পর্ব তিন – অন্যান্য প্রামাণ্য বস্তু
১৩।
প্রত্যক্ষদর্শনের উপাখ্যান আগের পর্বেই সমাপ্ত। এর বাইরে ধনঞ্জয় মামলায় প্রামাণ্য বস্তু হিসেবে ছিল আর তিনটি জিনিস। এক, একটি হার। যেটা হেতালের ফ্ল্যাটে পাওয়া যায়। দুই, একটি বোতাম, যা ফ্ল্যাটে পাওয়া যায় এবং একটি শার্ট-প্যান্ট যা পাওয়া যায় ধনঞ্জয়ের বাড়িতে। তিন, একটি রিকো হাতঘড়ি, যা নাকি পাওয়া যায় ধনঞ্জয়ের বাড়িতে।
একটা একটা করে প্রামাণ্য বস্তুগুলির প্রসঙ্গে আসা যাক। প্রথমে হার। পুলিশ অফিসার গুরুপদ সোমের আদালতে দেওয়া বয়ান অনুযায়ী তিনি খুনের রাতে হেতালের ফ্ল্যাটে একটি ছেঁড়া হার (broken chain) পান। এবং ওই রাতেই তিনি ওই হারের সঙ্গে ধনঞ্জয়ের সম্পর্ক আবিষ্কার করেন। কী করে জানা গেল ওই হারের সঙ্গে ধনঞ্জয়ের একটা সম্পর্ক আছে? হেতালদের এক প্রতিবেশি অরুণা শাহের অফিসে গৌরাঙ্গ ওরফে গোরা নামে একটি ছেলে কাজ করত। সেই রাতে গুরুপদ সোমের সঙ্গে তার দেখা হয়। তিনি গোরাকে হারটি দেখান, এবং সে হারটি শনাক্ত করে। গুরুপদ তার বিবৃতি নথিভুক্ত করেন।
ধনঞ্জয়কে ওই হার পরে কেউ দেখেনি। অন্তত আদালতের সাক্ষ্য অনুযায়ী কেউ দেখেনি। এমনকি ওই হার যে ধনঞ্জয়ের কাছে ছিল, সে ব্যাপারেও কেউ সাক্ষ্য দেয়নি। হারের ব্যাপারে শনাক্তকরণ এবং সাক্ষ্যদানের একমাত্র কাজটি করে গোরা। গোরাকে আদালতেও সাক্ষ্য দিতে ডাকা হয়। তার বয়ান থেকে জানা যায়, সে ওই সময়কালে অরুণা শাহের অফিসে কাজ করত এবং বিগত ১০-১২ বছর ধরে অরুণা শাহের সঙ্গেই থাকত। অফিসে তার কাজের সময় ছিল সকাল ৮-৩০ থেকে সন্ধ্যে ৭টা। খুনের আদালত-স্বীকৃত সময়টা এর মধ্যেই পড়ে। অফিস থেকে আনন্দ অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে, গোরা দেখে বাড়িটির নিচে বহু মানুষ জমায়েত হয়েছে। খোঁজখবর করে সে হেতালের মৃত্যুর খবর পায়। আদালতে দাঁড়িয়েও সে হারটিকে শনাক্ত করে।
আগেই বলা হয়েছে, এ ব্যাপারে গোরাই একমাত্র সাক্ষ্য। এখানে স্বভাবতই একাধিক প্রশ্ন আসে। প্রথমতঃ যে হার পরে ধনঞ্জয়কে কেউ কখনও দেখেনি, তার কাছে ছিল বলেই কেউ জানতনা, একমাত্র গোরার সাক্ষ্য অনুযায়ী সেটা ধনঞ্জয়ের, মেনে নেওয়া উচিত কিনা। দ্বিতীয়তঃ এমনকি গোরা সম্পূর্ণ সত্যি কথা বলছে ধরে নিলেও এখানে কিছুটা সন্দেহের অবকাশ থেকে যায়। যে প্রশ্নটা নির্দিষ্ট করে আসে, যে, কী এমন নির্দিষ্ট অদ্বিতীয় ডিজাইনের হার, যা দেখেই নির্দিষ্ট করে বলে দেওয়া যায়, যে, ওটাই ধনঞ্জয়ের? কোথাও কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই তো? হারটা সত্যিই ধনঞ্জয়ের তো?
এই দ্বিতীয় প্রশ্নটি, অর্থাৎ হারটি অদ্বিতীয় ডিজাইনের কিনা, এরকম একটি প্রশ্নের উত্তরে গোরা আদালতে জানায়, যে, হারটি মোটেই দামী নয় এবং এ ধরণের হার বাজারে কিনতেই পাওয়া যায়। অর্থাৎ জিনিসটা অদ্বিতীয় কিছু নয়।
তাহলে কিভাবে জানা গেল হারটা ধনঞ্জয়ের? গোরা আদালতে যেটা বলে সেটা বিস্ময়কর। গোরার বিবৃতি অনুযায়ী, হারটা আসলে ধনঞ্জয়ের নয়। হারটা গোরার নিজের।
তাহলে এর সঙ্গে ধনঞ্জয় জড়িয়ে গেল কিভাবে? নিজের বয়ানে গোরা জানায়, যে, সে ঘটনার মাসখানেক আগে হারটা ধনঞ্জয়কে দিয়েছিল। অবশ্যই সেই দেওয়ার কোনো সাক্ষী নেই। ধনঞ্জয়ের কাছে সেই হার ছিল এমন কোনো আলাদা সাক্ষ্য নেই। ধনঞ্জয় নিজে এই হার দেওয়ার কাহিনীটি অস্বীকার করে। গোরাও কবে হার দিয়েছিল আদালতে সেটা মনে করতে পারেনা। শুধু দেবার নির্দিষ্ট দিন নয়, মোটামুটি কবে (সপ্তাহের কোন দিন) সেটাও তার মনে নেই বলে জানায়। হঠাৎ ধনঞ্জয়কে সে হার দিয়েছিলই বা কেন? সেটাও জানা যায়না, কারণ সেই প্রশ্নটা করাই হয়নি।
এসব পরিস্থিতিতে সাধারণভাবে ঘটনাস্থল থেকে যার হার পাওয়া গেল, সে সন্দেহের ঊর্ধ্বে থাকেনা। কিন্তু ঘটনায় গোরার জড়িয়ে থাকা নিয়ে পুলিশ কোনো প্রশ্ন তোলেনি। এমনকি নিম্ন আদালতে ধনঞ্জয়ের আইনজীবিও না। হাইকোর্টে ধনঞ্জয়ের পক্ষের উকিল অবশ্য গোরাকে কেন গ্রেপ্তার করা হয়নি এই প্রশ্ন তোলেন। কিন্তু তখন প্রশ্ন তোলার সময় পেরিয়ে গেছে। জবাবে হাইকোর্ট তার রায়ে জানায় ঘটনাস্থলে গোরার সম্ভাব্য উপস্থিতি নিয়ে নিম্ন আদালতে ধনঞ্জয়ের উকিল তো কোনো প্রশ্নই তোলেননি। এই ঘটনাই অব্যর্থভাবে দেখিয়ে দেয় যে ঘটনার সময় গোরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলনা। “His unchallanged testimony shows that he was not present at ‘Anand Apartment’ at the time of the occurance.”
আসামী আর তার উকিল, এক্ষেত্রে আদালতের কাছে একটিই পক্ষ। উকিল যে বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি, আসামীপক্ষ সেটা মেনে নিয়েছে বলেই ধরা হয়(যদিও সামগ্রিকভাবে আসামী নিজে কখনই গোরার বক্তব্য সমর্থন করেনি)। এই আইনী মারপ্যাঁচে গোরা সন্দেহের ঊর্ধ্বে থেকে যায়, আর আরও একবার জোরদার হয় খুনের সরকারি আখ্যান।
১৪।
বাকি থাকে একটি ঘড়ি এবং একটি বোতাম ও শার্ট-প্যান্ট। সরকারি আখ্যান অনুযায়ী খুনের দিন ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া যায় একটি ক্রিম রঙের বোতাম। আর খুনের পরদিন পারেখ পরিবার ওলটপালট হওয়া আলমারি থেকে কেবলমাত্র একটি জিনিস খোয়া গেছে বলে খুঁজে পান এবং সেই মর্মে পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন। খোওয়া যাওয়া বস্তুটি হল একটি রিকো হাতঘড়ি, যার দাম ৩৫০ টাকা। পরবর্তীকালে, আদালত-স্বীকৃত আখ্যানানুযায়ী, ফেরার হওয়া ধনঞ্জয় গ্রেপ্তার হওয়ার পর, হাতড়িটি উদ্ধার হবে তার বাড়ি থেকে। সঙ্গে উদ্ধার হবে একটি শার্ট-প্যান্ট, যার সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া হবে হেতালের ফ্ল্যাট থেকে পাওয়া বোতামটি।
এই কাহিনীতে কি কোনো অসঙ্গতি আছে? খোঁজার জন্য আমাদের পূর্ব অনুসৃত পদ্ধতি অনুসারে যাওয়া দরকার আখ্যানের উৎপত্তিস্থলে। অর্থাৎ গ্রেপ্তার এবং হাতঘড়ি উদ্ধারের জায়গায়। কারণ, গ্রেপ্তার বা লুন্ঠনসামগ্রী উদ্ধারের আগে, সাধারণবুদ্ধিতে যা বলে, উদ্ধারের আখ্যান তৈরি হওয়া সম্ভব নয়। এটা অবশ্যই যৌক্তিক অনুমান। অবশ্য এই কাহিনীতে সাধারণবুদ্ধির বাইরেও অনেক কিছু ঘটেছে, কিছু যৌক্তিক অনুমান ভেঙে পড়েছে, সেটাও এক্ষেত্রে মাথায় রাখা দরকার। কিন্তু সেটা মাথায় রাখলেও শুরু করার দ্বিতীয় কোনো জায়গা নেই। অতএব, ধনঞ্জয়ের গ্রেপ্তারির আখ্যানটিই এরপর আমাদের অনুসন্ধানের বিষয়, যার পদ্ধতি যথারীতি হাইপোথিসিসবিহীন, এবং সতর্কতা অবলম্বন যার অঙ্গ।
ধনঞ্জয় গ্রেপ্তার হয় কোথায়? তার নিজের গ্রাম বাঁকুড়ার কুলডিহিতে। গ্রেপ্তারের তারিখ মে মাসের বারো। গ্রেপ্তারি অভিযানটির তদন্তকারী অফিসার ছিলেন সলিল বসুচৌধুরি। তিনি আদালতে সামগ্রিক গ্রেপ্তারি অভিযানটির একটি বর্ণনা দেন। তাঁর বয়ান অনুযায়ী অভিযানটি শুরু হয় গভীর রাতে, ছাতনা থানা থেকে। সলিল এবং আরও কয়েকজন পুলিশ ছাতনা থানা থেকে কুলডিহি গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হন। উদ্ধার হওয়া জিনিসপত্রের সাক্ষী হিসেবে কাজ করার জন্য দুজন স্থানীয় বাসিন্দা নন্দগোপাল দেওঘরিয়া এবং দেবদুলাল মুখার্জিকে পথে ছাতনা থেকেই তুলে নেওয়া হয়।
ধনঞ্জয়ের বাড়িতে তাঁরা পৌঁছন মধ্যরাতের পরে। ধনঞ্জয়ের বাড়ি সার্চ করা হয়, কিন্তু তাকে পাওয়া যায়না। পাশেই ধনঞ্জয়ের কাকার বাড়ি। সেখানেও সার্চ করা হয়, কিন্তু সেখানেও ধনঞ্জয় ছিলনা। তাকে খুঁজে পাওয়া যায় তার জ্যাঠার বাড়িতে। ধনঞ্জয় সেখানে লুকিয়ে ছিল বা লুকিয়ে পড়ার চেষ্টা করেছিল। কারণ শেষমেশ তাকে খুঁজে পাওয়া যায় জ্যাঠার বাড়ির খড়ের গাদার পিছনে, লুকিয়ে থাকা অবস্থায়। ওই খড়ের গাদার পিছন থেকে ধনঞ্জয়কে গ্রেপ্তার করা হয় রাত ২-০৫ নাগাদ।
এবং এখান থেকেই শুরু হয়ে যায় এই কাহিনীর অসঙ্গতি। সলিল বসুচৌধুরির সঙ্গে এই অভিযানের অন্যতম সঙ্গী ছিলেন ছাতনা থানার তৎকালীন সাব-ইনস্পেক্টর প্রণব চ্যাটার্জি। তিনিও আদালতে এই অভিযানের একটি বর্ণনা দেন। তাঁর বর্ণনা অনুযায়ীও তাঁরা ধনঞ্জয়ের বাড়ি পৌঁছন মাঝরাতের পরে এবং পাশাপাশি তিনটি বাড়ি সার্চ করেন। ধনঞ্জয়কে কোথায় পাওয়া যায়? তাঁর বর্ণনানুযায়ী একটা খড়ের চালের বাড়ির সামনে ছিল একটা খড়ের চালের বারান্দা। ধনঞ্জয় লুকিয়ে ছিল সেই বারান্দার ছাদে।
বারান্দার ছাদ আর খড়ের গাদার পিছন নিশ্চয়ই এক জায়গা নয়। তাহলে ধনঞ্জয়কে গ্রেপ্তার আসলে কোথায় করা হয়েছিল? যাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তাকে জিজ্ঞাসা করলে কি আসল উত্তরটা পাওয়া সম্ভব? আদালতে ধনঞ্জয়কে এই প্রশ্নটি করা হয়েওছিল, যে, সে কি জ্যাঠার বাড়ির খড়ের গাদার পিছনে লুকিয়ে ছিল এবং সেখান থেকেই পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে? ধনঞ্জয় তার উত্তরে স্পষ্ট করেই জানায়, সেটা ঘটনা নয়। সে ছিল তার বাড়িতে। তার স্ত্রীও ছিল সঙ্গে।
ফলে গ্রেপ্তারের জায়গা নিয়ে আমরা তিনটে আলাদা “প্রতক্ষদর্শী”র বর্ণনা পাই। চতুর্থ একজন সাক্ষীও আছে, যার প্রসঙ্গে আমরা পরে আসব। কিন্তু আপাতত প্রশ্ন একটাই। মাত্র তিনটে বাড়ি সার্চ করে গ্রেপ্তার করা হয়েছে একটি লোককে, তার গ্রেপ্তারের জায়গা নিয়ে কেন এত অসঙ্গতি? উত্তর জানা নেই। আদালতে এই অসঙ্গতির প্রশ্নটা সেভাবে ওঠেইনি। ফলে সাধারণভাবে বিষয়টা উপেক্ষিত হয়। তবে হাইকোর্টের রায়ে বলা হয় ধনঞ্জয়কে তার বাড়ির কাছ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। অর্থাৎ নির্দিষ্ট জায়গাটা উল্লেখ না করলেও বাড়ির বাইরে গ্রেপ্তার হওয়ার কাহিনীটি মোটামুটিভাবে মেনে নেওয়া হয়। তবে বিষয়টা নিয়ে কোনো প্রশ্ন না ওঠাতে আদালত আলাদা করে পুলিশি বয়ানের দুটি ভার্সানের অসঙ্গতি নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি, ব্যাখ্যা চায়নি বা দেয়নি।
১৫।
গ্রেপ্তারের নির্দিষ্ট জায়গাটি, স্পষ্টতই, এই মামলায় আদৌ জরুরি ভাবা হয়নি। “দোষী”কে এক নির্দিষ্ট রাতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, গ্রামের নাম আর সময় নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই, গ্রেপ্তার করা নিয়েও কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই, সেটা বাড়ির বাইরে হয়েছে না ভিতরে, তাতে সত্যিই কিইবা যায় আসে, আন্দাজ করা যায় এভাবেই ভাবা হয়েছিল। কিন্তু বিচারপ্রক্রিয়ার চলন যাই হোক না কেন, আমরা এখানে একটি আখ্যানের উৎসসন্ধান করছি, সেখানে এই নির্দিষ্ট জায়গাটির মূল্য আছে, কারণ, গ্রেপ্তারের জায়গার সঙ্গে বাকি আখ্যানটি ভীষণভাবে জড়িয়ে।
সরকারি আখ্যানটি খুঁটিয়ে পড়লে দেখা যায়, বাড়ির বাইরে ধনঞ্জয়ের গ্রেপ্তার হওয়াটা আখ্যানের একটা নির্দিষ্ট যৌক্তিক কাঠামো তৈরি করে। এই কাহিনীর বাকি অংশের সরকারি কাহিনী পড়লেই সেটা টের পাওয়া যায়। ধনঞ্জয়কে বাড়ির বাইরে গ্রেপ্তার করার পর পুলিশ কী করে? অভিযানের তদন্তকারী অফিসার সলিল বসুচৌধুরি আদালতে জানাচ্ছেন, তিনি গ্রেপ্তার করেই অভিযুক্ত ধনঞ্জয়কে জেরা করেন। তাঁর জেরায় অভিযুক্ত ধনঞ্জয় ওখানেই স্বীকার করেঃ “সোনালি ধাতব ব্যান্ডের যে লেডিজ রিকো হাতঘড়িটি আমি ৫।৩।৯০ তারিখে আনন্দ অ্যাপার্টমেন্টের ৩এ ফ্ল্যাট থেকে চুরি করি, সেটি আমি আমাদের বাড়ির একটি র্যাকে রেখেছি। যে জামাকাপড় পরে আমি হেতালকে ধর্ষণ এবং খুন করেছিলাম সেটাও আমাদের বাড়ির আরেকটি র্যাকে রেখেছি। র্যাক আর জিনিসগুলো আমি দেখিয়ে দেব।” ( এখানে একটা জিনিস কৌতুহলোদ্দীপক, যে, সরকারি আখ্যানে ধনঞ্জয় জামাকাপড় ‘পরে’ ধর্ষণ এবং খুন করে, আর আদালত-স্বীকৃত আখ্যানে ‘খুলে’)।
এই স্বীকারোক্তি ওখানেই রেকর্ড করা হয়। সরকারি আখ্যানানুযায়ী, এর পর, ধনঞ্জয়কে তার বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। সে খবরের কাগজে মোড়া একটি প্যাকেট নিয়ে আসে। সেই প্যাকেটে ছিল শার্ট ও প্যান্টটি। আর একটি ঘরের কোনে একটা র্যাকে ছিল লেডিজ ঘড়িটি। ধনঞ্জয় সেটা পুলিশকে দেখিয়ে দেয়। সেই মতো জিনিসদুটিকে বাজেয়াপ্ত করা হয়।
এই স্বীকারোক্তি গোটা মামলায় খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং বহুবার আলোচিত। মনে রাখতে হবে ১৯৯০ সালে খুনের দিন থেকে ২০০৪ সালে মৃত্যুর দিন পর্যন্ত কোনো প্রকাশিত বয়ানে ধনঞ্জয় অপরাধের কথা স্বীকার করেনি। একটি বারের জন্যও না। এমনকি, ফাঁসির সময় পর্যন্ত, সংবাদপত্রে পত্রের প্রতিবেদনানুযায়ী, সে নিজেকে নির্দোষ বলেছিল। একমাত্র ব্যতিক্রম এই বিতর্কিত (বিতর্কিত এই কারণে, যে, আদালতে ধনঞ্জয় এই স্বীকারোক্তিকে অস্বীকার করে) সরকারি স্বীকারোক্তি, যখন পুলিশ অফিসারের সামনে খুব অল্প সময়ের জেরাতেই সে কবুল করে ফেলে তার ‘অপরাধ’এর কথা।
কিন্তু প্রশ্নটা এখানে বিশ্বাসযোগ্যতার নয়। এই পুরো আখ্যানের যৌক্তিক কাঠামোয় “বাইরে গ্রেপ্তার হওয়া” কী ভূমিকা পালন করে সেটাই আমরা খুঁজছিলাম। ভূমিকা একটাই, এবং সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ধনঞ্জয়কে তার বাড়িতে গ্রেপ্তার করলে তার এই ‘স্বীকারোক্তি’ হত সরকারি ভাবেই বাড়ির লোকের সামনে। কিন্তু বাইরে গ্রেপ্তার ও জেরা করার ফলে ‘স্বীকারোক্তি’টি হয়েছে বাইরে, লোকচক্ষুর অন্তরালে। ধনঞ্জয় আগাগোড়াই আদালতে এই ‘স্বীকারোক্তি’কে অস্বীকার করেছে। কিন্তু বাড়ির বাইরে, বাড়ির অন্য লোকের চোখের আড়ালে হওয়ায়, ধনঞ্জয়ের বাড়ির দিক থেকে এর কোনো সাক্ষী নেই।
অর্থাৎ পুলিশি বয়ানের অসঙ্গতিটি খুব সামান্য নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ধনঞ্জয়ের ‘স্বীকারোক্তি’র প্রশ্ন। এই অসঙ্গতিকে প্রশ্ন করলে গোটা ‘স্বীকারোক্তি’টিই প্রশ্নের সামনে পড়ার কথা। সেক্ষেত্রে হয়তো মামলার গতিপ্রকৃতি অন্য হতে পারত। কিন্তু সেটা করা হয়নি। অন্যান্য নানা অসঙ্গতির মতই এটিও উপেক্ষিত, অনালোচিত।
১৬।
কিন্তু মামলায় পুলিশের কাছে এই স্বীকারোক্তি কতটা গ্রহণযোগ্য? প্রসঙ্গত আদালতে ধনঞ্জয় এই ‘স্বীকারোক্তি’ সম্পূর্ণ অস্বীকার করে এবং বলে তাকে থানায় একটি সাদা কাগজে সই করিয়ে নেওয়া হয়েছিল। এই অস্বীকার কারা সত্যি হোক বা মিথ্যে, সেটা আদালতে পেশ করা বক্তব্য। কেবলমাত্র পুলিশের কাছে দেওয়া ‘স্বীকারোক্তি’র চেয়ে আদালতে করা অস্বীকার কি অধিক মর্যাদা পাবার যোগ্য না?
আদালতে এইরকম (হুবহু এইগুলিই নয়) প্রশ্নগুলি উঠেছিল। নানা আইনী যুক্তি দিয়ে হাইকোর্ট উত্তরে যা বলে, তার মোদ্দা কথা এই, যে, পুলিশের কাছে আলাদা করে কোনো চোর যদি ‘স্বীকারোক্তি’ দেয়, তাহলে সেটা গ্রহণ করা নাও যেতে পারে। কিন্তু যদি সেই ‘স্বীকারোক্তি’র সাহায্যে চোরাই মাল উদ্ধার হয়, তবে সেই ‘স্বীকারোক্তি’কে মর্যাদা দিতেই হবে। এক্ষেত্রে যেহেতু ‘স্বীকারোক্তি’র ফলে হাতঘড়ি আর জামাপ্যান্ট ‘উদ্ধার’ হয়েছে, অতএব সেই ‘স্বীকারোক্তি’ তার মর্যাদা পেতেই পারে। “কেবলমাত্র আমি হেতালকে ধর্ষণ এবং খুন করেছিলাম” – এই অংশটি গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ এটা কোনোরকম উদ্ধার দ্বারা সমর্থিত নয়।
কথাটা নিঃসন্দেহে যুক্তিযুক্ত। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, ধনঞ্জয় স্বীকারোক্তি যদি নাই দিয়েছিল, তবে চোরাই মাল বাজেয়াপ্ত হল কিকরে? (যদিও এর সম্পূর্ণ উল্টো যুক্তিও থাকতে পারে, অর্থাৎ স্বীকারোক্তিটাই যদি ভুল হয় তাহলে ‘বাজেয়াপ্তকরণ’কেই বা বিশ্বাস করা হবে কেন?) অতএব ‘চোরাই মাল’ উদ্ধারের প্রক্রিয়াটিও আমাদের খুঁটিয়ে দেখা দরকার। এইকারণেই, যে, সেটায় যদি কোনো অসঙ্গতি না থাকে, তবে ‘স্বীকারোক্তি’র মর্যাদার প্রশ্ন তোলাই অর্থহীন। গ্রেপ্তারের স্থান নিয়েও প্রশ্ন তোলার মানে নেই। আর যদি ‘চোরাই মাল’ উদ্ধারের মধ্যে কোনো অসঙ্গতি পাওয়া যায়, তবে স্বীকারোক্তি এবং গ্রেপ্তারের জায়গার অসঙ্গতি একেবারেই উপেক্ষার যোগ্য নয়।
এই ‘বাজেয়াপ্ত’ করার প্রক্রিয়াটি ঠিক কী ছিল? সরকারি আখ্যান অনুযায়ী, আমরা আগেই পড়েছি, জেরায় ধনঞ্জয় বলে সে লুন্ঠনসামগ্রী রেখেছিল বাড়ির কয়েকটি র্যাকে। আর উদ্ধারের সময় খবরের কাগজে মোড়া শার্টপ্যান্টটি সে নিয়ে আসে এবং ঘড়িটি উদ্ধার করা হয় একটি ঘরের একটি র্যাক থেকে। এই প্রক্রিয়া অন্তত সরল এবং আপাতদৃষ্টিতে অসঙ্গতিহীন। কিন্তু মজা হচ্ছে, ধনঞ্জয়ের আদালতে দেওয়া বয়ান দেখলে এইটুকু জিনিসেও মতভেদ লক্ষ্য করা যায়। আদালতে জেরার মুখে ধনঞ্জয় জানায়, যে, তার বাড়িতে খবরের কাগজই কেউ ব্যবহার করেনা (অর্থাৎ থাকার প্রশ্নই নেই)। শুধু সেটুকুই নয়, ধনঞ্জয় আরও জানায়, যে তার বাড়িতে কোনো ‘র্যাক’ই নেই। এই দুটো বক্তব্য যাচাই করে নেওয়া এমন কিছু কঠিন ব্যাপার নয়। এবং ধনঞ্জয়ের বক্তব্য সত্যি হলে, সব মিলিয়ে পুরো সরকারি আখ্যানটাই বিরাট প্রশ্নচিহ্নের সামনে পড়ে। খবরের কাগজ নাহয় বাইরে থেকেও আনা হতে পারে, কিন্তু যে বাড়িতে র্যাক নেই, সেই বাড়ির র্যাক থেকে উদ্ধার হচ্ছে ঘড়ি, এটা অসম্ভব। একই সঙ্গে প্রশ্নচিহ্নের সামনে পড়ে যায় তার ‘স্বীকারোক্তি’ও। সেই অসঙ্গতিকে যৌক্তিক ভাবে সমর্থন করে গ্রেপ্তারের স্থান নিয়ে অসঙ্গতি।
এটুকুকেও যদি যথেষ্ট বলে না ভাবা যায়, তবে, এর পরেও অসঙ্গতির শেষ হয়না। বাজেয়াপ্তকরণের ক্ষেত্রে এই ধরণের প্রশ্ন তো ধনঞ্জয়ের মামলাতেই প্রথম উঠল তা নয়। ‘চোরাই মাল’ যে সত্যিই একটি নির্দিষ্ট জায়গা থেকেই উদ্ধার করা হয়েছে, কাউকে ফাঁসানোর জন্য অন্য জায়গা থেকে তুলে আনা সামগ্রীকে ‘ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হওয়া মাল’ বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছেনা সেটা প্রমাণ করার জন্য বাজেয়াপ্তকরণের কিছু নির্দিষ্ট আইনী পদ্ধতি আছে। পদ্ধতি অনুযায়ী যেখান থেকে সামগ্রী বাজেয়াপ্ত করা হয়, স্থানীয় কিছু মানুষকে তার সাক্ষী হিসেবে রেখে এবং সাক্ষীদের সইসাবুদ নিয়ে সামগ্রীগুলিকে সিল করে দেওয়া হয়। এছাড়াও যে বাড়ি থেকে বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে, তার অধিবাসীদের বাজেয়াপ্ত করা সামগ্রীর তালিকা বা সিজার লিস্ট দেওয়া হয়। সেই সিলের উপরে সাক্ষীদের সইসাবুদও নেওয়া হয়। এই মামলাতেই হেতালের ফ্ল্যাট থেকে যে সামগ্রীগুলি বাজেয়াপ্ত করা হয়, সেসবও এই পদ্ধতি মেনে করা হয়েছিল। সেখানে বাজেয়াপ্তকরণের অন্যতম সাক্ষী হিসেবে কাজ করে হেতালের দাদা ভবেশ।
ধনঞ্জয়ের বাড়িতে সার্চের ক্ষেত্রে কিন্তু অভিযুক্ত বা তার বাড়ির লোকেদের সিজার লিস্ট দেওয়া হয়নি। দুজন সাক্ষী আছে, তারা কেউ স্থানীয় নয়। সাক্ষী হিসেবে যাদের নাম আছে, তাদের নাম নন্দগোপাল দেওঘরিয়া এবং দেবদুলাল মুখার্জি। এরা ওই পাড়ার কেউ তো নয়ই, বরং পুলিশের সঙ্গী। তদন্তকারী অফিসার সলিল বসুচৌধুরির বয়ান অনুযায়ী, ধনঞ্জয়ের গ্রেপ্তার অভিযানে যাবার পথে সাক্ষী হিসেবে কাজ করার জন্য এই দুজন ব্যক্তিকে ছাতনা থেকেই তুলে নেওয়া হয়। এঁরা পুলিশের সঙ্গী হিসেবেই ধনঞ্জয়ের বাড়ি যান, কেবলমাত্র সাক্ষী হিসেবে কাজ করার জন্য। এঁরা পুলিশের কর্মচারী নন, কিন্তু পুলিশের সঙ্গী, এঁরাই ধনঞ্জয়ের গ্রেপ্তারের সাক্ষী, স্বীকারোক্তির সাক্ষী এবং বাজেয়াপ্ত করা সামগ্রীসমূহের সাক্ষী। সলিলের বয়ান থেকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছনোই যায়, যে, পাড়া জাগিয়ে তল্লাশি(তিনটি বাড়িতে তল্লাশি হয়েছিল) এবং গ্রেপ্তারাভিযানের পর সাক্ষ্যের জন্য পাড়ার কোনো লোককে পাওয়া যায়নি, বা পাওয়া গেলেও ব্যবহার করা হয়নি।
পাড়ার কোনো লোককে কেন পাওয়া গেলনা বা ব্যবহার করা হলনা, এখানে এ তো বড়ো প্রশ্ন বটেই। সঙ্গে আরও প্রশ্ন জাগে, যে, বাজেয়াপ্তকরণের সাক্ষ্যদানের জন্য পুলিশ আগে থেকেই লোক ঠিক করে নিয়ে যায়, তার অর্থ কি এই, যে, কী বাজেয়াপ্ত করা হবে সেটা আগে থেকেই জানা ছিল? এই উপাখ্যানের অনুসন্ধান শুরু করার সময় আমরা একটি যৌক্তিক প্রতিপাদ্য ধরে নিয়েছিলাম, যে, লুন্ঠনসামগ্রী উদ্ধারের আগে উদ্ধারের আখ্যান তৈরি হওয়া সম্ভব নয়, তাই অনুসন্ধানের জন্য আমাদের পূর্ব অনুসৃত পদ্ধতি অনুসারে যাওয়া দরকার আখ্যানের উৎপত্তিস্থলে। অর্থাৎ গ্রেপ্তার এবং হাতঘড়ি উদ্ধারের জায়গায়। “কারণ, গ্রেপ্তার বা লুন্ঠনসামগ্রী উদ্ধারের আগে, সাধারণবুদ্ধিতে যা বলে, উদ্ধারের আখ্যান তৈরি হওয়া সম্ভব নয়।” কিন্তু এই প্রশ্নটি ওঠার পরে আমাদের যৌক্তিক পূর্বানুমানটিও নিজেই প্রশ্নচিহ্নের সামনে পড়ে যায়। পুলিশের যদি জানাই থাকে কী উদ্ধার হবে, তাহলে আখ্যানটির সূচনা অন্যত্র। এবং এই সাক্ষীরা, সেই আখ্যানের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। যারা মধ্যরাতে কেবলমাত্র সমাজসেবার কারণেই পুলিশের সঙ্গ দেয়, তারা কারা?
এই প্রশ্নের উত্তর অজানা নয়। ধনঞ্জয় নিজেই আদালতে জেরার সময় জানায়, যে, দেবদুলাল তার পূর্বপরিচিত। এই ব্যক্তির দাদার একটা চা-মিষ্টির দোকান আছে। সেটা, থানাসংলগ্ন হওয়াই স্বাভাবিক, কারণ, ধনঞ্জয়ের বয়ান অনুযায়ী দেবদুলাল থানায় এসে চা-ও বানায়, অন্তত তার গ্রেপ্তারের পরদিন সকালে বানিয়েছিল।
ধনঞ্জয়ের বয়ানের নানা অংশ অসমর্থিত হলেও, এই বক্তব্যটি নয়। দেবদুলালকেও আদালতে ডাকা হয়েছিল। দেবদুলালের বয়ানেও এই অশটুকু সমর্থিতই হয়। জানা যায়, যে, দেবদুলালের দাদার দোকান, ছাতনা থানা থেকে দুই মিনিটের হাঁটা পথ। সেখানে থানার পুলিশের কর্তারাও প্রায়ই আসেন। “মেজোবাবু” অর্থাৎ প্রণব চ্যাটার্জি এই ছেলেটির পূর্বপরিচিত, যদিও তাঁর পরিচিতি নামে নয়, মেজোবাবু বলেই।
থানার পাশের দোকানের এই পূর্বপরিচিত ছেলেটিকেই, সরকারি আখ্যান অনুযায়ী, তার একজন প্রতিবেশী সমেত পুলিশ সাক্ষ্য দিতে নিয়ে যায় গভীর রাতে, যেখান থেকে উদ্ধার হবে সাক্ষ্যদানের উপযুক্ত নানা সামগ্রী।
১৭।
বলাবাহুল্য, ধনঞ্জয়ের বয়ানের সঙ্গে তল্লাশির গোটা সরকারি আখ্যানই একেবারেই মেলেনা। ধনঞ্জয়ের বয়ানানুযায়ী, সে ছুটি নিয়ে ভাইয়ের পৈতে আর বৌয়ের অপারেশনের জন্য বাড়িতে এসেছিল। গ্রেপ্তারের সময় সে বাড়িতেই ছিল, তার বৌয়ের সঙ্গে। অন্য কোথাও তল্লাশির ব্যাপারে সে কিছুই জানেনা। গ্রেপ্তারের সময় তার বাড়িতে দেবদুলাল বা নন্দগোপাল কেউই উপস্থিত ছিলেননা। গ্রেপ্তারের পর সে কোনো ‘স্বীকারোক্তি’ দেয়নি, পড়ে শোনানো বা সম্মতি নেবার তো কোনো প্রশ্নই নেই। বরং পরদিন সকাল ৭-৩০/৭-৪৫ নাগাদ থানায় একটি সাদা কাগজে তাকে দিয়ে সই করিয়ে নেওয়া হয়।
পুলিশ তার বাড়ি থেকে কোনোকিছু ‘উদ্ধার’ও করেনি। তার বৌয়ের বাক্স থেকে মানিব্যাগ (যাতে সিনেমার টিকিট ছিল), অফিসের কিছু কাগজপত্র, বৌয়ের কিছু গয়নাগাটি এবং একটি শার্ট-প্যান্ট জোর করে নিয়ে নেওয়া হয়। সে সে সময় লুঙ্গি পরে ছিল, শার্ট-প্যান্ট নেওয়া হয় তাকে পরানো হবে বলে। গয়নাগাটি পরে বৌকে ফেরত দেওয়া হয়। পরদিন সকাল ৭-৩০/৭-৪৫ নাগাদ সাদা কাগজে সই করানোর পর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় দর্জির দোকানে, যেখান থেকে সে জামা বানায়। এই জামাটিও ওই দোকানেরই বানানো ছিল।
কোনো ঘড়ি তার বাড়ির র্যাক থেকে উদ্ধার হয়নি। তার বাড়িতে কোনো র্যাকই নেই। সে খবরের কাগজে মোড়া কোনো প্যাকেট নিয়ে আসেনি। তার বাড়িতে খবরের কাগজের কোনো ব্যবহারই নেই। তদন্তকারী অফিসার শার্ট-প্যান্ট মুড়ে রাখবেন বলে বড়বাবুর কাছ থেকে একটা কাগজ চান। বড়বাবু পরদিন সকাল ৭টা নাগাদ নিজের বাড়ি থেকে খবরের কাগজটা নিয়ে আসেন। তারপর দারোগাবাবু বলেন, ওই শার্ট-প্যান্ট আর পরা যাবেনা। জামাকাপড় নিয়ে এর চেয়ে বেশি কিছু সে জানেনা।
দেবদুলালের দাদার দোকান ছিল সে জানে। দেবদুলালকে চেনেও। কিন্তু সেদিন তাকে দেখে গ্রেপ্তারের পরে, যখন দেবদুলালকে চা বানানোর জন্য থানায় ডাকা হয়। নন্দগোপাল ‘সাক্ষ্য’ দিতে থানায় আসেন পরের সকালে ৮-৩০/৮-৪৫ নাগাদ।
‘উদ্ধার’ হওয়া ঘড়িটি সম্পর্কে বাড়িতে বা থানায় সে কিছু জানত না(স্পষ্ট করে বললে ওটা তার বাড়িতে ছিলইনা)। জিনিসটা তাকে প্রথম দেখানো হয় লালবাজারে। সেখানে মারধোর করা হয়, আঙুলও ভেঙে দেওয়া হয়।
এই হল মোটামুটি ধনঞ্জয়ের এ সংক্রান্ত বয়ান। এইটুকু থেকে সত্য-মিথ্যা বিচার করা সম্ভব নয়। ধনঞ্জয়ের আখ্যান আংশিক বা সম্পূর্ণ অসত্যও হতেই পারে। কিন্তু যেটা লক্ষ্যণীয়, যে এই একই ব্যাপারে উল্টোপিঠের যে আখ্যানটি আছে, অর্থাৎ সরকারি আখ্যান, তাতেও অসঙ্গতি বিস্তর। গ্রেপ্তারের জায়গা থেকে শুরু করে বাজেয়াপ্তকরণ পর্যন্ত সর্বত্রই অসঙ্গতি। এবং ফাঁক পূরণের জন্য সেখানে সাক্ষী হিসেবে আসে থানার পাশের চায়ের দোকানে বসা পুলিশের পূর্বপরিচিত একটি ছেলে। যদি কোনো পূর্বসিদ্ধান্ত না নিয়ে স্রেফ আখ্যান হিসেবে বর্ণনাদুটি পড়া হয়, তবে ধনঞ্জয়ের এবং পুলিশের কারোরই বানিয়ে বলা অসম্ভব মনে হয়না।
এর অবশ্য একটা সহজ সমাধানসূত্র থাকা উচিত। কোনো একটি ঘটনা ঠিক কী হয়েছিল, এ বিষয়ে সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী দুটি প্রত্যক্ষদর্শনের আখ্যান পাওয়া গেলে আমরা সাধারণভাবে তৃতীয়পক্ষের শরণাপন্ন হই, যদি অবশ্য তৃতীয়পক্ষ হাতের কাছে থাকে। এখানে সৌভাগ্যক্রমে তৃতীয়পক্ষ হাতের কাছে ছিল। পাড়ার তিনটি বাড়িতে তল্লাশি হয়েছিল, সেখানে নিশ্চয়ই কিছু লোকজন জমে গিয়েছিলেন। ধনঞ্জয়ের স্ত্রীর উপস্থিতি তো ছিলই। পুরো ঘটনা সম্পর্কে তাঁদের কি মতামত জানলেই বিষয়টা অনেকটা পরিষ্কার হওয়া উচিত। এমনকি ধনঞ্জয়ের স্ত্রী এবং আত্মীয়স্বজন তার পক্ষেই বলবে, এমনকি এরকমটা ধরে নিলেও, কিছু সাধারণ জিনিস যাচাই করা যেতেই পারে। যেমন, ধনঞ্জয়ের কোনো ভাইয়ের সত্যিই পৈতে ছিল কিনা। বা ধনঞ্জয়ের বাড়িতে সত্যিই কোনো র্যাক আছে কিনা। দরজির কাছে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কিনা, হলে কেন। এমনকি কোথা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, বা পুলিশের সঙ্গে নন্দগোপাল/দেবদুলাল ছিলেন কিনা, কৌশলে জেরা করলে সেটা নিয়েও মিথ্যে বলা কঠিন। মিথ্যের ফাঁকফোকর নিশ্চয়ই বেরিয়ে আসবে। কোর্টে না এলেও আমরা যেভাবে চুলচেরা বিশ্লেষণ করছি, তাতে বেরিয়ে আসাই উচিত।
কিন্তু এই লেখায় সেটা সম্ভব না। শুধু এখানে নয়, আদালতেও ছিলনা। কারণ তৃতীয়পক্ষের বিবরণ গোটা মামলায় আসেইনি। ধনঞ্জয়ের স্ত্রী বা আত্মীয়স্বজন শুধু না, আসামীপক্ষের একটিও সাক্ষী আসেনি গোটা মামলায়। একজনও না। ফলে ধনঞ্জয়ের আখ্যানটি যাচাইই করা যায়নি। শুধু তাইই না, উল্টোদিকে সরকারি ‘সাক্ষী’কে ‘জিনিসপত্র উদ্ধার’এর আখ্যানটি নিয়ে নিম্ন আদালতে আসামীপক্ষের উকিল কোনো চ্যালেঞ্জই করেননি। ‘বাজেয়াপ্তকরণ’এর একজন সাক্ষী নন্দগোপালকে তো আদালতে ডাকাই হয়নি। বাকি যেটুকু চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে, তা শুধু ‘স্বীকারোক্তি’টুকু নিয়ে। হাইকোর্ট জানায়ঃ “It may be noted here that the recovery of the shirt and pant is not disputed by the accused in his examination under section 313 Cr. P.C. though according to him it was seized by police from a trunk after search and was not produced by him in pursuance of his statement.” এই আইনী যুক্তিটির প্রয়োগ ইতিপূর্বে আমরা আরও একবার দেখেছি। যদিও আসামীর আখ্যান সরকারি আখ্যানের সম্পূর্ণ উল্টো, কিন্তু তার উকিলের সরকারি আখ্যানকে এ নিয়ে প্রশ্ন না করার অর্থ হল, সরকারি আখ্যানটি আসামীপক্ষের দিক থেকে মেনে নেওয়া হচ্ছে। এই যুক্তির প্রয়োগে ‘জিনিসপত্র উদ্ধার’এর সরকারি আখ্যানটিই বৈধতা পায়। ধনঞ্জয়ের ‘স্বীকারোক্তি’র বিষয়টি নিয়ে অবশ্য কিছু কাটাছেঁড়া করা হয়, যেটা আমরা আগেই দেখেছি। সম্পূর্ণ সরকারি আখ্যানটিই সামান্য এদিক-ওদিক করে আদালত-স্বীকৃত আখ্যানের মর্যাদা পেয়ে যায়।
১৮।
এ বিষয়ে আর একটি কথাই বলার থাকে, যে, এই ঘড়ি এবং শার্ট-প্যান্ট ও বোতাম, এই মামলায় পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রত্যক্ষদর্শী নিরাপত্তারক্ষী (যাদের কথা দ্বিতীয় পর্বে বলা হয়েছে), ডিউটির পরে ধনঞ্জয়কে ক্রিম রঙের একটি শার্ট(ডিউটির সময় নিরাপত্তারক্ষীদের অন্য পোশাক পরতে হয়) পরে থাকতে দেখেছেন বলে জানান, যা উদ্ধার হওয়া শার্টটির সঙ্গে মেলে। উদ্ধার হওয়া শার্টটিতে একটি বোতাম একটু অন্যরকম ছিল, বাকি গুলি একই রকম। এই একই রকম বোতামগুলির সঙ্গে হেতালের ফ্ল্যাটে উদ্ধার হওয়া বোতামটি মোটামুটি মিলে যায়। ফরেনসিক বিশেষজ্ঞও এই মিলে যাবার পক্ষে মত দেন। ধনঞ্জয় এ ব্যাপারে কিছুই জানেনা বলে জানায়। আরও জানায়, যে, গ্রেপ্তার হওয়ার পরে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল স্থানীয় দর্জির দোকানে, যেখান থেকে সে জামা বানায়। এই জামাটিও ওই দোকানেরই বানানো ছিল। আমরা আগেই দেখেছি, যে, তার এই বয়ানের সত্যমিথ্যা যাচাই করা হয়নি। দর্জির দোকানে জামা নিয়ে কিছু করা হয়েছিল কিনা তাও জানা নেই, কারণ দর্জির সাক্ষ্য নেওয়াই হয়নি।
যে ঘড়িটি ‘উদ্ধার হওয়া’ নিয়ে এত অসঙ্গতি, আদালতে পেশ করা সেই ঘড়িটিই হেতালের ফ্ল্যাটের আলমারি থেকে ‘চুরি’ হয়েছিল কিনা এ নিয়েও প্রশ্ন আছে। সেই ঘড়িটিই ‘চুরি’ হলেও বাকি অসঙ্গতিগুলি মিটে যেত, বা ধনঞ্জয়ের বয়ান যাচাই করে নেবার প্রয়োজন থাকতনা, এমন একেবারেই নয়, অসঙ্গতির উপাখ্যান খুঁজতে বসলে এইটুকুও লিপিবদ্ধ রাখা উচিত, যে, এই নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল আদালতে। সে অবশ্য নিম্ন আদালতে নয়, (নিম্ন আদালতে আমরা দেখেছি, বহু জরুরি প্রশ্নই করা হয়নি যেগুলো উচ্চতর কোর্টে ‘মেনে নেওয়া’ ধরে নেওয়া হয়েছে), হাইকোর্টে। ধনঞ্জয়ের অ্যাপিল মামলায় তার উকিল প্রশ্ন তোলেন, যে, ‘চুরি’ হওয়া ঘড়িটির দোকানের সেলসম্যানের পর্যন্ত সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে, কিন্তু কোনো ক্যাশমেমো দেওয়া হয়নি। হেতালের পরিবার ক্যাশমেমো হারিয়েই ফেলতে পারে, কিন্তু দোকানের খাতা খুঁজে তার ডুপ্লিকেট পাওয়া সম্ভব ছিল, সেটাও যোগাড় করা হয়নি। পরিবর্তে দেওয়া হয়েছে গ্যারান্টি কার্ড।
গ্যারান্টি কার্ড আর ক্যাশমেমোর, আদালতের সওয়াল থেকে জানা যায়, একটা তফাত আছে। ক্যাশমেমোর সুবিধে হল, তাতে একটি সিরিয়াল নম্বর থাকে যেটা ঘড়ির সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে নিশ্চিত করে বলা সম্ভব, এটাই সেই ঘড়ি, নাকি একই মডেলের অন্য কোনো ঘড়ি। নইলে একই মডেলের অজস্র ঘড়ি বাজারে আছে, প্রতিটাই একই রকম দেখতে, চোখে দেখে একটি নির্দিষ্ট ঘড়িকে শনাক্ত করা অসম্ভব। গ্যারান্টি কার্ড থেকে সেটা যায়না।
আগেই বলা হয়েছে, এই ঘড়িটিই ‘চুরি’ করা ঘড়ি হলেও বাকি অসঙ্গতিগুলো মিটে যায় এমন নয়। উদ্ধারকার্যের অসঙ্গতিগুলি আলাদা করেই মনোযোগ দাবী করে। কিন্তু তার পরেও, কোনো সন্দেহ নেই, উদ্ধারকার্যের অসঙ্গতির সঙ্গে ঘড়ি মিলিয়ে নেবার পদ্ধতির সমস্যাটি যোগ করলে গোটা ব্যাপারটাতেই অতিরিক্ত একটা বিরাট মাত্রার অনিশ্চয়তা চলে আসে। কিন্তু যেহেতু ইতিপূর্বেই, আমরা দেখেছি, উদ্ধারের আখ্যানটি বৈধতা পেয়ে গেছে, তাই বিচারের প্রশ্নে এই অনিশ্চয়তাটুকু হয়ে দাঁড়ায় যৎসামান্য। আদালত তার রায়ে জানায়, যদিও তদন্তকারী অফিসারের ক্যাশমেমো কিংবা অন্তত তার একটা কার্বনকপি জোগাড় করা উচিত ছিল, কিন্তু তার মানে এই নয়, যে, গ্যারান্টি কার্ডটি বানানো। তদন্তকারী অফিসার কয়েকজন সাক্ষীর সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে বিষয়টা ঘটাচ্ছে ভাবারও কোনো কারণ নেই। ফলে সাক্ষীদের অবিশ্বাস করার কোনো জায়গা থাকতে পারেনা। এরকম কিছু যুক্তি দেখিয়ে আদালত এই অনিশ্চয়তাটুকু বিবেচনার যোগ্য মনে করে না। (মূল রায় থেকে সংক্ষেপিত। ভাষা বর্তমান লেখকের।)
আদালতের যুক্তিপরম্পরা এখানে আলাদা কিছু না। কোনো একটি বাড়ি থেকে যদি একটি ঘড়ি চুরি যায় এবং মুখ্য সন্দেহভাজনের বাড়ি থেকে সেই একই মডেলের ঘড়ি উদ্ধার হয়, তবে “ওই ঘড়িটিই চুরি যাওয়া ঘড়ি” প্রমাণ না করা গেলেও সাধারণভাবে বিষয়টা সন্দেহভাজনের বিরুদ্ধেই যায়। এটাকে “সাধারণভাবে” বলা হল কেন, সে নিয়ে অবশ্য বিতর্ক থাকতে পারে, কারণ, যুক্তি দেওয়া যেতে পারে, ওই একই মডেলের ঘড়ি সন্দেহভাজন তো কিনেও থাকতে পারে। যুক্তিটি অবশ্যই ফেলে দেবার মতো নয়। কিন্তু এখানে যেটা বলার চেষ্টা হচ্ছে, সেটা হল, “ঘড়ি মিলিয়ে না নেওয়া”র বিষয়টি নিজে যে পরিমান অনিশ্চয়তা তৈরি করে, তার সঙ্গে যদি “উদ্ধার হওয়া”র অসঙ্গতিগুলি যোগ করা হয়, তবে অনিশ্চয়তাটি আর উপেক্ষা করার যোগ্য থাকেনা। এখানে “উদ্ধার হওয়া” নিয়ে অসঙ্গতি, আমরা আগেই দেখেছি, আসামীপক্ষ “মেনে নিয়েছে”। অতএব বাকি অনিশ্চয়তাটুকু সে পরিমান অভিঘাত তৈরি করতে পারেনা। তাকে আদালত-স্বীকৃত আখ্যানে একরকম করে উপেক্ষাই করা হয়। ধনঞ্জয়ের বয়ান মিলিয়ে না নেবার খামতি, ধনঞ্জয়ের পক্ষের সাক্ষীর অভাব, “উদ্ধার হওয়া”র সরকারি বয়ানের অসঙ্গতি, এবং “মিলিয়ে না নেওয়া”র অনিশ্চয়তা সব মিলিয়ে চাপা পড়ে যায় এক আইনী প্রক্রিয়ার মধ্যে। বিপুলতর এক সরকারি আখ্যানের ছায়ায়।