়ে – এমনকী তার আনা টিফিনে স্বাদু তরকারীটিও একটা ছোটো হলেও চরিত্রে পার্ট করে যায়। আর সেই খুব চেনা বৃত্তে আলোচিত হওয়া প্রসঙ্গ, তাতে উচ্চারিত শব্দাবলী সম্পুর্ণ আলাদা। তার সঙ্গে বাড়িতে কথা বলা শব্দের মিল কম, সেটা এমনকি জীবনসঙ্গীর সঙ্গে বলা কথার সাথেও মেলে না অনেল জায়গায়। আমি এই মানুষটা ত এক নই – সে কখনো অফিসের কাজ সামলে বাংলা লিখছে, কখনো ছেলের সঙ্গে খেলে যাচ্ছে গেমস একমনে। সে বাজার আনছে, গাড়ি চালিয়ে কাজে যাচ্ছে বা বেড়াতে। খেলা দেখতে যাচ্ছে কখনো বা। কখনো আবার খুব বেসামাল – ক’পাত্তর চড়িয়ে এবং ছড়িয়ে একশা।
আর এখানেই প্রশ্ন আসে অবস্থানজনিত বৈধতার। যে কথা আমি তোমাকে বলতে পারি একলা হলে সেই কথাই তোমাকে আর হাটের মাঝে বলা যায় না। ফোনে যা বলা যায় আর দেখা হলে যা বলা যায় তারাও আলাদা। এক বন্ধুর গোপন কথা আরেক বন্ধুকেও বলা যায় না সে যত কাছের হোক না কেন যদি তাতে সীলমোহর থাকে গোপনীয়তার।
এই বৈধতা নির্ধারণ করে কে? আমি। কেন করি? – না, যাতে আমার ব্যবহার কাউকে অহেতুক আহত না করে সেই দিক চেয়ে। শুধু এইটুকু? – হ্যাঁ, শুধু একটাই নীতি মানি, আর সেটা এইটাই।
তাহলে কি দাঁড়াল? আমি এক সামাজিক মানুষ। আমি সর্বজনসমক্ষে এমন কিছু করে বসব না বা কিছু বেফাঁস বলে বসব না, বা লিখে বসব না যাতে কেউ একজন হলেও আহত হতে পারে - বা প্রশ্ন উঠতে পারে আমার বড় হয়ে ওঠার পদ্ধতির প্রতি, বা আমার চেনা মানুষদের প্রতি।
কিন্তু এই ধারণা শিথিল হতে থাকবে ঘনিষ্ঠ সমাবেশে। সেখানে মন খুলে দেওয়া যাবে বেশি। শব্দচয়নেও খুব বেশি ভাবনা থাকবে না।
কিন্তু আমি না হয় এইসব ভাবলাম টাবলাম। বাকিরাও এ হেন প্রস্তাব মেনে না নিলে কী করব? সামাজিক উঠোনে আমাকে উদ্দেশ্য করা অবাঞ্ছিত শব্দাবলী এলে যতটুকু সম্ভব জানতে চেষ্টা করব এর কারণ। মেনে নিতে না পারলে প্রশ্ন তুলব আবার। হয়ত পৌছব কোথাও , হয়তো কোথাও নয়। তবু আমার দ্বারা কেউ যেন আহত না হয় সেই চেষ্টা থাকবে যতদূর সম্ভব।
এখন এই এজমালি উঠোনে বলা সব কথা আমায় উদ্দেশ্য করে নয়, আমার বলাও নয়, বলাই বাহুল্য। সেখানে উচ্চারিত কোনো শব্দপ্রয়োগ কাউকে আঘাত করলে – ঔচিত্যবোধ বলবে -বাপু হে, এগিয়ে যাও – প্রতিবাদ রাখো। কিন্তু তা তো করিনা বেশিরভাগ সময়ে। প্রতিবাদ খুব বেশি হয়ে ওঠে না, সেই অনীহার পিছনে এক লোভ থাকে। আমার আড্ডার মৌতাত নষ্ট হয়ে যায় যদি। আরো একটা ব্যাপার থাকে – সেটা হল যাকে বা যাদের উদ্দেশ্যে বলা কথা ভালো লাগেনি, তার হয়ে বলতে গেলে যদি তার মনে হয় তার বা তাদের ব্যক্তিসত্তাকে অহেতুক করুণা দেখাচ্ছি – যদিও এটা অযুহাত হিসেবে রাখা গেল এখানে।
এখানেই প্রশ্ন ওঠে এক্তিয়ারের।
সামাজিক কাঠামোয় চলাচল করতে গিয়ে আরো দু-একটা ব্যাপার আমরা শিখে যাই যে ঘেন্না বা বিদ্বেষমূলক শব্দ ব্যবহার এড়িয়ে চলাই বাঞ্ছনীয়। আর এটা যদি বা অবস্থানগত প্রেক্ষিতে কোনো ব্যক্তিবিশেষের প্রতি হয়ও বা (কারণ এগুলিও অভব্যক্তি বই ত নয়) কিন্তু কোনো ধর্ম, জাতি, সম্প্রদায়, লিঙ্গ, বা শারীরিক খুঁত সংক্রান্ত হওয়া তো নৈব নৈব চ।
আমাকে বা আমার গোষ্ঠীকে উদ্দেশ্য করা অবাঞ্ছিত (আমার হিসেবে) শব্দাবলীর প্রতি সহিষ্ণুতা বেশি রাখি খানিক। তাতে নিজেকে বা নিজেদের একবার ফিরে দেখা হয়ে যায় – সত্যিই ঠিক ছিলাম কী না। কিন্তু উল্টোটা হলে খারাপ লাগাটা বেড়ে যেতে থাকে। আমার বা আমাদের হয়ে বলা কথার ধার পরখ করি নিজের জিভে বসিয়ে।
এখন, এখানে তো আর কোনোও উপায় নেই, শুধু ওই বাক্যবন্ধ – তার থেকে চিনতে হবে বাচনভঙ্গী, বক্তার উদ্দেশ্য সবকিছু। আমি অনেক দূরে থাকা কাউকে ডাকতে চেঁচালাম “ এই যে শ্রীমান হরিশচন্দ্র...” - “আমি এখানে” - এইটা বলা হল হাত তুলে। কিন্তু ধরুণ হরিশচন্দ্রবাবু আমার সামনে দাঁড়িয়ে – তখন যদি “এই যে শ্রীমান হরিশচন্দ্র..” বলে উঠি তার মানে দাঁড়ায় – তার কাঁধে মৃদু ধাক্কা দিয়ে আমার কথা শোনো মন দিয়ে বলে ওঠা।
এখন গায়ে ধাক্কা দিয়ে কেউ আমার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলে আমি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। সেটা বক্তা না বুঝলে বোঝানর চেষ্টা করতে থাকি ধাপে ধাপে।
এখন এই সম্বোধন যদি হরিশচন্দ্রবাবু না হয়ে তার পুরো গোষ্ঠীর প্রতি হয় তাহলে সেই কথাটির খারাপ অংশটুকু বেড়ে যায় যতজন মানুষ সেই গোষ্ঠীতে আছেন ঠিক ততগুণ , কিন্তু আমার গোষ্ঠীর কেউ হয়ে এই কথাটা উচ্চারিত হলে সেই খারাপ লাগাটা অনেক অনেক বেড়ে যায়, এর কারণ এই খারাপ কাজটা অন্য কাউকে আহত করল – সেটা আমার গোষ্টীর কেউ হয়ে – যেটা আমার একমাত্র নীতিকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে।
তার পরে কী বলা হচ্ছে সেটার মানে নিয়ে মতভেদ থাকলেও প্রাথমিক ধাক্কা দিয়ে বলা কথাটার অভিঘাত মৃদু হয় না। আর তার মধ্যেকার কোনো একটি মানে যদি সেই গোষ্ঠীর প্রতি ঔদ্ধত্তমূলক সম্বোধনের সঙ্গে একেবারে মিলে যায় তখন সেই মানেটিকেই নিতে হয়, আর কোনো উপায় থাকেনা যে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে কখনো সান্টা সিং বান্টা সিং এর মজার চুটিকিগুলোকে পোষাক পরাব সামাজিক সমাবেশে পেশ করার আগে? নাকি সুকুমার রায়ের লক্ষ্মণের শক্তিশেল কে কাঁটাছেড়া করতে যাব সম্প্রদায় ভিত্তিক কথার জন্য? – তখন দেখা হবে উদ্দেশ্য। আমি তখনই ভুল যখন সেই সম্প্রদায়ভিত্তিক, লিঙ্গভিত্তিক সম্বোধন করা হবে তাকে নীচু দেখানর জন্য। আর তাতে আমি বা আমার সম্প্রদায় বা আমার লিঙ্গের মানুষকেই ছোট করে তুলব। এ সত্যিই ভারী অদ্ভুত জায়গা, কয়টি মাত্র শব্দ কয়টি মাত্র কথায় আমি বয়ে বেড়াই আমার বংশপরিচয়, আমার শিক্ষাদীক্ষা, আমার চিন্তা আমার ভাবনা। এত সব করে চলেছি তার কারণ এই সমাজ থেকে আমি শুধু নিয়ে চলেছি, আমাকে ঋদ্ধ করেছে করে চলেছে সে অনবরত, আমাকে ফিরে ফিরে দেখায় সেইসব যা ফেলে এসেছি অনেক অনেক আগে আর যা আমি খুঁজে বেড়াই । সেই প্রাপ্তি থেকেই এই লেখা দেখা হোক আমার তরফ থেকে আসা দু-পয়সা হিসেবে।
পরিশিষ্ট - এই লেখা সাম্প্রতিক গোচরে আসা কিছু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মনের মধ্যে চলতে থাকা চিন্তাভাবনার লিখিত রূপ। যদিও এই লেখাতে যথাসম্ভব চেষ্টা করা হয়েছে তা সত্ত্বেও আবার বলছি এই লেখাটির মধ্যেকার সেই চিন্তাভাবনা নিয়ে আরো কথা আসুক কিন্তু সেই ঘটনাটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হয়ে পড়ে থাকুক সেইখানেই।