ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের ফঁসির এগারো বছর পূর্ণ হল আজ। বহু বছর আগের সেই কেস নিয়েই এই বিশদ লেখাটির প্রথম পর্ব প্রকাশ করা হল। সম্পূর্ণ হবে চার পর্বে।
ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের বহু আলোচিত কেসটি নিয়ে কলকাতার দুই অধ্যাপক প্রবাল চৌধুরী ও দেবাশিস সেনগুপ্ত দীর্ঘদিন ধরে অনুসন্ধান চালাচ্ছেন। তাঁদের দীর্ঘ পরিশ্রম, অনুসন্ধান, আলোকপাত এবং আলোচনা ছাড়া এই লেখা লেখাই সম্ভব ছিলনা। অধ্যাপকদ্বয়ের সৌজন্যেই এই লেখায় ব্যবহৃত আদালতের নথিসমূহ বিনা পরিশ্রমে বর্তমান লেখকের হাতে এসেছে। এখানে ব্যবহৃত একমাত্র চিত্রটি(লে-আউট)ও তাঁদের সৌজন্যেই প্রাপ্ত। যদিও, বলাবাহুল্য, এই লেখার বক্তব্য ও লিখনশৈলীর দায়, সম্পূর্ণতই বর্তমান লেখকের, অধ্যাপকদ্বয়ের নয়। - লেখক।
পর্ব এক – হত্যার আখ্যান
১।
ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের নাম পশ্চিমবঙ্গবাসী প্রথম জানে খবরের কাগজ মারফত। ১৯৯০ সালের মার্চ মাসের ৬ তারিখে। যদিও, চায়ের কাপের সঙ্গে এক ঝলকে প্রভাতী দৈনিক পড়া শহুরে পাঠকরা সে নাম তখন কতজন মনে রেখেছিলেন, বলা মুশকিল। আটপৌরে, নেহাৎই গ্রাম্য এই নামটি শহুরে মানুষের কাছে পরিচিত হবে ২০০৪ সালের পর। নানা ঘটনার ঘনঘটায় পর পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ধনঞ্জয় নামোচ্চারণেই যে মৃত্যুদন্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত অপরাধীকে নির্ভুলভাবে চিনে নেবে, সেই ধনঞ্জয় তখনও ভবিষ্যতের গর্ভে। কিন্তু শুরুটা ওইদিনই। কারণ ১৮ বছর বয়সের আইসিএসই পরীক্ষার্থিনী হেতাল পারেখ খুন হয় তার আগের দিন। মার্চ মাসের ৫ তারিখে। খুন হওয়া মেয়েটির রক্তাক্ত শরীর আবিষ্কৃত হয়, তার নিজের ফ্ল্যাটে, কলকাতার পদ্মপুকুর রোডে, আনন্দ অ্যাপার্টমেন্টের চারতলার ফ্ল্যাটে, সেদিন পর্যন্ত ধনঞ্জয় ছিল যে অ্যাপার্টমেন্টের কর্মরত নিরাপত্তারক্ষী।
বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলে ধনঞ্জয় সম্ভবত প্রথমবার খবরের কাগজে নাম তোলে পরেরদিন, খুনের খবরের সঙ্গে। ৬ তারিখ কলকাতার সমস্ত প্রথম সারির দৈনিক হইহই করে ছাপে হেতালের নৃশংস খুনের খবর। সঙ্গে উঠে আসে ধনঞ্জয়ের নামও। সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে জানানো হয়, “ভবানীপুর থানার পদ্মপুকুর রোডে আনন্দ অ্যাপার্টমেন্টের একটি ফ্ল্যাটে সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটা নাগাদ হেথলা (হেতাল – বর্তমান লেখক) পারেখ নামে ১৮ বছরের এক তরুণীকে খুন করা হয়। গলায় রুমাল বেঁধে ফাঁস দিয়ে এবং মাথায় ভারি কোনো জিনিস দিয়ে ওঁকে খুন করা হয়েছে বলে পুলিশের ধারণা। ওঁর হাত পায়ের হাড়ও ভেঙেছে বলে ডাক্তাররা অনুমান করছেন। পরনে ছেঁড়া সায়া, ব্লাউজ। পুলিশের অনুমান, খুন করার আগেই ওঁকে ধর্ষণ করা হয়েছে। ঘরের আলমারির দরজা ছিল খোলা। তবে কিছু খোওয়া গেছে কিনা এখনও জানা যায়নি। ঘটনার পরেই ওই অ্যাপার্টমেন্টের সিকিউরিটি গার্ড ধনঞ্জয় চ্যাটার্জি (২৬) উধাও হয়েছে। পুলিশ এখন তাকে খুঁজছে।” (আজকাল এর প্রতিবেদন, ৬ ই মার্চ ১৯৯০)।
ধনঞ্জয়কে পুলিশ কেন খুঁজছে, তা নিয়েও আলোকপাত করে সংবাদপত্রের প্রতিবেদন। “ওই অ্যাপার্টমেন্টের লিফটম্যান রামধনী। পুলিশকে ও জানায় যশোমতী (হেতালের মা – বর্তমান লেখক) মন্দির থেকে ফিরে আসার মাত্র মাত্র পাঁচ মিনিট আগে ওই বাড়িরই সিকিউরিটি গার্ড ধনঞ্জয় চ্যাটার্জিকে ও দেখেছে লিফট করে উপর থেকে নিচে নামতে। ধনঞ্জয়ের পরনে ছিল সাদা জামাপ্যান্ট। তবে তাতে রক্তের কোনো দাগ ছিলনা বলেই তার মনে হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গেই খোঁজ পড়ে ধনঞ্জয়ের। ওই বাড়িতেই রয়েছে কোয়ার্টার। ওখানে ওকে পাওয়া যায়না। ওর বাড়ি কাছাকাছি মহেন্দ্র রোডে। ওখানেও নেই। সম্ভাব্য আরও কিছু জায়গায় খোঁজা হল। কিন্তু কোথাও কোনো হদিশ পাওয়া গেলনা।” (আজকাল এর প্রতিবেদন, ৬ ই মার্চ ১৯৯০)।
সেদিন সকালের সমস্ত সংবাদপত্রই এই খুনের খবরটি ছাপে। কেউ বড়ো করে, কেউ তুলনায় ছোটো আকারে। অন্য কোনো কাগজে লিফটম্যানের দেওয়া তথ্যটির উল্লেখ তেমন নেই, যে তথ্যটি, পরে আমরা দেখব, এই ঘটনার অন্তর্তদন্তে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। লিফটম্যান রামধনির (রামধনির পুরো নাম রামধন যাদব, রামধনি এবং রামধন দুটো নামই নথিতে ব্যবহৃত হয়েছে, আমরা এই প্রবন্ধে রামধনি নামটিই ব্যবহার করব) এই বয়ানটিতে আমাদের পরে ফিরে আসতে হবে, যেটা প্রাথমিকভাবে আজকাল ছাড়া অন্য কোনো কাগজে বেরোয়নি। কিন্তু সেটা সম্ভবত খবরের শব্দসংখ্যার সীমাবদ্ধতার কারণে (কোনো কোনো কাগজে প্রথমদিন খবরটা ছোটো আকারে বেরিয়েছিল)। কারণ খুচখাচ তথ্য কমবেশি থাকলেও, প্রতিটি সংবাদপত্রেরই মূল সুরটা সেদিন একই ছিল। সমস্ত প্রতিবেদনেরই মূল স্তম্ভ তিনটে। ১। ফ্ল্যাটে অষ্টাদশী খুন। ২। খুন হওয়া মেয়েটির পোশাক খোলা/বিস্রস্ত। অতএব সম্ভাব্য ধর্ষণ। ৩। নিরাপত্তারক্ষী পলাতক। এই তিনটেকে জুড়লে সরাসরি ইঙ্গিতটা কোনদিকে বুঝতে অসুবিধে হবার কথা নয়। যেহেতু কেবল একটি সংবাদপত্রে নয়, প্রতিটিতেই এই একই আখ্যানের পুনরাবৃত্তি, কাজেই এটা মেনে নিতে কোনো অসুবিধে নেই, যে, খুনের একটি আবছা এবং সম্ভাব্য আখ্যান, পরেরদিনই তৈরি হয়ে যায়, যা “পলাতক” ধনঞ্জয়ের দিকে অঙ্গুলীনির্দেশ করে।
এখানে মনে রাখা দরকার, খুনের খবর পুলিশ পায় রাতে। পুলিশের সাব-ইন্স্পেক্টর গুরুপদ সোম, হেতালের বাবা নাগরদাস পারেখের কাছ থেকে খুব অগোছালো টেলিফোন বার্তা পেয়ে ঘটনাটি সম্পর্কে অবহিত হন। তাঁর আদালতে দেওয়া বয়ান অনুযায়ী টেলিফোনটি তিনি পান রাত ৯-১৫ নাগাদ। বার্তাটি ছিল ছোট্টো, শুধু খুনের খবরটিই দেওয়া হয়। এর পরে ঘটনাস্থলে পুলিশ পৌঁছয়, আদালতের বয়ান অনুযায়ী জিজ্ঞাসাবাদ চলে গভীর রাত পর্যন্ত। সংবাদপত্রের বিবরণ অনুযায়ী এরই সঙ্গে চলে ধনঞ্জয়কে সমস্ত সম্ভাব্য জায়গায় খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা। প্রভাতী সংবাদপত্রে প্রকাশ করার জন্য প্রতিবেদন যদি রাত ২ টো তেও লেখা শুরু হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়, তবে, খুনের এই সম্ভাব্য আখ্যানটি আসলে পরেরদিন নয়, তৈরি হয়ে যায় পুলিশ আসার অন্তত কয়েকঘন্টার মধ্যে।
ধনঞ্জয়কে খুন করতে কেউ দেখেনি। রক্তাক্ত অবস্থায় পালাতেও না। কিন্তু মাত্র কয়েকঘন্টার মধ্যেই খুনের আখ্যানে জড়িয়ে যায় ধনঞ্জয়ের নাম। সম্ভাব্য অপরাধী বা ভিলেন হিসেবে।
২।
খুনের যে সম্ভাব্য আখ্যানটি প্রাথমিকভাবে খবরের কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল, তা আপতিক কিছু নয়। খাপছাড়া রিপোর্টিং ও নয়। সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী কলকাতা পুলিশের তৎকালীন ডিসিডিডি প্রসূন মুখার্জি সেদিন গভীর রাতে ফ্ল্যাটে বসেই এই হত্যার কাহিনী সাংবাদিকদের শোনান। (বর্তমান পত্রিকা ৬ ই মার্চ ১৯৯০)। ফলে এই প্রতিবেদনগুলির সঙ্গে “অফিশিয়াল” পুলিশি বিবৃতির একটা সম্পর্ক আছে। এমনকি খবরের কাগজের প্রতিবেদন ধনঞ্জয়কে এই আখ্যানে কেন জড়িয়ে ফেলা হল, তারও কিছু ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। একটি কাগজ লেখে “মেয়েটির মা বেরিয়ে যাবার পরই (অর্থাৎ খুনের ঘটনার সম্ভাব্য সময় – বর্তমান লেখক) ওই বাড়ির সিকিউরিটি গার্ড জনৈক ধনঞ্জয় চ্যাটার্জি ফোন করার অছিলায় ওই ফ্ল্যাটে ঢুকেছিল বলে অভিযোগ শোনা গেছে। এই ঘটনার পর তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। পুলিশ অবশ্য এ ব্যাপারে মুখ খুলতে রাজি নয়।” (বর্তমান পত্রিকা ৬ ই মার্চ ১৯৯০)
পুলিশ মুখ খুলতে রাজি নয় বলা হলেও, সরকারপক্ষের আদালতে পেশ করা বয়ানের সঙ্গে সংবাদপত্রের এই প্রতিবেদন হুবহু মেলে। বস্তুত, ওইদিন, অর্থাৎ খুনের দিন গভীর রাতে কয়েক ঘন্টার মধ্যে তৈরি হওয়া খুনের আখ্যানের যে টুকরোটাকরা নানা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়, তার সঙ্গে খুনের “আদালত-স্বীকৃত” (অর্থাৎ আদালতের রায়ে যা বিবৃত হয়েছে) আখ্যানের কাহিনীসূত্র বা স্টোরিলাইনের খুব বেশি তফাত নেই। যেটুকু আছে, তা ডিটেলিং এর, এবং নতুন কিছু তথ্য ও সাক্ষ্য পেশ করা হয়েছে, যা খুনের দিনই পুলিশের হাতে আসেনি, আসা সম্ভবও ছিলনা। কিন্তু যেটুকু গণমাধ্যমে খুনের পরেরদিনই প্রকাশিত, সেই কাহিনীসূত্র থেকে একেবারেই কোনো বিচ্যুতি নেই।
ডিটেলিং এর প্রশ্নে অবশ্যই অনেক পরে আদালতে পেশ করা আখ্যানটি অনেক সুবিন্যস্ত। খবরের কাগজের খাপছাড়া ভাবটা একেবারেই নেই। ভূমিকা, উপসংহার সহ আখ্যান সেখানে একেবারেই স্বয়ংসম্পূর্ণ। বস্তুত “স্বীকৃত” আখ্যানে কাহিনী মোটেই খুনের দিন শুরু হচ্ছেনা। হচ্ছে তার তিনদিন আগে। অর্থাৎ মার্চের ২ তারিখ। সেখানে ঘটনা শুরু হচ্ছে ধনঞ্জয়ের বিরুদ্ধে হেতালের অভিযোগ দিয়ে। ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের আপিল মামলায় হাইকোর্টের রায়ের অংশবিশেষ থেকে পড়লে সেই “আদালত-স্বীকৃত” কাহিনীটি মোটামুটি এরকমঃ
মার্চের দুই তারিখে অর্থাৎ খুনের তিনদিন আগে, হেতাল তার মা যশোমতী পারেখের কাছে অভিযোগ করে, যে, ধনঞ্জয় স্কুলে যাতায়াতের পথে তাকে বিরক্ত (টিজ) করে, এবং সেদিন ধনঞ্জয় তাকে একসঙ্গে সিনেমা দেখতে যাবার প্রস্তাব দিয়েছে। যশোমতী তাঁর স্বামী নগরদাস পারেখকে ঘটনাটি জানান। নগরদাস যে সিকিউরিটি এজেন্সি থেকে ধনঞ্জয়কে নেওয়া হয়েছিল, সেখানে ধনঞ্জয়ের নামে অভিযোগ করেন, এবং ধনঞ্জয়ের জায়গায় অন্য কোনো নিরাপত্তারক্ষীকে নিয়োগ করতে বলেন। দুদিন পর, অর্থাৎ মার্চের চার তারিখে সিকিউরিটি এজেন্সি ধনঞ্জয়কে একটি লিখিত ট্রান্সফার অর্ডার দেয়। ধনঞ্জয়কে আনন্দ অ্যাপার্টমেন্ট থেকে সরিয়ে পরশ অ্যাপার্টমেন্ট নামক অন্য একটি বহুতলে ডিউটি দেওয়া হয়। বদলি হিসেবে পরশ অ্যাপার্টমেন্টের তৎকালীন নিরাপত্তারক্ষী বিজয় থাপাকে সরিয়ে আনা হয় আনন্দ অ্যাপার্টমেন্টে। এই ব্যবস্থাটি চালু হবার কথা ছিল পরের দিন, মার্চের পাঁচ তারিখ, অর্থাৎ খুনের দিন থেকে।
খুনের দিন, অর্থাৎ পাঁচ তারিখ, হেতালের বাবা নগরদাস সকাল ৯ টায় ব্যবসার কাজে বেরিয়ে যান। হেতালের দাদা ভবেশ(হেতালের থেকে এক বছরের বড়ো) কলেজ থেকে বাড়ি ফেরে সাড়ে এগারোটায়, তারপর খাওয়া দাওয়া করে বাবাকে ব্যবসায় সাহায্য করতে বেরিয়ে যায়। আইসিএসই পরীক্ষার্থিনী হেতাল পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফেরে দুপুর ১টা নাগাদ। যশোমতীর অভ্যাস প্রতিদিন বিকেলে স্থানীয় লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দিরে যাওয়া। তিনি সেদিন বেরোন ৫-২০ নাগাদ। বাড়িতে হেতাল থাকে একা।
সেদিনই বদলি হয়ে যাবার কথা থাকলেও ধনঞ্জয় সেদিন আনন্দ অ্যাপার্টমেন্টেই সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টো পর্যন্ত ডিউটি দেয়, প্রতিদিনের মতই। যশোমতী বেরিয়ে যাবার কিছুক্ষণ পরে ধনঞ্জয় পরের শিফটের নিরাপত্তারক্ষী দশরথ মুর্মুর কাছে এসে বলে সে সিকিউরিটি এজেন্সির অফিসে (যেখানে ধনঞ্জয় এবং দশরথ দুজনই কর্মরত) টেলিফোন করার জন্য হেতালদের ফ্ল্যাটে যাচ্ছে। এবং তারপর সে লিফট ধরে উপরে উঠে যায়। আরও সামান্য সময় পরে, ৫-৪৫ নাগাদ সিকিউরিটি এজেন্সির সুপারভাইজার প্রতাপচন্দ্র পতি আসেন ওই ফ্ল্যাটবাড়িতে। বিজয় থাপা আসেনি এবং ধনঞ্জয় প্রতিদিনের মতই কাজ করেছে শুনে তিনি ধনঞ্জয়ের খোঁজ করেন। প্রথমে ইন্টারকমে হেতালের ফ্ল্যাটে ফোন করা হয়। কেউ না ধরায় ওই ডিউটির জায়গা থেকেই দশরথ মুর্মু চিৎকার করে ধনঞ্জয়ের নাম ধরে ডাকেন। ধনঞ্জয় চারতলায় হেতালের ফ্ল্যাটের ব্যালকনি থেকে ঝুঁকে পড়ে উত্তর দেয়, যে সে নিচে আসছে। নিচে নামার পর ধনঞ্জয়ের কাছে জানতে চাওয়া হয়, সে পরশ অ্যাপার্টমেন্টে কাজে যায়নি কেন। সে বলে, তার কিছু ব্যক্তিগত সমস্যা ছিল। তারপর সে আনন্দ অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে যায়, এবং পুলিশের হাতে নিজের গ্রামে প্রেপ্তার হওয়ার আগে পর্যন্ত তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
যশোমতী অভ্যাস মতো মন্দির থেকে ফেরেন ৬-০৫ নাগাদ। লিফটে ওঠার সময় লিফটম্যান রামধনি তাঁকে বলেন, ধনঞ্জয় সিকিউরিটি এজেন্সিকে টেলিফোন করার জন্য তাঁদের ফ্ল্যাটে গিয়েছিল। শুনে যশোমতী বিচলিত হয়ে পড়েন। উপরে উঠে তিনি দরজায় বেশ কয়েকবার বেল বাজান। কোনো শব্দ না পাওয়ায় তিনি চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করেন। চারদিকে লোকজন জমে যায় (মূলত নানা ফ্ল্যাটের ভৃত্যকুল)। তারা সবাই মিলে দরজা ভাঙে। ফ্ল্যাটের একটি বেডরুমে হেতালের অচৈতন্য দেহ পাওয়া যায়। পোশাক আশাক এলোমেলো এবং খোলা ছিল, শরীর ছিল রক্তাক্ত। যশোমতী অচৈতন্য মেয়েকে কোলে তুলে লিফটে করে নিচে নামেন। পড়শিরা একজন্ ডাক্তার ডাকেন, তিনি দেখে হেতালকে মৃত ঘোষণা করেন। হেতালের দাদা ভবেশ ফিরে আসে ৭টা নাগাদ। ইতিমধ্যে আরও একজন ডাক্তার আসেন, তিনিও হেতালকে মৃত ঘোষণা করেন। হেতালের দেহ উপরে তার নিজের ফ্ল্যাটে তোলা হয়। পুলিশকে তখনও কোনো খবর দেওয়া হয়নি।
হেতালের মৃতদেহ ওভাবেই তার খাটে পড়ে থাকে ঘন্টা দেড়েক। যশোমতীর স্বামী নগরদাস বাড়ি ফেরেন সাড়ে ৮টায়। তারও ৪৫ মিনিট পরে তিনি ভবানীপুর থানায় ফোন করেন। খবর পেয়ে সাব-ইনস্পেক্টর গুরুপদ সোম আরও কয়েকজনের সঙ্গে ফ্ল্যাটে আসেন। যাশোমতী পারেখের জবানবন্দী রেকর্ড করা হয়। এবং সেটাকেই প্রথম এফআইআর হিসেবে গ্রহণ করে তদন্ত শুরু হয়। ( এই পর্যন্ত ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের আপিল মামলায় হাইকোর্টের রায়ের অংশবিশেষ থেকে সংক্ষেপিত। ভাষা বর্তমান লেখকের নিজস্ব)।
শুধু এটুকুই নয়, আখ্যানে আরও তিনটি সাক্ষ্যপ্রমাণের কথাও আছে, একটি বোতাম, একটি ঘড়ি, এবং একটি হার। সেগুলির প্রসঙ্গে আমরা পরে আসব। এখানে দেখার এইটুকুই, যে, এই “আদালত-স্বীকৃত” আখ্যানটি সুবিন্যস্ত হলেও, সংবাদপত্রে প্রথমদিন প্রকাশিত টুকরো-টাকরাগুলির প্রায় সবই অবিকৃত অবস্থায় এখানে আছে। ধনঞ্জয়কে সম্ভাব্য অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করার যে মূল কারণগুলি সংবাদপত্রে একদম প্রথমদিনই প্রকাশিত হয়েছিল, তার তিনটি স্তম্ভ। এক, লিফটম্যানের বয়ান। দুই, কর্মরত নিরাপত্তারক্ষীর বয়ান। তিন, পলাতক ধনঞ্জয়। “আদালত-স্বীকৃত” বয়ানে এরা একেবারে বদলায়নি তা নয়। যেমন লিফটম্যানের বয়ান, খুঁটিয়ে পড়লে দেখা যায়, যে, সংবাদপত্র এবং আদালত-স্বীকৃত আখ্যানে আলাদা। সংবাদপত্রে লেখা হয়েছে “ওই অ্যাপার্টমেন্টের লিফটম্যান রামধনী। পুলিশকে ও জানায় যশোমতী মন্দির থেকে ফিরে আসার মাত্র মাত্র পাঁচ মিনিট আগে ওই বাড়িরই সিকিউরিটি গার্ড ধনঞ্জয় চ্যাটার্জিকে ও দেখেছে লিফট করে উপর থেকে নিচে নামতে। ধনঞ্জয়ের পরনে ছিল সাদা জামাপ্যান্ট। তবে তাতে রক্তের কোনো দাগ ছিলনা বলেই তার মনে হয়েছে।”
কিন্তু আদালত-স্বীকৃত আখ্যানে লিফটম্যানের বয়ানে লিফটে করে নেমে আসার জায়গা নিয়েছে, ফ্ল্যাটে যাবার বিবরণ (রামধনি ফ্ল্যাটে যেতে দেখার কথা যশোমতীকে বলেন)। ব্যাপারটা আপাতদৃষ্টিতে সামান্য মনে হয়। সেই কারণে বয়ান সামান্য বদলালেও আখ্যানের ওই তিনটি স্তম্ভ আদালত-স্বীকৃত কাহিনীতেও অবিকল একই রকম থেকে যায়। খুব সোজা ভাষায় বললে, দুই জায়গাতেই ব্যাপারটা একই রকমঃ “লিফটম্যান তো ওকে দেখেছিল। নিরাপত্তারক্ষীও বলেছে দেখেছে। তারপর আবার ঘটনার পরেই পালিয়েছিল।” (বলাবাহুল্য, উদ্ধৃতি চিহ্ন থাকলেও, এইগুলো এই ভাষায় কেউ কোথাও বলেননি)
অর্থাৎ আদালত-স্বীকৃত কাহিনীর যে স্তম্ভগুলি প্রাথমিকভাবে ধনঞ্জয়কে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে, তারা গভীর কোনো তদন্তের ফসল নয়। পুলিশ পৌঁছনোর কয়েকঘন্টার মধ্যে (আরও তাড়াতাড়িও হতে পারে) এগুলি নির্মিত হয়। বাকি যা যা এসেছে, তা মূলত এই নির্মিতির পাদপূরণ। মূল গল্পটি তৈরি হয়েছিল খুনের দিন, অর্থাৎ মার্চ মাসের পাঁচ তারিখ রাতে সংবাদপত্রের প্রতিবেদকরা প্রভাতী সংবাদপত্রের জন্য তাঁদের প্রতিবেদন লিখতে শুরু করার আগেই।
৩।
এখানে বারবার আখ্যান, কাহিনী, এইসব শব্দ ব্যবহারে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, আখ্যান কেন বলা হচ্ছে বস্তুটাকে? অপরাধের প্রাথমিক এবং গোছানো বিবরণে যে মিল আছে, তাতেই বা আশ্চর্যের কি আছে? এমন তো হতেই পারে, যে কেসটা খুব সোজা ছিল। প্রাথমিক ভাবেই যে চিহ্নগুলি পাওয়া গিয়েছিল সেগুলো এতই সহজ এবং স্পষ্ট, যে, সেগুলো ঘোষণা করতে কোনো অসুবিধে হয়নি। পরবর্তীকালে আরও কিছু সাক্ষ্য পাওয়া গেছে, যা প্রাথমিক অনুমানগুলিকে জোরদার করেছে। এবং সমস্ত অনুমানগুলি যদি একই দিকে অঙ্গুলীনির্দেশ করে, তাহলে সেটা অপরাধকে প্রমাণ করে। বস্তুত “আদালত-স্বীকৃত” আখ্যানটি তো দেখাচ্ছেই, যে, কেসটা মোটেই জটিল কিছু ছিলনা। প্রাথমিক বিবরণে সন্দেহ ঠিকই ছিল, কিন্তু খুনের কারণটা ঠিক বোঝা যাচ্ছিলনা। আদালত-স্বীকৃত বিবরণটি কারণ অর্থাৎ মোটিভটিকেও যুগিয়ে দেয়। কামনা, প্রতিহিংসা পরায়ণতা, ক্রোধ এবং নির্বুদ্ধিতা, একসঙ্গে কোনো মানুষের মধ্যে থাকলে সে এ ধরণের ঘটনা ঘটাতেই পারে। মোটিভ যদি তাৎক্ষণিকভাবে খুঁজে না পাওয়া যায়, আবিষ্কৃত হয় পরে, সে ধরণের পাদপূরণে অসুবিধে টা কি? এবং প্রাথমিক সাক্ষ্য ও পারিপার্শ্বিকতার নানা পরবর্তী উদ্ঘাটন যদি একই সম্ভাবনাকে নির্ভুলভাবে দেখিয়ে দেয়, তবে সেটা আখ্যান হবে কেন? সেটা তো একরকম ভাবে প্রমাণিত সত্য।
এই সম্ভাব্য প্রশ্নটিকে নিয়ে নানারকম দার্শনিক কূটতর্কের অবতারণা করা গেলেও, বাস্তব ক্ষেত্রে, মেনে নিতে দ্বিধা নেই, অপরাধ প্রমাণের প্রশ্নে সাধারণভাবে আমরা এরকম একটা ধারণা নিয়েই চলি। অর্থাৎ, জনৈক ব্যক্তি রামকে যদি বুকে ছুরি বসিয়ে খুন করা হয়, এবং রামের শত্রু শ্যামকে যদি সেই ঘটনার সময় রামের ঘরে ঢুকতে দেখা যায়, ছুরির হাতলে পাওয়া যায় শ্যামের হাতের দাগ, রামের হাতের মুঠিতে শ্যামের চুল লেগে থাকে, শ্যামের জামাকাপড়ে যদি পাওয়া যায় রামের রক্তের দাগ, তবে শ্যামকে রামের হত্যাকারী হিসেবে আমরা মেনে নিই। কিন্তু প্রশ্ন হল, বাস্তব জীবনের সমস্ত ঘটনাই কি এতটা সরল? আরও নির্দিষ্টভাবে বললে, ধনঞ্জয়ের ঘটনায় পারিপার্শ্বিকতা কি এতটাই “নির্ভুল” ভাবে পুরোটা দেখিয়ে দেয়? আমাদের অনুসন্ধানের বিষয় সেইটুকুই। যে কারণে এই ঘটনার বিবরণকে আমরা আপাতত “সত্য” বা “মিথ্যা” কিছুই ধরছিনা। “আখ্যান” বলা হচ্ছে, গল্পকথা হিসেবে নয়, বরং শুধু একটা বিবরণ হিসেবে, যে বিবরণকে নিয়েই একটি অন্তর্তদন্ত আমরা করছি। আমাদের কাছে, আপাতত এ সত্যও নয়, মিথ্যাও নয়, শুধুই একটি আখ্যান।
কিন্তু এটা শুধু প্রশ্নের একটা উত্তর। দ্বিতীয় উত্তরটা একটু জটিল, যদিও এখানে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। হেতালের খুনের যে আখ্যানটি আদালতের সামনে পেশ করা হয়েছিল, সেটা কি সত্যিই শূন্য থেকে শুরু করা একটি অনুসন্ধান ছিল, যেখানে প্রাথমিক তথ্যগুলি কিছু চিহ্ন তুলে ধরেছিল, এবং পরবর্তীকালে উদ্ঘাটিত তথ্যগুলি সেই চিহ্নকেই জোরদার করে? নাকি শুরুতেই একটি হাইপোথিসিস বা আখ্যানসূত্র দিয়েই শুরু হয়েছিল অনুসন্ধান? অপরাধ প্রমাণের “সাধারণ ধারণা”য়(এই পরিচ্ছেদের শুরুতেই যে ধারণাটার কথা বলা হয়েছে) এমনই মনে হওয়া সোজা, যে, সমস্ত অপরাধ অনুসন্ধানই শুরু হয় শূন্য থেকে, হাইপোথিসিস বিহীন। এখানেও সেটাই হওয়ার কথা। এই পরিচ্ছেদের শুরুতেই ওই “সাধারণ ধারণা”র কথা বলা হয়েছে। বস্তুত এই ধারণাটি নতুন কিছুই নয়। অপরাধ অনুসন্ধানের “আদর্শ” ব্যবস্থা হিসেবে অবিকল একই ধারণা আমরা নানা জায়গায় এমনিই দেখতে পাই। যেমন পাই প্রচলিত ফিকশনে, উদাহরণস্বরূপ শতাব্দীপ্রাচীন এক বিশ্বখ্যাত গোয়েন্দার বয়ানে, যিনি তদন্তকে “বিজ্ঞান” হিসেবে দেখতেন। আর্থার কোনান ডয়েলের সৃষ্টি শার্লক হোমস এই পদ্ধতিতেই তাঁর তদন্ত শুরু করতেন, অর্থাৎ, শূন্য মাথায় এবং হাইপোথিসিসহীন। “দা অ্যাডভেঞ্চার অফ দা কার্ডবোর্ড বক্স” গল্পে হোমস খুব পরিষ্কার জানাচ্ছেন, "Let me run over the principal steps. We approached the case, you remember, with an absolutely blank mind, which is always an advantage. We had formed no theories. We were simply there to observe and to draw inferences from our observations."। তাহলে সত্যে পৌঁছনো হবে কিকরে? সমস্ত “তথ্য”কে এক জায়গায় করে স্রেফ বিশ্লেষণী ক্ষমতা দিয়ে অতীতকে পুনর্নির্মান করে। এবং সেই পুনর্নির্মান হবে “নির্ভুল” এবং “সত্য”। স্বয়্ং হোমস এ ব্যাপারে বলছেন, "In solving a problem of this sort, the grand thing is to be able to reason backwards... In the every-day affairs of life it is more useful to reason forwards, and so the other comes to be neglected. There are fifty who can reason synthetically for one who can reason analytically...Let me see if I can make it clearer. Most people, if you describe a train of events to them, will tell you what the result would be. They can put those events together in their minds, and argue from them that something will come to pass. There are few people, however, who, if you told them a result, would be able to evolve from their own inner consciousness what the steps were which led up to that result. This power is what I mean when I talk of reasoning backwards, or analytically." (আ স্টাডি ইন স্কারলেট)
এখানে শার্লক হোমসের জগৎ হল নিউটনের, বা বলা ভালো ল্যাপলাসের বিজ্ঞানের জগৎ, যেখানে “কাল” এর আলাদা করে কোনো ভূমিকা নেই। আজকের সমস্ত তথ্য জানা থাকলে স্রেফ যুক্তি দিয়েই যেমন আগামীকাল সম্পর্কে নিখুঁতভাবে জানা যাবে, তেমনই গতকাল কেমন ছিল, সেটাও যথাযথভাবে বুঝে নেওয়া যাবে। জানার পদ্ধতিটা একই, শুধু সেটাকে দিক পরিবর্তন করে চালনা করতে হবে, এই মাত্র।
তাত্ত্বিক অবস্থানটি এখানে পরিষ্কার। কিন্তু প্রশ্ন হল “বিজ্ঞান” নিজেই কি এভাবে চলে? ডয়েলের মৃত্যুর কয়েক দশকের মধ্যেই টমাস কুন বিজ্ঞানের ইতিহাস নিয়ে পর্যালোচনা করতে গিয়ে দেখিয়েছিলেন, পদ্ধতিটা অন্যরকমও হতে পারে। চিন্তার একটি কাঠামো বা প্যারাডাইম তৈরি করা বিজ্ঞানের একটি সাধারণ চলন।(দা স্ট্রাকচার অফ সাইন্টিফিক রেভলিউশনস)। তার মধ্যে কিছু হাইপোথিসিস বানানো এবং সেটাকে পরীক্ষা করে দেখে “সত্য” অথবা “মিথ্যা” বলে মেনে নেওয়া বিজ্ঞানের একটি স্বীকৃত ভঙ্গী। এই হাইপোথিসিস কোথা থেকে আসবে সে ব্যাপারে বিজ্ঞান কিছু বলেনা, কিন্তু “শূন্য” মাথায় অনুসন্ধান শুরু করলে কোনো হাইপোথিসিসই তৈরি করা সম্ভব নয়। বস্তুত ডয়েলের জীবৎকালেই বিজ্ঞান ও গণিতের ক্ষেত্রে পঁয়কারে এই পর্যালোচনাগুলি করে গেছেন। (সায়েন্স অ্যান্ড হাইপোথিসিস)।
এটা বিজ্ঞানের পদ্ধতির আলোচনা নয়। বস্তুত বিষয়টা তেমন অজানা কিছুও নয়। কিন্তু মানুষের প্রাণ যেখানে জড়িত, সেখানে এই পদ্ধতির প্রয়োগ নিয়ে একটু অস্বস্তি তৈরি হয়। কারণ, আমরা জানি, যে, বিজ্ঞানের “প্রমাণিত সত্য”গুলিও অনেক ক্ষেত্রে পরবর্তী পর্যালোচনায় “ভুল” হয়ে যায়। আর প্যারাডাইম বদলে গেলে বহু “সত্য”ই তার অর্থ হারায়। কিন্তু মানুষের প্রাণের ক্ষেত্রে এই বদলে যাওয়া “সত্য” খুব সহজ ব্যাপার নয়, কারণ প্রাণ গেলে তা আর ফেরত আসেনা। তাই এখানে আরও গভীর এবং প্রশ্ন হল, বিজ্ঞান যেভাবেই ভাবুক, বিচারব্যবস্থা কি হোমসীয় পদ্ধতিতে চিন্তাভাবনা করে? নাকি অপরাধের ন্যায়বিচারের প্রশ্নটিকে হাইপোথিসিস মডেলে ভাবা হয়?
একদম সরাসরি আলোচ্য কেসটা নিয়েই দেখা যাক। ধনঞ্জয়ের বিচার প্রক্রিয়াতেই, “আদালত-স্বীকৃত” আখ্যানটির প্রসঙ্গ একাধিকবার উঠেছে হাইকোর্টে এবং সুপ্রিম কোর্টে। খুব প্রাসঙ্গিকভাবেই। এবং কোর্টের রায়ে হোমসীয় মডেলের ঠিক উল্টোদিকে গিয়ে বারবারই “আদালত-স্বীকৃত” আখ্যানটিকে প্রাথমিকভাবে “হাইপোথিসিস” হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। অর্থাৎ, বিচারব্যস্থার মতেই “আদালত-স্বীকৃত” বয়ানটি প্রাথমিকভাবে একটি “আখ্যান” মাত্র, যা প্রমাণিত হবার অপেক্ষায়। যে প্যারাডাইমের মধ্যে এই হাইপোথিসিসটি প্রমাণ করতে হবে, তার নাম “প্রচলিত আইন” বা “সেটলড ল”। সেই প্যারাডাইম প্রমাণের একটি পদ্ধতিকেও নির্দিষ্ট করে দিয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের রায়ে যে পদ্ধতিটির বিবরণ আছে। অর্থাৎ হোমসীয় মডেল নয়, তার বিপরীতে “হাইপোথিসিস এবং প্রমাণ” – এই পদ্ধতিগত কাঠামোটি এই ক্ষেত্রে বিচারব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এই পদ্ধতিগত কাঠামোটির নিজেরই কিছু সমস্যা আছে, যেকথা বিজ্ঞানের প্রসঙ্গে আমরা দেখেছি (অর্থাৎ “ঠিক” এবং “ভুল” কেবলমাত্র উপস্থিত নানা পর্যবেক্ষণের উপর নির্ভরশীল। নতুন বা অনাবিষ্কৃত পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে “ঠিক” “ভুল” হয়ে যেতে পারে, বা উল্টোটা। মানুষের জীবনের ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হলে যা খুবই মর্মান্তিক হয়ে দাঁড়াতে পারে)। অবশ্যই এই কাঠামোর মধ্যে থেকেই ত্রুটিহীন হওয়ার যথেষ্ট চেষ্টা “প্রমাণ”এর ঘোষিত প্রক্রিয়াটির মধ্যে আছে, একথা অনস্বীকার্য। ধনঞ্জয় মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায় এই প্রসঙ্গে বলছেঃ “It is settled law that in a case based on circumstantial evidence, the circumstances from which the conclusion of guilt is to be drawn have not only to be fully established but also that all the circumstances so established should be of a conclusive nature and consistent only with the hypothesis of the guilt of the accused. Those circumstances should not be capable of being explained by any other hypothesis except the guilt of the accused and the chain of the evidence must be so complete as not to leave any reasonable ground for the belief consistent with the innocence of the accused.”
অর্থাৎ, অপরাধীর অপরাধের বিবরণ একটি হাইপোথিসিস। আখ্যানমাত্র। সিদ্ধান্তে পৌঁছতে দেখতে হবে, সমস্ত পারিপার্শ্বিকতা কেবলমাত্র এই আখ্যানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা, এবং একেবারে ওই আখ্যানের দিকেই ঠেলে দিচ্ছে কিনা। এবং একই সঙ্গে দেখতে হবে, সমস্ত পারিপার্শ্বিকতা যেন অন্য কোনো আখ্যান দিয়ে ব্যাখ্যা করা না যায়। সমস্ত সাক্ষ্যের শৃঙ্খল সিদ্ধান্তকে এতটাই সম্পূর্ণ হতে হবে, যা অন্য কোনো আখ্যান (অর্থাৎ অভিযুক্তের নির্দোষ থাকার আখ্যান)এর কোনো যৌক্তিক জায়গা না থাকে।
এই কারণেই আমরা প্রথম থেকে “আদালত-স্বীকৃত” বর্ণনাটিকে আখ্যান বা কাহিনী বলছি। খুঁজছি তার উৎস। এর উদ্দেশ্য দুটো। ১। খুঁটিয়ে দেখা, যে, সমস্ত পারিপার্শ্বিকতা কেবলমাত্র ওই একটি আখ্যানের দিকে আমাদের ঠেলে দেয় কিনা, না তাতে কিছু অসঙ্গতি আছে। অর্থাৎ বিচার প্রক্রিয়া তার নিজের ঘোষিত পদ্ধতিকেই অনুসরণ করেছে কিনা। ২। “হাইপোথিসিস- প্রমাণ” মডেলটি নিজেই বিচার প্রক্রিয়ার উপর কিছু সীমাবদ্ধতা চাপিয়ে দিয়েছে কিনা।
এর জন্যই আমরা খুঁজছি “আদালত-স্বীকৃত” আখ্যানটির সূচনাবিন্দু। “হাইপোথিসিস” নিজে-নিজে তৈরি হয়না। তার পিছনেও কিছু প্রক্রিয়া থেকে যায়, যা থেকে যায় “হাইপোথিসিস-প্রমাণ” মডেলটির বাইরে, অনধিগম্যতায়। আমরা খুঁজছি সেই অনধিগম্যতাকে।
৪।
আমরা আগেই দেখেছি, যে, আদালত-স্বীকৃত কাহিনীর যে স্তম্ভগুলি প্রাথমিকভাবে ধনঞ্জয়কে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে, তারা গভীর কোনো তদন্তের ফসল নয়। তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশ পৌঁছনোর কয়েকঘন্টার মধ্যে (আরও তাড়াতাড়িও হতে পারে) এগুলি নির্মিত হয়। কিভাবে এগুলো নির্মিত হয়, সেই নির্মানপদ্ধতি আইনী প্রক্রিয়ায় সরাসরি আসেনি। কিন্তু সে তার কিছু চিহ্ন অবশ্যই রেখে গেছে প্রক্রিয়াটার মধ্যে। আমরা এখানে সম্পূর্ণ খোলা মন নিয়ে সেই চিহ্নগুলো খোঁজার চেষ্টা করব। একেবারে শূন্য থেকে শুরু করব। এখানে আমাদের কোনো হাইপোথিসিস নেই। তাই এই পদ্ধতি কিয়দংশে হোমসীয়ও বলা যেতে পারে।
কাহিনীটা শুরু হল কিভাবে? ধনঞ্জয় যে সম্ভাব্য অপরাধী, পুলিশ জানল কিকরে? এটাই এখানে মূল প্রশ্ন। ভবানীপুর থানার সাব-ইন্স্পেক্টর গুরুপদ সোম এই ঘটনার তদন্তে প্রথম থেকে জড়িত। নিম্ন আদালতে দেওয়া তাঁর বয়ান অনুযায়ী, খুনের রাত ৯-১৫ নাগাদ তিনিই নগরদাস পারেখের ফোন পান। এবং আরও কয়েকজ্ন পুলিশের সঙ্গে ঘটনাস্থলে পৌঁছন। তিনিই প্রাথমিক তদন্তের পর শেষরাতে ধনঞ্জয়ের নামে খুনের অভিযোগ লিপিবদ্ধ করেন।
গুরুপদ সোম প্রথম কার কাছে ধনঞ্জয়ের নাম শোনেন? আদালতে তাঁর সাক্ষ্যে সেটা লিপিবদ্ধ নেই। তবে যেটুকু লিপিবদ্ধ আছে, তা হল, ফ্ল্যাটে পৌছে প্রাথমিকভাবে তিনি নগরদাস পারেখের সঙ্গে ফ্ল্যাটটি ঘুরে দেখেন। এবং তারপর প্রথম যাঁর বয়ান লিপিবদ্ধ করেন, তিনি যশোমতী পারেখ। যশোমতীর কাছ থেকে তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পুরো ঘটনাটা শোনেন, লিখে ফেলেন, যশোমতীকে পড়ে শোনান এবং সম্মতি নেন। প্রাথমিকভাবে এই বয়ানের ভিত্তিতেই ধনঞ্জয়ের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ আনা হয়। সেই বয়ানটি লিখিত আকারে রক্ষিত আছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, তিনি পরিষ্কার ভাবেই ধনঞ্জয়ের বিরুদ্ধে শুধু খুন নয়, ধর্ষণেরও অভিযোগ এনেছেন। “I strongly suspect Dhananjoy Chatterjee for committing murder of my daughter and even committing rape on my daughter” – এই হল যশোমতী পারেখের বক্তব্য।
প্রশ্ন হল, যশোমতী তো ধনঞ্জয়কে দেখেনই নি। তাহলে তিনি অভিযোগটা করলেন কিসের ভিত্তিতে? বয়ানে সেটা স্পষ্ট করে বলা নেই। বস্তুত ধনঞ্জয়ের নাম যশোমতীর গোটা বয়ানে আর একবারই এসেছে। যশোমতী যখন বাড়ি ফিরছিলেন, লিফটে ওঠার সময় লিফটম্যান রামধনি তাঁকে বলেন, ধনঞ্জয় টেলিফোন করার জন্য তাঁদের ফ্ল্যাটে গিয়েছিল। শুনে যশোমতী বিচলিত হয়ে পড়েন। এইটুকুই। পরবর্তীতে আদালতে সাক্ষ্য দিতে গিয়েও তিনি রামধনি প্রসঙ্গে একই কথা বলেন। অতিরিক্ত হিসেবে যোগ করেন, ধনঞ্জয় হেতালকে বিরক্ত(টিজ) করত, এবং একদিন সিনেমা দেখতে যেতে বলেছিল সে কথাও। কিন্তু ধনঞ্জয় যে খুন করেছে, সে বিষয়ে তাঁর প্রাথমিক সন্দেহের সূত্র একটাই। লিফটম্যান রামধনির বক্তব্য।
যশোমতীর বয়ান নেবার আগে সাব-ইন্স্পেক্টর গুরুপদ সোম খুনের রাতে অনেকক্ষণ সময় কাটান নগরদাস পারেখের সঙ্গেও। নগরদাস পরে আদালতে জানান, যে, তিনি পুলিশকে ফোন করেন (রাত ৯-১৫ নাগাদ) এবং পুলিশ সেই রাতেই ১০টা বা ১০-৩০ নাগাদ তাঁর বয়ান নেয়। তিনি এও জানান যে পুলিশকে ফোন করার আগেই তিনি জানতেন ধনঞ্জয়ই খুন করেছে। কিভাবে জানলেন তিনি এ কথা? তাঁর ক্ষেত্রেও পদ্ধতিটা একই। লিফটম্যান রামধনি তাঁকে বলেন, ধনঞ্জয় টেলিফোন করার জন্য তাঁদের ফ্ল্যাটে গিয়েছিল। পরে যশোমতীও তাঁকে ওই একই কথা বলেন।
পারেখ পরিবারের তৃতীয় সদস্য হেতালের দাদা ভবেশ। পুলিশ সে রাতে তারও সাক্ষ্য নেয়। আদালতে ভবেশ জানায়, সম্ভাব্য খুনির কথা সে জানে তার মায়ের কাছ থেকে।
অর্থাৎ, পারেখ পরিবারের তিনজন জীবিত সদস্যই সম্ভাব্য খুনি হিসেবে একজনকে চিহ্নিত করেন। সে হল ধনঞ্জয়। কিভাবে তাঁরা জানলেন ধনঞ্জয়ের কথা? মূল সূত্র একজনই। লিফটম্যান রামধনি। রামধনিই প্রাথমিক সূত্র। রামধনির প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকেই আখ্যানে ঢুকে পড়ে ধনঞ্জয়ের নাম। পুলিশও পরপর একাধিক বয়ান পেয়ে প্রাথমিকভাবেই নজর দেয় ধনঞ্জয়ের উপর।
এখানে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবেনা, যে, সম্ভবত পুলিশও এই কেসে দ্রুত একটি কাহিনীসূত্র খুঁজছিল। ঘটনার রাতেই ফ্ল্যাটবাড়িতে উপস্থিত হন স্বয়ং ডিসিডিডি। এই ঘটনার কয়েকদিনের মধ্যেই শহরের প্রভাবশালী গুজরাতিদের পক্ষ থেকে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর কাছে জনৈক কাউন্সিলর দ্রুত ব্যবস্থা নেবার জন্য দরবার করেন। (আজকাল ১০ই মার্চ, ১৯৯০)। এটা খুনের দুদিন পরের ঘটনা। আন্দাজ করা অসম্ভব নয়, যে, মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে দরবার করার আগে থেকেই ঘটনাটির ফয়সালা করার জন্য পুলিশের উপর কিছু চাপ ছিল। ফয়সালা করার জন্য পুলিশের দরকার ছিল একটি কাহিনীসূত্র। পারেখ পরিবারের তিনজন সদস্য এবং তাদের তথ্যের মূলসূত্র লিফটম্যান রামধনির কাছ থেকে পুলিশ পেয়ে যায় সেই মূল্যবান সূত্রটি। এবং ধনঞ্জয় জড়িয়ে যায় আখ্যানের সুতোয়।
৫।
এ পর্যন্ত এ কাহিনীতে অসঙ্গতির কোনো জায়গাই নেই। কেবলমাত্র রামধনির সাক্ষ্যের উপর ভিত্তি করে “আদালত-স্বীকৃত” হাইপোথিসিসটি প্রমাণ করা যায় কিনা, সেটা একটা ভাবনার বিষয় ঠিকই, কিন্তু সেটা কাহিনীর কোনো অসঙ্গতি নয়। তাছাড়া পুলিশ কেবলমাত্র একটি সাক্ষ্যের উপরে দাঁড়িয়ে ধনঞ্জয়কে খুনি প্রমাণ করার চেষ্টা করছিল তাও নয়। তাদের হাতে আরও কয়েকজন “প্রত্যক্ষদর্শী” ছিল, যারা সরাসরি খুনের ঘটনা দেখেনি ঠিকই, কিন্তু তাদের সাক্ষ্যও যেথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। সেসবে আমরা পরে আসব। কিন্তু আপাতত এ পর্যন্ত কাহিনীতে অসঙ্গতির কোনো জায়গা নেই। সেটা শুরু হয় এর পরে।
পারেখ পরিবারের তিনজন সদস্য শুধু নয়, পুলিশ অফিসার গুরুপদ সোম তাঁর বয়ানেও আদালতে বলেন যে, লিফটম্যান রামধনি তাঁকে ঘটনার রাতেই জানিয়েছিলেন যে তিনিই লিফটে করে ধনঞ্জয়কে চারতলায় নিয়ে যান এবং পারেখদের ফ্ল্যাটে যেতে(বা এগোতে) দেখেন। অর্থাৎ মোট চারজন প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে রামধনির সূত্রে জেনেছিলেন যে ধনঞ্জয় সেই বিকেলে লিফটে চড়ে পারেখদের ফ্ল্যাটে যায়।
এই তথ্যের মূল সূত্র রামধনিকেও আদালতে ডাকা হয়। এটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা যে রামধনিকে আদালতে ডেকে মূল ঘটনাটা যাচাই করে নেওয়া হবে। সেখানেই ঘটনার একটি চমকপ্রদ দিক-পরিবর্তন ঘটে। আদালতে দাঁড়িয়ে রামধনি বলেন, যে, তিনি আদপেই ধনঞ্জয়কে নিয়ে লিফটে চড়িয়ে উপরে নিয়ে যাননি। ফ্ল্যাটে যেতেও দেখেননি। তিনি ধনঞ্জয়কে একবারই দেখেছিলেন, সেটা ৫-৩০/৫-৪৫ নাগাদ, যখন সে চারতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছিল, তিনি নিচে নেমেও তাকে দেখতে পান। রামধনি আরও জানান তিনি শুধু ধনঞ্জয়কে উপরে নিয়ে যাননি তাইই না, হেতালের মা যশোমতী বা পুলিশ অফিসার গুরুপদ সোমকে আদৌ বলেননি যে তিনি ধনঞ্জয়কে নিয়ে উপরে উঠেছিলেন। তিনি পুলিশকে শুধু নিচে নামার কথাই বলেছিলেন। পুলিশ ইংরিজিতে তাঁর বয়ান লেখে, কিন্তু তিনি ইংরিজি না জানায় কী লেখা হয়েছিল বলতে পারবেননা।
যশোমতী যখন লিফটে করে বাড়ি ফিরছিলেন, তখন রামধনি একবার ধনঞ্জয় প্রসঙ্গ তোলেন ঠিকই। কিন্তু সেটা ছিল ধনঞ্জয়ের সঙ্গে তাঁর সেদিন হয়ে যাওয়া একটা ঝগড়া প্রসঙ্গে নালিশ। ঝগড়াটা কী নিয়ে তার বিশদ বিবরণ রামধনি দেননি। কিন্তু তিনি স্পষ্ট করে জানান, যে, তিনি “পারেখ মাইজি”কে বলেন, তিনি যেন “পারেখ বাবু”কে বলে ধনঞ্জয় এবং রামধনি দুজনকেই ফ্ল্যাটের কাজ থেকে নিষ্কৃতি দেন। বলার ধরণটা এমন, যে, বক্তব্য হল এটাই, যে, দুজনে একসঙ্গে এক জায়গায় কাজ করা অসম্ভব। উত্তরে যশোমতী কি বলেছিলেন, সেটা আদালতে রামধনির বয়ানে লিপিবদ্ধ নেই। সম্ভবত প্রশ্নটাই রামধনিকে করা হয়নি।
রামধনির বিবৃতি মেনে নিলে খুনের সরকারি(অর্থাৎ সরকারপক্ষ ও পুলিশ প্রদত্ত, এই প্রবন্ধে “সরকারি আখ্যান” বলতে সাধারণভাবে সরকারপক্ষের কথাই বলা হয়েছে। ) আখ্যানটি সম্পূর্ণ টুকরো টুকরো হয়ে যায়। কারণ এই বয়ান অনুযায়ী তিনি ধনঞ্জয়কে ফ্ল্যাটে যেতে দেখেননি। এটা মেনে নিলে ধনঞ্জয়ের অকুস্থলে যাবার কোনো প্রত্যক্ষদর্শীইই থাকেনা। তিনি অবশ্য চারতলা থেকে নামতে দেখেছিলেন। কিন্তু সেটা একে তো কোনো জোরালো প্রত্যক্ষদর্শন নয়, ফ্ল্যাট থেকে বেরোনো নয়, শুধু চারতলা থেকে নামা। তদুপরি তার সময়কাল ৫-৩০/৫-৪৫, এই সময়টা মেনে নিলে খুনের আদালত-স্বীকৃত সময়সীমাটা দাঁড়ায়না। ফলে এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই, যে রামধনির বিবৃতি আদালত-স্বীকৃত আখ্যানটির সঙ্গে চূড়ান্ত অসঙ্গতিপূর্ণ। আখ্যানের একজন মূল কথক, নিজেই যদি সম্পূর্ণ উল্টো কথা বলতে থাকে, একমাত্র যে “প্রত্যক্ষদর্শী” ধনঞ্জয়কে হত্যাকান্ডের অকুস্থলে যেতে দেখেছিল, কাহিনীর সেই জনকই যদি বলে “আমি ওরকম কিছু দেখিনি”, তাহলে হত্যাকান্ডের পুরো আখ্যানটাই ভেঙে পড়ে। এবং এই কারণেই মামলা চলাকালীন রামধনিকে সরকারপক্ষের পক্ষ থেকে বিরূপ সাক্ষী ঘোষণা করা হয়। ঘটনার যে সরকারি আখ্যান, তার একজন মূল কথক নিজেই সেই আখ্যানে এক মূর্তিমান কালাপাহাড়। কাজেই পুলিশের আখ্যান থেকে বাদ দেওয়া হয় কথককে, সমস্ত অসঙ্গতিকে সমূলে উৎখাত করে, সম্ভাব্য সমস্ত বিকল্প আখ্যানের সম্ভাবনাকে উপেক্ষা করে তৈরি হয় খুনের পুলিশি আখ্যানটি।
কিন্তু বিচার প্রক্রিয়া তো শুধু সরকারি আখ্যান নয়। রায় সরকার দেয়না, দেয় আদালত। এখানে দেখা যাচ্ছে, “প্রত্যক্ষদর্শী” রামধনির আদালতে দেওয়া সাক্ষ্যের সঙ্গে সরকারি আখ্যানের সম্পূর্ণ অসঙ্গতি সৃষ্টি হয়েছিল। এবং মনে রাখতে সুপ্রিম কোর্ট খুব স্পষ্ট করেই জানিয়েছে, যে, সিদ্ধান্তে পৌঁছতে গেলে, একটি আখ্যানকে “সত্য”এর মর্যাদা দিতে হলে অবশ্যই দেখতে হবে, সমস্ত পারিপার্শ্বিকতা কেবলমাত্র এই আখ্যানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা, এবং একেবারে ওই আখ্যানের দিকেই ঠেলে দিচ্ছে কিনা। এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে আদালত এখানে কী করে? স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে, অন্তত একটি পারিপার্শ্বিকতা, একজন মূল কথকের বিবরণই মূল আখ্যানের উল্টো দিকে যাচ্ছে, অর্থাৎ সমস্ত পারিপার্শ্বিকতা মোটেই একটিমাত্র আখ্যানকে “সত্য” বলে মেনে নিচ্ছে না। তাহলে আদালত কি মেনে নেয়, যে, সমস্ত পারিপার্শ্বিকতা দ্ব্যর্থহীনভাবে খুনের সরকারি হাইপোথিসিসটির দিকে অঙ্গুলীনির্দেশ করছে না?
উত্তরটা আলাদা করে দেবার প্রয়োজন নেই। ধনঞ্জয়ের মৃত্যুদন্ড নিজেই প্রমাণ করে, যে, মানা হয়নি। বিচার প্রক্রিয়ায় এই পারিপার্শ্বিকতার অসঙ্গতিকে উপেক্ষা করা হয়।
৬।
এর নিশ্চয়ই আইনী ব্যাখ্যা আছে। কিন্তু ব্যাপারটা আপাতদৃষ্টিতে অবিশ্বাস্য মনে হয়। আইনী বিচারে নয়, সত্যাসত্যবিচারের হাইপোথিসিসহীন সাধারণবুদ্ধিতে। আমরা নানা ক্ষেত্রে এই সাধারণবুদ্ধি প্রয়োগ করি। যেমন ধরা যাক, “মঙ্গলবার সকালে কি বৃষ্টি পড়ছিল?” এই প্রশ্নের উত্তরে কেউ যদি এসে বলে, “হ্যাঁ, রামধনি(কল্পিত ব্যক্তি) বলছিল পড়ছিল”, তাহলে সাধারণভাবে আমরা ব্যক্তি রামধনির(কল্পিত) কাছে যাচাই করে নিই, সত্যিই বৃষ্টি পড়ছিল কিনা। যদি রামধনি(কল্পিত) প্রশ্নের উত্তরে জানায়, “কই পড়ছিল বলিনি তো, আর পড়েও তো নি”, তাহলে সাধারণভাবে আমরা বৃষ্টির সম্ভাবনাকে বাতিল করি। কিন্তু এক্ষেত্রে ঠিক উল্টো বিচার প্রয়োগ করে লিফটম্যান রামধনির (কল্পিত রামধনি নয়) বক্তব্যকেই ছেঁটে দেওয়া হয়। বা উপেক্ষা করা হয়। বৃষ্টি এখানে পড়তেই থাকে, রামধনি (কল্পিত) বলুক বা না বলুক।
বলে নেওয়া উচিত এই “ছেঁটে ফেলা” কিন্তু এই প্রবন্ধের কোনো অনুসিদ্ধান্ত নয়, বরং আদালতের রায়ের অংশ। “বিরূপ সাক্ষী”র সক্ষ্যের মূল্য কতটা, এবং সেই সাক্ষ্যকে কিভাবে দেখতে হবে, তার নানা আইনী ব্যাখ্যা আছে, থাকাই উচিত। এখানে আইনী পথেই রামধনির বক্তব্যকে ছেঁটে ফেলা হয়। হাইকোর্টের রায়েই রামধনির বিবৃতির কতটুকু গ্রহণ এবং বর্জন করতে হবে, তার নির্দিষ্ট বিবরণ আছে। সেই প্রক্রিয়াটি কৌতুহলোদ্দীপক।
রায়দানের সময় হাইকোর্ট অবশ্যই লক্ষ্য করে যে, পুলিশের কাছে রামধনির দেওয়া বয়ান এবং আদালতে পেশ করা বয়ানের মধ্যে পরস্পরবিরোধিতা আছে। নানা আইনী যুক্তি দেখিয়ে কোর্ট বলে যে সাক্ষী বিরূপ হলেই যে তার সমস্ত সাক্ষ্যকে বর্জন করতে হবে তা নয়। অন্যান্য সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণের উপর ভিত্তি করে, এবং পুরো সাক্ষ্যটিকে সতর্ক ভাবে খতিয়ে দেখে বিচারক স্থির করতে পারেন, বিরূপ সাক্ষীর বয়ানের কোন অংশ গ্রহণযোগ্য এবং কোন অংশ নয়। সমস্ত দিক খতিয়ে দেখে এক্ষেত্রে রায় দেওয়া হয়, যে, রামধনি তাঁর বয়ানের যে অংশে বলেছেন, তিনি ধনঞ্জয়কে চারতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসতে দেখেন, সেটি বিশ্বাসযোগ্য নয়, কারণ এর আগে পুলিশের কাছে দেওয়া বয়ানে (সেই বয়ান প্রসঙ্গে রামধনি আদালতে বলেছিলেন, পুলিশ ইংরিজিতে তাঁর বয়ান লেখে, কিন্তু তিনি ইংরিজি না জানায় কী লেখা হয়েছিল বলতে পারবেননা) রামধনি অন্য কথা বলেছিলেন। অবশ্য সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে দেখেছিলেন, এই কথাটি গ্রহণযোগ্য না হলেও, তিনি যে নিচে নেমে ধনঞ্জয়কে দেখতে পেয়েছিলেন, এই বক্তব্যটি গ্রহণ করা হবে, কারণ সেটি অন্যান্য সাক্ষ্যের (অর্থাৎ নিরাপত্তারক্ষীদের সাক্ষ্যের) সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। একই সঙ্গে, কোর্টের রায়ে, দেখা যায় রামধনির বক্তব্যে “আমি ধনঞ্জয়কে লিফটে চড়ে গিয়ে হেতালের ফ্ল্যাটে ঢুকতে দেখেছিলাম” জাতীয় কোনো বিবৃতিও নেই, অর্থাৎ ওটাও বর্জন করা হয়েছিল। কিন্তু ওই কোর্টের রায়েই, অর্থাৎ আদালত-স্বীকৃত আখ্যানেই আছে, যে, “As she(যশোমতী – বর্তমান লেখক)was about to enter the lift, she was told ny liftman P.W.8 Ramdhan Yadav that the accused had gone to her flat for contacting the security agency over telephone. ”। অর্থাৎ, রামধনির বলা কথাটি, রামধনি অস্বীকার করলেও তার বয়ানেই একরকম করে আখ্যানে থেকেই গেছে।
স্পষ্টতই, এটি রামধনির সাক্ষ্যের সম্পাদনাকার্য। রামধনির সাক্ষ্য সরকারি আখ্যানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা মিলিয়ে দেখার বা প্রশ্ন করার পরিবর্তে এখানে সাক্ষ্যটিকেই এমনভাবে সম্পাদনা ও কাটছাঁট করা হচ্ছে, যা একটি বিশেষ ভাষ্যের সঙ্গে মিলে যায়। আইনী যুক্তি যাই হোক, “সমস্ত পারিপার্শ্বিকতা” যে এখানে একটি নির্দিষ্ট দিকে অঙ্গুলীনির্দেশ করছিলনা, অন্তত একটি অসঙ্গতি ছিল, এবং সেই অসঙ্গতি দূর করার জন্য বিকল্প আখ্যানটিকেই বিশ্বাসযোগ্য নয় বলে ছেঁটে ফেলা হয়েছিল, সে নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এই সুচারু সম্পাদনাকার্যেই ক্রমশ সরকারি আখ্যানটি হয়ে ওঠে “সত্য”, খুনের “আদালত-স্বীকৃত আখ্যান” যার আর কোনো অন্যতর অভিমুখ থাকতেই পারেনা।
এই ব্যাপারটি কেন করা হল, সাধারণবুদ্ধিতে তার ব্যাখ্যা পাওয়া মুশকিল। মানুষ “বিরূপ সাক্ষী” হয় অন্যের প্রভাবে, ভয়ে, অর্থলিপ্সায়, বা অন্য কোনো অনুরূপ কারণে, যার কোনোটাই ধনঞ্জয়ের আয়ত্ত্বে ছিল বলে জানা যায়না। এমনকি রামধনির বয়ান অনুযায়ী তার সঙ্গে ধনঞ্জয়ের ঝগড়াও হয়েছিল, তাই প্রিয়জনকে বাঁচানো হচ্ছে এরকম একটা কারণ আবিষ্কার করাও কঠিন। তবু খুঁজতে গেলে এখানে মনে হতে পারে, যে এই সম্পাদনা বা উপেক্ষা অন্য একটি কারণে যুক্তিসঙ্গত হতে পারে। হয়তো অন্যান্য পারিপার্শ্বিকতা হয়তো এতই জোরালো ছিল, এতই শক্তপোক্ত ছিল অন্যান্য সাক্ষ্যপ্রমাণ, যার জন্য রামধনির সাক্ষ্যের অসঙ্গতিকে উপেক্ষা করা যেতেই পারে। সেটা একেবারেই ফেলে দেবার কথা নয়। প্রশ্নটা হল সত্যিই কি তেমন ছিল? সেটাই আমরা খুঁটিয়ে দেখব পরবর্তী পরিচ্ছেদে। কিন্তু তার আগে আরও একটি তথ্য বলে নেওয়া দরকার, যে বিষয়টি আদালতে আসেনি। খুনের ঘটনার পরেরদিনই নানা সংবাদপত্রে যে খবরগুলি বেরোয়, তার মধ্যে অন্তত একটিতে লিফটম্যান রামধনির প্রসঙ্গ এসেছে, যে খবরটি আমরা এই লেখার একদম শুরুতে উদ্ধৃত করেছি। সেই প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে “ওই অ্যাপার্টমেন্টের লিফটম্যান রামধনী। পুলিশকে ও জানায় যশোমতী মন্দির থেকে ফিরে আসার মাত্র মাত্র পাঁচ মিনিট আগে ওই বাড়িরই সিকিউরিটি গার্ড ধনঞ্জয় চ্যাটার্জিকে ও দেখেছে লিফট করে উপর থেকে নিচে নামতে। ধনঞ্জয়ের পরনে ছিল সাদা জামাপ্যান্ট। তবে তাতে রক্তের কোনো দাগ ছিলনা বলেই তার মনে হয়েছে।” আশ্চর্যজনক ভাবে পুলিশ আগমনের কয়েক ঘন্টার মধ্যে লিখে ফেলা এই প্রতিবেদনের সঙ্গে রামধনির খারিজ হওয়া বয়ান হুবহু মিলে যায়। এই মিল আপতিক বা সাজানো হওয়া কঠিন, কারণ সংবাদপত্রের প্রতিবেদকের পক্ষে বহুদিন পরে রামধনি আদালতে গিয়ে কী বলবেন সেটা আন্দাজ করা অসম্ভব। যেটা সম্ভব, সেটা হল, রামধনি হয়তো আদালতে সত্যি কথাই বলছিলেন। এটি অবশ্য একটি সম্ভাবনাই, কিন্তু সেটা ফেলে দেবার মতো নয়। এবং আদালতে সংবাদপত্র প্রসঙ্গটি আসেইনি। রক্তের দাগের প্রসঙ্গটি অবশ্য এসেছিল। হাইকোর্টে ধনঞ্জয়ের কৌঁসুলী প্রশ্ন তোলেন, যে, এই নৃশংস খুনের(হেতালের শরীরে ২১ টি আঘাত ছিল) পরেও কোনো সাক্ষীই কেন ধনঞ্জয়ের হাল্কা রঙের জামাকাপড়ে কোনো রক্তের দাগ দেখতে পায়নি? সরকারপক্ষের আখ্যানে এর কোনো উত্তর নেই। বিচারক রায়দানের সময় এই ধাঁধার সমাধান করেন এই ভাবে, যে, যেহেতু খুনের আগে ধর্ষণ হয়েছে, তাই খুনের সময় ধনঞ্জয়ের শরীরে জামাকাপড় ছিলনা। এবং সেখানে রক্তের দাগ লাগার তাই কোনো প্রশ্নই নেই।