এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  অপর বাংলা

  • লং মার্চের ডায়েরি - প্রথম কিস্তি

    নাসরিন সিরাজ লেখকের গ্রাহক হোন
    অপর বাংলা | ২৩ নভেম্বর ২০১০ | ৭৬৩ বার পঠিত
  • তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুত, বন্দর রা জাতীয় কমিটি আয়োজিত
    ২০১০ সালের পদযাত্রায় অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা
    ----------------------------------------

    “উন্মুক্ত না, রপ্তানী না, বিদেশী না” এই শ্লোগানকে সামনে রেখে এই বছরের ২৪ থেকে ৩০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত হল তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুত, বন্দর রা জাতীয় কমিটি (এর পর থেকে জাতীয় কমিটি) আয়োজিত ৪৬৫ কিলোমিটার দীর্ঘ লং মার্চ। এই পদযাত্রা শুরু হয় ঢাকার পল্টনের মুক্তাঙ্গন থেকে, শেষ হয় দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলা শহরের উর্বশী সিনেমা হলের সামনে।

    বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের জ্বালানী সম্পদের উপর শতভাগ জাতীয় মালিকানা, জাতীয় সংস্থা সহ জাতীয় সমতার বিকাশ, খনিজ সম্পদ রপ্তানী ও উন্মুক্ত খনি পদ্ধতি নিষিদ্ধ করা এবং জ্বালানী মন্ত্রণালয়কে বহুজাতিক তেল কোম্পানীগুলোর দাসত্ব থেকে মুক্ত করা সহ ৭ দফা দাবী বাস্তবায়নের কথা বলে আসছে এই জাতীয় কমিটি। এই লং মার্চটি ছিল জাতীয় কমিটির রাজনৈতিক কর্মসূচীর ধারাবাহিকতায় সংগঠিত ৪র্থ তম লং মার্চ।

    জাতীয় কমিটির পক্ষ থেকে লং মার্চ এ অংশগ্রহণকারী সদস্য সংগঠনগুলোকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে যে চিঠি বিলি করা হয় তা অনুযায়ী ৭ দিন ব্যপী এই পদ যাত্রায় অন্তত: দশ লাখ লোক জড়িত হয়েছিল। প্রথম দিনই প্রায় এক হাজারের বেশী লোক ঢাকা থেকে যাত্রা শুরু করে। পরে পথে পথে স্থানীয়ভাবে আরো শ’খানেক লোক প্রতিদিনই লং মার্চে অংশ নিত। শেষ দিনে লং মার্চে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা ছিল সবচাইতে বেশী। সেদিনের ফুলবাড়ি মহাসমাবেশে প্রায় দেড় লাখ লোকের সমাগম হয়। উল্লেখ্য, এই লং মার্চে প্রায় দেড়শ নারী অংশগ্রহণ করে। তাদের মধ্যে গার্মেন্টস শ্রমিক ও বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের সংখ্যা ছিল উল্লেখযোগ্য।

    আমি এই লং মার্চে অংশগ্রহণ করি একজন গবেষক হিসেবে। এর আগে ২০০৯-২০১০ শিক্ষা বছরে ভ্রিজ ইউনিভার্সিটি, আমস্টারডামের নৃবিজ্ঞানের মাস্টার্স পর্যায়ের ছাত্রী হিসেবে আমি ফুলবাড়িতে একটি গবেষণা কাজ চালাই। সে গবেষণা কাজের উদ্দেশ্য ছিল ফুলবাড়ির খনি বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের অনুপ্রেরণা খেআঁজা এবং কিভাবে মানব নিরাপত্তা ভাবনা আন্দোলনকারীদের খনি বিরোধীতার সিদ্ধান্তে প্রভাব রাখে সেটি বোঝা। যেহেতু ফুলবাড়ির খনি বিরোধী আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক দাবীগুলো জাতীয় কমিটি থেকে তোলা হয় সেহেতু তাদের এই কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ আমার আগের গবেষণা কাজের ধারাবাহিকতা রায় জরুরী ছিল। মোটা দাগে বলতে গেলে বাংলাদেশে উন্মুক্ত খনি প্রতিষ্ঠা বিরোধী আন্দোলনকে আরও গভীরভাবে জানতে নতুন গবেষণা ক্ষেত্র বা প্রশ্ন খুঁজতেই আমার এই অংশগ্রহণ।

    অংশগ্রহণকারী পর্যবেক হিসেবে লং মার্চ এর মত একটি রাজনৈতিক কর্মসূচীকে বুঝতে আমি মূলত: সামাজিক আন্দোলন নিয়ে গবেষণা কাজ করেছেন এরকম নৃবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিভঙ্গী ধার করেছি। সংক্ষেপে বললে, এই ধারার নৃবিজ্ঞানীদের মতে সামাজিক আন্দোলনের মত একটি সংগঠিত ও সামষ্টিক শক্তিকে বুঝতে অবশ্যই এর সদস্যদের সামাজিক কর্মী হিসেবেই দেখতে হবে, যারা একই সাথে ব্যক্তি হিসেবে স্বাধীন আবার সংস্কৃতির কাঠামো দ্বারা আবদ্ধ। ফলে দেখতে হবে এর আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক কর্মকান্ড, বন ও শ্লোগান এর স্তর ছাড়িয়ে সাধারণ সদস্যদের দৈনন্দিন জীবন যাপন, বিবেচনা করতে হবে তাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট ও তাদের ঐতিহাসিক শিক্ষা বা ভুলে যাওয়া।

    এখানে পাঠকদের জন্য আমি এই লেখাটি সাজিয়েছি প্রথমে জাতীয় কমিটির সংপ্তি একটি পরিচয় দিয়ে। এর পরে দিয়েছি লং মার্চ-এর প্রেস বিফ্রিং থেকে শুরু করে প্রস্তুতি মূলক সভাগুলোতে আমার অংশগ্রহনের অভিজ্ঞতা। তার পরে লিখেছি সাত দিনের লং মার্চের দৈনন্দিন কিছু পর্যবেক্ষণ। লেখাটির শেষে ছোট একটি উপসংহার দেয়া হয়েছে।

    জাতীয় কমিটি

    ১৯৯৭ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত একটি জাতীয় কনভেনশনের মাধ্যমে জাতীয় কমিটির জন্ম। এই কনভেনশনটি অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (এর পর থেকে সিপিবি) অফিসে। সেই সময়ে কনভেনশনে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের বামপন্থী এগারো দলের নেতৃতৃন্দ। তখন থেকেই এই মোর্চাটির আহবায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন শেখ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি একজন প্রকৌশলী । তার নিজস্ব সংস্থার অফিস ঘর জাতীয় কমিটির দাপ্তরিক ঠিকানা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। জাতীয় কমিটির প্রথম সদস্য সচিব ছিলেন গোলাম মহিউদ্দীন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক। ক্যান্সারে তাঁর মৃত্যুর পর ২০০৫ সালে তার পদে আসেন আনু মুহাম্মদ। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক।

    জাতীয় কমিটি মূলত: প্রচার চালায় যেন বাংলাদেশ সরকার ও বহুজাতিক তেল গ্যাস কোম্পানীর মধ্যে সম্পাদিত উৎপাদন বন্টন চুক্তি-২০০৮ বাতিল করা হয়। তারা আরো প্রচারণা চালায় যে বাংলাদেশের আমলারা দেশের স্বার্থ সংরক্ষণের বদলে বহুজাতিক তেল কোম্পানীগুলোর স্বার্থ রক্ষা করে। তারা সরকারকেও দোষারোপ করে যে সরকার তেল-গ্যাস নিয়ে নীতির ব্যপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষীত্র দেশের জ্বালানী চাহিদাকে অবহেলা করে।

    ফুলবাড়িতে উন্মুক্ত খনি বিরোধী আন্দোলন সংগঠন ছাড়াও জাতীয় কমিটি এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি আন্দোলনকে সংগঠিত করে। যেমন: ১) সুনামগঞ্জের গ্যাস ফিল্ড থেকে পাইপ লাইন স্থাপনের মাধ্যমে পাশ্ববর্তী দেশে গ্যাস রপ্তানীর প্রকল্প বাতিল। ২) ভারতীয় কোম্পানী টাটার ২ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাবনা বাতিল যেটি বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে গ্যাসের মূল্যের উপর ভর্তুকি চেয়েছিল। ৩) মাগুরছড়া ও টেংরাটিলায় গ্যাস ফিল্ড বিস্ফোরনের জন্য দায়ী বহুজাতিক তেল কোম্পানীগুলোর (যেমন: শেভরন ও নাইকো) কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের দাবী।

    প্রেস ব্রিফিং এবং প্রস্তুতি সভা

    লং মার্চের আনুষ্ঠানিক ঘোষনা হয় সেপ্টেম্বরের ২৮ তারিখ একটি প্রেস ব্রিফিংঅএর মাধ্যমে। আমি এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের দাওয়াত পাই আনু মুহাম্মদের কাছ থেকে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানের শিক্ষর্থী হবার সুবাদে আনু স্যারের সাথে আমার পরিচয় এবং পরবর্তীতে গণমাধ্যমে আমার কাজের সুবাদে তার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ। প্রকৃতপক্ষে ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত খনি বিরোধী আন্দোলন নিয়ে আমার গবেষণা করার আগ্রহ তৈরী করাতেও তাঁর ব্যপক প্রভাব রয়েছে।

    জাতীয় কমিটির কেন্দ্রীয় কমিটির আরেক সদস্য মেহেদী হাসান সহ আনু স্যারের সাথেই আমি প্রেস ব্রিফিং-এ যাই। মেহেদীর নিজস্ব গাড়ি আছে। মেহেদী আর আমার বাসা কাছাকাছি হওয়ায় সে প্রথমে আমাকে তারপর আনু স্যারকে বাসা থেকে গাড়িতে তুলে। ঢাকা শহরের যানজটের কারনে আমার বাসা থেকে প্রেস ব্রিফিং এর মিলনায়তনে যেতে (১০-১২ কি.মি দূরত্ব) কম পক্ষে দেড় ঘন্টা সময় লাগে এবং সিএনজি চালিত অটো রিক্সায় যেতে প্রায় ১৫০ টাকা খরচ হয়। টাকা পয়সা আর সময় বাঁচাতে যাতায়াতের এই ব্যবস্থাই আমার কাছে সবচেয়ে ভালো মনে হয়। আমাদের এই একসাথে গাড়ী ভ্রমণ নিয়ে আমার দু’টি গল্প বলার আছে।

    প্রথম গল্পটি মেহেদীর গাড়ি মালিকানা বিষয়ে। আমি সেই ২০০৮ থেকে দেখছি মেহেদী কয়েক মাস পর পরই গাড়ি পাল্টায়। যতদূর জানতাম মেহেদী চাটার্ড একাউনটেন্ট কিন্তু সেই লাইনে ‘জব’ করেনি। ১৯৯০ এর শেষের দিক পর্যন্ত সে কোন একটি শ্রমিক সংগঠনের হয়ে রাজনৈতিক কর্মকান্ড করতো। পরে কয়েক বছর সে নিজের ব্যক্তিগত উদ্যোগে করা ছেলেদের একটি শরীর চর্চা কেন্দ্র চালাতো, যেখানে সে ছিল ইনসট্রাকটর। এতোসব তথ্য এটাই বলে যে গাড়ি কেনার আর্থিক সঙ্গতি মেহেদীর নেই, কয়েক মাস পর পর গাড়ি পাল্টানোর মত বিলাসিতা তো দূর অস্ত। জিজ্ঞেস করে জানলাম ওর একটা গাড়ীর ওয়ার্কশপ আছে। আরও নির্দিষ্টভাবে বললে অভিমান করে বাবা-মা এর বাড়ি ছেড়ে আসা মেহেদী’র সাথে এক ওয়ার্কশপ মালিকের পাতানো ভাই সম্পর্ক আছে। যেদিন লং মার্চ শুরু হয় সেদিন সেই ভাইকে আমি দেখি। দেখে মনে হল সে খেটে খাওয়া মানুষ। হয়তো সে কিশোর বয়স থেকে গাড়ির ওয়ার্কশপে কাজ করেছে। পরে তরুন বয়সে হয়তো সে পেশাদার ড্রাইভার হিসেবে কাজ করতো। ছিপছিপে শরীরের লোকটির রোদে পোড়া তামাটে রং। তার চশমা পরা, পান খাওয়া মুখমন্ডল দেখে তাকে স্বচ্ছল একটি সংসারের কর্তা বলে মনে হল। তেল দিয়ে পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুলও সেই আলামত প্রকাশ করে।

    মূল প্রসঙ্গে ফেরা যাক। মেহেদী আসলে এই ভাইয়ের ওয়ার্কশপের মেরামতাধীন গাড়ীগুলো থেকে তার পছন্দের কোন একটি নিয়ে টেষ্ট ড্রাইভ করে। সারাই করা গাড়ীটি বিক্রি হয়ে গেলে বা প্রকৃত মালিক সেটা নিয়ে গেলে সে অন্য আরেকটি গাড়ি টেষ্ট ড্রাইভের জন্য বাছাই করে। মেহেদীর গাড়ি রহস্য বলাটা জরুরী মনে করলাম কারণ মেহেদী আনুর ‘নিরাপত্তা’ বিবেচনা করে প্রায় সময়ই তাকে গাড়ী করে ঢাকা শহরের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়ে যায় এবং বাসায় পৌঁছে দেয়। যেহেতু বাংলাদেশে পাবলিক একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকও গাড়ি কেনার সামর্থ্য রাখেনা তাই আনুর নিত্য নতুন গাড়ি চড়া নিয়ে ‘জনমনে সন্দেহ’ থাকলে তা এই গল্প থেকে দূর হতে পারে বলে আমার ধারণা। প্রায়ই আমরা, মানে তার ঘনিষ্ট কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী, সহকর্মী, সাংবাদিকরা আনু স্যারের “দামী গাড়ি” নিয়ে ঠাট্টা রসিকতা করি। আনু স্যারের বাসায় হলে বাপ্পি আপা, মানে আনুর স্ত্রী শিল্পী বড়–য়াও এই ঠাট্টায় অংশ নেন। আবার এই ফাঁকে বাপ্পি আপা মেহেদীকে গাড়ীর জন্য গ্যাস বা অক্টেন কিনতে টাকাও দেন। স্যারের বাসায় আমাদের সবসময়ই খাওয়ার ব্যবস্থা থাকে। সেটা পাউরুটি দিয়ে দেশী পাকা কলা থেকে শুরু করে ভাত দিয়ে সবজী ও গরুর মাংস পর্যন্ত বিচিত্র হয়। আর, মেহেদী গাড়ী চালানোর মত ‘কষ্টসাধ্য’ কাজটি করার অজুহাতে মাঝে মাঝে খাবারের বেশী ভাগটা দাবী করে থাকে।

    দ্বিতীয় গল্পটি লং মার্চ উপলেয জাতীয় কমিটির সম্মেলন ক প্রসঙ্গে। প্রেস ব্রিফিং এ যাওয়ার জন্য যখন মেহেদী বিজয় নগর পার হয়ে বায়তুল মোকাররম মসজিদের দিকে গাড়ী ঘুরানোর সিগনাল দিল তখন আমি একটু অবাকই হলাম। সাধারনত: সাংবাদিকদের জন্য অনুষ্ঠান করতে লোকে প্রেস কাব ভাড়া করে। সেই অনুযায়ী আমাদের গাড়ি ঘোরানোর কথা উল্টো দিকে। জানতে চাইলাম “আমরা কি প্রেস ব্রিফিং-এ যাচ্ছি না?” উত্তরে আনু খোশ মেজাজে বললেন, “তুমি কি ভেবেছো প্রেস ব্রিফিং প্রেস কাবে হচ্ছে? না। আমরা প্রেস কাব বর্জন করেছি। এরা তো আমাদের খবর ছাপেই না, উল্টো তেল কোম্পানীগুলোর দালালী করে।” উল্লেখ্য যে গণমাধ্যমের কর্মীদের মধ্যে তেল কোম্পানীগুলোর স্বার্থ রক্ষাকারী মনোভাব নিয়ে এই অভিযোগগুলো জাতীয় কমিটির বেশ পুরোনো। ফলে এর পাল্টা জবাব দিতে জাতীয় কমিটি বিকল্প সম্মেলন কক্ষ হিসেবে বেছে নিয়েছে সিপিবি এর সম্মেলন কক্ষ । আমার ধারণা ছিল শরীক দল হিসেবে সিপিবি হয়তো কক্ষটি বিনে পয়সায় ব্যবহার করতে দিচ্ছে। জিজ্ঞেস করে জানলাম আমার ধারণা ভুল, এবং সিপিবি’র করে ভাড়া প্রেস কাবের ভাড়ার কাছকাছি।

    এই পর্যায়ে আমি সিপিবি অফিসের একটি বর্ণনা দেবো। ১৯৯০ এর শেষ থেকে বিভিন্ন কারনে বাংলাদেশের বাম সংগঠনগুলোর অফিসে গেছি আমি। সেই পর্যবেনের সূত্রে আমার মনে হয় অর্থনৈতিকভাবে সিপিবি সবচাইতে অবস্থাপন্ন অবস্থায় আছে। সম্ভবত: ২০০৫ সালে প্রথম আমি সিপিবি অফিসে যাই। ততদিনে পল্টনের মোড়ে সিপিবি দুইটি বহুতল ভবনের মালিক। এর মধ্যে একটি শপিং মল আরেকটি সংগঠনের কাজে ব্যবহৃত হয়। শপিং মলের সাইন বোর্ড পড়ে পড়ে যতদূর বুঝলাম এই ভবনগুলো মণি সিংহ-ফরহাদ স্মৃতি ট্রাস্ট এর অধীনে পরিচালিত হয়। এঁরা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ছিলেন।

    ভবনগুলোর সামনের পুটপাথে পুরোনো বইয়ের দোকান, গরুর দুধের চায়ের ছাপড়া এবং মৌসূমী স্বস্তা ফল নিয়ে ফেরীওয়ালা সহ আছে আরও কিছু ছোট দোকান। সন্ধ্যার দিকে এই ফুটপাথে আলুর চপ, বেগুনী, পেঁয়াজুর দোকানও চালু হয়ে যায়। সিপিবি অফিসে ঢোকার জায়গা ভবনের পার্কিং এ প্রবেশ পথ দিয়ে। প্রবেশ পথের মুখের দেয়ালে প্রায় সব বাম সংগঠনের সাম্প্রতিকতম পোস্টারগুলো সাঁটানো। এই জায়গাটা পার হলেই নাক বরাবর হল লিফ্‌ট, বামে আছে নোটিশ বোর্ড আর ডানে পার্কি এর জন্য জায়গা। নোটিশ বোর্ডটিতে কবে কোন সম্মেলন কে কি বিষয়ে সভা হবে সেটা উল্লেখ করা। সম্ভবত: সাংবাদিকদের জন্য এই নোটিশগুলো লেখা। বোর্ড থেকে আরও জানতে পারলাম যে তুহিন চৌধুরী নামে একজন নেতা জেলে বন্দী আছেন, যিনি গার্মেন্টস শ্রমিকদের আন্দোলন সংগঠনে জড়িত ছিলেন। মেহেদী এই নোটিশ বোর্ডের সামনে আনু স্যারকে নামায় আর আমি পার্কিং এর জায়গাটা দেখবো বলে মেহেদীর গাড়ীতে পেছনের সীটে বসে থাকি।

    পার্কি এর জায়গাটা পুরোনো প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুনে ঠাসাঠাসি। গাড়ী এগুতেই লুঙ্গি আর কুর্তা পরা একজন বয়ষ্ক লোক সেখানে প্রায় ছুটে আসলেন। তাকে দেখে মনে হল তিনি কৃষক বা তে মজুর সংগঠনের সাথে আছেন। তার তঙ্কÄ¡বধানে মেহেদী বাঁশ আর চাটাই এর ডাঁই ঘেষে এমন ভাবে গাড়ী পার্ক করে যে আমাদের দুজনেরই গাড়ী থেকে বের হতে দরজা নিয়ে ধাক্কাধাক্কি করতে হয়। পার্কি থেকে লিফ্‌ট এর কাছে এসে দেখি আনু স্যার উপরে চলে গেছেন। ঢাকা শহরের আর দশটা বহুতল ভবনের মত এখানেও লিফ্‌ট এর বাম পাশে একটা ডেস্ক। সাধারনত: এখানে “সিকিউরিটি চেক” হয়। অর্থাৎ কে এসেছে, কোথা থেকে এসেছে, কার কাছে যাবে এই ধরনের তথ্য লিখে অতিথির স্বার নেয়া হয়। “সিকিউরিটি চেকের” সময় অনেক জায়গায় আবার মেটাল ডিটেকটর দিয়েও তল্লাশী করা হয়। তবে, এখানে সেই সব হাঙ্গামা নেই। ডেস্ক এ যিনি থাকেন তার আচার আচরণ দেখে মনে হয় তিনি কোন শ্রমিক সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন বা আছেন। একজন রাজনৈতিক কর্মীর মতই তিনি আমাদের অভ্যর্থনা করেন, কিন্তু মেহেদী ছোটে চা খেতে। আমি মেহেদীকে অনুসরণ করি।

    সকাল এগারোটায় প্রেস ব্রিফিং শুরু হয়। এর মধ্যে চা খেতে উধাও হবার জন্য মেহেদী “আয়োজক হিসেবে তো আগে আগে উপস্থিত থাকতে হবে” এই মন্তব্য শুনে ফেলেছে, সম্মেলন কে জনা পাঁচেক সাংবাদিক, স্থির চিত্র গ্রাহক, চলচ্চিত্র গ্রাহক উপস্থিত হয়ে গেছে, এবং জাতীয় কমিটির কেন্দ্রীয় কমিটির প্রায় সকল নেতৃবৃন্দও চলে এসেছেন। নেতৃবৃন্দ মঞ্চে ওঠার পর আমি খেয়াল করলাম এখানে আমি এক মাত্র মেয়ে। আমার না আছে সাংবাদিক পরিচয়, না আছে রাজনৈতিক কর্মীর পরিচয়। ফলে “না ঘরকা, না ঘাটকা” ধরনের অস্বস্তিকর একটা অনুভূতি নিয়ে আমি একজন সাংবাদিকের পাশে বসলাম। কিন্তু একটা পর্যায়ে চিত্রগাহকদের পেশাদারী কাজের যন্ত্রণায় সেই জায়গা ছেড়ে পরিচিত রাজনৈতিক কর্মীদের পাশে গিয়ে বসলাম।

    লং মার্চ উপলক্ষে জাতীয় কমিটির প্রেস ব্রিফিং ছিল নির্দিষ্ট, কিন্তু বিস্তারিত। এখানে লিখিত বক্তব্যের সাথে সাংবাদিকদের জন্য দেয়া হয় লং মার্চের পথের মানচিত্র, পদযাত্রিকদের থাকা-খাওয়া-সভাস্থলের বিস্তারিত পরিকল্পনা ও লং মার্চ উপলেয বিভিন্ন পর্যায়ের সংগঠকদের নিয়ে প্রস্তুতি বিষয়ক সভার তালিকা। প্রেস ব্রিফিং-এ লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন আনু মুহাম্মদ এবং সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দেন তিনি সহ বিচারপতি গোলাম রাব্বানী এবং ইঞ্জিনিয়ার শেখ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ।

    প্রেস ব্রিফিং-এ সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে মাত্র তিনটি প্রশ্ন আসে। প্রশ্নগুলো নির্দিষ্ট কোন তথ্য জানার উদ্দেশ্য থেকে করা হয় না। বরং প্রশ্নগুলো শুনে ধারণা হয় যে এরা উত্তরদাতাদের কাছ থেকে সরকারের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক ও অসহিষ্ণু মন্তব্য কামনা করে। যেমন, একটি প্রশ্ন ছিল “সরকার যদি আপনাদের কর্মসূচীতে বাধা দেয় তাহলে আপনারা কি করবেন।” আনুষ্ঠানিকভাবে আনু এই প্রশ্নের উত্তরে প্রথমে হাসি দিয়ে প্রশ্নকারীর উত্তেজনা প্রশমন করেন। পরে তিনি ব্যাখ্যা করেন যে সরকার শুধু জাতীয় কমিটির না তার নিজ দলের সমর্থকদেরও ক্ষতি করছে। তাই সরকারী দলের সমর্থকদেরও উচিত তাড়াতাড়ি লং মার্চে অংশগ্রহণ করা। উল্লেখ্য যে ন দিগন্ত, দিগন্ত টেলিভিশন, ইসলামিক টেলিভিশনের মত সরকার বিরোধী পত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিকদের উপস্থিতি লং মার্চের প্রস্তুউতি পর্বে নিয়মিত ছিল। আর জাতীয় কমিটির নেতৃবৃন্দ পত্রিকায় “লীড নিউজ” হবার “ফাঁদ” থেকে সদা সতর্ক ছিলেন। যেমন এই প্রশ্নটি নিয়েই যখন প্রেস ব্রিফিং পরবর্তী চা চক্রে নেতৃবৃন্দ আলোচনা করেন তখন একজন সরস মন্তব্য করেন, “প্রশ্নটা শুনে আমার মাথায় তো একটা শ্লোগান এসেছিল। বাধা দিলে বাঁধবে লড়াই, এ লড়াইয়ে জিততে হবে।” আরেক জন মন্তব্য করেন, “এই সাংবাদিকরা মনে করে এই রকম ঢ়্‌ৎড়াড়শরহম প্রশ্ন করলে আমরা বুঝি তোফায়েলের (আওয়ামী লীগের একজন নেতা) মত জবাব দেবো।”

    দ্বিতীয় সাংবাদিক কথা বলেন লিখিত ব্রিফিং এর কোন একটি বাক্যের ভুল গঠন বা যতি চিহ্নের ভুল ব্যবহার নিয়ে, যেটা আনু খুঁজে পান না। যে বাক্যটা নিয়ে কথা হচ্ছিল সেটা হল তেল কোম্পানীগুলোকে তৃতীয় পরে কাছে গ্যাস বিক্রি করতে দেয়ার অনুমতি প্রসঙ্গে। বাক্যের ভুল না পেয়ে আনু তাই এই চুক্তির ফলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক তির হিসাব নিকাষ ব্যাখ্যা করেন। কিন্তু সাংবাদিকটি সেই ব্যাখ্যার নোট নেন না।

    তৃতীয় সাংবাদিকটি রীতিমত হাহাকার করে ওঠেন, “এই যে আপনারা এতো ক্ষতির কথা বলছেন, গ্যাস রপ্তানী করতে না দেয়ায় দেশের কত লাভ হল সেটা বললেন কিন্তু সরকার তো আপনারা যেটা মানা করছেন সেটাই করছে তাহলে এখন কি হবে?” উত্তরে বিচারপতি গোলাম রাব্বানী মন্তব্য করেন, “সত্যের পক্ষে যারা আছে তারা থাকবেই। ইতিহাসে এরকম অনেক নজির আছে, দেখবেন।”

    (চলবে....)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • অপর বাংলা | ২৩ নভেম্বর ২০১০ | ৭৬৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি প্রতিক্রিয়া দিন