এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  অপর বাংলা

  • লং মার্চের ডায়েরি - ষষ্ঠ কিস্তি

    নাসরিন সিরাজ লেখকের গ্রাহক হোন
    অপর বাংলা | ২০ জুন ২০১১ | ৯৬৩ বার পঠিত
  • বাংলাদেশে জনসভার মত গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচীগুলো রাজধানী ঢাকার বাইরের জেলা শহরের যে সব স্পটে অনুষ্ঠিত হওয়ার রেওয়াজ আছে গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা সে রকমই একটা স্পট। সাধারনত আন্ত:জেলা মহাসড়কটিই জেলাগুলোর প্রধান সড়ক হয়। বেশীরভাগ সময় দেখা যায় জেলার আন্ত:জেলা বাস স্টপেজই সে এলাকার প্রধান বা একমাত্র বাস স্টপেজ। স্টপেজ সংলগ্ন এলাকায় জেলার সবচাইতে আধুনিক বহুতল বাজার, ডাক্তারের চেম্বার-ক্লিনিক-ওষুধের দোকান, আর নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের কাঁচাবাজারগুলোও গড়ে উঠে। তাই প্রতিদিন এসব স্পটে বাস যাত্রী, ক্রেতা, বিক্রেতাসহ বিপুলসংখ্যক মানুষের সমাবেশ ঘটে। গাজীপুর একটি উল্লেখযোগ্য শিল্প কারাখানা জোনও বটে। তাই চলমান ভিড়ের মধ্যে কারখানাফেরত কর্মচারী ও শ্রমিকও লক্ষ্য করা যায়।

    লং মার্চের প্রথম বিকালের ম্লান আলোতে চান্দনা চৌরাস্তায় হাজার হাজার লোকের ভীড়ে আয়োজিত জাতীয় কমিটির জনসভায় অংশগ্রহণকারীদের ওপর নজর বুলাচ্ছিলাম আমি। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চর্চার চরিত্র আন্দাজ করতে বাম রাজনৈতিক দলগুলোর সফল ও সক্রিয় একটি মোর্চার এই কর্মসূচীতে স্বশরীরে অংশগ্রহণ করার সুযোগ পাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হল আমার।

    আমি লক্ষ্য করেছিলাম এই রাজনৈতিক কর্মসূচীর মাধ্যমে জাতীয় কমিটির বক্তব্যের সফল প্রচারনা। জনসভার দৃপ্ত চেহারার কর্মী, প্রায় বিলুপ্ত লোক গান জারি গানের সুরে চারণ শিল্পী গোষ্ঠির গান, রাস্তার পথিকদের হাতে এবং চলমান বাসের জানালায় মার্চারদের লিফলেট বিতরণ, বুকলেট বিক্রি, সমাবেশের শেষ প্রান্তে স্টল বসিয়ে ছাত্র ফেডারেশনের কর্মীদের টি-শার্ট ও পুস্তিকা বিক্রি -- ইত্যাদি আয়োজনে প্রচারণা কাজ চলছিল। প্রচারণার অংশ হিসেবে গান শেষে শুরু হয় বক্তৃতা।

    জনসভায় বক্তৃতাই হচ্ছে মূল আকর্ষণ। বক্তৃতা শুরু হওয়ার আগে গানের আয়োজন করা হয় মূলত: সাধারণ দর্শক-শ্রোতার দৃষ্টি আকর্ষণ ও সভাস্থলে বসার সুযোগ তৈরীর জন্য। সাধারনত: অনুষ্ঠানের শেষের দিকে গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের বক্তৃতা দেওয়ার জন্য ডাকা হয়। বক্তাকে ডাকার সময় আহ্বায়ক বক্তার নামের আগে বিশেষণ ব্যবহার করে তার গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা করেন। এই সভাতেও তার ব্যতিক্রম হল না। সন্ধ্যা পাঁচটা থেকে বক্তৃতা অনুষ্ঠান শুরু হয়ে রাত প্রায় দশটা পর্যন্ত চলে। অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন জাতীয় কমিটির গাজীপুর জেলা কমিটির আহ্বায়ক আবদুল কাইয়ুম। বক্তব্য দেন স্থানীয় নেতা ওসমান আলী, জয়নাল খান, মীর দেলোয়ার হোসেন, মজিবুর রহমান, কেন্দ্রীয় কমিটির আহ্বায়ক প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, সদস্য সচিব ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আকমল হোসেন, সমুদ্র বিষয়ক গবেষক নুর মোহাম্মদ, কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মনজুরুল আহসান খান, সমাজতান্ত্রিক দলের আহ্বায়ক খালেকুজ্জামান ভূঁইয়া, ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক বিমল বিশ্বাস, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, জাতীয় গণফ্রন্টের আহ্বায়ক টিপু বিশ্বাস, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সভাপতি মোশরেফা মিশু, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্ববয়ক জোনায়েদ সাকী, সাম্যবাদী দলের পলিটব্যুরো মেম্বার ধীরেন সিং, ওয়ার্কার্স পার্টি পুনর্গঠিত-এর সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আবদুস সাত্তার, অ্যাডভোকেট শ্যামল কান্তি দে সহ আরও অনেকে।

    একেকজন বক্তা পনের থেকে বিশ মিনিট বা তারও বেশী সময় ধরে কথা বললেও স্বীকার করতে লজ্জা নেই, নেতাদের বক্তব্য শোনার জন্য আমি আগ্রহী ছিলাম না। কারণ প্রত্যেক বক্তা প্রায় একই কথা বলছিলেন, যেটি একঘেয়েমি তৈরি করছিল। তাছাড়া বক্তারা বলিষ্ঠ ও জোরালো কন্ঠ বানিয়ে চিৎকার করে বক্তৃতা দিলেও শস্তা সাউন্ড সিস্টেমের মাইকগুলো কর্কশ আর ফাটা আওয়াজে বেশীরভাগ সময়ই স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল না।

    বক্তাদের কথার সারমর্ম প্রেস রিলিজে পাওয়া যাবে -- এরকম আশা করে আমি বুকলেট বিক্রির দলে যোগ দিতে চেয়ার ছেড়ে সভাস্থলের দক্ষিণ দিকের মার্কেটটির দুই ধাপের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। মার্কেটের বারান্দা যেখানে শেষ হয়েছে, আর জনসভার বক্তৃতা শোনার জন্য শ্রোতারা যেখানে দাঁড়িয়েছে, তার মাঝামাঝি সরু এক চিলতে চলার পথ। সেই পথ দিয়ে শত শত লোকজন দ্রুত গতিতে যাওয়া-আসা করছে। আমি তাদেরকেই বুকলেটের ক্রেতা হিসেবে টার্গেট করলাম।

    আমার কাছে দ্বিতীয় লক্ষ্যনীয় বিষয়, এই রাজনৈতিক কর্মসূচীটি স্থানীয়দের মতামতে কেমন প্রভাব ফেলছে, সেটা বোঝা।

    আমি প্রশ্ন করার আগেই শুনলাম লোকজন নিজেরাই এই জনসভায় অংশগ্রহণকারীদের নিয়ে নানা মন্তব্য করছেন। প্রসঙ্গত, বাম রাজনৈতিক দলের কর্মীরা আদর্শবান, আদর্শের জন্য সারাজীবন উৎসর্গ করেন এবং রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নির্বাচনের মত টাকার খেলায় নামেন না-- এরকম একটা ধারণা সাধারণভাবে রয়েছে। তখন লোকমুখে শোনা নানান মন্তব্যে এই অনুমানই জোরালোভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল। যেমন, একজন তার সঙ্গীকে বলছেন, সমাবেশে বসে থাকা কর্মীদের টাকার প্রতি নির্লে?ভ আচরণের কথা। তিনি বলেন, বড় বড় দলেরও (আওয়ামী লীগ/বিএনপি) মিছিল-মিটিংয়ের জন্য টাকা দিয়ে লোক ভাড়া করতে হয়। কিন্তু এই যে এতগুলো লোক দেখছেন ...বামপন্থীদের মিছিলে আনতে টাকা দিতে হয়না। ...

    স্থানীয় একজন নেতা বক্তব্য দিতে স্টেজে উঠলে আবার মন্তব্য করতে শুনলাম, ওই নেতা নাকি খুবই ভালো লোক। তার এ জন্য সুনামও রয়েছে। অনেক পুরনো নেতা হওয়া স্বত্বেও তিনি ক্ষমতালোভী নন।

    রাত নয়টার দিকে দোকানপাট বন্ধ করে বাড়ি ফেরার সময় জনসভায় বসে থাকা কর্মীদের দিকে তাকিয়ে একজন দোকানদার মন্তব্য করেন, ''আওয়ামী লীগ, বিএনপি'র মিটিং হইলে লোকজন এতোক্ষণে বাড়ির দিকে চলে যাইতো। আর এরা এরকমই, মিটিং শেষ না কইরা কেউ যাইবে? না।"

    চান্দনা যে ধরনের স্পট তার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখানে পুরুষদের উপস্থিতির আধিপত্যই বেশী। বাংলাদেশে পাবলিক প্লেসে নারীদের প্রান্তিক অবস্থানের কারণে অনেক পুরুষই সংঘবদ্ধভাবে নারীদের প্রতি অনেক সময় আগ্রাসী মন্তব্য বা আচরণ করে থাকেন। তবে সেদিন আমার ব্যতিক্রম অভিজ্ঞতা হল। অবশ্যই আমারা স্বদল-বলে ছিলাম বলেই এমনটি হয়েছে। লং মার্চারদের সাথী হিসেবে আমি "নিরাপদেই' ভিড়ের মধ্যে মিশে গিয়ে মানুষের সাথে আলাপ করতে পারছিলাম।

    আমি যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম সেখান থেকে স্টেজটা হাত দশেক দূরে। স্টেজের পেছনে, অর্থাৎ পূব পাশে একটা চায়ের দোকান রয়েছে। সেখানে লং মার্চারদের কেউ কেউ গিয়ে চা এবং সিগারেট খাচ্ছেন। মাগরিব ও এশার আজানের কারণে এর মধ্যে দু'বার বক্তৃতায় বিরতি দেওয়া হয়েছে। বিরতির মধ্যে দুবার আমিও মেহেদী আর সবুজ ভাইয়ের সাথে গিয়ে চা খেয়ে এসেছি। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর বেশ কয়েকজন স্টেজের আশেপাশেই দাঁড়িয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের নিরাপত্তা তদারকি করছেন। আমার কাছাকাছি আরও একজন স্বেচ্ছাসেবক লিফলেট বিলি করছিলেন। তিনি গার্মেন্টস শ্রমিকদের একটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত পেশায় একটি তৈরী পোষাক কারখানার সেলাই মেশিন অপারেটর।

    আমার আরেকটি লক্ষ্যনীয় বিষয় ছিল, ওই জনসভায় নারীদের অংশগ্রহণ। আগেই বলেছি, জাতীয় কমিটির প্রায় প্রতিটি শরিক দল থেকেই নারী কর্মীরা লং মার্চে অংশগ্রহণ করেছেন। তাদের সংখ্যা মোট অংশগ্রহণকারীদের এক শতাংশের বেশী হবে না। তাদের মধ্যে আবার গার্মেন্টস শ্রমিক ও ছাত্রীদের সংখ্যাই বেশী। সমাবেশস্থলে তাকিয়ে সেই সব কর্মীদের চেয়ারে বসে মনোযোগ দিয়ে বক্তৃতা শুনতে দেখলাম। স্টেজে একমাত্র নারী বক্তা হিসেবে উপস্থিত মোশরেফা মিশু। মার্চাররা ছাড়া স্থানীয় যে সব পথচারী জনসভা শোনার জন্য সভাস্থলটিকে ঘিরে দাঁড়িয়েছিলেন, লক্ষ্য করে দেখলাম, তাদের মধ্যে কোনো নারী পথিক নেই। জনসভার শেষের দিকে, রাত প্রায় সাড়ে আটটা/নয়টার দিকে গার্মেন্টস কারখানা থেকে নারী শ্রমিকরা দলে দলে বাড়ি ফিরছিলেন আমার সামনে দিয়েই। কিন্তু তাদের চোখ মাটির দিকে নিবদ্ধ, তারা কিছু শুনছেন কি না সন্দেহ। কয়েকজনকে লিফলেট বাড়িয়ে দিলে তারা পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন। আবার কয়েকজন চোখ তুলে এমন ভীত হয়ে আমার দিকে তাকালেন যে, মনে হল আমি বোধহয় কোনো রাস্তার বখাটে। আর যেটা এগিয়ে দিচ্ছি সেটা লিফলেট নয়, প্রেম পত্র!

    রাত দশটার দিকে জনসভা শেষ করে মার্চাররা রওনা হলেন ভাওয়াল কলেজের দিকে। সেখানে সবার জন্য রাতের খাবার ও ঘুমানোর আয়োজন করা হয়েছে। আমি, আনু মুহাম্মদ, মেহেদী, গণসংহতি আন্দোলনের নেতা ফিরোজ আহসান একসাথে সেদিকে হাঁটছিলাম। মার্চাররা ছাড়া রাস্তাঘাট প্রায় জনমানব শূন্য হয়ে পড়েছে। হাঁটতে হাঁটতে দেখি চান্দনার গোল চত্বরে গ্রীল দিয়ে ঘেরা ছোট একচিলতে জায়গায় আরো অনেক ব্যানারের সাথে একটি ব্যানার শোভা পাচ্ছে। তাতে লেখা আছে: সংসদে রাশেদ খান মেনন কর্তৃক প্রস্তাবিত খনিজ সম্পদ রপ্তানী নিষিদ্ধকরণ আইন পাশ কর!

    উল্লেখ্য, ২০০৯ সালের ১৫ অক্টোবর জাতীয় কমিটি খনিজ সম্পদ রপ্তানী নিষিদ্ধকরণ আইনের খসড়াটি জ্বালানী বিষয়ক সংসদীয় কমিটির কাছে পেশ করে। খসড়াটি তৈরীতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন জাতীয় কমিটির অন্যতম সদস্য বিচারপতি গোলাম রাব্বানী। এই খসড়াটিই ২০০৯ এ ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি এবং ঢাকা মহানগরীর একটি আসনের সাংসদ রাশেদ খান মেনন সংসদে পেশ করেন। তবে এর পরে সংসদে এ নিয়ে কোন নড়াচড়া দেখা যায়নি।

    মনে মনে ভাবলাম, বামপন্থীরা যে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে না, এই ধারনাটি সব সময় সত্য নয়। আর তাদের কেউ কেউ নির্বাচনী প্রচারনায় জাতীয় কমিটির সাফল্যকেও অনেক সময় সামনে নিয়ে আসছেন।

    ভাওয়াল কলেজে পৌঁছে দেখি এলাহী কাণ্ড। স্কুলের ক্লাসরুমের বেঞ্চগুলোকে বিছানার মত ব্যবহার করছেন অনেকে। অনেকে আবার বেঞ্চ সরিয়ে ঘর ফাঁকা করে মেঝেতে কার্পেট বিছিয়ে ঘুমানোর ব্যবস্থা করেছেন। রান্না করা হয়েছে ভাত, ডাল আর ডিমের তরকারি। প্লেট হাতে সারি ধরে দাঁড়িয়েছেন মার্চাররা। আনু স্যার এর মধ্যে আমাকে বললেন, "এই সবে শুরু। সামনে আরো অনেকবার ডিম খেতে হবে।' আমিও একমত হলাম। এতো মানুষের জন্য খাবারের আয়োজন করতে ডিমের মত শস্তা ও সহজ তরকারি আর হয় না। লাইনে দাঁড়িয়ে খাবার পেতে বেশীক্ষণ লাগে না। কোন রকম হৈ চৈ ছাড়াই খাবার বিতরণ তদারকি করছেন স্বেচ্ছাসেবকরা। আর মার্চাররাও খাবার নিয়ে কেউ বেঞ্চে বসেছেন, কেউ কেউ গোল হয়ে বসেছেন নিজ দলের সাথে স্কুলের মাঠে চাঁদের আলোয়। খেতে খেতে কেউ বা ছোট খাটো সাংগঠনিক মিটিংও সেরে নিচ্ছিলেন।

    খবর নিয়ে জানলাম, মেয়েদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটে। গণসংহতির মেয়ে কর্মীরা তাদের স্থানীয় সহকর্মীদের বাসায় থাকার ব্যবস্থা করেছে। সংগঠনটির অন্যতম নেতা তাসলিমা আখতার। তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব অনেকদিনের। সে আমাকে তাদের সাথে থাকার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু আমি নতুন মানুষদের সাথে পরিচয় হবে, বন্ধুত্ব হবে -- এ উদ্দেশ্যে ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটেই থাকবো বলে ঠিক করি।

    একটি পিকআপ ভ্যান ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটে মেয়েদের নিয়ে যাবার জন্য অপেক্ষা করছিল। এটাই আমাদের পথ প্রদর্শক গাড়ি। এটিতে সারাদিন মেহেদী আর মাসুম চড়ে বেড়িয়েছে। গাড়িটির খোলা জায়গায় উঠে দেখি এরইমধ্যে সেটা লিফলেট, বুকলেট, চোঙ্গা মাইক, মাইকের ব্যটারী, ব্যাগ ইত্যাদিতে বোঝাই। ওর ভেতরেই আমরা দশ-বারো জনের মত মেয়ে উঠে বসলাম। জায়গার অভাবে কেউ কেউ একে অন্যের কোলে চড়ে বসলো। এখানে মেয়েদের সাথে গাড়ির চালক ও তার সাহায্যকারীর আচরণ উল্লেখ না করে পারছি না।

    নেতারা আমাদের বিদায় দিয়ে সরে যেতেই গাড়ির চালক ও তার সাহায্যকারীরা আমাদের সাথে এমন মাতব্বরী করতে শুরু করলো যেন এসব মেয়েদের দায়িত্ব তাদেরই। আর মেয়েরা গাড়ীতে চড়ে বসার মত সামান্য কাজটিও নিজে নিজে করতে পারে না। যেন চোঙ্গা মাইকটির ওপর কেউ বসে না পড়ে, সে জন্য কিশোর সাহায্যকারীটি মুখ খিঁচিয়ে বকতে শুরু করলো। সারাদিনের ক্লান্তিতে মেয়েদের কারোরই আর মেজাজ ঠিক নেই। এমনভাবে মেয়েদের বসতে হয়েছে যে গাড়িটি চলার সময় রাস্তার খানাখন্দে পড়ে লাফিয়ে উঠলে দু-একজনের সেখান থেকে টুপ করে পড়ে যাওয়ার আশংকা আছে। কোলে বসতে গিয়েও কেউ কেউ হেসে খুন হয়ে যাচ্ছে। এসব হৈ চৈ এর মধ্যে ওই কিশোরের সাথে আরও যোগ দিলেন চালক। সে মেয়েদের হৈ চৈ-এ খুব বিরক্ত। তবে আমার সহযাত্রী মেয়েরা এই ধমকে চুপ হননি। জলি নামে কমিউনিস্ট পার্টির একজন নেত্রী উল্টো ধমক দিয়ে গাড়ির চালক ও তার সাহায্যকারীকে থামিয়ে দিলেন। গাড়ি চলতে শুরু করলে তিনি তার সহকর্মীদের গান ধরতেও উৎসাহিত করলেন। জলির কাছেই জানলাম, যারা গান গাইছেন তারা গার্মেন্টস শ্রমিক। তারা সকলেই গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরী নিয়ে বাংলাদেশে চলা আন্দোলনের কর্মী। আন্দোলন করতে গিয়ে তারা জেলও খেটেছেন। জেলেই তারা এইসব গান বেঁধেছেন। ব্যানার দিয়ে গাড়ির হেডলাইট ঢাকা থাকায় আমরা অন্ধের মত চলছিলাম। তার ওপর চালক ও তার সহকারীরা রাস্তা ঠিকভাবে চেনে না বলে পরষ্পরের সাথে আলাপ করছে। এমন পরিস্থিতিতে গার্মেণ্টস শ্রমিকদের জেল জীবনের তৈরি গান শুনতে শুনতে আমরা গন্তব্যে পৌঁছে যাই। ঘড়িতে তখন রাত প্রায় বারোটা।

    (চলবে)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • অপর বাংলা | ২০ জুন ২০১১ | ৯৬৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে মতামত দিন