লোকটা মরে ফর গেল না তো! অজ্ঞান হয়ে গেছে নাকি? কপালের কাছটা তো অনেকটা কেটে গেছে, হলদে হ্যালোজেন আলোয় রক্তের দাগ কালো দেখাচ্ছে। আশেপাশে কেউ দেখেছে নাকি? এদিকে তো আবার সব জায়গাতেই সিসিটিভি ক্যামেরা বসান। কিন্তু দোষ তো লোকটারই, সেটাও নিশ্চয় বোঝা যাবে ক্যামেরায় – আর ওর কাছে অস্ত্র ছিল – ওইত, একটা ছ’ইঞ্চি মাপের ছুরি – নাকি একেই ভোজালি বলে?
প্রতিবারই এটিএম থেকে টাকা তোলার পর আচমকাই নিজে থেকে কিছুটা সতর্ক হয়ে যায় সুজয়। জায়গাটা এমনিতে দিনমানে জমজমাট বেশ কয়েকটা ব্যাঙ্ক ও তাদের এটিএম রয়েছে। সামনে অনেকটা পার্কিঙ এর জায়গা। ব্যাঙ্ক গুলো ছাড়াও বেশ কিছু বীমা কোম্পানি, শেয়ার কোম্পানির অফিস, মোবাইলের ঝকঝকে দোকান এমনকি ভালো রেস্তোরাঁও রয়েছে এখানে। কিন্তু সুজয়ের টাকা তোলার সময়টায় জায়গাটা বড় শুনশান হয়ে যায়। অফিস থেকে ফেরার পথে এখানে গাড়ি থামিয়ে টাকা তোলার সময় পার্কিং এ একটাও গাড়ি থাকে না। কচ্চিত একটা দুটো এটিএমে নড়বড়ে সিক্যুরিটি গার্ড থাকে, তারা গরমের দিনে এটিএমের মধ্যেই টুলে বসে ঝিমোয়। খুব একটা রাত্তির নয় যদিও, শহরে রাত সাড়ে ন’টা মানে সন্ধ্যাই। বাজার এলাকা এইসময়ে জমজমাট। এদিকের অফিস পাড়া যেন বড় বেশি ফাঁকা।
টাকা তুলেই সুজয় বুঝতে পেরেছে কেউ পিছু নিয়েছে। নিঃশব্দে পিছন থেকে খুব কাছে এসে “দেশলাই আছে?” টাইপের ভান করে কোমরের কাছে ঠান্ডা ভোজালি রেখে মানিব্যাগটা চেয়ে নেবে। খুব তাড়াতাড়ি হাঁটে না ও। হাতের মুঠোটা নিজের মনে মনে পাকিয়ে নেয়। ভাবে পিছন থেকে সামান্য কোনও টোকা পড়লে সবার আগে কনুই চালাবে আচমকা সেই শব্দ ঠাহর করে। সে খুব সতর্ক আছে, তার আক্রমণকারী হয়ত জানবে না। আর তারপরেই ঘুরে গিয়ে এক ঘুষি – তার মুঠোর ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে রয়েছে গাড়ির চাবি আর গীয়ার লকের চাবিটা দুটো ফলার মতো। যদি কোনও মতে কনুইয়ের খোঁচাটা লক্ষ্যভ্রস্ট হয় তাহলে এই চাবির ফলা-ওলা ঘুষি তে সে কুপোকাত হবেই। আক্রমণকারী আগে থেকে বুঝতেই পারে নি এই আপাত মোটাসোটা থপথপ করে হাঁটা বেঁটে লোকটা এত বেশি তীক্ষ্ণ আর সাবধানী।
ঠিক যা ভেবেছিল, তাইই হ’ল। কনুই চালাতেই আক্রমণকারী হতচকিত আর পরক্ষণেই মারা এক ঘুষিতেই এক-পাক ঘুরে গিয়ে থপ করে পড়ে গেল চিত হয়ে মাটিতে। এ তো নাড়াচাড়া করছে না আর? ভাণ করছে নাকি? লোকটা মরে ফর গেল না তো! ...
একটু দুরে ভোজালিটা পড়ে আছে – লোকটা যদি ভাণ করে? ওটা তুলে দুরে ছুড়ে দেবে নাকি? তা হলে হাতের ছাপ লেগে যাবে ভোজালি তে – পা দিয়ে লাথি মেরে সরানই ভালো ভেবে - দিল এক শট।
সুজয় এইসব ভাবছিল, একই সঙ্গে নিজেকে বলছিল এই অবস্থায় মাথা ঠান্ডা রাখার কথা। এই শীত রাতেও জ্যাকেটের মধ্যে ঘাম দিচ্ছে ওর। জল তেষ্টাও পাছে। গাড়িতে জল আছে কিন্তু কয়েকটা ফোন সারতে হবে। এখনই...।
এক শূন্য শূন্য তে আগে কখনও ফোন করে নি সুজয়। কপাল জোড়ে একেবারেই ও’পাশ থেকে ফোন তুললেন একজন ভদ্রলোক আর তিনি সুজয়ের ভাঙা হিন্দি আর তাতে জোড়াতালি দেওয়া ইংরাজি স্পষ্ট বুঝলেন। আর অবিশ্বস্য সহানুভূতি দেখিয়ে বললেন – এক্ষুণি পুলিশের ভ্যান পৌঁছচ্ছে।
এবার সোসাইটিতে একটা ফোন করতে হবে – কাকে করলে ভালো হয় – কৌশিক? হ্যাঁ কৌশিক, ছেলেটা সারাক্ষণই অন-লাইন থাকে। একবার খবর পেলেই সঙ্গে সঙ্গে সারা সোসাইটির সব-ক’টা গ্রুপে সুজয়ের বীরত্ব-গাথা ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু ছেলেটার সুজয়ের কথা পাত্তা না দিতেও পারে, সকলের সামনে কী অপমানটাই করল সে দিন।
কিছুই না, সকালে একটু হাঁটতে বেরোয় সুজয় – সোসাইটির রাস্তায় এক চক্কর লাগিয়ে অবশ্য মাঠের ধারে বেঞ্চিতে বসে পড়ে খেলা দেখে – একটা নেট খাটিয়ে প্র্যাকটিশ করে সোসাইটির উঠতি ক্রিকেটাররা। সে দিন প্র্যাকটিস দেখতে দেখতে খেয়াল করে নি কখন কৌশিক এসে পাশে বসেছে – একটা সোজা বল সোসাইটির চ্যাম্পিয়ন ব্যাটসম্যান রিকু চালিয়ে খেলতে গিয়ে বোল্ড হতেই – সুজয় বলে বসল – ওটা ব্যাট না কোদাল? বলের লাইনে পা নেই, মাথা আকাশের দিকে – এ ভাবে ক্রিকেট হয়? রিকু গতবার দিল্লির আইপি এল টীমের সঙ্গে প্র্যাকটিশ করেছে – জুনিয়র রাজ্য দলে চান্স পেয়েছে। সুজয়ের চমক ভাঙল কৌশিকের কথায় – দেখল – কৌশিক জিজ্ঞেস করছে – তা সুজয়, তুমি যেন কটা টেস্ট খেলেছ বললে সেদিন?
শুধু তাই নয়, সেই কথাটা জনে জনে বলে বেরিয়েছে কৌশিক। মুদির দোকানে দেখা হতে সুমিত, অর্ণব আলাদা আলাদা করে জিজ্ঞেস করে গেল – মুখটা খুব সিরিয়াস করে প্রশ্ন – সুজয়দা, আপনি নাকি দুর্দান্ত ক্রিকেটার ছিলেন – একটু দেখিয়ে দিতে পারেন তো আমাদের বাচ্চাদের!
না, কৌশিক নয়, বয়স্ক প্রদীপ বাবুই ভাল, তবে উনি আবার কানে এত কম শোনেন – ফোনে কী শুনতে কি শুনবেন আর কী লিখবেন – থাক।
তবে, এইসব খবর চাপা থাকে না। কেউ বিশ্বাস করবে যে সুজয় ঘোড়াই একটা সাদামাটা থলথলে লোক একজন সশস্ত্র ছিনতাইবাজকে অনায়াসে কাবু করেছে – শুধু তাই নয় তাকে একেবারে পুলিশের জিম্মায় তুলে দিয়েছে সম্পূর্ণ একা? ভালোই হয়েছে – সোসাইটির কাউকে এ কথা জানানর কোনও দরকার নেই এখন। পুলিশের কাছে তার নাম ঠিকানা দেওয়া আছে – একেবারে সকালের কাগজে তার নাম ছেপে বেরোবে। হয়ত কালকেই নয়, কালকের কাগজ তো ছাপা হ’তে চলে গেছে এতক্ষণে। তাহলে পরশুর কাগজে তো নিশ্চিত। টিভিতেও বলতে পারে – কলকাতার বাড়িতে তো নিউজ চ্যানেল দেখে বাবা কাকা রা। ফোন করবে হয়ত। কী যে কাণ্ড হবে – ভাবাই যায় না।
প্রথমতঃ কেউ বিশ্বাস করবে না। কিন্তু আবার পুলিশের কথা, তায় সিসিটিভির ফুটেজ কিভাবে অবিশ্বাস করবে। সুজয়ের নিজেরই ইচ্ছে হল – সিসিটিভির ফুটেজটা দেখে – কে জানে হয়ত কয়েকদিনের মধ্যেই ভাইরাল হয়ে যাবে এই ক্লিপটা। আচ্ছা টিভি থেকে ইন্টারভিউ নিতে এলে সুজয়ের কি বলা উচিৎ যে সে ব্রুস লীর সিনেমা দেখে ওই প্রতি-আক্রমণের স্টাইল শিখেছিল? আচ্ছা, কৌশিক ঠিক কী বলে বেড়াবে লোককে – পুরো পালটি খেয়ে হয়ত বলবে – “দেখেছ একমাত্র আমিই বুঝেছিলাম আমাদের নতুন প্রতিবেশী একেবারেই হেঁজিপেঁজি কেউ নন” তারপর দেখা হলে একটু কাছে এসে গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করবে – “সুজয় দা, আপনি তো “র” ইয়ে চাকরি করেন, তাই না?” – এর উত্তরে একটা ছোট মৃদু রহস্যের হাসি দিয়ে প্রসঙ্গান্তরে যেতে হয়, ব্যস। সুজয় জানে সে কথা।
কিন্তু সুজয় এও জানে ভাল করে যে খবরের কাগজ বা টিভিতে তাকে দেখাবে না কখনও। আগেও তো ঘটেছে এমন কত। – সেই যে সেবার স্কুল টীম খেলতে গেল জামশেদপুর – পুরো ছুটিতে সে একা। টিমের বাকিরা যেন ওকে চেনেই না, কেউই কথা বলছে না পনের জনের দলে পনের নম্বর ছিল সে। কোচ-স্যর অজয়বাবু ওর নাম অবধি জানতেন না। তারপর সেই ফাইনাল ম্যাচের আগের দিন প্রাকটিস করতে গিয়ে মাথা ঠোকাঠুকি হয়ে টীমের বাইরে ফাস্ট বোলার অনিন্দ্য আর জয়ন্ত। এদিকে বাড়িতে বাবা অসুস্থ খবর পেয়ে টীমের ওপেনার দীপঙ্কর সেমিফাইনাল খেলেই ট্রেনে রওনা দিয়েছে। রজতের গোড়ালি ফুলে ঢোল- সে তো হাঁটতেই পারছে না – খেলবে কী করে।
ফাইনাল ওদিকে সেন্ট জেভিয়ার্সের তুখোড় টীম – কোচ বললেন টীম নামিয়ে কী লাভ – ফার্স্ট টীমের চারজন নেই। কিন্তু বাইরের ট্যুর্নামেন্ট – না খেললে স্কুলের বদনাম। এই অবস্থায় খেলার শেশ তিন ওভারে পঞ্চাশ রান করে স্কুল টীমকে জেতান এগার নম্বরে ব্যাট করতে নামা খেলোয়াড় কে নিয়ে যখন হৈ চৈ হচ্ছিল – সুজয় কী তাতে ভেসে গেছে? জয়ী দল স্কুলে ফিরে এলে অ্যানুয়াল ফাংশানে স্টেজে তুলে তাদের কত কী দেওয়া হ’ল, সুজয় ডাক পায় নি। তাতে কিছু এসে গেছে তার - নাকি সে জনে জনে সে কথা বলে বেড়িয়েছে সবাইকে? সুজয় এমনই।
একী! - লোকটা একটু নাড়াচাড়া করছে যেন, যদি উঠে ফের আক্রমণ করে? যদি ওর কাছে আরও কোনও অস্ত্র থাকে? খুব একটা রোগাসোগা নয় লোকটা, বেকায়দায় মার খেয়ে কাবু হয়ে পড়েছে। বেশিক্ষণ অজ্ঞান থাকার কথা নয়, তবে অনেকটা রক্ত বেরিয়েছে, যদি ওর সঙ্গীরা ওর খোঁজে আসে দেরি দেখে – সুজয় আস্তে আস্তে পিছু হাঁটছিল লোকটার দিকে তাকিয়ে। এত ঠান্ডা আজ, এত হাওয়া দিচ্ছে – একটা কুকুর অবধি দেখা যাচ্ছে না।
স্বাভাবিকভাবেই বাড়ি ফিরতে অনেকটা রাতই হ’ল সেদিন। না, এখনও এখানে কেউ জানে না খবরটা, অন্যদিনের মতোই লোকজন আর অন্য দিনের মতোই ফাঁকা ফাঁকা গেটের কাছটা। ফেরার সময়েই টের পেয়েছিল, এখন বুঝতে পারল মাথাটা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে পড়ছে যেন। তালা খুলতেই ঘরের একরাশ অন্ধকার প্রিয় পোষ্যর মতো তার গায়ে মাথায় উঠে পড়ল অন্যদিনের মতোই, তাদের সইয়ে নেয় সুজয়। বারান্দার খোলা প্যাসেজের আলোটা পা টিপে টিপে ঘরে এসে ছড়ানো অন্ধকারগুলো এক একটা জায়গায় ডাঁই করে তুলে রাখে। এই সময়টা সুজয় দেয় বুঝে নিতে আর কেউ তার ফ্ল্যাটে আছে কি না জানতে। দরজা খোলার শব্দ হ’ল আর আলো জ্বলছে না – এতে অবাঞ্ছিত অতিথি ঘাবড়ে গিয়ে সামনে চলে আসবে। সুজয়ের হাতের মুঠোয় চাবিটা তেমনই ফলা বের করে রাখা।
দু’টো শোওয়ার ঘর আছে এই ভাড়া নেওয়া ফ্ল্যাটে। একটা তো বন্ধই রাখা, অন্যটাই একটা বিছানা, আলমারি ও লাগোয়া স্নানঘর। আলমারিটা খুব একটা ব্যবহার হয় না আজকাল। জামা-কাপড়গুলো কয়েকটা বিছানার পাশে আর বাকিরা ডাইনিং রুমের সোফায় থাকে। আলো জ্বেলে দিলে সেই ঘরে সোফায় ছড়ান জামাকাপড়, সেন্টার টেবিলের ওপর মাস খানেকের খবরের কাগজ আর টিভির ফাটা কাচটা আবার চোখে পড়ল তার। টিভিটা সারাতেই হবে এবার, ক্রিকেট বিশ্বকাপ আসছে। পরের ছুটির দিনে এই সোফা থেকে জামাকাপড় সরাবেই সে। ডাইনিং টেবিল দেখল শুনশান, মানে রান্নার মেয়ে কাজল ফের ডুব দিয়েছে। ও হো – সে তো আজকেও ফোন করে বলছিল। ভুল হয়ে গেছে খুব। ওর বাকি টাকাটা আজই রেখে যাবে বলেছিল – কোনও মানে হয়? গরীব মানুষ, বাড়ি বাড়ি রান্না করে, তার তিন মাসের মাইনে বাকি তাছাড়া বেশ কয়েকবার আনাজপাতি কেনার টাকাও সুজয় প্রায় মাসখানেক ধরে রেখে যায় নি। সেই টাকাই তো তুলতে গেছিল সে। কী যে হ’ল – এত সাবধানী সে, আজকেও কীভাবে সে এটিএম থেকে টাকা তুলে গুণে গেঁথে ফের সেটা এটিএম মেশিনের ওপর রেখে এল? ভীষণ মাথা যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল সুজয় – টিভি থেকে সেই লোকটাও ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে – তারও কপালের একদিকে অনেকটা কেটে গেছে, রক্ত গড়াচ্ছে অনেকদিন ধরেই।