ঢাকা গত এক সপ্তাহ ধরে তার ইতিহাসের অভূতপূর্ব এক আন্দোলনের সাক্ষী হয়ে আছে। সূত্রপাত গত ২৯ তারিখ রাজধানী ঢাকার রেডিশন হোটেলের বিপরীত পাসে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে থাকা ছাত্র ছাত্রীর গায়ের উপরে বাস তুলে দিয়ে তৎক্ষণাৎ দুইজন মারা যাওয়া দিয়ে।দুইটা বাস একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করে এসে এই কুৎসিত কাণ্ডটি ঘটায়। মারা যায় শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই জন। ছাত্র মৃত্যু বা বাস দুর্ঘটনা নতুন না ঢাকা শহরে। কিন্তু এই মৃত্যুটা আগুন ধরিয়ে দিল সবার মনে। ঠিক যেমন একটা স্ফুলিঙ্গ শাহবাগ তৈরি করেছিল, ঠিক তেমন। শাহবাগ আন্দোলন তৈরি হয়েছিল কাদের মোল্লার ভি চিহ্ন দেখানোর ফলে। এখানে হয়েছে নৌ পরিবহণ মন্ত্রীর হাসির কারণে। যদিও তিনি নৌ পরিবহণ মন্ত্রী তবুও সড়ক পরিবহণ নিয়ে তাকে মাথা ঘামাতে হয় কারন তিনি বাংলাদেশ পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি। ঘটনার পরে পরেই তাকে এই বেপরোয়া গাড়ি চালানো, দুইজনের মৃত্যু নিয়ে যখন প্রশ্ন করা হল তখন তিনি তেলতেলে হাসি দিয়ে বললেন “আমাদের দেশে এই সব নিয়ে বেশি বেশি হয়, ভারতে কয়দিন আগে ৩৩ জন মারা গেছে, কই সেখানে তো তা নিয়ে কোন কথাবার্তা হয়নি!” জী, এটা একটা মন্ত্রীর ভাষাই ছিল।
দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ল এরপর আন্দোলন। ঢাকার সমস্ত স্কুল কলেজের ছাত্র ছাত্রীরা নেমে এসে গেলো রাস্তায়। এবং গত সাতদিন এই খুদে বিগ্রেডই ঢাকা শহর চালাচ্ছে বলতে গেলে। উত্তাল থেকে মহা উত্তাল অবস্থা ঢাকা শহরের। আস্তে আস্তে সমস্ত রাস্তা ঘাট দখলে চলে গেলো ছাত্রদের। যারা কেউই বয়সসিমা ১৮ পার করেনি। প্রথমে ছিল অবরোধ। পরে শুরু হল গাড়ির ফিটনেস পরীক্ষা করা, চালকের বৈধ কাগজ পত্র পরীক্ষা করা।এবং এরপরেই আন্দোলন অন্য মাত্রা পায় যেন। একে একে ধরা পড়তে থাকে রথী মহারথীদের করুণ চেহারা। বিচারপতির গাড়ির চালকের কাগজ পত্র নাই, গাড়ির কাগজ পত্র নাই। পুলিশের নাই, বিজিবির নাই, ডাক্তারের নাই, সচিবের নাই, মন্ত্রীর নাই এমন কি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গাড়ির কাগজ পত্রও পাওয়া যায়নি গাড়িতে। তীব্র ব্যাঙ্গ বিদ্রূপ চালিয়ে যায় ছাত্ররা। অভূতপূর্ব দৃশ্য তৈরি হয় ঢাকা শহরে। নানান শ্রুতিমধুর স্লোগানে ভরপুর ঢাকা শহর। পুলিশ কে একদম রাস্তার ভাষায় আক্রমণ করে তৈরি ব্যানার অনলাইনে সুপার হিট হয়ে গেছে মুহূর্তেই।
আমাদের দেশের সব কিছুই কেমন যেন অদ্ভুত, আজব।যা স্বাভাবিক তার জন্য আপনাকে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে হবে। মানুষের খুব সহজ স্বাভাবিক চাওয়া হচ্ছে জীবনের নিরাপত্তা। কেউ যুদ্ধক্ষেত্রে জীবনের নিরাপত্তা চাচ্ছে না। স্বাভাবিক ভাবে চলতে ফিরতে নিরাপত্তা চাচ্ছে। ন্যায্য দাবি করছে, বলছে যে বাসের ফিটনেস নাই তা রাস্তায় চলতে পারবে না।যাদের গাড়ি চালানোর বৈধতা নেই তারা গাড়ি চালাতে পারবে না। এই কথা গুলা রাস্তায় নেমে, রোদ বৃষ্টিতে ভিজে পুড়ে বলতে হচ্ছে কেন আজকে? এ তো ট্রাফিক পুলিশের ফরজ কাজ। কিন্তু আমাদের দেশে তা হয় না। যেটা ট্রাফিক পুলিশের প্রথম কাজ বা ফরজ কাজ তা পালনের জন্য রাস্তায় নামতে হচ্ছে বাচ্চা বাচ্চা ছেলে মেয়েদের।
এই রকম একটা আন্দোলন হওয়ারই ছিল। ঢাকার রাস্তা এক মরণ ফাঁদ সবার জন্য। ঢাকার অবস্থা ভয়াবহ।সিটি বাস গুলার আচরণ গুলার ছবি দিয়ে হলিউডের সিনেমা বানানো যাবে অনায়াসে। রেডিসনের সামনে তবু অনেক কম হয়। বনানী, ফার্মগেট, আসাদগেট শাহবাগ এলাকার ছবি তো রীতিমত হরর ফিল্ম কেউ হার মানায় সময় সময়। ঢাকার বাহিরের চিত্রও প্রায় একই রকম। সমস্যা হচ্ছে ঢাকার বাহিরের খোঁজ মানুষ একটু কমই রাখে। ঢাকা কেন্দ্রিক বাংলাদেশ জানে না দৈনিক কি পরিমাণ মানুষ দুর্ঘটনার শিকার হয়। বড় কোন দুর্ঘটনা না হলে পত্রিকার চারের পাতার আট নাম্বার কলামের নিচের দিকে থাকে এই সব সংবাদ। আমরা খোঁজও নিয়ে দেখি না, দেখার প্রয়োজনও বোধ করি না। কোথাও কোন টু শব্দ হয় না। যার কারনে শ্রমিক নেতা তেলতেলে হাসি হাসার সাহস পায়। দিনের পর দিন এই চলে আসছিল।এবার নতুন যোগ হল ভারতে প্রতিবাদ হয়েছে কিনা তা খোঁজ নিয়ে দেখার!!
সমস্যার গোড়ায় হাত দিতে রাজি না কেউ। কেন একটা বাস পাগলের মত পাল্লা দিয়ে রাজপথে চলে? এত এত মিনিবাস সার্ভিস আসলে ঢাকা শহরের জন্য দরকার কিনা তা কেউ ভেবে দেখেছে কি? পরিবহন ব্যবস্থায় কোথাও বিন্দু মাত্র নিয়ম নীতির বালাই নেই। যেমন ইচ্ছা তেমন চলছে, কেউ দেখারও নেই, শোনারও নেই। মাঝে মাঝে আন্দোলন হয়, বিভিন্ন তত্ত্ব এসে পরে, দুইদিন পরে সব কুল!
যে জায়গায় এই দুর্ঘটনাটা ঘটেছে সেই জায়গার ছবি চোখে ভাসছে। কত কতবার বাসে উঠছি ওখান থেকে। দুর্ঘটনাটা যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। কারণ ওইরকম প্রতিযোগিতা করে বাসের ছুটে আসা দেখে লাফ দিয়ে জীবন বাঁচানোর ঘটনা অহরহ আছে। ঢাকাবাসী যারা বাসে চলাচল করে তাদের প্রত্যেকেরই দুই একটা অমন গল্প আছে। বন্ধু রিপনের পায়ের উপরে তো তুলেই দিয়েছিল বাস ফার্মগেটে। ঢাকা শহরে এ নিত্যদিনের চিত্র। এটা যে প্রথম ঘটল তা ভাবার কোন কারণ নাই। অল্পের জন্য বেঁচে যাওয়া বা হাত হারানো পা হারানো ধরনের ছোট ঘটনা জাতীয় জীবনে প্রভাব ফেলে না কিন্তু যার যায় সে বুঝে। রিপনকে কয়দিন আগেও দেখছি খুড়ায় খুড়ায় হাঁটতে।তাই খুব জরুরি ছিল এমন একটা ঝাঁকুনির।
ছাত্ররা নয় দফা দাবি জানালো। দাবি গুলো হচ্ছে -
১। বেপরোয়া ড্রাইভারকে ফাঁসি দিতে হবে এবং এই শাস্তি সংবিধানে সংযোজন করতে হবে।
২। নৌ-পরিবহন মন্ত্রীর গতকালের বক্তব্য প্রত্যাহার করে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইতে হবে।
৩। শিক্ষার্থীদের চলাচলে এমইএস ফুটওভার ব্রিজ বা বিকল্প নিরাপদ ব্যবস্থা নিতে হবে।
৪। প্রত্যেক সড়কের দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকাতে স্পিড ব্রেকার দিতে হবে।
৫। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ছাত্র-ছাত্রীদের দায়ভার সরকারকে নিতে হবে।
৬। শিক্ষার্থীরা বাস থামানোর সিগন্যাল দিলে, থামিয়ে তাদের বাসে তুলতে হবে।
৭। শুধু ঢাকা নয়, সারাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
৮। ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় চলাচল বন্ধ ও লাইসেন্স ছাড়া চালকরা গাড়ি চালাতে পারবে না।
৯। বাসে অতিরিক্ত যাত্রী নেওয়া যাবে না।
দুই একটা বালখিল্য দাবি সত্ত্বেও চোখ বন্ধ করে বলা যায় সব গুলা দাবিই ন্যায় সঙ্গত। সমস্যা শুরু হল যখন সরকারের তরফ থেকে সব মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেওয়ার পরেও ছাত্ররা রাস্তা ছাড়ল না। আরও কড়া করে আন্দোলনের ঘোষণা দিচ্ছিল তারা। এবার রাজধানীতে ঢুকার মুখে চেক পোস্ট বসানো হল। বাচ্চারা বাসের কাগজ পত্র পরীক্ষা করে তবে ঢুকতে দিবে ঢাকায় বাস। অত সহ্য হল না পরিবহন মালিকদের। ঢাকায় বাস প্রবেশ বন্ধ করে দিয়ে বসে থাকলেন। এতে শাজাহান খানের ইশারা ছিল বলে মনে করলেও ভুল মনে করা হবে না। এবার যা হল তা হচ্ছে কার্যত দেশ অচল হয়ে গেলো। কিন্তু যারা সব আগুন গেলার বাসনা নিয়ে হাজির তাদের তা বুঝায় কে? উল্টো দিকে গত দশ বছরে যে সুযোগ বিএনপি জামাত পায়নি তারা যে এই সুযোগ হাত ছাড়া করতে রাজি হবে না তা ছিল স্বাভাবিক। ফলাফল দাবি মেনে নেওয়ার পরেও ছাত্ররা রাস্তায়। হয়ত কখন কিভাবে তাদের আন্দোলন হাতছাড়া হয়ে গেছে তা বাচ্চারা বুঝতেও পারেনি।
এরপরেই ভয়ের জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে এই আন্দোলন। সরকার দাবি মেনে নেওয়ার পরেও তাদের রাস্তায় অবস্থান কে কোন মতেই মেনে নিতে পারে না। তার উপরে পুলিশের প্রতি এই কয়দিনের ছাত্রদের ব্যবহার যে তাদের কে তাতিয়ে রেখেছে তাও সহজেই অনুমেয়। তাই শুরু হয়ে গেল বাচ্চাবাচ্চা ছেলে মেয়েদের উপরে প্রায় বলা যায় ছাত্রলীগ আর পুলিশের যৌথ আক্রমণ। বৃহস্পতিবার মিরপুরে একবার হয়েছে হামলা আর গতকাল দুপুরের পরে জিগাতলায় হয়েছে আরও চরম মাত্রায়। যে ভয়টা পাচ্ছিলাম সেদিকেই দ্রুত যাচ্ছে ঘটনা প্রবাহ। আওয়ামীলীগ দাবি করছে তাদের ধানমন্ডি অফিসে আক্রমণ করেছে, এদিকে জিগাতলায় ছাত্র মারা গেছে ছাত্রলীগের হামলায় বলে দাবি করছে অনেকে। যদিও পরে জানা যায় হামলায় মৃত্যু বা চারজন ছাত্রীর ধর্ষণের যে খবর দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে, তা আদতে গুজব। কিন্তু হামলার খবর, ছাত্রছাত্রীদের আহত হওয়ার কথা সত্য।
এখন কথা হচ্ছে এই পরিস্থিতি তৈরি হল কেন? এর পরিণতি কি হবে তা কেউ ভেবে দেখেছেন? যারা ছাত্রদের উৎসাহ দিচ্ছিলেন রাস্তায় থাকার জন্য তারা নিরাপদে আরাম করে বসে থেকে মুরগী খাচ্ছেন আর রক্ত ঝরছে বাচ্চাদের। ইচ্ছা করে তাদের এই পরিস্থিতির মুখে ফেলা হয়েছে। যে বয়সীরা আন্দোলন করছে তারা মাথায় কতটুকু রাখে তা ভেবে দেখার দরকার ছিল সকলের। এই বয়সের কিছু সুবিধা যেমন আছে ঠিক তেমনই অসুবিধাও আছে। সুবিধা হচ্ছে যা ইচ্ছা তাই করে ফেলা যায় এই বয়সে, অত কিছু চিন্তা করতে হয় না। এর অসুবিধাও এইটাই। ভাল মন্দের তফাৎ বুঝতে পারে না এই বয়স।আলাদা হিরোইজম মনে বাস করে, তার সাথে বাস্তবের মিল খুব কমই থাকে।আর রাজনীতির প্যাঁচ গুজের কথা বাদই দিলাম। সেখানে ধাড়ি ধাড়ি খেলোয়াড়ও শিশু হয়ে যায়। সরকার ভাল, ছাত্রলীগ ভাল আমি এসব কিছুই বলছি না। আমি বাস্তবটা বুঝতে বলছি। বাস্তব হচ্ছে যারা ভেবেছিলেন এই আন্দোলনের ফলে দেশে বিপ্লব তৈরি হয়ে যাবে, রাতারাতি দেশের পরিবহণ খাতের সমস্ত অন্যায়, দুর্নীতি দূর হয়ে যাবে, বাংলাদেশ সুখী সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হবে, গোলা ভরা ধান আর পুকুর ভরা মাছ ভর্তি থাকবে তাদের জন্য সমবেদনা। বাস্তব হচ্ছে আমরা জানি সরকার কিভাবে টিকে আছে ক্ষমতায় এবং এই সরকার যেভাবেই হোক ক্ষমতায় থাকবে, এই ধরনের আন্দোলনকে তোয়াক্কা করার সময় নাই এখন। আর যারা এদের কে ব্যবহার করে অন্য খেলা খেলতে চেয়েছেন তারা খুব খারাপ একটা কাজ করে ফেলেছেন। এবং সম্ভবত তাদের ফাঁদেই পড়ে গেছে ছাত্ররা। সরকারের কথা বাদ দিলাম। যারা সরকারের পতন চায় তারা যদি দুই একটা লাশ ফেলে দেয় এই বাচ্চাদের? তাহলে আন্দোলনের চেহারা কী হবে? সরকার তখন কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখালে তা ন্যায় বলে মনে হবে? আমার জানা নেই।
পরিস্থিতি বিবেচনায় মনে হচ্ছে জরুরি অবস্থা ঘোষণাও করে বসতে পারে সরকার। সরকার তার স্বার্থে যা করার তাই করবে। এখানে আবেগ দিয়ে চিন্তা করে লাভ নাই। চিন্তা করতে হলে বাংলাদেশকে বুঝতে হবে, ঢাকাকে বুঝতে হবে। এই কয়দিনে যতটুকু অর্জন ছিল এই আন্দোলনে তা সম্ভবত হারাতে যাচ্ছে তাদের হঠকারী সিদ্ধান্তের কারণে।
এই অভূতপূর্ব আন্দোলনের প্রতিটা যোদ্ধার নিরাপদে বাড়ি ফিরে যাওয়ার, মায়ের কোলে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রার্থনা করি। ঢাকা ছেড়ে আসার পর অনেক কিছু নিয়ে মাঝে মধ্যে আফশোস হয়। বড় আফশোস থেকে গেল এই আন্দোলনে শরিক না হতে পারাটা। নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলন বেঁচে থাকুক আমাদের প্রতিটা সড়ক নিরাপদ হওয়া পর্যন্ত।