আজ থেকে প্রায় বছর দশ এগারো আগের কথা, ইন্টারনেটের দৌলতে বন্ধুবান্ধব ততদিনে বেশকিছু হয়েছে, বিভিন্ন শহরে গেলে তাদের সাথে দেখা করার একটা তাগিদ থাকে, এমনভাবেই কলকাতায় কিছু বন্ধুর সাথে প্ল্যান করে দেখা করা হল। তখনও সবাই এসে পৌঁছায় নি, আমরা জনাতিনেক তখন প্রায় কাছাকাছি একই ধরণের পেশায় নিযুক্ত, ফলে গল্প জমে উঠতে দেরী হল না। পেশাগত চাপ, লুপ্তপ্রায় অবকাশ ইত্যাদি দু’এক কথা হতে না হতেই একজন কিছুটা অভিযোগ, কিছুটা পরিহাসের সুরে আমাকে জিগ্যেস করলেন 'কিন্তু মেয়েরা যে কেঁদেকেটে ছুটি আদায় করে, বেশি সুবিধে চায় এ তো আর অস্বীকার করতে পারবে না!?' সত্যি বলতে কি, আচমকা এরকম একটা আধা অভিযোগ আধা স্বতঃসিদ্ধ ঘোষণার জন্য আমি ঠিক প্রস্তুত ছিলাম না। তবে কর্পোরেটে দীর্ঘদিন কাজ করার সুবাদে মুখের পেশীর নড়াচড়া সম্পূর্ণ নিজ নিয়ন্ত্রণেই থাকে, কাজেই চমকটুকু গিলে নিয়ে উত্তর একটা দিলাম, আমার উত্তরে কথঞ্চিৎ শান্ত হলেও, আরো কিছুক্ষণ তাঁর দেখা দুই তিনটি কেঁদে সুবিধে/ছুটি আদায় করার গল্প শুনতে হল। প্রসংগত এঁর সাথে এই প্রথম দেখা, যদিও এর আগে ইন্টারনেটে বহু বিষয়ে মত বিনিময় হয়েছে। এই আপাততুচ্ছ ঘটনাটি নিয়ে আমি পরে বহুবার ভেবেছি। মেয়েদের ‘কান্না’ ও তদ্বজনিত সুবিধে আদায় এমনই বহুল প্রচারিত যে সাক্ষাৎ পরিচয় নেই অথচ বিভিন্ন বিষয়ে মতামতের ব্যপারে পরস্পর যথেষ্ট পরিচিত এমন মোটামুটি অভিজ্ঞ দুজনের সাক্ষাতেও মহিলাটিকে প্রায় প্রথমেই মেয়েদের কেঁদেকেটে প্রাপ্যের অতিরিক্ত সুবিধে আদায়ের বিরুদ্ধে নিজ অসন্তোষ ব্যক্ত করে নিতে হবে? অন্তত সেটাই প্রত্যাশা করেন কেউ কেউ? তাহলে পড়াশুনো শেষ করে যে মেয়েগুলি সদ্য সদ্য কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে তাদের এই বদ্ধমূল ধারণাজনিত চাপ কতটা সামলাতে হয়? অর্থাৎ আজ থেকে কুড়ি বছর আগের মতই এখনও এই পূর্বনির্দিষ্ট ধ্যানধারণাগুলি রয়ে গেছে। সে নাহয় থাকুক, কিন্তু সেগুলি প্রকাশ্যে এসে কারো উপর চাপ সৃষ্টি করতে চাইলে তো মুশকিল। কিছু 'কাঁদুনে' মেয়ে যেমন সত্যিই কেঁদেকেটে একটু অতিরিক্ত সুবিধে নেওয়ার চেষ্টা করে, তেমনি কিছু 'স্মার্ট' ছেলেও ভারত পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ কিম্বা স্থানীয় লোকসভা কিম্বা বিধানসভা কেন্দ্রের রেজাল্ট বেরোবার দিন গুরুত্বপূর্ণ ডেলিভারি থাকলে নানা অজুহাতে পিছানোর চেষ্টা করে। এমনও দেখেছি একটি পরিবারে হঠাৎই অতিথি বা অত্মীয়স্বজন আসবে, পুরুষ ও নারী নিজ নিজ অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে, এক্ষেত্রেও ক্থা চালাচালি হচ্ছে মেয়েটির সম্পর্কেই, কতই না সহজ তার ছুটি নেওয়া ইত্যাদি। তা এতে যেটা হয়, যারা এরকম কেঁদে কিছু আদায় করতে অভ্যস্ত নয়, অথবা ব্যক্তিগত সমস্যা অপরের সামনে আনতেই যারা সঙ্কোচ বোধ করে তাদের পক্ষে এই ধরণের কথাবার্তা, ঠাট্টা, টীকাটিপ্পনী অনেকসময় একধরণের মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। কিছুক্ষেত্রে ন্যায্য কারণ থাকলেও ওই ‘মেয়েদের এমনিই এত কথা বলে লোকে’ যে আর দরকারের কথাটাও মুখ ফুটে বলে ওঠা যায় না। আবার কিছুক্ষেত্রে ‘মেয়েদের তো এমনিও বলবে অমনিও বলবে তাহলে বাপু নিয়েই নি সুবিধে যতটা পারি’ – এই দুইরকমই হয়। কোনওটাই খুব একটা স্বাস্থ্যকর কাজের পরিবেশ সৃষ্টি করে না।
এ তো গেল সাধারণভাবে ছুটি নেবার কথা। এইবার আসি আরেকটি সম্প্রতি বহুল আলোচিত নির্দিষ্ট ছুটি প্রসঙ্গে। গতবছর হঠাৎই মুম্বাইয়ের এক ডিজিটাল মিডিয়া কোম্পানি তাদের মহিলা কর্মীদের জন্য “ফার্স্ট ডে অফ পিরিয়ড” লিভ অর্থাৎ কিনা মেন্সট্রুয়াল লিভ চালু করা মাত্রই সারা দেশে মহা হৈ চৈ শুরু হয়ে গেল। কোম্পানির মহিলা কর্মীগণ অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে নিজেদের খুশীর ভিডিও শেয়ার করেছিলেন। ( প্রসঙ্গত, বিহারে রাজ্য সরকার মেয়েদের জন্য এই পিরিয়ডকালীন ছুটির ব্যবস্থা করেছেন তা, আজ হয়ে গেল বেশ কিছু বছর।) আরেক ডিজিটাল মার্কেটিং কোম্পানিও তাঁদের মহিলা কর্মীদের জন্য এই ছুটির ঘোষণা করলেন। এর প্রতিক্রিয়ায় দেখলাম বন্ধু বান্ধব পরিচিত সহকর্মীদের মধ্যে অনেকে এটিকে ইতিবাচক পদক্ষেপ বলে স্বাগত জানিয়েছিলেন। কিন্তু বৃহদংশের প্রতিক্রিয়াই মৃদু থেকে তীব্র মাত্রায় বিরূপ। FOP লীভ সংক্রান্ত আপত্তির কারণগুলো মূলত নিম্নরূপ
ক) মেয়েরা লিঙ্গসাম্যের কথা বলে একটা দুটো অতিরিক্ত ছুটি কীভাবে চাইছেন/নিচ্ছেন?
খ) যে সব শ্রমজীবি মেয়েরা মিস্ত্রির যোগাড়ে, বাজারে সবজিওয়ালি বা বাড়ী বাড়ী গৃহকর্মসহায়িকা, এরকম বিবিধ অসংগঠিত পেশায় আছেন তাঁদের তো এই ছুটি নেবার বিলাসিতা নেই। তাঁরা যদি কর্পোরেট কর্মীদের তুলনায় অনেক কম মজুরীতে, অনেক কম স্বাচ্ছন্দ্যের পরিবেশে কাজ করেও এই ছুটি না পেতে পারেন, তাহলে অধিক সুবিধা ও অধিক বেতনভোগী মেয়েরা সেটি কেন চাইছেন/নিচ্ছেন?
গ) মেয়েদের কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে যোগদানের সুযোগ আরো কমবে এবং আরো বেশি করে বৈষম্যের শিকার হবে মেয়েরা এই অতিরিক্ত ছুটির জন্য।
আমরা এক এক করে আপত্তির বিষয়গুলো দেখব এবার।
ক) লিঙ্গসাম্যঃ- এখানে ইক্যুইটি আর ইকোয়ালিটির ধারণায় গুলিয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। জেন্ডার ইকোয়ালিটি সমবন্টনের কথা বলে, জেন্ডার ইক্যুইটি বলে ন্যায়বিচারের কথা। সমবন্টন অর্থাৎ পুরুষ, নারী, তৃতীয় লিঙ্গ, লম্বা, বেঁটে, ফরসা, কালো, ধনী, দরিদ্র সকলকেই সমান সুযোগ দিতে হবে। একই পদে আসীন সকলের প্রাপ্য সুযোগসুবিধে বেতন সমান হতে হবে। যদিও কার্য্যক্ষেত্রে অনেকসময়ই তা হয় না জানি, তবু দাবি সেরকমই। কিন্তু ন্যায়বিচার এর থেকে একটু আলাদা। কারো যদি দৃষ্টিশক্তির কোনও সমস্যা থাকে তাকে চশমা নিতে হয়। এরপরেও কারো হয়ত একটু দূরের জিনিষ দেখতে অসুবিধে হয়, সেক্ষেত্রে তাকে ক্লাসে ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে বসতে দেওয়া হয়, সেটিই ন্যায়ত ঠিক। দৃষ্টিশক্তির সীমাবদ্ধতা তার শারিরীক বৈশিষ্ট্য, এর জন্য তাকে যদি বলি ‘তুমি চশমাও পরবে আবার ক্লাসে সামনেও বসবে তাহলে আর অন্যদের সাথে সমান হবে কীকরে?’ তাহলে সেটা ন্যায়ের পরিপন্থী হয়। ব্ল্যাকবোর্ডের লেখায় তারও সমান অধিকার ক্লাসের বাকী আর সকলেরই মত। আর তাকে এই অধিকার পেতে সাহায্য করবে চশমা ও সামনের বেঞ্চের আসন দুইই, যেখানে আরেকজন, যার দৃষ্টিশক্তি ভাল, অনেকটা পেছনে বসেও একই অধিকার ভোগ করতে পারছে। আবার সে হয়ত শুনে দ্রুতলিখনে অপটু, সেক্ষেত্রে তার একটি রেকর্ডার যন্ত্র দরকার, যাতে পরে আস্তে আস্তে লিখে নিতে পারে। অর্থাৎ ক্লাসের যা পড়ানো হয় তাতে সব ছাত্রছাত্রীর সমান অধিকার। সেই অধিকারটুকু পেতে যার যেখানে অসুবিধে সেইখানে সুবিধে করে দেওয়াই ন্যায়বিচার।
লিঙ্গসাম্যের ক্ষেত্রেও একইভাবে সমান সুযোগ পেতে পুরুষ ও মেয়েদের জন্য ঠিক একই নিয়ম সর্বদা প্রযোজ্য হয় না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় সন্তানধারণের জন্য ছুটি মূলতঃ নারীর লাগে কারণ নারীই সন্তানধারণ করে। সন্তানজন্মের পরে সদ্যপ্রসুতিকে সাহায্য ও সন্তানের সাথে সময় কাটানো, বন্ধন গড়ে ওঠার জন্য পুরুষও ছুটি পায়। কিন্তু সে তো এখন। এ অধিকারও মেয়েদের আদায় করতে হয়েছে দীর্ঘ লড়াইয়ের পরই। একসময় ছিল গর্ভধারণ করা মাত্রই মেয়েটির চাকরিটি যেত। এখনও যে একেবারে যায় না তা নয়, যে সব চাকরি চুক্তি ভিত্তিক অনেকসময়ই শোনা যায় অন্তঃস্বত্ত্বা মেয়েটির চুক্তি নবীকরণ হয় নি। কিন্তু বর্তমানে এগুলি ব্যতিক্রম ধরা হয়, সেই নিয়ে হইচই হয়, কখনও কখনও সংবাদপত্রে যথেষ্ট পরিমাণ প্রতিবাদী লেখালেখিও হয়। (বলাবাহুল্য এখানে শ্রমজীবি, গৃহকর্মসহায়িকা ইত্যাদি অসংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মজীবিদের কথা ধরা হয় নি, তাঁদের সন্তানধারণকালীন সুযোগসুবিধে, ছুটি প্রায় কিছুই নেই।) যা বলছিলাম, কর্মক্ষেত্রগুলি, জীবিকা নির্ধারণের বিভিন্ন ক্ষেত্রগুলি, সে কারখানাই বলুন বা অফিস, কিম্বা বিদ্যায়তনগুলি, মূলত সৃষ্টি হয়েছিল কেবলমাত্র পুরুষেরা চাকরি করবে এইটি ধরে নিয়ে। এর সপক্ষে প্রমাণস্বরূপ বলা যায় আমরা যদি বিভিন্ন জায়গার শৌচাগার ও তার বিবর্তন লক্ষ করি তাহলেই দেখব মহিলা শৌচাগার পরে তৈরী হয়েছে, কোথাও কোথাও সংখ্যায় এখনও অপ্রতুল। এবার যখন মেয়েরাও যথেষ্ট পরিমাণে কর্মক্ষেত্রে যোগদান করছে তখন তাদের প্রয়োজন অনুসারে ইনফ্রাস্ট্রাকাচার, নিয়মকানুন সবই বদলে যথেষ্ট নারীবান্ধব করা প্রয়োজন। সেই লক্ষেই সন্তানধারণকালীন সবেতন ছুটি, যা আমাদের দেশে সম্প্রতি বাড়িয়ে ৯০ দিন থেকে ১৮০ দিন করা হয়েছে। সমাজ আরো খানিক এগিয়েছে, তাই এখন শুধু নিজস্ব বায়োলজিক্যাল সন্তানই নয়, দত্তক সন্তানের জন্যও সবেতন ছুটি পাওয়া যায়। ঠিক এই একই যুক্তিতে পিরিয়ডের প্রথম দিনের ছুটিও অনেক মেয়েরই দরকার হয়। যাঁদের দরকার হয় তাঁরা যেন সেটি নির্বিঘ্নে নিতে পারেন এটা নিশ্চিত করাই জেন্ডার ইক্যুয়িটির লক্ষ। একইভাবে আগামীদিনে তৃতীয়লিঙ্গের জন্য, অন্য কোন যৌনতার কারো জন্য জেন্ডার ইক্যুয়িটি সুনিশ্চিত করতে হয়ত আরো কিছু বদল আনতে হতে পারে। এর সাথে লিঙ্গসাম্যের কোন অসঙ্গতি নেই।
খ) অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমজীবি মহিলারা এই ছুটি পাবেন না –প্রথমদিকে এই যুক্তির ব্যবহার দেখে একটু হাসি পেলেও পরে এর বহুল ব্যবহার দেখে মনে হল নাঃ এই নিয়েও দুই কথা বলা দরকার। হ্যাঁ একদম ঠিক কথা, অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমজীবি মহিলারা এফওপি লিভ পাবেন না। ঠিক যেমন তাঁরা আসলে কোনওরকম ‘লিভ’ই পান না, ‘সিক-লিভ’ বা ‘মেটার্নিটি লিভ’ও নয়, তেমনি এটাও পাবেনই না ধরেই নেওয়া যায়। তেমন অসুস্থ হলে সবজিওয়ালিমাসি বাজারে বসতে পারেন না, বিকল্প কেউ বসবার না থাকলে তাঁর অনুপস্থিতি আসলে তাঁর বেরোজগারি হয়ে দাঁড়ায়। একই কথা প্রযোজ্য দিনমজুর, ইটভাঁটার কর্মী ইত্যাদিদের জন্যও। পরিচারিকাদের অবস্থা তুলনামূলকভাবে একটু ভাল। তাঁরা ছোটখাট অসুস্থতায় সবেতন ছুটি পান অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, তবে সন্তানধারণকালে যতদিন পারেন কাজ করেন এবং যখন পারেন না, চেষ্টা করেন পরিচিত কাউকে কাজটি দিয়ে যেতে যাতে ফিরে এসে আবার পাওয়া যায়। প্রসবকালীন ছুটির পয়সা খুব কমক্ষেত্রেই পান। আমার পরিচিত গৃহকর্মসহায়িকাদের মধ্যে (সংখ্যাটি একশোর উপর) মাত্র ৪ জন এই সুবিধা তাঁদের নিয়োগকারি গৃহ থেকে পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন। সত্যি বলতে কি অনেক বাড়িতে একটু বয়স্ক কিম্বা নিতান্ত অল্পবয়সী পরিচারিকার খোঁজ করা হয়, যাতে দুম করে সহায়িকাটি প্রসবকালীন ছুটি চেয়ে না বসেন। অসুস্থতাও যদি দীর্ঘকালীন এবং/অথবা খরচসাপেক্ষ হয়, পরিচারিকার কাজটি যাবার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। কারণ এখানেও ‘আনপেইড লিভ’ বলে কিছু হয় টয় না। একজন পরিচারিকার আর্থারাইটিস বা চোখে ছানি পড়লে তাকে বিদায় করে আরেকজনকে রেখে নেওয়া হয়।
তা এগুলো তো আমাদের সব সুযোগসুবিধার সাথেই দিব্বি সহাবস্থান করছে। কিছুক্ষেত্রে এমনকি অফিসে কর্মরত মহিলাটি নিজের গৃহকর্মসহায়িকাটির কাছে বছরের ৩৬৫ দিনই উপস্থিতি আশা করেন উইকডেজে তিনি বেরিয়ে যান এবং ছুটির দিনগুলি তাঁর একমাত্র বিশ্রামের সময় বলে। তো এই অসঙ্গতিগুলি চোখের সামনে দেখলেও আমরা কখনো ভদ্রতার খাতিরে, কখনো বা অন্যের ব্যপারে মাথা না গলানোর সুশিক্ষায় বিশেষ কিছু বলি না। তাহলে অফিসে কর্মরত মহিলাটি যদি এফওপি লিভ পান এবং তাঁর পরিচারিকাটি না পান, তাহলে খুব নতুন কিছু বৈষম্যের সৃষ্টি হবে না। বরং অসংগঠিত ক্ষেত্রের দাবিদাওয়া আদায়ের ক্ষেত্রে এই দাবিটিও জুড়ে নেওয়া যায়, নেওয়া উচিৎ। আজ তা শুনতে যতই অবাস্তব লাগুক, ধারাবাহিক লড়াই একদিন নিশ্চয় তাঁদের জন্যও ন্যায্য অধিকার এনে দেবে। এই প্রসঙ্গেই উল্লেখ করা থাক, অনেক মহিলা নিজেদের উদাহরণ দিয়েও বলেছেন যে তাঁরা মাসের ওই ক’টা দিন অসহনীয় কষ্ট সহ্য করেও নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে ঠিক উপস্থিত হয়েছেন, এই উপলক্ষে ছুটি নেবার কথা ভাবেন নি, কাজেই এই ছুটি একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। অনেকে কষ্টের বেশ বিস্তারিত বিবরণও দিয়েছেন। তাঁদের প্রতি সম্পূর্ণ সম্মান দেখিয়েই বলতে বাধ্য হচ্ছি এই যুক্তি অনেকটা ‘আমাদের সময় বিশ্ববিদ্যালয় এত নম্বর দিত না। এখন ঢেলে নম্বর দেয় তাই সবাই এত বেশি বেশি নম্বর পায়, এ ভারি অন্যায়।‘ গোছের যুক্তি। এই একই যুক্তিতে তাহলে যাঁরা মাতৃত্বকালীন ছুটি নেন নি তাঁরাও বলতে পারেন ‘আমার তো লাগে নি, মাতৃত্বের ছুটি একেবারেই অপ্রয়োজনীয়।’ এ আবার কিরকম হিংসুটেপনা রে বাবা!
গ) মেয়েদের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ কমবে ও বৈষম্য বাড়বে – এযাবৎ শুনে আসা যাবতীয় যুক্তিগুলির মধ্যে এটিই সবচেয়ে সিরিয়াস। আগেও উল্লেখ করেছি সন্তানধারণ করলেই একসময় চাকরি যেত। কিছু চাকরিতে মুচলেকা দিয়ে ঢুকতে হত যে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কর্মী মহিলাটি কোনভাবেই গর্ভধারণ করবেন না। এখন খাতায় কলমে আইনটি উঠে গেলেও বৈষম্যমূলক আচরণ অনেক্ষেত্রেই হয়েই থাকে। উদাহরণস্বরূপ যদি আইটি কিম্বা আইটি এনেবলড সার্ভিসের কথা ধরি, তাহলে এইসব কোম্পানিগুলিতে প্রতিটি কর্মীর বাৎসরিক কর্মদক্ষতা মাপার অন্যতম মাপক হল সে কতদিন ‘বিলেবল’ ছিল। অর্থাৎ তার কাজের জন্য তার কোম্পানি তাদের মক্কেল কোম্পানিদের কাছে কতদিনের মূল্য দাবি করতে পেরেছে। এবার কোনও প্রোজেক্টের টিম তৈরীর সময় প্রজেক্ট ম্যানেজারদের সর্বদা নজর থাকে কত বেশি বিলিং করা যায়, সেখানে যে মেয়েটি প্রসবকালীন ছুটি নিচ্ছে তার ৯০ দিন অথবা বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী ১৮০ দিন বিলিং হচ্ছে না। যার ফল সরাসরি গিয়ে পড়ে তার বার্ষিক মূল্যায়নে। এযাবৎ আমার জানা মাত্র দুটি কি তিনটি কোম্পানি এক্ষেত্রে প্রোরেটেড রেটিং অর্থাৎ যতদিন কাজ করেছে কেবলমাত্র তারই ভিত্তিতে মূল্যায়নের ব্যবস্থা করেছে। বাকীরা এখনও গোটা বছর ধরেই হিসেব করে। ফলতঃ মেয়েটি নীচের দিকের রেটিং পায়। কিছুক্ষেত্রে এই নীচের দিকের রেটিং মানে কয়েক মাসের মধ্যে কোম্পানি থেকে বিদায়ও হতে পারে। তার মানে আমরা দেখছি সরাসরি না হলেও সন্তানধারণ পরোক্ষভাবে মেয়েটির চাকরি হারানোর কারণ হতে পারে। এবার যদি মেয়েটির ইউনিট ম্যানেজারের দিকে তাকাই, দেখব তার উপরেও কোম্পানির রেভিনিউ টার্গেট মিট করার চাপ রয়েছে, রয়েছে একটি টিমের মধ্যে এক একটি নির্দিষ্ট রেটিঙের শতাংশ ভাগ করার চাপ। কাজেই কখনো কখনো খুব একটা ইচ্ছে না থাকলেও বিকল্পের অভাবেই ম্যানেজার ওই মেয়েটিকেই কম রেটিং দেয়।
কিন্তু এ তো গেল বিকল্পের অভাব, বার্ষিক মূল্যায়নে উপযুক্ত নীতির অভাব, যা মেয়েটিকে ন্যায়ত সঠিক মূল্যায়ন পেতে দিচ্ছে না। আরেকদিকে আবার আছে এইগুলিকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে মেয়েদের টিমে নেবার অনীহা। এই দ্বিতীয় দলের লোকজন আসলে বৈষম্যবাদী, কিন্তু সেটি তাঁরা ঢেকে রাখেন ‘মেয়েরা কেঁদেকেটে ছুটি নেবে/ রাত করে থাকতে চাইবে না/ এই তো দুদিন বাদেই সন্তানসম্ভবা হয়ে মাসের পর মাস ছুটি নেবে’ এইসব বলে। যেহেতু সন্তানসম্ভবা হওয়া একটি অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা কাজেই অনেকসময় এঁরা এঁদের বক্তব্যের সমর্থনে কিছু লোকও পেয়ে যান। এই পরিস্থিতিতে এফওপি লিভ সত্যিই তাঁদের হাতে আরেকটি অজুহাত তুলে দিতে পারে মেয়েদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করবার।
তা সভ্যতার যাত্রা তো ইক্যুয়ালিটি ও ইক্যুয়িটির দিকে, তাই প্রসবকালীন দীর্ঘ ছুটি ও পরবর্তীকালে অনেকসময় সন্তানের দেখাশোনার জন্য মায়ের উপস্থিতি প্রয়োজন হলে/ সহায়তা করার লোকজন তেমন না থাকলে মেয়েদের জন্য বাড়ী থেকে কাজ করার সুবিধে, নমনীয় কাজের সময় (ফ্লেক্সি আওয়ার্স অর্থাৎ দিনের যে কোনো সময় এসে সুবিধেমত ৮ বা নয় ঘন্টা কাজ করে যাওয়া) ইত্যাদি সুযোগ আস্তে আস্তে কিছু কিছু কোম্পানিতে হচ্ছে। বড় বহুজাতিক আইটি এবং আইটি এনেবলড সার্ভিস প্রোভাইডার প্রায় সবকটিতেই এই সুবিধাগুলি আছে। এছাড়াও আছে বৈষম্য হলে তার জন্য অভিযোগ জানানোর সুযোগ। এই সচেতনতা একদিনে তৈরী হয় নি, ধীরে ধীরেই এসেছে। একইভাবে পিরিয়ডের সময় অনেক মেয়ের ছুটি পেলে ভাল হয়, অনেক মেয়ের লাগে না, তা যাদের পেলে ভাল হয় কিম্বা যাদের নিতান্তই দরকার হয়ে পড়ে শারিরীক নানা অসুবিধে, যন্ত্রণার কারণে তারা যেন এই ছুটি নিতে পারে সেরকম নমনীয় নিয়মনীতি সব কোম্পানিতেই হওয়া দরকার। কোম্পানির তরফে নির্দিষ্ট নীতি তৈরী হলে, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও দেখাশোনার দপ্তর থেকে তার প্রয়োগের ব্যপারে নির্দেশিকা জারি করলে বৈষম্যের সুযোগ কমবে। এর পরে দরকার সচেতনতা তৈরী, যেমন আজকাল বিভিন্ন ধরণের হয়রানী সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা হয় সকল কর্মীর মধ্যে, সেই পাঠক্রমের অঙ্গীভুত করে নেওয়া যায় মেয়েদের এই নিতান্ত শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া ও তদ্বজনিত প্রতিক্রিয়াসমূহ। এছাড়া সরকারের তরফেও সচেতনতা সৃষ্টি প্রয়োজন। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে চাই, বছর আট - দশ আগেও বৃক্ষরোপণ ও সবুজায়ন, নদী সুরক্ষা ও পুনরুদ্ধার ইত্যাদি ব্যপারে একটি মোটরগাড়ি নির্মাণ কোম্পানি বা আইটি কোম্পানির কোন মাথাব্যথা, উদ্যোগ কিছুই ছিল না। এরপরে সরকার থেকে ঘোষণা করা হয় পরিবেশরক্ষা, সবুজায়ন ইত্যাদি করলে, কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমাতে সাহায্য করলে মোটা অঙ্কের করছাড় পাওয়া যাবে। এখন প্রায় প্রতিটি বড় কর্পোরেট সবুজায়ন বা গ্রিন ইনিশিয়েটিভের জন্য বাৎসরিক অর্থ বরাদ্দ রাখে। একইভাবে মেয়েদের প্রয়োজন অনুযায়ী সুযোগের ব্যবস্থা করে দিলে যদি কোম্পানিদের কিছু ছাড় দেবার ব্যবস্থা করা হয়, অনেক কোম্পানিই উৎসাহী হয়ে এগিয়ে আসবে। কার্বন ফুটপ্রিন্ট কতটা কমান হয়েছে তার জন্য যেমন নির্দিষ্ট হিসেব দেখাতে হয়, তেমনি এক্ষেত্রেও কতগুলি মেয়ে প্রতিবছর কাজে যোগদান করছে ও কত ছেড়ে যাচ্ছে, কোম্পানিতে বিভিন্ন পদে ছেলে ও মেয়েদের পদোন্নতির অনুপাত কীরকম (যে কোনো একটি অসম হলে তার কারণ), সন্তানধারণের পর কতজন পুনরায় কাজে যোগ দিয়েছেন, তার মধ্যে কতজন পরবর্তী পদোন্নতি এক বছরের মধ্যেই লাভ করেছেন ইত্যাদি বিভিন্ন উপাত্তের ভিত্তিতে করছাড়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে দেশের মানবসম্পদ, সামাজিক সাম্য ও অর্থনীতি সবেরই উন্নয়ন সম্ভব হবে।