ইদানীং ব্যোমকেশের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। গত তিনমাসের মধ্যে বাংলায় আরো দুটি ব্যোমকেশের সিনেমা দেখা গিয়েছে। একটা মেগা ও চলছে টিভিতে।
হিন্দি ভাষায় দিবাকর ব্যানার্জীর এই ছবিটি মুক্তি পাওয়ার টাইমিং বিশেষতঃ বাঙালি দর্শকের জন্য ঠিক মানানসই কিনা সে নিয়ে সন্দেহ ছিল। তার আরো একটা কারণ হতে পারে যেহেতু দিবাকরবাবুকে আমরা দেখেছি তার আগের কাজগুলোতে যে তিনি একেবারেই নতুনতর জমিতে খেলতে পছন্দ করেন। প্রথম ছবি “খোসলা কা ঘোসলা” ছিল একেবারে আনকোরা নতুন প্লট – যেখানে তার আগে বাড়ি কেন কেউ চাষবাস করার সাহস অবধি দেখিয়েছেন কিনা মনে পড়ছে না। দিবাকরবাবু সেখানে তার “ঘোসলা” বানিয়ে নগর পত্তন করে ছাড়লেন।
এ হেন দিবাকরবাবু ব্যোমকেশ নিয়ে এলেন বলে একটা উৎসাহ ছিল – এটাতে কী আর নতুন মাত্রা দেখাতে পারবেন উনি? পুরোদস্তুর বাঙালিয়ানা ঠাসা ব্যোমকেশের জাতীয় স্তরের আবেদন গ্রাহ্য হবে তো? আরো প্রশ্ন ছিল আজকালকার সাবালক হিন্দি সিনেমার যুগে (যে সাবালকত্বের কিছুটা কৃতিত্ব তাঁরও) ঠাসবুনোট চিত্রনাট্যের সঙ্গে ব্যোমকেশের গল্পের গতি কি পাল্লা দিতে পারবে? সেই সময়ের কলকাতা কীভাবে দেখানো যাবে স্টুডিওর সীমাবদ্ধতায় – যেখানে ব্যোমকেশকে প্রায়শই রাস্তাতেও নামতে হবে।
দিবাকরবাবু এইসব প্রশ্ন থুড়ি চ্যালেঞ্জগুলোকে সোজা ব্যাটে খেলার চেষ্টা করেছেন দেখলাম। খামোখা চালিয়ে খেলতে গিয়ে আউট হন নি, আবার বেজায় বোর করেও ফেলেননি। কার্পেটের নীচে লুকিয়েও রাখেন নি। কীভাবে ? – বলছি।
শেষ প্রশ্নটা থেকে শুরু করি। কলকাতা। মানুন না মানুন আমরা যারা কখনো বা কখনো এই শহরের সঙ্গে জড়িয়েছি তাদের বেশির ভাগই নিজের মধ্যে নিজস্ব কলকাতা বহন করে চলি। শ্লাঘা অনুভব করি একে খুব ভালো করে চিনি বলে। আশির গোড়ার দিকে ধুসর নীল রঙের সরকারী বাস এবং “বাঘমার্কা ডবলডেকার” গিয়ে যখন লাল রঙের বাসগুলো এল – এক লহমায় যেন ভোল বদলে গেল শহরটার। মনে পড়ে। এমনিতে চিংড়ি মালাকারির স্বাদের মতো এই শহরের চরিত্রে খুব একটা ফারাক হয় না – কিন্তু আমাদের মতো বিশেষজ্ঞরা ধরে ফেলতে পারে চিংড়িটা যথেষ্ট তাজা ছিল কিনা কিম্বা কেনা নারকোল দুধ ব্যবহৃত হয়েছে নাকি নারকোল কুরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। সাম্প্রতিক হিন্দি সিনেমায় দেখা কলকাতা বলতে গেলে “কাহানী” র স্মৃতি ই তাজা। সেখানে কলকাতা মন ভরিয়ে দিয়েছিল বলে এবারে প্রত্যাশার পাশ নম্বর বেশিই রেখেছিলাম। সেই পরীক্ষায় জন্ম ইস্তক প্রবাসী বাঙালি দিবাকরবাবু একেবারে সফল।
টাইটেল কার্ডে চলন্ত ট্রামের জানলা দিয়ে দেখা কলকাতা যেখানে হীরো ব্যোমকেশ ঝাপসা হয়ে থাকে আর আমরা সাইনবোর্ড পড়ি পুরনো কলকাতার, দেওয়াল লিখন পড়ি, সিনেমার পোস্টার। রাস্তার ধার দিয়ে যাওয়া সেই ট্রামলাইনের পাশেই চাপাকল – লোকে বিন্দাস চান করছে। ট্রাম এলে সরে যাচ্ছে টুক করে। দেখি। এমনকি সেই ট্রামের মডেলটাও এখন যাদুঘরেই পাওয়া যাবে। তার নম্বর ও গন্তব্যে লেখা বোর্ডের হরফটাও সেদিনের। পরে একটা দৃশ্যে অবশ্য এখন চলতে থাকা ট্রামও দেখলাম বটে – কিন্তু সেগুলোও কি অত পুরনো নয়? তখনকার লাল বাসের মতো? ততক্ষণে দিবাকরবাবুর কলকাতার পরীক্ষা হয়ে গিয়েছে। আমরা হাত খুলে নম্বর দিয়েছি আর ঠিক করেছি এবার যা যা দেখব সেটাই চল্লিশের কলকাতা। আমরা তো নিজেরাও দেখিনি সে সময়টা।
সেই টাইটেল কার্ডের দৃশ্যেই দেখি ব্যোমকেশের সহযাত্রী খবরের কাগজ মেলে দিলেন। যুগান্তর। হিন্দি। দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায় বাঙালিয়ানা বজায় রেখেই জাতীয় পর্যায়ে পৌছে দেওয়ার প্রস্তাব রাখলেন সিনেমাটিকে। চরিত্ররা সবাই বাঙালি কিন্তু তাদের হিন্দি বাঙালির হিন্দি নয় – সাবলীল কথ্য হিন্দি তাতে বাংলা মেশানো নেই। সোজাসাপটা খেলা। পছন্দের।
পরের পরীক্ষাটাই হল অঙ্ক। পাশ না করলে কেউ ঘুরে জিজ্ঞাসাও করবে না ইতিহাসের নম্বর। ভুগোলের আশি পাওয়ায় বৃথা। ওনার সহজতর পথ ছিল কোনো একটা গল্পের মধ্যে রেখে খেলে যাওয়া। অনেক চরিত্র ওয়ালা চিড়িয়াখানা ধরণের চেনা রাস্তাতেও যেতে পারতেন। তাহলে এই ব্যোমকেশের সিনেমাটাও আরো একটা ব্যোমকেশ বলে ভুলে যাওয়া যেত সহজে। তার বদলে তিনি অপেক্ষাকৃত কঠিনতর রাস্তাটি নিলেন। শরদিন্দুর গল্পগুলির কিছুটা কিছুটা নিয়ে বোধ হয় মনে মনে চিত্রনাট্য বানানর সময় স্মরণ করলেন ফেলুদা স্রষ্টার। তাতে গল্পে এল গতি। কিন্তু কেন জানিনা এতে একটু হাঁফ ধরার মতো অবস্থাও হয়েছিল বৈকি। কারণ এটা একটা পিরিয়ড সিনেমাও বটে। তার সেট, তার দৃশ্যরচনা তার আবহের পিছনে এত খাটাখাটনি এত যত্ন – সেটা না চাইতেও মনোযোগ কেড়ে নেয়। এ যেন একটা প্লেটভর্তি অনেক অনেক সুস্বাদু খাবার কিন্তু নির্দিষ্ট সময়সীমায় শেষ করতে হাবে। যে গতিহীনতার আশঙ্কা ছিল তার বদলে ওভারস্পীডের টিকিট দিতে হবে সেটা ভাবিনি আগে থেকে।
জাতীয় স্তরে গ্রহণযোগ্যোতা বাড়াতে সাধারণ খুনের মামলা সমাধান করার পাশে ব্যোমকেশকে নিতে হয়েছে শহর কলকাতাকে বাঁচাবার ভার। সেটা তার কপাল। কী আর করা যাবে। আজকাল চুরি থেকে সিনাজোরি সবকিছুতেই বিশ্বায়ন হয়ে গিয়েছে। হালফিলের ডন থেকে ধুম সবাই সেই রাস্তায়। সেখানে শহরের দু একটা খুনের মামলা সমাধান করা ব্যোমকেশকে তাই বহরে বাড়তে হল অবস্থার ফেরে। খাটতে হল খুব এই সিনেমায়। তার পাল্লায় পড়ে আমরাও। কিন্তু আন্তর্জাতিক স্তরে এক দেশের ড্রাগ মাফিয়া ও অন্য দেশের সেনার বন্ধুত্বের অংশটা খুব বিশ্বাস করতে পারলাম না, যখন তারা এমনিতে খুব বন্ধুত্বপূর্ণ বলে ইতিহাস জানায় না।
সেটুকু মেনে নিয়েও বলা যায় কাজটা কঠিন ছিল। কারণ ফেলুদা রচয়িতা তার গল্প লেখার সময়ে চিত্রনাট্য হিসেবেই সেটা ভাবতেন। শরদিন্দু নিখাদ কাহিনিকার। তাই ফেলুদা পড়ার সময়ে সবাই মোটামুটি একই দৃশ্য মনে মনে কল্পনা করতে পারে সেখানে ব্যোমকেশকে কেমন দেখতে তা নিয়েই একটা আস্ত আলাদা প্রবন্ধ লেখা হয়ে যায়। ইদানীং এত বেশি নানান মানুষ ব্যোমকেশ সেজেছেন যে সেই ধারণাটা আরো টালমাটাল। এই পটভূমিতে এই সময়ের নামকরা উঠতিদের মধ্যে অন্যতম সুশান্ত সিং রাজপুত সাবলীল। ধুতি পরে সারা সিনেমায় এত সহজ লাগছিল – এমনকি একটি দৃশ্যে তার স্যুট পরা অস্বস্তি ধরা পড়ে গেল যেন। তবু রজিত কাপুরের ব্যোমকেশের সঙ্গে একটা তুলনা চলেই আসে। রজিত কাপুর ঝকঝকে। রোদ্দুরের মতো। সেখানে সুশান্তের ব্যোমকেশ একটু ভুরু কোঁচকানো মানুষ। আনন্দ তিওয়ারির অজিত বেশ মানানসই। বিশ্বাসযোগ্যো। তবে অবাক করেছেন নীরজ কবি। সাঙ্ঘাতিক ভালো অভিনয়। অভিনয়ের মধ্যেও অভিনয় ছিল তার – ভিলেন যেহেতু। নিজের শেয়ারের স্ক্রীন প্রেসেন্স একেবারে ঠিকঠাক টেনে নিয়েছেন যে দৃশ্যে উনি রয়েছেন। মহিলা চরিত্র কম। সেখানে দিব্যা মেননের সত্যবতীর থেকেও মনে থাকেন স্বাস্তিকা। তার চরিত্র শরদিন্দু বানান নি যদিও তবুওএই সিনেমাটিতে তিনি বেশ আছেন। একটু বেশি আছেন বলে মনে হল যদিও।
বিশেষ কিছু মূহূর্ত মনে থাকে। মেসবাড়ির দৃশ্য খুব স্বাভাবিক। তার আসবাব চৌবাচ্চা সব মিলিয়ে খাপে খাপ হয়েছে। কফি হাউসের ভিড় আর সেই ভিড়ের দৃশ্য আলাদাভাবে পরিচালকের যত্নের স্বাক্ষর বহন করে। অ্যাকশনের দৃশ্যগুলো বেশির ভাগই অন্ধকারে তোলা। বিশ্বাসযোগ্যো বটে কিন্তু তাতে স্পষ্টাতাকে বলি যেতে হয়েছে। সিনেমার এক গুরুত্বপুর্ণ দৃশ্যে চৈনিক উচ্চারণ ও সুরে “এ কী তব বিবেচনা” গানটি যেন দিবাকরবাবুর শুধুমাত্র বাঙালির প্রতি পক্ষপাতপ্রসূত বলে মনে রাখলাম। চুপি চুপি সেই উপহার চালান করলাম জামার পকেটে। আর বেশি কিছু বলে দিলে স্পয়লার হয়ে যেতে পারে ভেবে থামলাম।
পরিশেষে, সিনেমা নিয়ে ভাবতে ভাবতে লেখকের সঙ্গে চিত্রনাট্যকার তথা পরিচালকের একটা তুলনামূলক আলোচনা চলেই আসে। দুজনের দর্শনের ফারাক। সেই প্রসঙ্গে মনে হল সর্বচরাচরব্যাপী ব্যোমে দিন আর রাত্রির মিল গরমিল নিয়ে। শরদিন্দুর ব্যোমকেশ যেন রোদ্দুরে ঝকঝকে – আবার দিবাকরের ব্যোমকেশ বেশ খানিকটা অন্ধকারপ্রবণ। প্রথম ইনিংসে বান্দ্যোপাধ্যায় বাবু সাদা কালো অক্ষরে রঙ্গিন ব্যোমকেশ নিয়ে আসেন তো তার জবাবে ব্যানার্জীবাবু আসেন তাঁর রঙ্গিন ছবিতে কালো আর ধুসর রঙের নানান শেড নিয়ে। ডিটেক্টিভ ব্যোমকেশের কাঠামোতে শরদিন্দুর ব্যোমকেশের নানান কাহিনির ছিটের জামা থাকলেও দিবাকরবাবুর ব্যোমকেশ অনেকটাই পুনর্নির্মিত। সেইজন্যই গল্প উপন্যাসগুলো সব পড়া থাকলেও সিনেমাটা স্বচ্ছন্দে গিয়ে দেখে আসা যায়। পড়া না থাকলে তো কথাই নেই – একেবারে আনকোরা নতুন থ্রিলার। তাই, প্রাপ্তির সম্ভাবনা দিবাকরবাবুর পরের সিনেমাটির জন্য রয়ে যায়।
এদিকে এই সিনেমার শেষ দৃশ্যে এর সিক্যুয়াল তৈরির সম্ভাবনা কিন্তু রেখে দেওয়া হল। হোকব্যোমকেশ!