গতরাতে আমরা যখন সবাই ঘুমোচ্ছি, তখন রাজারহাটে টিসিএসের গীতাঞ্জলী পার্কের সামনে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল প্রায় - পনেরো কুড়িটা অস্থায়ী দোকান।
আগুনের আঁচে কিম্বা গ্যাস সিলিন্ডার ফেটে নষ্ট হল আরও অন্তত কুড়ি-তিরিশখানা ছাউনি এই উপরে বলা সম্পূর্ণ পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া দোকান ছাড়াও। সবই নানা রকমের খাওয়ার দোকান। মিষ্টি- ইডলি-দোসা- চা- আখের রস- চাওমিন- শরবৎ এই রকমেরই আর কি। দোকানিদের অধিকাংশই স্থানীয় মানুষ। হাতে গোনা কয়েকটা দোকান চালান বিহার এবং উৎকলবাসীরাও। বাঁশের এবং সরু কংক্রীটের স্তম্ভের ওপরে দরমা-পলিথিন শীট দিয়ে ঢেকে তৈরি এই দোকানগুলো ছিল বেশ কিছু চাকুরের নিত্য প্রয়োজনীয়তা এবং তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ভাবে অন্তত দোকানপিছু একটা বা দুটো পরিবারের জীবিকাও।
শোনা খবর অনুযায়ী বারোটা গ্যাস সিলিন্ডার একে একে ফেটে আগুন ছড়িয়েছে একটু একটু করে। ধীরে ধীরে নয় বরং বেশ হন্তদন্ত হয়েই। আগুন নেভাতে সাহায্য করেছে সামনের তথ্যপ্রযুক্তি কম্পানী TCS। আরও ভালো করে বললে এই কম্পানীর সিকিউরিটি গ্রুপ।
মূলত এই গ্রুপ G4S নামে সংস্থা থেকেই সংগ্রহ করা হয় - অন্তত টিসিএসে। এরা গতকাল খুব তৎপর ভাবে আগুন নেভাতে এগিয়ে এসেছিলেন স্থানীয় দুর্ভাগা মানুষদের পাশে। আগুন নেভাতে গিয়ে সিলিন্ডার ফেটে অত্যন্ত বেদনাদায়ক ভাবে মারা যান এক সিকিউরিটি সুপারভাইজার - জয়ন্ত মন্ডল। মধ্য তিরিশের জয়ন্ত বাবুর পরিবারে একটা ছোটো ছেলে আছে। আশা করা যায় যে G4S এবং TCS নিশ্চয়ই এগিয়ে আসবেন জয়ন্তবাবুর পরিবারের পাশে।
এই সব খবরের মতন বলে যাওয়া ধারাবিবরণীর চেয়েও এক আশ্চর্য কথা শুনুন এবারে। চট করে এমন আর শোনা যায়না এখন। নিশ্চল করে চলা আশপাশের অজস্র অসংখ্য ঘটনা এবং সময়ের বিষাদ যখন আমাদের খুব তীক্ষ্ণ ভাবে সিনিক করে তোলে তখন এমন দু চার দৃশ্য দেখা জরুরী।
স্থানীয় অঞ্চল মুসলমান প্রধান। স্থানীয় দোকানীরাই সবচেয়ে বেশী,বাইরের লোক ২০% হবেন। সকাল নটার মধ্যেই প্রচুর স্থানীয় মানুষ নতুন ঘর তোলার উপকরণ নিয়ে হাজির। এদের সবার কিন্তু দোকান পোড়েনি। প্রায় আপতিক তৎপরতার মধ্যে দিয়ে সূর্যাস্ত হওয়া অব্দি সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মাপজোখ করে বাঁশ পুঁতে আর ছাই-কয়লা সরিয়ে ঘরের কাঠামো তৈরি করে ফেললেন। কেউ খোঁজ নিলেন না যে যার হয়ে, যার জন্যে তারা কাজ করছেন তারা মুসলমান না হিন্দু, বাঙ্গালি না বিহারী। প্রায়োরিটি কিভাবে সেট করেছেন জানিনা কিন্তু আলো নিভে যাওয়ার আগেই প্রায় আশি শতাংশ কাঠামো নির্মাণ সমাপ্ত। কেউ হাঁকডাক করেননি, দোষারোপ করেননি কাউকে - শুধু চোয়াল শক্ত করে নিজেদের কাজ করে গ্যাছেন। ওনারা বোধহয় এমন ভাবে কাজ করতে,জীবন কাটাতে এখনও অনভ্যস্ত হননি।
দেখে বড় ভালো লাগলো যে এই দোকানীরাই যাদের মধ্যে চলাচল করে নিশ্চিতভাবেই হাজার সূক্ষ্ণ এবং মোটা ভেদাভেদ,খদ্দের নিয়ে রেষারেষি এবং সাম্প্রদায়িক উৎকর্ষ বোধ তাদের সবার আজ নিজেদের পাশে দাঁড়ানোর মুহূর্তে শুধু পাশে থাকার প্রয়োজনটাই মনে রাখা। বেছে নেওয়া সবচেয়ে দরকারি সিদ্ধান্তটা।
কাল পরশুর মধ্যে দোকানপাট গড়ে উঠে নিশ্চয়ই আবার সামলে ওঠা যাবে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতিগুলো থেকে। বলা বাহুল্য - আজ সব দোকানই বন্ধ। জানা নেই স্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলো কে কেমন- কতটা সাহায্য করেছে। দোকানীদের ইউনিয়ন নিশ্চয়ই পাশে থেকেছে কিন্তু সব চলা ইউনিয়ন পাশে থাকলেও হয়ে ওঠে না। বিশেষত এমন অগোছালো পেশাগুলোয়।
মানুষের ওপর বোধহয় এখনও ভরসা রাখা যায়। অন্ত্যত আরও বেশ কিছুদিন। যদ্দিন অব্দি মানুষের কমন শত্রু এবং বন্ধুগুলো সমান সমান।
=============================================
পুড়ে যাওয়া দোকানপাটের দ্বিতীয়দিনের খবর এইরকম--> TCS নাকি HIDCOর বিরুদ্ধে কেস ঠুকেছে - তাদের একজন সিকিউরিটি মারা গেছে এই কারণ দর্শিয়ে। পুলিশ এসে সমস্ত নির্মাণ এবং আস্ত থাকা দোকান বন্ধ করিয়ে গেছে। কিছু ছোটোখাটো শরবৎ, চা,আখের রসের দোকানি লুকিয়ে চুরিয়ে খুলেছেন অবশ্য। নেহাতই এক আঙ্গুলে গোনা যায় এমন তারা।
আধ খাঁচড়া কাঠামো সব প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে। তার পাশে খাঁ খাঁ করছে টিকে থাকা দোকান চত্বর। দোকানীরা ফ্যাল ফ্যাল চাউনি নিয়ে আশা করছেন যে আগামীকালের এক সম্ভাব্য মিটিং নাকি সব জট ছাড়িয়ে দেবে!!
=============================================
ছবিঃ