ছত্তিশগড়ের গেঁয়ো ব্যাংকঃ স্মৃতির কোলাজ (২)
এরিয়া ম্যানেজারের ব্র্যাঞ্চ ভিজিট
ন্যালাক্যাবলা ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজার রায় সদ্য প্রমোশন পেয়ে এরিয়া ম্যানেজার হয়েছে। গোটা দেশে গ্রামীণ ব্যাংকের অফিসারদের প্রথম প্রমোশন। ফলে ওর পেছনে একটা লেজ বেরিয়েছে। প্রথমে ভেবেছিল ময়ুরের মত পেখম, পরে দেখল—দুত্তোরি, ওটা ইঁদুরের মত লেজ!
কী জ্বালা, ও কি তবে অন্যদের মত চাকরির ইঁদুর দৌড়ে সামিল! নিজেকে এসবের থেকে আলাদা ভেবেছিল যে!
যাহোক, ওর দেখাশুনোর ভাগে পড়েছে ২৮টি ব্র্যাঞ্চ। ওদের বিজনেস গ্রোথ এবং টার্গেট, আচমকা না বলে কয়ে স্ন্যাপ অডিট, স্টাফের ছুটিছাটা, ট্র্যাভেলিং বিল, রিলিভারের বন্দোবস্ত, সব এখন ওর জিম্মায়।
এছাড়া আছে জেলাস্তরে সমস্ত ব্যাংক এবং সরকারি ডিপার্টপমেন্টের সঙ্গে তালমেল, কালেক্টরের সঙ্গে মাসিক এবং বিশেষ ত্রৈমাসিক বৈঠক। বছরের শেষে অডিট ফার্মএর ছেলেপুলেদের নিয়ে প্রচণ্ড গরমে বিভিন্ন ব্র্যাঞ্চে গিয়ে অডিট করানো, গাড়ি এবং পথ চলতি পান্থশালায় থাকা খাওয়ার সুবন্দোবস্ত করা ইত্যাদি।
এর উপর রয়েছে ওর এলাকার পাব্লিক কমপ্লেন শোনা, প্রাথমিক এনকোয়ারি করা, দরকারমত ডিপার্টমেন্টাল এনকোয়ারিতে এনকোয়ারি অফিসার হওয়ার সাত-সতেরো ঝামেলা।
এর চেয়ে রায়পুরের কোন কলেজে লেকচারশিপ পেলে ও বেশি সুখি হত।
যাহোক, আজ ওর প্রথম সুযোগ কোন ব্র্যাঞ্চে গিয়ে মাতব্বরি ফলানোর।
অফিসের জীপ ওকে দেয়া হয়নি।
--যাও, বাসে ট্রেনে করে। এসে বিল সাবমিট কর, মায় হোটেলে থাকা-খাওয়ার। পনেরদিনের মাথায় পকেটের খরচা হওয়া টাকা ফের পকেটে। তবে মনে রেখ, টি ই বিল হল খরচা ফেরত আসার মাধ্যম। দু’পয়সা কামানোর নয়।
ওর পিত্তি জ্বলে গেছল। স্টেট ব্যাংক থেকে ডেপুটেশনে আসা ওদের নতুন জেনারেল ম্যানেজার ভদ্রলোক কি ওকে চোর ভেবেছেন? ফলস্ টি ই বিল?
সাত সক্কালে ঘরে থেকে বেরিয়ে প্যাসেঞ্জার ট্রেনের পাঁচটা স্টেশন, সেখান থেকে লজঝরমার্কা বাসে চড়ে ও যখন ছোট্ট ব্র্যাঞ্চে পৌঁছল, তখন পেটে ছুঁচোয় ডন মারছে। কিন্তু কাজ আগে, নতুন প্রমোশন!
ব্রিফকেস থেকে নিজের ডায়েরি বের করে ম্যানেজার ভদ্রলোকের সামনে বেশ গুছিয়ে বসল, মুখে আনল একটা ভারিক্কি ভাব। বলল—রিজার্ভ ব্যাংকে পাঠানোর উইকলি রিপোর্টের ফাইল এবং জেনারেল লেজার এনে আমার সামনে রাখ। আর তারপর গত একমাসে যা যা লোন দিয়েছ তার ডকুমেন্ট এবং লেজার।
শাখা প্রবন্ধকের মুখে এক চিলতে হাসি খেলা করছে।
এটা কি নাট্যশালা? ওর হাসি পাচ্ছে ক্যান? তবে কি ওর চেহারায় পোষাক আশাকে কোন--। ও একবার নিজের অজান্তেই প্যান্টের জিপ ছুঁয়ে দেখল—সব ঠিক আছে, পোস্ট অফিসে তালা। এসব ব্যাপারে ওর রেকর্ড খুব ভাল নয়।
ও অস্বস্তি কাটাতে কলমের ক্যাপ খুলল।
কিন্তু ম্যানেজার বলল—সব হবে স্যার, জেনারেল লেজার, লোন ডকুমেন্ট—সব দেখবেন। তবে তার আগে আমার একটি প্রশ্ন আছে।
সে অবাক। ভাল করে ম্যানেজারকে খেয়াল করে দেখল ওর মোটা গোঁফ আর মোটা ফ্রেমের চশমার আড়ালে একটি সদ্য কলেজ পেরনো কমবয়েসি ছেলের মুখ।
--কবে ব্যাংক জয়েন করেছ?
--আট মাস আগে, কিন্তু আমার প্রশ্নটা স্যার—
--বলে ফেল।
--আমাকে একটা লিস্টি বানিয়ে দিন।
--কিসের?
--ব্যাংকের বিভিন্ন সম্পত্তি নষ্ট করলে কত কত টাকা গুনেগার দিতে হবে—তার লিস্ট। বুঝিয়ে বলি। ধরুন আমি যদি জেনারেল লেজারটা জ্বালিয়ে দিই তাহলে কত ফাইন? যদি ব্যাংকের সিন্দুকটা শাবল দিয়ে ভেঙে ফেলি? যদি পেট্রোল ঢেলে ফার্নিচার জ্বালিয়ে দিই তাহলে কত টাকা?
এটা কী ধরণের ইয়ার্কি! ছেলেটা কি পাগল?
--সেই লিস্টি নিয়ে কী হবে?
--তাহলে লিস্টি দেখে দেখে আমার টার্গেট ঠিক করব। একটা করে আইটেম প্রতিমাসে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নষ্ট করব। তারপর মাইনের থেকে সেটার জন্যে ফাইন জমা করব। লিস্ট পেলে আমার বাজেট করতে সুবিধে হবে।
ইচ্ছে হল ছেলেটার গালে সপাটে একটা চড় কষাই। কিন্তু তিনটে কারণে এটা করা গেল না।
এক, আমার কাজের যা ম্যান্ডেট তাতে শারীরিক হিংসার কোন স্থান নেই।
দুই, মারামারিতে আমার নিতান্ত অনীহা।
তিন, ও স্কুলের ছাত্র নয়। বেশ গাট্টাগোট্টা যুবক। হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়লে আমিই বেশি মার খাব।
তাই দাঁতে দাঁত চেপে জানতে চাই –এবংবিধ উদ্ভট চিন্তার কারণ।
--বলছি, তার আগে চা খেয়ে নিন, ভাজিয়া খান। এই নয়াগড়ের তেমাথার মোড়ে সন্তরামের দোকানের ভাজিয়া খুব বিখ্যাত। দুপুরের মধ্যেই সব শেষ হয়ে যায়।
--আমি কি এখানে ভাজিয়া খেতে এসেছি? কাজের কথা বল। ব্যাংকের জিনিসপত্রে আগুন দিতে চাও কেন?
-আহা, রাগ করেন কেন, স্যার? সব বলছি। কিন্তু সেই সাত সকালে বিলাসপুর থেকে রওনা দিয়েছেন। আর জাঁজগীর জেলার খারাপ রাস্তায় বাসের ঝাঁকুনি খেতে খেতে সকালের নাস্তা হজম হয়ে গেছে।
ওর ইশারায় চাপরাশি সাইকেল আর চায়ের কেটলি নিয়ে দ্রুত রওনা হয় তেমাথার মোড়ে সন্তরামের চা-ভাজিয়ার দোকানের উদ্দেশে।
ম্যানেজার পাঠকজি এবার বলতে শুরু করেন।
--স্যার, গত সপ্তাহে ক্যাশ ভেরিফিকেশন করতে এখানে এসেছিলেন বিলাস দুবে, ডিস্ট্রিক্ট লেভেল ব্র্যাঞ্চের ম্যানেজার। উনি এসে ঠিক আপনার মতই জেনারেল লেজার চেক করলেন, লোন ডকুমেন্ট চেক করলেন।
তারপর চোখ গোল গোল করে আমার দিকে একমিনিট তাকিয়ে রইলেন। শেষে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন—সর্বনাশ করেছ, আমি তোমায় বাঁচাতে পারব না।
তারপর ভিজিটিং রেজিস্টার টেনে কী সব নোট করলেন।
আমি তো ভয়ে কাঁটা! বললেম -স্যার আমার অপরাধটা কী একটু বুঝিয়ে বলুন।
উনি বললেন—উই আর আপার্স, ইউ আর লোয়ার্স। আমাদের কাজ তোমার ভুল ধরা, ভুলটা কী সেটা বলে দেয়া নয়। তবে তুমি ব্রাহ্মণ সন্তান, তাই বলছি –হেড অফিস থেকে তোমার নামে একটা ওয়ার্নিং আসবে, তাতে ভুলটা এবং মাইনে থেকে কত টাকা কাটা যাবে সেটা বলে দেয়া হবে।
বললাম টাকা কাটবেন কেন? উনি জানালেন যে তোমার ভুলে ব্যাংকের লোকসান হলে তার ভরপাই করতে হবে না? সরকারি বিভাগ হলে তুমি জেলে যেতে। ব্যাংক যেহেতু আর্থিক লেনদেনের সংস্থা, অতএব এর জন্য খালি ফাইন করে ছেড়ে দেবে।
--তারপর? হেড অফিস থেকে কিছু এসেছে?
--এখনও নয়। তাই বলছিলাম কিভুলের জন্য যদি টাকা দিলেই দায় মিটে যায় তাহলে আমাকে লিস্টি দিন—কোনটা নষ্ট হলে কত টাকার ভরপাই—
--শোন, ফালতু কথা ছাড়। আমাকে দুবে’র ভিজিটিং নোটস্ দেখাও। আর যা বললাম—জেনারেল লেজার, রিজার্ভ ব্যাংককে পাঠানো উইকলি স্টেটমেন্ট এবং লোন ডকুমেন্টস নিয়ে এস।
--এই তো, চাপরাশি এসে গেছে চা আর গরমাগরম ভাজিয়া নিয়ে। এগুলোর সদ্বব্যবহার হোক, তারপর –।
টেবিলে সব কাগজপত্র এসে গেল। কিন্তু আমরা আগে টমেটো, লাল লংকা আর রসুন পেষা রক্তলাল চাটনি দিয়ে ভাজিয়া থুড়ি বেগুনি আর ফুলুরির সাঁটাতে থাকি। খিদে সব হজম করিয়ে দেয়। এবার কাজ।
দুবে’র নোটস্ দেখে আমি ম্যানেজারকে বলি—ওর ম্যান্ডেট ছিল শুধু ক্যাশ ভেরিফিকেশন। এগুলো কাছাকাছি ব্র্যাঞ্চগুলোর মধ্যে ক্রসচেকের জন্য মিউচুয়াল ভেরিফিকেশন। ব্যস। ওর কাজ নয় লেজার এবং লোন চেক করা।
বুঝি, দুবে এবার আমাদের সঙ্গে প্রমোশনের পরীক্ষায় ক্যান্ডিডেট ছিল, পাশ করেনি। তাই এইসব রোয়াব ঝাড়া ভয় পাওয়ানোর নাটক। এসব তো পাঠককে বলা যাবে না।
বলি—ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কোন প্রেমপত্র আসবে না। আমি হেড অফিস গিয়ে দেখে নেব। কিন্তু ফের যদি টাকা জমা করে ব্যাঙ্কের লেজার জ্বালিয়ে দেয়া বা ফার্নিচার ভাঙার আবদার করেছ তো-- ।
ম্যানেজার দাঁত বের করে।-- না স্যার, আর কাউকে বলব না।
আমার চোখ আটকে যায় একটি লোন ডকুমেন্ট এবং তার লেজারের পাতায়। বিহান নাচা পার্টির( ছত্তিশগড়ি যাত্রার দল) প্রোপাইটর দরসরামকে দশ হাজার টাকা দেয়া হয়েছে দু’বছরের জন্যে। কেন?
--স্যার, ওর নাচা পার্টি বিখ্যাত। আর এবার নতুন পালা লিখেছে, বিষয়ঃ ধানকাটার পর গাঁ থেকে কাজের খোঁজে ছত্তিশগড়ের গরীবগুর্বোর দিল্লি, হরিয়ানা, ভোপাল, রাজস্থানে পলায়ন। গণেশ পুজোর সময় অনেক বুকিং পাবে। আগামী ধানকাটার আগেই লোন বন্ধ হয়ে যাবে।
--সে তো বুঝলাম। কিন্তু কোল্যাটারাল বলতে কিস্যু নেই। কোন অ্যাসেট নেই, প্লেজ নেই। কেবল দুজন অভিনেতার পার্সোনাল গ্যারান্টি। ওরা তো পালার অধিকারী দরসরামের মতই ভবঘুরে। তাছাড়া এগুলো কোন ইকনমিক অ্যাক্টিভিটি নয়। এতে কোন নতুন অ্যাসেট নির্মাণ হচ্ছে না, ঋণীর কোন আয়বৃদ্ধি হবে কিনা সেটা অনিশ্চিত।
কথা না বাড়িয়ে লিখে দিই—এই লোন এগ্রিমেন্ট অনুযায়ী ঠিক সময়ে আদায় না হলে সেটা ঋণদাতা ম্যানেজারের ব্যক্তিগত দায়িত্ব হবে।
পাঠক হাঁ করে তাকায়। ওকে বলি—মনে হচ্ছে তোমার ওরিয়েন্টেশন ট্রেনিং ঠিকমত হয়নি। বল তো, দরশরাম যদি তোমার কাছ থেকে দু’হাজার টাকা ধার চাইতো মাসে মাসে ২০০ টাকা করে ফেরত দেবে বলে—তুমি রাজি হতে?
পাঠকের হাঁ-মুখ বন্ধ হয়।
বলি – ব্যাংকের টাকা খোলামকুচির মত দানছত্র করার জন্য নয়, মনে রেখ।
এবার উঠে পড়ি। পনের কিলোমিটার দূরের একটি আদিবাসী ‘ফার্মার্স সার্ভিস সোসাইটি’ (এফ এস এস) এফ এস এসের আমরা কো-অপারেটিভ ব্যাংকের থেকে দশ বছরের জন্য দত্তক নিয়েছিলাম, সেখান থেকে কমপ্লেইন এসেছে। আমার কাজ ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং এনকোয়ারি।
পাঠককে বলি—ক্যাশ ক্লোজ করে ব্যাংকের রাজদূত মোটরবাইকে করে আমায় সেখানে নিয়ে যেতে। ততক্ষণ ব্যাংকের দায়িত্ব ক্যাশিয়ার সামলে নেবে।
ওখানে পৌঁছে পাঠককে বলি—আমার প্রশ্ন করার সময় তুমি সামনে থাক। একজন সাক্ষী থাকা দরকার।
গিয়ে দেখি যার বিরুদ্ধে নালিশ সেই ম্যানেজিং ডায়রেক্টর (গালভরা নাম, আসলে ইনচার্জ) নিজের কামরায় রয়েছে। কিন্তু নালিশকর্তা স্থানীয় বড় কৃষক, যে আবার ওই সোসাইটির গভর্নিং বডির মেম্বার, সে হাজির নেই। তাকে খবর পাঠানো হল।
এই সোসাইটি স্থানীয় কৃষকদের সাবসিডাইজড্ দরে কেমিক্যাল সার, কেরোসিন, গেঁয়ো ধূতি , জনতা শাড়ি এবং রেশনের চিনি বিতরণ করে।
আমি স্টক রেজিস্টার চেক করি। গত সাতদিন ধরে কোন এন্ট্রি নেই। কিছুই বিক্রি হয়নি কি? প্রশ্নটা করি সোসাইটির ক্লার্ককে। ও জবাব না দিয়ে ইনচার্জের দিকে তাকায়।
ইনচার্জ থুড়ি এমডি’র কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ওমিনমিন করে বলে—সামান্য বিক্রি হয়েছে। দু’দিন বৃষ্টি পড়ছিল। লোকজন আসেনি। তাই খাতায় চড়েনি। আজকেই করে দিচ্ছি।
--যা সামান্য বিক্রিবাটা হয়েছে তার ভাউচার নিয়ে এস।
এবার এম ডি তাকায় ক্লার্কের দিকে। চোখে চোখে কিছু কথা হয়। ক্লার্ক অন্য কামরায় অদৃশ্য হয়।
উত্তেজিত কন্ঠস্বর। বাইরে থেকে হুড়ুম দুড়ুম করে কেউ অফিসে ঢুকছে। মাঝবয়েসি লোকটির পরণে ধুতি আর হলদে পাঞ্জাবি, তার উপরে একটি জ্যাকেট। চোখে রোদ চশমা, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা আর হাতে একটা খেঁটো লাঠি।
উনি রামগোপাল যাদব, হেড অফিসে নালিশ করেছেন। হেড অফিস থেকে এসেছি শুনে গলবস্ত্র ভাব—হুজুর, ন্যায় করুন।
আমি চেয়ার দেখিয়ে বসতে বলি, এক গেলাস জল দেয়া হলে ঢক ঢক করে খেয়ে উনি ঠোঁট মুছে আমার দিকে তাকানোর আগে একবার তীব্র দৃষ্টিতে এমডিকে দেখে নিলেন।
--বলুন, কী হয়েছে? এমডির বিরুদ্ধে অভিযোগটি কী?
--ওসব তো আমি আগেই লিখে দিয়েছি।
--সে ঠিক আছে। তবু আপনাকে আমার সামনে বলতে হবে। আর এমডি সায়েবের কী বলার আছে সে ও শুনব।
আমি ব্রিফকেস থেকে লিফাফা বের করে ওর হাতে লেখা শিকায়ত পত্রটি বের করে সঙ্গের হেড অফিসের জিএম এর চিঠিটি সরিয়ে ব্যাগে পুরি।
তারপর ওই কাগজটি দেখিয়ে বলি—এই চিঠিটি আপনার লেখা? সই আপনি করেছেন? নালিশগুলো সব সত্যি?
উনি মাথা একদিকে কাত করেন।
এমডি চেঁচিয়ে ওঠে—মিথ্যে কথা, ও খালি নাম সই করতে পারে। চিঠিটা অন্য কারও লেখা।
আমি মৃদু ধমক দিই, বলি মাঝখানে কথা বলবে না, শিকায়ত কর্তাকে ধমকাবে না।
তারপর জিজ্ঞেস করলে যাদব বলেন—চিঠিটা উনি ক্লাস ফাইভে পড়া ছোটছেলেকে দিয়ে লিখিয়েছেন, কিন্তু সইটা ওনারই।
--বেশ, আমি পড়ে শোনাচ্ছি, বলুন এটাই আপনার নালিশ কিনা।
তারপর আমি কাগজ খুলে পড়তে গিয়ে হোঁচট খাই, শেষে কর্তব্য পালন করিতে হইবে বলিয়া মনকে প্রবোধ দিই। আজ এরিয়া ম্যানেজারের প্রথম দিন যে!
--“নিবেদন হ্যায় কি আপনাদের বর্তমান এমডি একটি হারামি এবং লুঠেরা। আপনারা ন্যায় না করিলে মজবুর হইয়া আমি পরিচালন সমিতিতে প্রস্তাব পাশ করাইয়া জিলা কালেক্টরের নিকট যাইব।
বলিতে চাহি, গত মাসের ১৭ তারিখ শুক্রবারে আমি আসিয়া এমডি শ্রীমান প্যাটেলকে বলি কেরোসিন বিক্রির সময় ওজনে কম হইতেছে। গ্রাহকদের শিকায়ত। আপনি সতর্ক হউন। কর্মচারীদের উপর কড়া নজর রাখুন। নতুবা ঘোর কলি—।
তাহাতে তিনি নারাজ হইয়া আমাকে ‘মাদারচোদ’ বলিলেন। মায়ের অপমান! উহার মাথা ফাটাইয়া দিতাম। কিন্তু নিজেকে সামলাইয়া ভাবিলাম—ভগবানের রাজত্বে ‘দের হ্যায়, অন্ধের নহীঁ’। তাই এই পত্র পাঠাইলাম।
যাদবব্জী বললেন—অভিযোগ যথার্থ।
--এমডি, আপনি এই ভদ্রলোককে মা তুলে গাল দিয়েছেন?
--ওই আগে গাল দিয়েছে।
--কী বলেছে?
--মাদারচোদ। আমিও এক ব্যাপের ব্যাটা! কেন ছেড়ে দেব? আমিও পালটা দিয়েছি।
ভাল জ্বালা হয়েছে। এইসব রাস্তার গালাগালি উদ্ধৃত করে রিপোর্ট লিখতে হবে?
--তো আপনারা দুজনেই স্বীকার করছেন যে একে অপরকে মায়ের গালি দিয়েছেন। কোন সাক্ষী আছে? এই ঝগড়ার সময় কেউ হাজির ছিল?
এমডি কর্মচারির দিকে তাকালেন। সে চটপট গুডবয় হলে বলল—আমি তো চায়-নাস্তা আনতে গেছলাম।
--বেশ, কোন সাক্ষী নেই। মামলা ডিসমিস্। আপনারা দুজনে হাত মেলান আর বলুন কখনও কাউকে বাপ-মা তুলে গাল দেবেন না। কই, এগিয়ে আসুন, নইলে আমি দুজনের বিরুদ্ধেই রিপোর্ট করব। এখানে অন্ততঃ দু’জন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী রয়েছে ।
যাক শালা! এটা ভালয় ভালয় মিটে গেল। গোল বাঁধল কেরোসিনের স্টক চেক করতে গিয়ে। ড্রামের গায়ে লেখা ২০ লিটার। ওজনে দেখা যাচ্ছে ১৪ লিটার।
--এর ব্যাখ্যা কী এমডি মহোদয়?
--স্যার, খোলা জায়গায় রাখা ছিল। রোদ্দুরে খানিকটা উবে গেছে।
--আচ্ছা? ৬ লিটার বাষ্প হয়ে গেল? ঠিক আছে; আমার রিপোর্টের পর হেড অফিস শোকজ করলে আর কী নতুন ব্যাখ্যা দেবেন এখন থেকেই ভাবুন।
পাঠক আমাকে মোটরবাইকে করে বাসস্ট্যান্ড না গিয়ে সোজা ২০ কিলোমিটার দূরের রেল স্টেশনে পৌঁছে দেয়। আমি কৃতজ্ঞতায় দ্রবীভূত। ট্রেন আসতে কুড়ি মিনিট দেরি। কড়িমিঠি চায়ের ঠোঁট পোড়ানো গেলাসে চুমুক দিতে দিতে জিজ্ঞেস করি—আচ্ছা, এই পশ্চাদপদ গ্রামাঞ্চলে লোকে ইংরেজি মেশানো গাল দেয় কেন? মানে, কী করে শিখল?
--মানে?
পাঠক হেঁচকি তোলে।
--এই যে মা-তুলে -গালি। মাদার তো ইংরেজি, তারসঙ্গে দুই অক্ষরের প্রাকৃত গালির সন্ধি—অবাক লাগে না?
পাঠক হাসিটাকে গিলে ফেলে গম্ভীর মুখে আমাকে বোঝায়ঃ ভুল করছেন স্যার। এখানে মায়ের প্রতিশব্দ ইংরেজি ‘মাদার’ নয়, ফার্সি ‘মাদর’। যেমন মাতৃভূমির ফার্সি এবং ঊর্দূ প্রতিশব্দ মাদর-এ-বতন!
আপনার রিপোর্টে ঠিক করে বানান লিখবেন। বাঙালি কানে অমন শোনায়। আর ওটা সন্ধি নয়, সমাস। বহুব্রীহি। মাদরকে যে অমুক কার্য করিতেছে সে!
ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে। হাত নেড়ে উঠে পড়ি। কাল অফিসে গিয়ে জিএমকে রিপোর্টটা দিয়ে বলব আমাকে যেন ওইসব গালিগালাজ এবং ঝগড়ার এনকোয়ারি না দেয়া হয়, যত্তসব!
(চলবে)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।