
আজ পাঁচই জুন। ছত্রিশ বছর আগে আজকের দিনে বিশ্বসংঘ বারো দিন ব্যাপী এক ঐতিহাসিক বৈঠকের সূত্রপাত করেন সুইডেনের স্টকহোমে। বিষয় ছিল পরিবেশ আর তার সাথে মানুষের সম্পর্ক। সেই বৈঠকের দু’বছর পর থেকে আজকের দিনকে বিশ্বপরিবেশ দিবসের মর্যাদা দেওয়া হয়। প্রতীকি ভাবেই এই দিনে বিশ্ব জুড়ে মানুষ ভাবতে চান পরিবেশকে কী ভাবে আর কতটা দায়িত্বপূর্ণ ভাবে রক্ষা করা এবং ভালোবাসা দরকার।
কথা হলো যে ১৯৭৪ সাল প্রথম নয়, পরিবেশ নিয়ে মানুষ ভেবেছেন অনেক দিন থেকেই। সে ভাবনাদের স্বর ও প্রস্বরেরা প্রাচীন মানুষের কৌম অভ্যাসের নানা স্তর পরম্পরার নানা অঙ্গে বহু বহু বছর ধরে রয়েছে। আজও আছে। শেষ শ’দুয়েক বছরে নতুন করে সে ভাবনা ভেবেছেন বহুপ্রজ মহাচিন্তকেরা। নিজের মতন করে সে ভাবনা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন তাঁরা। একজন বিশাল মাপের মানুষ প্রকৃতি,পরিবেশ আর মানুষের সহচেতনার বীজ খুব যত্ন নিয়ে একটা নাতিদীর্ঘ বইতে বুনে দিয়েছেন। আজ কথা বলা যাক সেই বইটা নিয়ে। দুই ভাগে বিভক্ত হলেও আসলে সে বই একটাই চিন্তাস্রোতের ধারা। আমি ধন্য যে সেই বই দিয়ে আমার ছোটব্যালার বাংলা পাঠ শুরু হয়েছিল। পরিবেশ নিয়ে যেকোনো মানবিক ভাবনা ভাবতে বসলে আজও সে বই আমার কাছে নিকটতম। সে বই সহজপাঠ।
বাংলায় শিশুশিক্ষার সার্থক প্রাইমার, শিশুমানসের নিকটবর্তী সারল্য এবং অকৃত্তিম কল্পনাশক্তির চরমতম বিকাশের আহ্বায়ক হিসেবে সহজপাঠ এমনিতেই তার যোগ্য সমাদর লাভ করেছে। সে নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। নন্দলাল বসুর ছবি সমেত এই বই অক্ষরপরিচয় সম্পন্ন যেকোনো বাঙালির জীবনের এক অংশও হয়ে উঠেছে। এবং হয়ে ওঠেওনি। সত্যি যদি সহজপাঠ তা হয়ে উঠত তাহলে আমরা হয়ত কিছুটা কম হিংস্র হতাম!
আচ্ছা পরিবেশ বলতে কী বুঝি আমরা? গাছ-পালা,পশু,কীটপতঙ্গ, নদ-নদী, পাহাড়, সমুদ্র, অন্তরীক্ষ এইসব? মানে মানুষ এবং তার সমাজের বাইরের জিনিসপত্র। জাতিভেদ মেনে নিয়ে প্রজাপতিকে চুমু খেলে তা কি সু-পরিবেশ চেতনা? ধোঁয়াহীন ইলেক্ট্রিক গাড়িতে করে দিল্লি-মথুরা হাইওয়ে দিয়ে চলতে চলতে জানালা দিয়ে চিপসের খালি প্যাকেট ফেলে দেওয়া? পরিবেশের বাইরে আসলে কে? কী? যে স্মলপক্সের ভাইরাস নির্মূল করার জন্য আমাদের দীর্ঘ অধ্যাবসায় আসলে তো প্রকৃতি সেও। গোড়াতেই তাই মেনে নেওয়া ভালো যে মানুষের পরিবেশ চেতনা আসলে মানুষেরই স্বার্থে। কখনো সেটা প্রত্যক্ষ ভাবে অর্থ, কখনো বা নন্দনবোধ, কখনো বা কারুণ্য ও সহমর্মীতা। এবারে দ্যাখার দরকার যে স্বার্থটা য্যানো দীর্ঘমেয়াদী হয়। দশ-বিশ কিম্বা একশো বছরের জন্যে লাভ করার জন্যে এমন কিছু যদি করা হয় যাতে পাঁচশ বছর বাদে না থাকতে হয় তাহলে সেটাই আমরা মেনে নিই কু বা অ পরিবেশ চেতনা হিসেবে।
এইবারে আসি সহজপাঠের প্রথম দুইভাগে। যেগুলো শুধুই রবীন্দ্রনাথের। খেয়াল করলে দেখবেন যে এখানে এই সব কিছুকেই শিশুর সামনে তুলে ধরা হয়েছে। ঋতুপর্যায়, পাখি, পোকা, গাছ, ফুল, বন, মেঘ, মাসি, পিসি, ভাই, বোন, দইওয়ালা, পেয়াদা, ধোপা, মুদি, গয়লানী, ডাকাত, ডাক্তার, প্রজা এবং জমিদার – এই সবই আছে আশেপাশে। সবাইকে নিয়েই জগত। সব কিছুই প্রকৃতির অংশ। মানুষ নিজেকে তার থেকে বিচ্ছিন্ন না করে ফেললে সেও প্রকৃতি, সেও পরিবেশ। ঠিক যে কারণে নিজের হাত কিম্বা পা কাটিনা, নিজের ভুরু উপড়াই না, ঠিক সে কারণেই সঙ্গমরত কুকুরকে ঢিল মারবোনা, ফড়িঙ ধরে গায়ে কাঠি বিঁধিয়ে দেবো না, পিঁপড়েকে আগুন জ্বেলে পোড়াবোনা। তার মানে কি বাঘকে ঘরে নিয়ে এসে গলায় মালা দিতে হবে? দরকার নেই। “বনে থাকে বাঘ”। রক্তজবা নামের নৌকায় শক্তিবাবু বাঘ শিকার করতেও যান। পাঁঠার মাংস কিম্বা পুকুরের মাছ খেতেও বারণ করে না সহজপাঠ। তবে অনর্থক অসূয়ার স্থান নেই সেখানে। বাঘ শিকার করতে গিয়ে বাঘের মুখে মশাল ছুঁড়ে ভয় দেখিয়ে তাড়িয়ে দিলে আর বাঘকে গুলি করার প্রয়োজন পড়ে না।
সময়ের কিছুটা পিছুটান থাকে। রবীন্দ্রনাথ স্বাভাবিক ভাবেই নিজেও তার পার ন’ন। তাই সহজপাঠে ও আর ঔ তাদের বড়বৌকে দিয়েই ভাত বাড়ায়, দল বেঁধে চ বর্গ বোঝা নিয়ে হাটে যায়, প বর্গ মাঠে যায় ধান কাটতে যখন জমিদারের পিসি কাত্যায়নী পালকি চড়েন। বাবুরা সেখানে আসেন,যান, খান, কাজ করেন কিন্তু সাধারণ মানুষ গান গায়, খায়, কাজ করে। কিন্তু বিশাল ভাবে সমাজের কাঠামোকে উল্টেপাল্টে না দেওয়ার প্রবণতা থাকলেও সহজপাঠ একটা অবৈরীতা শেখায়। নিপুণ ভাবে বাচ্ছাদের মনে ভালোবাসা আঁকতে আঁকতে চলে। বহুত্বের আলিম্পনে পৃথিবী যে কতটা বিপুল ভাবে সুন্দর সেই চেতনার গোড়ায় সহজপাঠ জল ঢালে নিজের হাতে।
সহজপাঠের দ্বিতীয়-ভাগ প্রথমভাগের চেয়েও বিস্ময়কর! শ্রমের বিচিত্র স্তরবিন্যাস এবং বহুত্বের ধর্ম শিখতে এবং নিজের জীবনে ধারণ করতে শিশুদের এর থেকে ভালো শিক্ষকবন্ধু আর বোধহয় হতেই পারেনা। বর্ষার মেঘ গর্জন, আকাশের চকিত বিদ্যুৎ , নদীর বান, শুক্লপক্ষের জ্যোৎস্না, অঘ্রাণ মাসের ব্যালা, পশ্চিমের সূর্যাস্ত, রাতের জোনাকির দৃশ্য নান্দনিকতার পাশাপাশি শিশুদের এও বোঝানো হয় যে জমিদার চাইলে পুকুরে মাছ ধরা বন্ধ করতে পারেন। প্রজা খাজনা না দিলে তার পুলিশ-হাজত করা জমিদারের কাছে বড় কথা কিছু নয়। বাস্তবের এই সংবাদের পাশে সহজপাঠ এ’কথা জানাতে ভোলে না যে জমিদারের এই সিদ্ধান্ত অকল্যাণময়। জমিদারিপ্রথার মূল উপড়ে না ফেললেও সহজপাঠ শিখিয়ে দিতে চায় যে প্রজার কন্যার বিয়ে আর জমিদার কন্যার অন্নপ্রাশনের কল্যাণ একই সুতোয় গাঁথা। একটাকে মাটিতে ফেলে পায়ে দললে অন্যটাও ভালো হতে পারেনা। এইটাই সহজপাঠের পরিবেশ ভাবনার মূল দর্শন।
ডাক্তার বিশ্বম্ভরবাবুকে মনে পড়ে? লাঠিয়াল শম্ভুকে নিয়ে রোগী দেখতে গিয়ে ডাকাতের হাতে পড়েছিলেন যিনি। শম্ভু ডাকাতদের উত্তম মধ্যম দিতে ভোলেনা। নিজেদের প্রাণ বাঁচাতেই। কিন্তু তার পরেই ডাক্তার তাঁর নিজের ধর্ম ভোলেন না। তিনজন আহত ডাকাতের জন্যে শম্ভুর কাছে ডাক্তারির বাক্স খোলার নির্দেশ পৌঁছে যায়। নির্দেশ পৌঁছে যায় সহজপাঠ দিয়ে জীবন শুরু করা বাচ্চাদের কাছেও। চরমতম অপরাধের জন্যেও শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে একজন যখন নিজের নৈতিকতায় এবং যুক্তিবোধে শান দ্যান তখন তাঁর নিজেরই শিশুকালের সহজপাঠ পড়ার অভিজ্ঞতা কোথাও য্যানো যোগ্য সম্মান পায়।
দারোয়ান আক্রমের সাথে শক্তিনাথ বাবু বাঘ শিকারে গিয়ে পথ হারান। কাঠুরিয়াদের একটা গ্রামে এসে আতিথ্য নিয়ে সুস্থির হ’ন। তালপাতার ঠোঙায় চিড়ে, বনের মধু, ছাগলের দুধ, মাটির ভাঁড়ে করে নদীর জল খেয়ে বটের ছায়ায় সারা রাত ঘুমিয়ে ব্যালা চার প্রহরে কাঠুরিয়া সর্দার যখন পথ চিনিয়ে নৌকোয় পৌঁছিয়ে দ্যান তখন শক্তিবাবু দশটাকা বখশিশ দিতে চান। সর্দার হাত জোড় করে বলেন তা সম্ভব নয়, টাকা নিলে অধর্ম হবে। এই ধর্মই পরিবেশ চেতনা। মানব চেতনা। এই সহজপাঠের সামগ্রিক ধর্ম। এ শেখা বড়ই কঠিন। আমরা বেশির ভাগ মানুষই তা শিখতে পারিনি। আরও একটা পাঁচই জুনে এসে সহজপাঠের কথাই মনে পড়ছে সবচেয়ে বেশি। শিশুদের সাথেসাথে যুবা ও প্রবীণদেরও আরও বহুবার এ বই পড়ে চলা উচিৎ। পৃথিবী আর মানববিশ্বের ভালো হবে বলেই মনে হয়।
arpita | unkwn.***.*** | ০৬ জুন ২০১৮ ০৪:৫৯84368
Kallol Lahiri | unkwn.***.*** | ০৬ জুন ২০১৮ ০৫:০৯84369
পারমিতা | unkwn.***.*** | ০৬ জুন ২০১৮ ০৫:৪৮84370
অভিষেক | unkwn.***.*** | ০৭ জুন ২০১৮ ০৩:৩২84373
শক্তি | unkwn.***.*** | ০৭ জুন ২০১৮ ০৪:০০84371
দ | unkwn.***.*** | ০৭ জুন ২০১৮ ০৫:৫০84372
মৌসুমী | unkwn.***.*** | ০৮ জুন ২০১৮ ০১:২১84375
i | unkwn.***.*** | ০৮ জুন ২০১৮ ০১:৫২84374
অভিষেক | unkwn.***.*** | ০৮ জুন ২০১৮ ০২:৫৭84376
h | unkwn.***.*** | ০৯ জুন ২০১৮ ০৩:০৬84377