প্রেম সরে গেলে, লিখনটি - অলীক দেওয়ালে
সুমন মান্না
কথা তো কাহিনিময় স্তব্ধতা কবিতার মতো
অলক্ষ্যে ছুঁয়ে গেল স্মিতরূপ বেদনার ক্ষত
বুক জুড়ে শূন্যতা যেন পরিযায়ী পোষাকের ভাঁজ
কাল ফিরে গিয়েছিল ঘুম, জেগে থাকা সারারাত আজ-
তোমাকে লুকিয়ে রেখে মৃদু ভয় খোঁজা সাপখোপ
আলোর ঘোমটা টানা মুখ ঢাকা গাঢ় ঘেরাটোপ।
কোথায় এসেছ ফেলে প্রিয় খেলনাটি, কলার মান্দাস যাকে নিয়ে কেটে
যেত বেলা কত অবেলায়। কোথায় রেখেছ মনে রূপকথা প্রতিটি ছড়ায়,
খেলাশেষে ঘাসের বিছানা জুড়ে রাত নেমে আসে দ্রুতলয়ে বলে ফিরে
গেছ বাড়ি - অনেক রাত্রি পরে সেই রাত শুধু তোমাকেই ধরে দিতে পারি।
নৌকা ভাসাতে যেন এসেছিলে, মনে আছে, তিরতিরে নদীটির বুকে
নাকি ওজর অন্য ছিল, জলের শব্দ বুঝি এইভাবে টানে আর ঘরছাড়া
করে মর প্রাণ ঈশ্বরের মতো। হয়ত এসব নয় বাইরে এসেছ বলে
বেখেয়ালে উড়ে বেড়িয়েছ গাছ থেকে গাছে ডালে ডালে আর বুঝি চোখ
পড়ে গেছে সেই ক্ষণে নদীটির নিজের বাগানে।
নিজেকে দেখেছ তুমি ধীর স্রোতে - ছবিটি কেঁপেছে বলে ফিরে
তাকিয়েছ প্রতিবিম্বের দিকে - তোমাকে ছুঁয়েছে জল যেন তাই বারবার
শিউরে উঠেছ ভেবে অসহ একথা কুকথা। নিষিদ্ধ আহ্বান বুঝি নির্জনে
জলের ইশারা তোলপাড় করে তোলে কিশোরীর সমূহ প্রহরা।
হায় রে অবুঝ নদী, সে কী জানে এতশত কথা। তাকেই দেখছে কেউ
এতখানি ঝুঁকে - এ কেমন অহেতুক দেখা, এ চাহনি তেষ্টার জলে মিশে
গেলে জলের তেষ্টা শুধু বাড়িয়েই চলে। যত ঝুঁকে পড়ে গাছ,
জল ছোঁব ছোঁব করে - নদী বেড়ে চলে ক্রমে বয়সা লেগেছে জোয়ারে।
আরো আছে চাঁদ টাঁদ যেমনটা গল্পের কালে - থুতনির পাশে তিল,
বাসা বাঁধা সে গাছের ডালে। নগর বাড়ছে বলে নদীটিও বহরে বাড়বে
- এই গল্পের নদীটিও নাব্যতা ক্রমশঃ হারাবে।
যখনি সরেছে জল দেখ তুমি এতটা গভীরে, এত আগোছালো ঘর দোর
খানাখন্দের সারি দেখ তুমি প্রেম সরে গেলে বুঝি বটগাছ সুদৃঢ প্রাচীরে
ঘর বাঁধে। হয়ত চশমা তুমি চোখে নিলে ফের, ফেনিল মেঘের সারি
ফিরে গেলে ঘরে বুঝি তার, ভার বাড়ে রাতের শরীরে।
তখনি ফিরল ঘরে অনুভূতি কিছু - খিদেতে জ্বলেছে পেট, মাথা ছিঁড়ে
পড়ে গেছে যেন, ফেটে গেছে রক্ত ঝরল বলে তুমি সেই উষ্ণ লৌহ স্বাদ
পেলে বুঝি। মাথা চাড়া দিল কিছু কথা, ভাষায় গদ্যরূপ - থিকথিকে
আদেখলে পড়শীর মতো খুঁটে গেল সবটুকু আনাচকানাচ। হিসেবে উঠল
সব হাবিজাবি আঁকিবুকি খাতা সের দরে নিল সেই সাইকেল ভ্যানে -
ঘেয়ো কুকুরের মতো তাকে ধাওয়া করে পার করে দিলে চরাচর।
এখনো জ্যোৎস্না দেখি বাজপড়া উলঙ্গ গাছটির স্নায়ু সিল্যুয়েটে।
সব বাসা ভেঙে গেছে, সব ফুল পাতা ঝরে গেল সে হঠাৎ একদিন ঝড়ে -
বাজ পড়ে পুড়েছিল - একলা দুহাত হাত ছেড়ে ভয়ানক লেলিহান শিখা -
রেখে গেল খাঁচাখানি তার, এই টুকু যন্ত্রণা মাখা।
নদীটি হয়েছে শেষ তারও বেশ কিছুদিন আগে - শ্মশানের মতো ফাঁকা
চড়ে এলোমেলো হাওয়া থাকে জেগে।
ঠান্ডা ভাতের মতো জেগে আছ, প্রেম। টকে যাওয়া তরকারি কিছু -
বিউলির ডালে সর - ঢাকনা গিয়েছে সরে, তাই বুঝি পিঁপড়ের সারি লেখে
ফাটা মেঝেটার বুকে কত কথা। বলা হয়েছিল তার কিছু - বাকি কিছু খেয়ে
নেয় ভীরু নীরবতা। দিনশেষে ফিরে গেছি ঘরে মানুষের মতো, কিছুটা গোপনে
ভাঁজে ভাঁজে মিলিয়েছি (যতটুকু পারি) দেওয়ালের সাথে মেঝে প্রায় সমকোণে।
তারও আগে মাটি ফেলে ফেলে সমান করেছি জমি, উঁচু। জল আর
জমতে পারেনা যেন কোনোদিন যেন প্রেম কোনো আছিলায় এসে
জমা জলে নিজেকে দেখবে বলে ঝুঁকে যেতে পারে আর ভেবে যাব -
দেখছে আমাকে- বলে স্রোতে বয়ে যাব জোয়ারের কালে।
নদী সরে গেছে। কতকাল। অনুভূতিমালা নিয়ে মজে আছি বাকিদের
মতো। বেঁচে গেছি মানে মানে। এখন শুনিনা কোনো স্তব্ধতা অশ্রুত
গানে। এখন দেখিনা জল চিত হয়ে ভেসে যাওয়া ফুল কবেকার অচেনা
বাগানে। এখন ছোঁবেনা আর মুহূর্ত আলো অকারণ অলীক অস্থান -
অসময় সোঁদা কোনো ঘ্রাণ।
হয়ত গিয়েছি মরে। কতকাল। প্রেম সরে গেছে, প্রিয় খেলনাটি, সবটুকু
প্রাণ নিয়ে চলে গেছে - জানিনা কতটা দূরে।