শৈশব ব্যাপারটা নিয়ে আমার বিশেষ আদিখ্যেতা নেই। গেছে- বাঁচা গেছে, আপদ গেছে। বাঙালির শৈশব(অন্তত আমি যখন শিশু ছিলুম) তো ঠিক অ্যালিস বা চার্লির শৈশব নয়। কোনও নার্নিয়ার গপ্পো নেই। শিশু অর্থাৎ বারোয়ারি দুচ্ছাই! যেই না সিলিং-এর নুরনকশায় একটা হিজিবিজবিজ দেখতে পেয়েছে, অথবা ব্যাকরণ শিং-এর সঙ্গে দু’দণ্ড আপন মনে কথা বলতে বসেছে – সবে মনে হয়েছে, দূর এইখানটায় হ য ব র ল ফেল, আমি হলে তো এইটা বলতাম – সাতপাঁচ ভেবে যেই না খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠতে যাবে,অমনি কোথ্থেকেকে এক হুমদো কাকীমা এসে, ‘ওমা! আপন মনে কী বিড়বিড় করছিস?’ বলে গাল টিপে দিয়ে চলে যাবে। তুমি লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছ তাতে কারও কিছু যায় আসে না, তোমার কোনও নির্জনতা নেই। সর্বক্ষণ গোটা দুনিয়া তোমার ঘাড়ের ওপর নিশ্বাস ফেলছে, তুমি উলঙ্গ, ল্যাংটো। তোমার যে কোনও নিরিবিলিকে, একলাযাপনকে দুনিয়ার সামনে বেপর্দা করে দেওয়া যায়। বাবা সিগারেট খাওয়ার সময় বলবে, ‘বড়রা খায়’; চপ-মুড়ি খেতে খেতে রোববারের সিনিমা চোখে মাসিমা বলবে, বড়রা দেখে; মধ্যকৈশোরে পা-রাখা দিদি বাড়িতে তুমি থাকলে আরামসে বয়ফ্রেন্ডকে ডেকে নেবে, ফোনে বলবে; একা আছি’। তুমি নেই চাঁদ, তুমি আসলে একটা ছায়া। তুমি ভোট দাও না, দেশের সেবায় মিছিল করো না, বন্যাত্রাণ কি বিচিত্রানুষ্ঠানে চাঁদা দাও না, মাধ্যমিকে ফার্স্ট হয়ে মুখ্যমন্ত্রীর করুণা কুড়োও না, তুমি জাস্ট নেই।
সদ্যকৈশোর আমায় আজও টানে। আমার একটা অলীকযাপনের জানলা ছিল। জানলার বাইরে অনে-এ-কটা দূরে একটা চায়ের দোকান। মনোজদার দোকান। স্যাঁতস্যাঁতে মফসসলের এক কোণে ঘরে ফেরা আলোয় কাচের গেলাসে টুং টাং সুর তুলত সাবির। স্কুলফিরতি আমরা কজন মনোজদার দোকানে থামতাম। বিস্কুট খেতাম, লজেন্স খেতাম। পয়সা দিত বাবারা, সান্ধ্য আড্ডায়। বাবাদের সন্ধ্যের আড্ডা সবে বসেছে। শনিবারের আড্ডা, লম্বা টানবে। টিভিতে কোন এক ন্যাকাকন্যে কাইন্দে কাইন্দে চেরাপুঞ্জীকে চ্যালেঞ্জ দিতে ব্যস্ত। আমি সেই জানলার ধারে বই নিয়ে বসে রিয়ার জামা থেকে ঝরে পড়া একটা বোতামের গন্ধ শুঁকছি। মিষ্টি হাস্নুহানার গন্ধ।হঠাৎ একটা হিসহিসে গলা, ‘ওই!বেরো?’ জানলার ঠিক বাইরে দাঁড়িয়ে সাবির। কাঁধে একটা ঝোলা ব্যাগ। একটা ফর্সা হাফ শার্টও পরেছে। প্যান্টটি অবশ্য যথারীতি কালিঝুলি মাখা – সিনেমার শিশু শ্রমিকের মতোই। সন্ধেবেলা বাড়ি থেকে বোরনো বিসসাল হ্যাপা। পড়ো না পড়ো বই নিয়ে বসে বিদ্যাসাগরকে-পাঁচ-গোল-দিচ্ছি অ্যাটিটুডটা থাকা চাই। ‘আরে বেরো! হেব্বি জিনিস আছে’। ব্যাগ দেখিয়ে বলল সাবির। অমনি আমার অঙ্কগুলো বোঝার জন্য এক কাল্পনিক বন্ধুর সাহায্য জরুরি হয়ে পড়ল। বেশ খানিকটা চুপচাপ হেঁটে আমরা খালপাড়ের ব্রিজে গিয়ে বসলাম। সাবির মুই-কি-হনু হাসি হেসে ব্যাগটা চওড়া পাঁচিলে নামিয়ে রাখল।কী আছে? ধীরে ধীরে যেটা আত্মপ্রকাশ করল তাকে হাত দিয়ে ছুঁতে পারব ভাবিনি কখনও। সে কী আবেগ থরোথরো মুহূর্ত! একটি ওল্ড মংক রামের পাঁইট! তখন অবশ্য অত ডিটেইল জানতাম না – সাবিরের হাতে মদের বোতল; দোকান থেকে দুটো গ্লাসও নিয়ে এসেছে। ‘কোথায় পেলি? দেশি মাল?’ ‘চল সালা! মাল চিনিস না? রাম! রাঙাদা দিল’ ‘সে কী রে? বুড়ো দিল? ‘কদিন ধরে চা দিতে গিয়ে বসে কবিতা শুনতাম তো, কাল খুশি হয়ে দিয়েছে।’ রাঙাদা আমার বাবারও রাঙাদা, আমারও। তিনি স্বভাবকবি এবং তাঁর ওই বদস্বভাবের কারণে অত্যন্ত অপ্রিয়। তাঁর নিবাস ছিল পাড়ার ক্লাব। বাবা কাকারা পরামর্শ করে তাঁর জন্যে ক্লাবেই একটা ঘরের বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন। আর একটা বই খাতার ছোট দোকান বানিয়ে দেওয়া হয়েছিল ঘর লাগোয়া। সেসবে রাঙাদার মন ছিল না, পাব্লিক দেখলেই ধরে কবতে শোনাত আর মাল খাওয়ার পয়সা চাইত। রাঙাদার বোতল থেকে রাম পেঁদিয়ে আমি আউট। ব্রিজে শুয়ে পড়েছিলাম। বেশ খানিক পরেই হবে – সাবির জলের ঝাপটা দিয়ে তুলেছিল। শুনেছিলাম আমায় সামলাতে গিয়ে সাবিরের আর নেশা করা হয়নি। আমি নাকি থেকে থেকে চেঁচিয়ে উঠছিলাম, ‘ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুইন’। সাবির লাইনটা বলতে পারেনি, তবে ওর কথা থেকে বুঝেছিলাম ওই লাইনটাই হবে। রাঙাদার বাসায় তারপর মাঝে মাঝে যেতাম। যেদিন পেটে পড়ত সেদিন কবিতাগুলোও শুনতে মন্দ লাগত না। অ্যালকোহলের গন্ধে গুলে যেত ছন্দের ভুল, শব্দপ্রয়োগের অপটুত্ব, বৈচিত্র্যের অভাব, ক্লিশে হয়ে যাওয়া বাক্যবন্ধ। প্যারিসের পথে পথে বেপরোয়া রাঁবো থেকে পাংক রক, কেরুয়াক থেকে হোসে মার্তি ঘিরে ফেলত আমাদের। সেই রাঙাদা একদিন সাতসকালে ঝুলে গেল সিলিং ফ্যান থেকে। অভিকর্ষের টানে থেমে থাকা ফানুস ফুসমন্তরে উধাও। ঘরে সুইসাইড নোট খুঁজতে গিয়ে যে চিরকুটটা পাওয়া গেছিল তাতে ছিল কিছু হিজিবিজি ছবি আর লেখা ছিল, ‘কাক্কেশ্বর-কুচকুচে’।
আমাদের শ্মশানযাত্রার সঙ্গী ছিল দেড় বোতল রাম। খান তিন চার মাতাল নিঃশব্দে কেঁদেছিলাম। শেষে নাভির সঙ্গে গঙ্গায় ভেসে গিয়েছিল দুটো খালি বোতল। রাঙাদার থেকে ধার করা কবিতার বইগুলো আর ফেরত দেওয়া হয়নি। তারই একটায় লেখা ছিল, ‘আজ সেই ঘরে এলায়ে পড়েছে ছবি / এমন ছিল না আষাঢ় শেষের বেলা...’।
বাঙালি মদ খাওয়া ধরেছে অথচ বাড়িতে ক্যালানি খায়নি এ দৃষ্টান্ত বিরল। তাতে নেশায় ছেদ পড়ে না। ওটা একটা প্রোফেশনাল হ্যাজার্ড। মদ প্রথমবার ছাড়তে হয় একটু বড়ো বয়সের পয়লা নং প্রেম জমে উঠলে। সে এক তীব্র আগুন গেলা নেশা। মগজে হাজার সাবধানবাণী কচকচ করছে না। গোপন আর নিষিদ্ধ অভিযান। ঠোঁট থেকে ক্রমশ গভীর গভীরতর অসুখে উত্তরণ। তুলতুলে বুকের ওম, নিঃশ্বাসে কেঁপে ওঠা ভয়। ‘তড়পত রয়না দিন... – মারু বেহাগের বিস্তারে বেপরোয়া ঝুঁকি নিয়ে আচমকা ছুঁয়ে আসা কড়ি মধ্যম। সপাট তানের মতো অবাধ্য বেয়াড়া আদর। কিন্তু তখন ভালো ছেলে হওয়াটা ও গুচ্ছের বন্ধুবান্ধব ছেঁটে ফেলাটা আবশ্যক হয়ে পড়ে। নিতান্ত অমানবিক, স্বার্থপরের মতো সেটা করেও ফেলি। না না, কোনও অনুতাপ হয় না, খারাপ লাগা নেই। প্রেমে শয়তানের আশীর্বাদ আছে। প্রেম দানবীয়, নেশাও। কাল অবধি যে বন্ধুর সঙ্গে সারাদিন বসে আড্ডা দিতাম আজ তার উপস্থিতি ভাল্লাগেনা আর, ঢপ মেরে কাটিয়ে দিই। কেউ বলেনি, কী করে যেন মদসঙ্গটা ছেড়ে গেল। তারপর মদ খেয়ে লেখা টুকিটাকি কবিতাগুলো খুঁজে পেলে পড়তাম আর দেদার হাসতাম। বলাই বাহুল্য কড়া অ্যালকোহলে ডোবানো কবিতাগুলো যা চিত্তির হত তাতে কাব্যি করা বন্ধ করার জন্য আমি অনায়াসে নোবেল পেতে পারতাম। সুইডিশ অ্যাকাডেমিকে সময় মত ব্ল্যাকমেল করিনি বলে এখনও হাত কামড়াচ্ছি।
এত করেও কিছু হয় না। ভেঙে যায়। যা হওয়ার তাই হল মাস কয়েক পরে। একা ঘরে চুপি চুপি ঢুকে পড়ল নাশকতা, কোকের বোতলে ভরা রাম। হেব্বি দেবদাস, মেলোড্রামা তুঙ্গে। হেনকালে দরজায় খটখট। স্বর্ণপ্রভ, গত দুমাসে ওর মুখটাও দেখিনি, ফোন ধরিনি। ঢুকেই বলল, ‘কী রে কেঁচে গেছে? এ কী, এখনও রাম? নাঃ তোর আর প্রোমোশন হল না। চল’। বিস্তর ওজর আপত্তি ধোপে টিকল না। টানতে টানতে ওর ফ্ল্যাটে নিয়ে গেল।এখানে ওর বাবা-মা বিশেষ একটা আসেন না। ওর শোওয়ার ঘর থেকে ভেসে আসছে সেই মারু বেহাগ। ঢুকেই নেশা ফেশা চটকে গেল। আমার বান্ধবীটি আলুথালু বসে আছে। চোখ বন্ধ। হাতে হুইস্কির গ্লাস। আমি ব্যোমকে বিয়াল্লিশ, ‘যাঃ শালা !তুইও খাস? স্বর্ণপ্রভ স্পিকারের ভল্যুম বাড়িয়ে দিয়ে ‘আসছি’ বলে কোথায় যেন কেটে পড়ল। নেশাগ্রস্ত ফুলে ওঠা ভিজে ঠোঁট, গেলাসের টুং টাং, পিয়া বিন মোরা জিয়া / তড়পত রয়না দিন। কী তুমুল সে অচৈতন্য। বাইরে বারান্দা, তার বাইরে আকাশ, তারাদের অলিতে গলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে গমকের কারুকাজ।
না না কোনও সিনেম্যাটিক পুনর্মিলন হয়নি, তবে অনেক কথা যা কখনও বলা হয়নি, ওইটুকু সময়েই বলে ফেলেছিলাম। দুজনেই।
হড় হড় করে বমি করে ফেললাম। সেই প্রথম। বাথরুম থেকে টালমাটাল পায়ে করিডর। নিচের রাস্তায় ঝিলমিল ঝিলমিল ছেলে মেয়ে। একডালিয়া থেকে সাউথ সিটি, সাউথ সিটি থেকে নাকতলা। ওরা কদিনের জন্য শহরটা ইজারা নিয়েছে। আর আমার চাকরিটি গেছে। বন্ধুবর যাদবপুরে গবেষণা করছেন। পার্ক স্ট্রিটে দেখা করলাম। সেখান থেকে সোজা যাদবপুর। হস্টেল। তখনও সরকারি শুভবুদ্ধি ততটা পেকে ওঠেনি। কাঁচা মাথায় আধদামড়া পিএইচডি স্কলারের ঘরে উঁকি দিয়ে দু ঢোক মাল খেল কি না দেখে নেওয়ার মতো যথেষ্ট বুদ্ধি লোকের ছিল না। গাঁজা, চরস ও আফিম আটকে দিলে জনমানসে বিপ্লব চেতনা জেগে ওঠে কি না তা নিয়ে কেউ ভাবিত হত না। আরও অবাক কাণ্ড কতগুলি সুস্থ প্রাণী হঠাৎ মদ খেয়ে কারওর ওপর চড়াও হয়ে জামা ছিঁড়ে দেবে বা হস্টেলের ঘরে আটকে পাথরচাপা যৌনতা ঝালিয়ে নেবে এমন সম্ভাবনা বিশেষ ছিল না। একদিকে চাকরি নেই, পকেটে একটা পয়সা নেই, অন্যদিকে বাড়ির সূক্ষ্ম চাপ। প্রেম-ফ্রেম মাথায় উঠেছে। তুঝসে ভি দিল ফরেব হ্যায় গম রোজগার কে। গালিবিয় নয়, ফৈজিয় বাস্তব। আমরা গ্লাসে তরল ঢাললাম। যত্ন করে নিয়ে আসা লাইম কর্ডিয়াল পড়ল তাতে। মোবাইলে চালু হল লালন, হাছন রাজা। কুথায় নিয়া রাখব আল্লা যার লাগি প্রাণ কান্দে...। ‘ম্যালা ঘ্যানঘ্যান করিস না তো; বন্ধু ধমকে উঠল, ‘সমস্যা সবার থাকে, সালা এ জাতটা মাল খেলেই প্যানপ্যানায়। আনন্দে নেশা কর, ধামসা, মাদল, পাহাড়িয়া বাঁশি...তা না’। ওই পেগটায় একটা অদ্ভুত কিক ছিল। মাথাটা হাল্কা হয়ে গেল। ‘লোরকা শুনবি?’ ‘এবার কে কাব্যি ফলাচ্ছে ?’ আমি সাবলাইম, ন্যাকা নই, শুনবি?’ ‘লোরকা নয়, ফিলিপ লারকিন’। ‘বেশ’। দুজনে ছাদে চলে গেলাম। তারার আকাশ আর শহরের আলোরা মেঘের দেশে ঘরবাড়ি বানিয়েছে। বড় রঙীন এ গেরস্থালি। বন্ধু আবৃত্তি করছে, ‘দ্য সেন্স অফ সলভিং এম্পটিনেস /দ্যাট লাইজ জাস্ট আন্ডার অল উই ডু...’। আমার মনে পড়ে যায়, হাসপাতালের বেডে শুয়ে এক ন্যূব্জ কবি ভাঙা শরীরের ক্ষীণকায় আঙুলগুলো টেনে টেনে লিখছেন, ‘যাই হোক রোগ নিয়ে এত মনোযোগ দিয়ে/ভাবি না, আমাকে রোগে খাবে?’ খানিক দূর থেকে ভেসে আসছে ঢাকের বাদ্যি। আকাশের একটু নিচে যেখানে আলোর হাট বাজার, সেখানে আজ বিরাট মেহফিল। গালিবের হাত ধরে আছেন সিলভিয়া, লালনের সঙ্গে গলা মেলাচ্ছেন জন লেনন, টেড হিউজ ঈর্ষায় পুড়ে যাচ্ছেন। আর এ টেবিল থেকে ও টেবিলে সুরাপাত্র ভরে দিচ্ছে রাঙাদা। ওর কবিতা শুনে বাহবা দিচ্ছে সবাই। চাকরি রোজগার সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। গালিব গাইছেন, মওত কা এক দিন মু-ইয়ন হ্যায়/ফির নিন্দ ক্যুঁ নহি আতি রাতভর...