আমি যে বাসে উঠেছি সেটায় আছেন ছাত্র ইউনিয়ন, সাম্যবাদী দল, জাতীয় গণতান্ত্রিক গণ মোর্চার নেতা ও কর্মীরা এবং আরো বেশ কয়েকজন, যারা ঠিক কোন দলের সাথে সম্পৃক্ত না হয়েও আন্দোলনে যুক্ত আছেন বা জাতীয় কমিটির আন্দোলনটির বিষয়ে জানতে আগ্রহী। প্রস্তুতি পর্বের সভাগুলোর মধ্যে "সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়' শীর্ষক সভায় লং মার্চে অংশগ্রহণ করতে আগ্রহী সাংবাদিকদের যে "ভেহিক্যাল সাপোর্ট' দেবার কথা হয়েছিল বুঝলাম ১০ নম্বর বাসটি সে কাজেও নিয়োজিত।
বাসে সিট অপ্রতুল থাকবে এবং সিটে বসা নিয়ে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে পারে এই বিষয়ে আমার আগে থেকে প্রস্তুতি ছিল। সিনিয়ররা সিট ছাড়েনা, অথবা সিনিয়রদের সিট ছাড়তে বললে "বেয়াদপি' হয় এ নিয়ে আগের লং মার্চগুলো থেকে অভিযোগ পেয়ে জাতীয় কমিটির নেতৃবৃন্দ শিক্ষা নিয়েছিলেন। প্রস্তুতি সভাগুলোতে জাতীয় কমিটির কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে তাই সকলকে সকলের প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণ করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল। আগের লং মার্চগুলোতে অনেক যাত্রীই বাসে সিট না পেয়ে দুই সারির মাঝখানে হাঁটাহাঁটির জায়গায় বিছানার চাদর পেতে বসে ভ্রমণ করেছেন বলেও শুনেছি। তাই বাসে উঠে বেশ কিছু সিট খালি দেখে অবাক হলাম। প্রথম সারির একটা সিটে বসলাম আমি।
বাসের সহযাত্রীদের দিকে তাকানোর পর বেশ একলা লাগতে থাকে আমার। কোন পরিচিত মুখ নেই বাসে। পুরো বাসে আমি একমাত্র মেয়ে। স্বেচ্ছাসেবক দলের একজনকে শুধু চিনি আমি (সে ছাত্র ইউনিয়নের নেতা)। সে আমার পাশে এসে বসলো। আমাদের প্রথম যাত্রা বিরতি হল টঙ্গীতে বাটা কারখানার কাছে নির্মাণাধীন একটি কমপ্লেক্সে। আমরা থেমেছিলাম দুপুরের খাবারের জন্য।
বাস থামার পর আমার বাস থেকে নামতে ইচ্ছা করছিল না। কারণ, এক ক্লান্তি, দুই একাকীত্ব বোধ। বাস থেকেই দেখতে পাচ্ছিলাম নিমার্ণাধীন ভবনের দোতলায় লাইন ধরে লোকজন খাবার নিচ্ছে, কেউ কেউ গোল হয়ে দাঁড়িয়ে বা বসে খাচ্ছে, কেউ খাবার শেষ করে হাত ধুচ্ছে, কুলি করছে। সাধারনত: এভাবে গণ খাবারের বন্দোবস্ত করলে একটা ভিড়-ধাক্কাধাক্কি হয়। অনেক সময় প্রথম দিকে খাবার পাওয়া যায় কিন্তু শেষের দিকে খাবারে টানাটানি পড়ে যায়। খাবার নিয়ে বিশৃংখলা দেখতে আমার রুচিবোধেও বাধ সাধছিল। বাসে গ্যঁ¡ট হয়ে বসে থাকার সেটা তৃতীয় কারণ।
আমার জানা মতে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ ছাড়া আমার পরিবার খাবার নিয়ে কখনও কোন অভাব বোধ করেনি, যদিও বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৪৮% দারিদ্র সীমার নীচে বসবাস করে। অর্থাৎ, প্রায় ৮ কোটি লোক সর্বনিম্ন খাদ্যের চাহিদা মেটাতে পারে না। যার অর্থ তারা হয় একবেলা খায়, আরেক বেলা খায় না, বা প্রতিবেলা খেলেও আধপেটা খায়, অথবা যা খায় সেটার পুষ্টিমান কম।
এর মধ্যে একবার বাসের ড্রাইভারের সহকারী এসে আমাকে একলা বাসে বসে থাকতে দেখে বললো তারা খেয়ে ফিরে আসা পর্যন্ত যেন আমি বাসের পাহারায় থাকি। আমি বাসে বসে থাকার একটা পোক্ত অজুহাত পেয়ে আমার ল্যাপটপে ফেসবুক খুলে বসলাম। পরিবার বা নিকটজনের সাথে মোবাইলে সাধারণ খবর আদান প্রদান করার মত পরিস্থিতি আমার না, যদিও এটা এখনকার সময়ের মানুষদের একটা সাধারণ আচরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার বাবা-মা হজ্জ্ব এ গেছেন, কিন্তু তারা দেশে থাকলেও টিভি খবরে কোন দুর্ঘটনার বা মারামারির খবর না পেলে আমার ঢাকার বাইরে ভ্রমণ নিয়ে তারা সাধারনত: কম উদ্বিগ্ন থাকেন। আমার স্বামীও আমার পেশার স্বার্থে ঢাকার বাইরে ভ্রমণের বিষয়টিতে অভ্যস্ত। তবে এই লং মার্চ নিয়ে আমার বন্ধু ও পরিচিত মহলের নানা কারণে আগ্রহ ছিল। তাদের জন্য আমি ফেসবুকের স্ট্যটাসটাকে খবর এর মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করলাম। প্রথম খবর ছিল, "কোন প্রকার বাধা বিপত্তি ছাড়া লং মার্চ টঙ্গী এসে পৌঁছেছে।' আমি ব্যবহার করি সিটিসেল কোম্পানীর মোবাইল ইন্টারনেট সার্ভিস, যার নাম জুম। এই সার্ভিস ব্যবহার করে এই স্ট্যাটাসটা দেওয়া ছাড়া আর বেশী কিছু করতে পারলাম না। স্ট্যাটাসটা পোস্ট হওয়ার সময় দেখলাম দুপুর একটা বাজে। বেশ অবাকই হলাম। কারণ সকাল থেকে এতো হৈ হট্টগোলের মধ্য দিয়ে গিয়েছি যে ভাবতেই পারিনি এত কম বেলা গেছে। এরপরে বেশ কিছুক্ষণ লং মার্চের কিছু ছবি, মিছিলের ভিডিও আপলোডের চেষ্টা করলাম, কিন্তু পুরোপুরি ব্যর্থ হলাম।
আমি যখন আমাদের মধ্যাহ্ন বিরতির জায়গায় পৌঁছালাম ততক্ষণে অনেকের মূল খাওয়া পর্ব শেষ, চা-পান-তামাক খাবার পর্ব চলছে। নির্মাণাধীন বহুতল কমপ্লেক্সের গেট দিয়ে ঢুকে দেখি কাঠামোটির সামনে একটু খোলা জায়গায় সবুজ ঘাস আছে সেখানে চেয়ার পেতে শহীদুল্লাহ ভাই, আনু স্যার, নূর মোহাম্মদ ভাই, কমরেড খালেকুজ্জামান, নান্নু ভাই সহ আরো অনেকে বসে পত্রিকা পড়ছেন এবং চা খাচ্ছেন। দোতলায় উঠে দেখি তখনও দুটো লম্বা লাইন খাবার পাবার জন্য অপেক্ষা করছে। লাইনে দাঁড়ানো সবার হাতে হাতে মেলামাইনের প্লেট ও কাঁচের গ্লাস। বড় বড় দুই/তিনটা পাতিল ভর্তি খিচুড়ি বিলি করা হচ্ছিল। হাত ধোয়ার আর প্লেট ধোয়ার পানিতে পুরো জায়গাটা ছয়লাপ হয়ে আছে। খুব অবাক হলাম যে প্লেট ধোয়ার জায়গাতেও নারী শ্রমিক নেই। খাবার বিলি, পানি বিলি সবজায়গাতেই পুরুষরা কাজ করছে। মনে হল পেশাদার লোক দিয়েই খাবার রান্না ও বিলি করা হয়েছে। বাংলাদেশে সাধারনত: যারা পেশাদার রাঁধুনী বা বাবুর্চি তাদের দলে মশলা পেশা ও থালা বাসন ধোয়ার কাজটা মহিলারা পেয়ে থাকে।
থরে থরে সাজানো প্লেট আর গ্লাস থেকে নিজেরটা নিতে নিতে দেখি সবুজ ভাই তার প্লেটের উপচে পড়া খিচুড়ি থেকে কিছুটা তারই আরেক নারী কমরেড মোসলেমা আপাকে দিচ্ছেন। তার থেকে আমিও একটু ভাগ পেলাম, খিচুড়িটা কেমন হয়েছে সেই স্বাদ বোঝার জন্য। এরপরে লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে করতে আশে পাশের মানুষের কথোপকথন শুনতে থাকলাম আমি। বুঝলাম খাবার নিয়ে কোন ঝামেলা হয়নি, বা খাবারে কোন টান পড়েনি, বরং সবজী দিয়ে খিচুড়িটা রান্না করায় বেশ পুষ্টিকর হয়েছে বলে প্রশংসা করা হচ্ছে; খিচুড়ির পাশাপাশি আজকে তকমার শরবত দেয়া হচ্ছে। গরমের কারণে এই আপ্যায়নে সবাই খুশী; হাত ধোয়ার পানি কম পড়ে গেছে। পানির পাম্প নষ্ট বা বিদ্যুৎ না থাকায় পানি সমস্যার সমাধান করা যাচ্ছেনা; একটি ছাত্র সংগঠন আরেকটি সংগঠনের চেয়ে বেশী বুকলেট বিক্রি করায় কর্মীদের মধ্যে উত্তেজনা টগবগ করছে।
আমি আমার ভাগের শরবত আর খিচুড়ি নিয়ে যোগ দিলাম মোশরেফা মিশু, সবুজ ভাই আর মোসলেমা আপার সাথে। গার্মেন্টস শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ করার কাজে এই দলটি বেশ কয়েক দশক ধরে কাজ করে চলেছে। আগে মিশু আপা ছিলেন গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের প্রধান। এখন তাদের রাজনৈতিক দলের নাম গণতন্ত্রী বিপ্লবী পার্টি। এখানে উল্লেখ্য যে, বেশ কয়েকবার শোনার পরও আমার বেশ কিছু বন্ধু কোন রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত সেটা আমি এখনও ভালো করে মনে রাখতে পারি না। কারণ, হয় তাদের দলের নামগুলি প্রায় কাছাকাছি শব্দের, কাছাকাছি কম্বিনেশনে তৈরী, না হয় বিভিন্ন বিষয়ে কর্মীদের মধ্যে মতপার্থক্যের কারণে তারা মাঝে মাঝে দল পরিবর্তন করে বা দলের নাম পরিবর্তন করে। খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, জাতীয় কমিটির ভেতরে এই দলা ভাঙ্গাভাঙ্গি মেনে নিয়েই সকলে কাজ করছে। কারণ, দল মত নির্বিশেষ জাতীয় সম্পদ রক্ষার স্বার্থে এই মোর্চায় কাজ করার সুযোগ আছে বলে কেন্দ্রীয় কমিটি স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে এবং সেভাবেই প্রচার চালানো হয় বা জাতীয় কমিটির সাংগঠনিক কাঠামোতেও সেটা স্পষ্ট করে উল্লেখ আছে।
আসলে কোন দলের কি নাম, কোন দলের কি রাজনৈতিক আদর্শ সেটা পড়ে বা যাচাই করে আমি গবেষণায় নামিনি। যারা স্বাগত জানিয়েছেন তাদের সাথেই আমার আলাপ করার সম্পর্ক তৈরী হয়েছে বা তাদের সম্পর্কে জানার আগ্রহ তৈরী হয়েছে। যেমন: মিশু আপা। সম্ভবত: ১৯৯৮ সালে জাহাঙ্গীরনগরের ধর্ষণ বিরোধী আন্দোলন চলাকালে ছাত্রী-ছাত্রদের সাথে একাত্ম হতে তিনি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়) গেলে প্রথম আমি তাঁকে দেখি। এরপরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক শহীদুজ্জামান এক ছাত্রীর সাথে যৌন আগ্রাসী আচরণ করলে সেখানকার ছাত্রী-ছাত্ররা (ছাত্রীদের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য ছিল বলে তাদের আগে স্মরণ করলাম) তার প্রতিবাদে সংগঠিত হলে মিশু আপা ও তার সংগঠন তাদের সাথে সংহতি জানান, প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নেন। আমার কয়েকজন বন্ধুর সাথে সেই আন্দোলনে আমিও ছিলাম। এরপর ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বরের থার্টি ফার্স্ট রাতের উৎসবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের সামনে মিলন চত্বরে প্রায় দুই শতাধিক ছাত্রের যৌন আগ্রাসী আক্রমণে একটি তরুণীকে উলঙ্গ করার ঘটনা ঘটে। পত্র পত্রিকায় ঘটনাটির সচিত্র খবর প্রকাশিত হলে এই ঘটনাটির প্রতিবাদ করতে ঢাকার বেশ কিছু নারী সাংবাদিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, নারী সংগঠনের (যেমন: যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ মঞ্চ, সম্মিলিত নারী সমাজ) কর্মীরা সংঘবদ্ধ হয়। মিশু আপার সংগঠনের কর্মীরা তাদের এই প্রতিবাদ কর্মসূচীগুলোতেও অংশগ্রহণ করেন। আমি এদের সঙ্গেও ছিলাম।
আমার সাথে মিশু আপার যতবারই দেখা হয়েছে ততবারই তিনি, "হ্যালো কমরেড' বলে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করেছেন, কুশলাদি বিনিময় করেছেন। বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে পরস্পরকে অনেকে কমরেড বলে সম্বোধন করেন। আমি কোন বাম রাজনৈতিক দলের সদস্য না তারপরও কেন মিশু আপা আমাকে কমরেড ডাকেন সেটা কখনও জিজ্ঞেস করিনি বা করার প্রয়োজনও বোধ করিনি। কারণ তার সম্বোধনের মধ্যে আছে উষ্ণ আন্তরিকতার প্রকাশ। বেশ কয়েকবার আমি তার বক্তৃতা শুনেছি। আমার কাছে তার বক্তৃতার ঢং ও বেশ আকর্ষণীয় লাগে। তার বেশীরভাগ বক্তৃতার সারমর্ম হয় এরকম- এই রাষ্ট্র, সরকার সবাই হল মালিক পক্ষের। তারা শ্রমিকের রক্ত চুষে আজকে গাড়ী হাঁকায়, এসির বাতাসে ঘুমায়। এই সব লুটেরাদের আমাদের চ্যালেঞ্জ করতে হবে। তাদেরকে আস্তাকুঁড়ে ছুড়ে ফেলতে হবে। শ্রমিক শ্রেণীর জয় সুনিশ্চিত।
মিশু আপার পোষাক চুলের স্টাইলও আমার কাছে আকর্ষনীয় লাগে- সব সময় তিনি শক্ত করে চুল বাঁধেন, সুতীর শাড়ী কুঁচি দিয়ে পিন আপ করে পরেন, ব্লাউজও তিনি এমনভাবে স্টাইল করেন যেন পেট-পিঠ দেখা না যায়। তার পোশাক আমার নজর কাড়ার কারণ সম্ভবত: আমার নিজের সাজ পোশাক, যেটা মিশু আপার ঠিক উল্টো। আমার চুল খোলামেলা এলোমেলো রাখতে ভাল লাগে, পোষাক বাছাইয়ের সময় "শরীর দেখা গেলেও সমস্যা নেই' এরকম একটা সিদ্ধান্ত কাজ করে। এগুলো তৈরী হয়েছে সমাজের বিদ্যমান প্রচ্ছন্ন নিষেধাজ্ঞাকে মানবো না এই অবস্থান থেকে। "What else do you suggest me to do?" Local perceptions of Human Security and Motivations to join the Phulbari social movement, Bangladesh শীর্ষক গবেষণা কাজটির সময় আমি মিশু আপার সাথে বেশ কয়েকদিন ধরে একান্ত সাক্ষাৎকার রেকর্ড করি। তখন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে তার পোষাক, দর্শন, জীবন যাপন বাছাইয়ের যে গল্প শুনেছি সেটা আমাকে তার সম্পর্কে আরও আগ্রহী করে তুলে। সরকারী কর্মকর্তার মেয়ে হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার সুযোগ তিনি পেয়েছেন। পরিবার থেকে মার্গারেট থ্যাচারের মত বিশ্বখ্যাত নেতা হবারও উৎসাহ পেয়েছেন। বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে সাধারণ একটি মেয়ের যে ধরনের অভিজ্ঞতা হয় তাঁর অভিজ্ঞতাও সেরকমই। কিন্তু পুরুষের যৌন বিকারগ্রস্ততার সংস্কৃতি এবং সমাজের নিপীড়ন-বৈষম্যকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে, সমাজের বিদ্যমান কাঠামোকে ভাঙ্গতে হবে, সকলের জন্য ন্যূনতম খাবার-শিক্ষা-চিকিৎসা-বাসস্থানের সুযোগ থাকতে হবে এবং এই জন্য সংগঠিত হতে হবে এই বিষয়গুলো তিনি তাঁর মত করে বুঝে নিয়ে গত ৩৮-৩৯ বছর ধরে নানা রকম তৎপরতা চালিয়েই যাচ্ছেন।
১৯৮০ তে বাংলাদেশের স্বৈরশাসক এরশাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার যে আন্দোলন সেখানেও তিনি ছিলেন ডাকসাইটে ছাত্র-নেত্রী। আর তখন থেকেই বিভিন্ন সময়ে পুলিশের নির্যাতন সহ্য করেছেন তিনি। গার্মেন্টস শ্রমিকদের আন্দোলন প্রতিহত করতে সম্ভবত ২০০৬ থেকে নিয়মিতভাবে মিশু আপাকে গ্রেফতার ও তদন্তের নামে রিমান্ডে নির্যাতন করা শুরু হয়। শেষবার আমি তাঁর যতটুকু খবর পেয়েছিলাম তিনি এবছরের জুন মাসে গ্রেফতার হয়েছিলেন এবং পরে মুক্তি পেয়ে কয়েক দিনের জন্য আত্মগোপন করেন। জাতীয় কমিটির সাংবাদিক সম্মেলনের দিন তাঁর সাথে আমার দেখা হয় কিন্তু সেদিন তিনি ঢাকার বাইরে থেকে এসেছিলেন বলে দেরীতে পৌঁছেছিলেন।
আজকের দিনে ফেরা যাক আবার। মিশুআপাদের দলে খাবার নিয়ে ঢোকার পর যথারীতি স্বাগত হলাম এই ভাবে- "এই যে কমরেড নাসরিন সিরাজ অ্যানী।' প্রথমেই তিনি মাফ চাইলেন চেয়ারে বসে থাকার জন্য। কারণ তার স্পন্ডিলাইটিসের ব্যাথা। এছাড়াও আমি জানি তাঁর হাঁপানী আছে। তিনি যখন বসে থাকার জন্য মাফ চাচ্ছিলেন আমি মনে মনে ভাবছিলাম শারীরিক ব্যথার চাইতেও মিশু আপা অপমানে বেশী কাবু হয়ে পড়েন। আমি যতবারই জানতে চেয়েছি পুলিশেরা কিভাবে তাঁকে নির্যাতন করে ততবারই তিনি শারীরিক নির্যাতনের চাইতেও মানসিক নির্যাতনের প্রতি গুরুত্ব দিতেন। বলতেন, "সেকি ভয়ানক অপমান অ্যানী। শুনলে আপনার গা শিউরে উঠবে। এরকম সব কাজ কারবার। রাগে অপমানে গা কাঁপতে থাকে। আমি তো সহ্য করতে পারি না। অসুস্থ হয়ে পড়ি।'
খেতে খেতেই তিনি খাবারের প্রশংসা করলেন, খাবারের পরে চা খেতে চাইলেন। তিনি আমার লেখাপড়ার খে?ঁজ নিলেন এবং বর্তমানে কি কাজ করছি সেটা জানতে চাইলেন। আমি বললাম, "আমার ডিসারটেশান লেখা শেষ। মাস্টার্সের রেজাল্টও দিয়ে দিয়েছে। সামনে কী করবো এখনো জানি না। লং মার্চে এসেছি দেখি ইন্টারেস্টিং কোন রিসার্চ টপিক পাওয়া যায় কি না।'
আমাদের কথার ফাঁকে ঢাকাবাসী এক বন্ধু ফোন করলো। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেখেই তার এই ফোন। আমার এই বন্ধুটি গান করে। তাদের পরিবার বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পে কাজ করছে অনেক বছর ধরে। আমি বেশ কয়েকবার তাদের প্যাকেজ ট্যুরে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছি এবং দেখেছি যেন পরিবেশের ক্ষতি না হয় এবং ট্যুরের খরচটা যেন সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সাধ্যের মধ্যে থাকে সেটা মাথায় রেখে তারা পর্যটনের ব্যবসাটি করে। অনেক অতিথির সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক দীর্ঘায়িত করতেও তারা যত্নশীল। সামাজিক আড্ডার সময় বেশ কয়েকবার বন্ধুটির সাথে আমার বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সংকট নিয়ে আলাপ হয়েছে। কারণ তার নিজের কাজটি- গানের রেকর্ডিং স্টুডিওর কাজ- বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় যাচ্ছেতাই লোডশেডিং এর ফলে। সে মাঝে মাঝে ঢাকার বাইরে যায় প্রামাণ্য চিত্রের কাজে বিবিসি, চ্যানেল ফোর বা এই ধরনের দলের সাথে। ঢাকার বাইরে লোডশেডিং এর অবস্থা ঢাকার মত খারাপ না বলে তার ধারণা। তার আরও ধারণা সরকার ঢাকা শহরে ইচ্ছে করে বেশী বেশী লোডশেডিং দেয় অর্থাৎ ঢাকার বিদ্যুৎ সংকটটা সরকারের "তৈরী করা'।
জিতুর (ছদ্ম নাম) সাথে মোবাইল ফোনে আমার কথোপকথনটি লক্ষ্য করা জরুরী কারণ এ থেকে বোঝা যায় যে জাতীয় কমিটির আন্দোলন নিয়ে সংগঠনের সাথে সংশ্লিষ্ট নয় এরকম অনেক মানুষেরও আগ্রহ বেড়েছে। জিতুর সাথে আমার নিম্নরূপ আলাপ হয়।
-হেই তোমরা টঙ্গী পৌঁছে গ্যাছো? তুমি বলসো কোন বাধা বিপত্তি ছাড়া। হোয়াট ডু ইউ মীন বাই দ্যাট? তুমি কি ভাবসিলা বাধা দেবে তোমাদের?
-হ্যঁ¡, তা তো ভাবসিলামই। পুলিশ আমাদের পেটাতেই পারতো। সেরকম কি করে না পুলিশ?
-ওকে। গুড দ্যাট ইউ'ভ রিচড সেইফলী। তোমরা কি পুরো রাস্তা হেঁটে যাচ্ছো?
-না না। আমরা পল্টন থেকে মিছিল করে মহাখালী পর্যন্ত এসে বাসে উঠেছি।
-অ্যাই তোমরা নাম দিসো লং মার্চ। বাসে করে গেলে ক্যামনে হবে? ইউ শুড ওয়াক। (জিতুর কথায় কৌতুক ভাব মেশানো, যেন আমরা ফাঁকি মেরে খুব ধরা পড়ে গেছি)
-ওহ কম অন। বি প্র্যাকটিকাল। কি রকম গরম পড়েছে দেখছো? তোমরা কি চাও আমরা মরে যাই? আর হেঁটে হেঁটে ফুলবাড়ি গেলে সাত দিনে কি যেতে পারবো? তাহলে লং মার্চ করতে হবে পনের দিনের।
-হা হা হা...। সবাই এক। বলে এক, করে আরেক।
-শোন, আমরা যেখানে লোকালয় বা বাজার আছে সেখানে সভা করবো, মিছিল করবো। আর যেখানে লোকবসতি নেই সেটা বাসে করে পার হব। এভাবেই পরিকল্পনা হয়েছে। আমরা তো হাইওয়ে দিয়ে যাচ্ছি।
-উইশ ইউ অল দ্যা বেস্ট।
-আই উইল কীপ পোস্টিং।
জিতুর ফোন ছাড়ার পর আমি বিষয়টা নিয়ে আবারও ভাবলাম। গত বারো বছরে জাতীয় কমিটির আন্দোলন আসলেই বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আমার মনে আছে মাগুর ছড়া অথবা টেংরা টিলা কোন একটি গ্যাস ফিল্ড বিস্ফোরণের ফলে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের যে ক্ষতি হয়েছিল সেই ক্ষতিপূরণ আদায়ের দাবীতে করা জাতীয় কমিটির একটি মিছিলে আমি ২০০০ সালের প্রথম দিকে যোগ দিয়েছিলাম। মিছিলের লক্ষ্য ছিল পেট্রোবাংলা বা দায়ী বহুজাতিক তেল কোম্পানীর অফিস ঘেরাও (কর্মসূচীটি সঠিক ভাবে মনে নেই)। কিন্তু মিছিল নিয়ে আমরা ভিআইপি রোডে ওঠার আগেই পুলিশ বেরিকেড দেয়। মিছিলটিও লোকবলের অভাবে পিছু হটে যায়। অথচ, এই আন্দোলনকারীরাই ২০০৬ সালে ফুলবাড়িতে পুলিশী হামলায় মানুষ খুনের প্রতিবাদে দেশব্যাপী অর্ধদিবস হরতাল করার শক্তি অর্জন করে। ২০০৯ সালে সমুদ্র বক্ষে গ্যাস ব্লক কনোকো ফিলিপসকে ইজারা দেওয়ার ও আনু মুহাম্মদের উপর পুলিশী হামলার প্রতিবাদে আবার তারা অর্ধদিবস হরতাল পালন করে।
(চলবে....)