এবারের দুর্গাপূজায় যা হয়ে গেল বাংলাদেশে, তা নিয়ে বলতে হলে কোথা থেকে শুরু করব? সেদিনের ঘটনা থেকে? কুমিল্লার পূজামণ্ডপে কোরান শরীফ রাখা হয়েছে, সকালে আগে থেকে তৈরি থাকা লোকজন সেই কোরানকে ঘিরে মুহূর্তে পরিবেশ ঘোলা করে ফেলল। পুলিশ আসল, কোরান নিয়ে যাওয়া হল। ইন্টারনেটের যুগে এই খবর ছড়িয়ে পড়তে কয়েক পলক হয়তো লেগেছে। যারা ফাঁদ পেতে এই মুহূর্তের সৃষ্টি করল, তারা তাদের কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে গেল। মণ্ডপ ভাঙচুর হল, প্রতিমা ভাঙা হল। পুলিশ মোটামুটি সেখানকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক করল। কিন্তু কেন জানি, কর্তাব্যক্তিরা পুরো চিত্র দেখতে পেল না। সেদিন পার হলেও, পরের দিন থেকে শুরু হয়ে গেল বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রদায়িক শক্তির আস্ফালন, শক্তি প্রদর্শন। চট্টগ্রাম, ফেনি, চাঁদপুর রণক্ষত্রে পরিণত হল। হিন্দুদের বাড়ি পুড়ল, হতাহত হল, মন্দির ভাঙা হল। পরেরদিনও জারি থাকল এই কাণ্ড। ১৫ অক্টোবর, দশমীর দিন, সমস্ত হিসাব নিকাশ পাল্টে গিয়ে, কুরুক্ষেত্রে পরিণত হল নানা জায়গা। অনেক জায়গায় সকাল সকাল প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে নিরাপদে থাকতে চেয়েছে অনেকেই। কিন্তু সবাই তো আর নিরাপদে থাকতে পারে না। দিনভর চলেছে পিশাচ-নৃত্য। সারা দেশে নানা জায়গায় শুরু হয়ে গেল ধ্বংসলীলা। এর ভিতরে রংপুর আরও এগিয়ে গেল। পুরো একটা গ্রাম জ্বালিয়ে দিল ধার্মিক পরিচয় দেওয়া পিশাচেরা।
আমি সেখান থেকেই শুরু করব? শুরু কি কুমিল্লা থেকেই হয়েছিল? এর বীজ কি আগে পোঁতা হয়নি? এখন যে মহীরুহ দেখছি, যার শিকড় কত গভীরে পৌঁছেছে তার কোন হিসাব নেই, তার কথা না বললে বলা হবে পুরো কথা?
ডঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল প্রায়ই একটা কথা বলেন। তিনি বলেন, একটা দেশ কেমন তা জানতে হলে, সেই দেশের সংখ্যালঘুরা কেমন আছে তা জানতে হবে। আমাদের দেশের সংখ্যালঘুরা কেমন আছে? এখানেই লজ্জায় মুখ লুকাতে হয় সংখ্যাগুরুর। আমারা ভাল রাখতে পারিনি আমার প্রতিবেশীকে। নানা প্রতিবেদন, গবেষণা প্রমাণ করছে যে আমরা কত যত্ন করে দেশের বিশাল একটা অংশের মানুষকে স্রেফ দেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছি। গবেষণা বলছে, প্রায় একটা দেশের মত জমি আমরা দখল করেছি শুধু মাত্র দেশছাড়া করেই! কত চমৎকার না ব্যাপারটা? এই যে পরিস্থিতি – তা হুট করেই তৈরি হয়েছে? আকাশ থেকে নাজিল হয়েছে গজব?
সংখ্যাগুরুর পায়ের পাতা থেকে মাথার চুল পর্যন্ত নানা অনুভূতি। পোশাকে অনুভূতি, জুতাতে অনুভূতি, চোখের দৃষ্টিতে অনুভূতি। পান থেকে চুন খসলে এই সব অনুভূতি আঘাত প্রাপ্ত হয়। সেই সংখ্যাগুরুর ধর্ম-অনুভূতি কত শক্তিশালী হতে পারে? এখানে পান থেকে চুন খসা অনেক বড় ব্যাপার – পান আর চুন নেওয়া পছন্দ না হলেও কারো কারো অনুভূতিতে আঘাত লাগতে পারে!
অন্যদিকে সংখ্যালঘুর কোন অনুভূতি নাই। পেটে নাই, রক্তে নাই, ঘরবাড়ি কোথাও কোন অনুভূতি নাই। এই যাদের অবস্থা, তাদের আবার ধর্মের অনুভূতি? এগুলা বিলাসিতার পর্যায়ে চলে গেছে এখন। এখন অবস্থা হচ্ছে – ভিক্ষা চাই না মা, তোর কুত্তা সামলা!
আমি ব্যক্তিগতভাবে পূজার সময়টাতে আমার শহরে ছিলাম না। কিন্তু খুব মিস করতেছিলাম আমার জেলার, আমার শহরের পূজাকে। তড়িঘড়ি করে উপস্থিত হলাম অষ্টমীর রাতে। সন্ধ্যায় যখন আমি শেরপুর পৌঁছাই, তখন শহরে পা দিয়েই বুঝলাম, কোথাও একটা তার কেটে গেছে। আমাদের ছোট শহরে প্রায় পাঁচশ’ পূজামণ্ডপে পূজা হয়। পূজার কয়টা দিন শহরে পুলিশ আমাদেরকে রিকশা নিয়ে ঢুকতে দেয় না। আগেই নামিয়ে দেয়। সবাই রিকশা বা অটো নিয়ে শহরে ঢুকলে শহর জ্যামে একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে। তাই এই বুদ্ধি। আমি বাস থেকে নেমে, বাড়ি না গিয়ে আগে শহরে ঢুকলাম। অষ্টমীর দিন রাতে বেধুম মজা হয়, আমি সেই মজা কোনোমতেই হারাতে চাইনি। কিন্তু আমি শুরুতেই বুঝলাম সব স্বাভাবিক না। মানুষ আছে কিন্তু নাইও। যে পরিমাণ মানুষ আমরা দেখে অভ্যস্ত, তার সিকিভাগ মানুষ নাই শহরে। আমার বুঝতে খুব একটা দেরি হয়নি। কুমিল্লার ভূত এসে হাজির হয়েছে এখনেও। তীব্র রাগ হল। কিন্তু কিছুই করারও নাই। আমি জানি শহর হিসেবে শেরপুর বেশ শান্ত। এখানে তেমন কিছু হওয়ার ভয় নাই, যার জন্য আতঙ্কিত হতে হবে কাওকে। কিন্তু আমি তো ভাগ্যগুণে সংখ্যাগুরুর দলে, আমি কি জানি একজন সংখ্যালঘুর মনে কী চলছে? কোনোদিন জানা সম্ভব? একটা সময় পর্যন্ত আমি মানতে চাইতাম না। আমি বলতাম – আরে দেশ তোর, মাটি তোর, কেউ কিছু বললেই কাঁটাতার পার হতে হবে? আমাদের উপরে জুলুম হয় না? আমরা দৌড় দেই? আমরা এখানেই দাঁতে কামড় দিয়ে পড়ে থাকি; জীবন যায় তবুও এখানেই জীবন দেই – আমাদের যাওয়ার জায়গা কই? তোরা কেন পারস না? এগুলা কত বেহুদা কথা, তা যদি জানতাম! আমার উপরে জুলুম হয় যে কারণে, সেই কারণে তাঁদের উপরেও হয় জুলুম। তাঁদের সাথে যুক্ত হয় আরেকটা বাড়তি বিষয়, তুই সংখ্যালঘু! তুই হিন্দু, তুই ভাগ এখান থেকে! এই অনুভূতি আমার বুঝে আসা সম্ভব? আমি কোনোদিন বুঝতে পারব, ঈদের দিন কেউ এসে ঈদের নামাজে আক্রমণ করে নামাজ ভণ্ডুল করে দেওয়ার অনুভূতি? সংখ্যাগুরুর মস্তিষ্ক দিয়ে সংখ্যালঘুর অনুভূতি বুঝা মুশকিল। খুব বেশি হলে আমি আমার জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়ে বুঝতে পারি, যে একটা অন্যায় হচ্ছে। কিন্তু অনুভূতি বুঝি কী দিয়ে?
প্রতিবার পুজা শুরুর আগে আমি মনে মনে শঙ্কিত অবস্থায় থাকি। মনে মনে কামনা করতে থাকি, এবার কোথাও কোন গণ্ডগোল হবে না। এবার অন্তত পুরো দেশের সকল মানুষ উৎসবে অংশ নিবে, মনের কোথাও কোন দ্বিধা, কোন তিক্ততা থাকবে না, কোন অজানা ভয়ে কেউ শিউরে উঠবে না। আমি পাপীতাপী মানুষ, আমার চাওয়ায় কোনো কিছুই হয় না। প্রতিবারই তাই কোথাও না কোথাও, কেউ না কেউ, বিপুল বিক্রমে ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে লেগে যায়। ঈদের দিন কেউ ঈদগায়ে ময়লা আবর্জনা ফেলে দিয়ে আসল, ক্যামন লাগবে? উৎসব চলছে, কেউ অবিশ্বাস্য অভিযোগ এনে বেধুম পিটুনি দিল আপনাকে, ক্যামন লাগবে? আমরা জানি না। আমরা এই দেশে সংখ্যাগুরু, আমাদের বোধের বাহিরে এই সব। কিন্তু আমাদেরই প্রতিবেশী, আমাদেরই বন্ধু বান্ধবদের প্রতি বছর এমন অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে যেতে হয়। এর চেয়ে লজ্জার কিছু হতে পারে? আমার মন প্রতিবারই কুঁকড়ে যায়, যখন শুনি কোথাও আঘাত হেনেছে শকুনেরা। আমার মনে হয় প্রত্যেক হিন্দু বন্ধুবান্ধব, ভাইবোনদের কাছে গিয়ে করজোড়ে ক্ষমা চাই আমি। এই দায় আমাদের, এই লজ্জা আমাদের। দিনের পর দিন অদ্ভুত এক পিশাচ নেচে যাচ্ছে আমাদের সামনে, আমরা দেখেও দেখি না, শুনেও শুনি না। আর ধীরে ধীরে এদের শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর দায় আমাদের নিতে হবে না? সরকার কিছু করল না বলে বসে থাকার সময় আছে? রক্তের বিনিময়ে পাওয়া দেশ, কারো দয়া-দক্ষিণায় পাওয়া দেশ না। এত সহজে মৌলবাদের উত্থান মেনে নেওয়া যায়? এর জন্য দেশ স্বাধীন হয় নাই। এর জন্য মুক্তিযুদ্ধ হয় না। মৌলবাদের জন্য জর্জ হ্যারিসন গান গায় নাই, এই দেশের জন্য জ্যঁ ক্যুয়ে বিমান ছিনতাই করে নাই, এমন দেশের জন্য বাল্টিমোরে সাধারণ মানুষ পাকিস্তানের জাহাজ আটকে দেয় নাই। ভিন্ন-ধর্মাবলম্বীদের তাদের ধর্ম পালন করতে দিবেন না – এমন দেশের জন্য কোনো মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধ করে নাই। রক্তের হিসাব দিতে গেলে, দাম হিসাব করতে গেলে দেখা যাবে সবচেয়ে বেশি রক্ত দিয়েছে হিন্দুরাই। আজকে রেডিমেড দেশ পেয়ে ধর্মশিক্ষার ক্লাস নিচ্ছে জারজেরা!
লজ্জার এই দিন একদিনে আসেনি। ক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছে, জমিতে পানি দেওয়া হয়েছে, হাল চাষ করা হয়েছে, বীজ রোপা হয়েছে। বৃক্ষ বড় হয়েছে, এর শেকড় পৌঁছে গেছে কতদূর আমরা জানি না। আমরা সব দেখেছি। অদ্ভুত এক কারণে আমরা কিছুই করিনি। আমরা মেনে নিয়ে চুপ করে দেখেছি। বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনোযোগ সরিয়ে রেখেছি। হেফাজতের মত দলকে সরকার যেভাবে পারছে সেভাবে সাহায্য করে গেছে। হেফাজতের নেতারা খুশি হয়ে সরকার প্রধানকে কওমি জননী উপাধি দিয়েছে। কওমি জননী উপাধিও রক্ষা করতে পারেনি, দুই দিন পরেই সরকার পতনের আন্দোলনে ডাক দিয়েছে এই নেতারা। কে কোন মন্ত্রণালয় নিবে – এই দ্বন্দ্বে ক্ষমতা আর নেওয়া হয়নি। এই যে মৌলবাদকে মাথায় তোলা, এর দায় কে নিবে? সব বিরোধী দলের ষড়যন্ত্র বলে পার পাওয়া যাবে? বিএনপি ক্ষমতা ছাড়ছে সেই ২০০৬ সালে! দুই বছর তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেশ চালানোর পর থেকে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায়। এখনও যদি বিএনপি জামাতের কথা শুনতে হয় তাহলে বিপদ না? তারা ক্ষমতার জন্য নানা কাণ্ড করবে, তা প্রতিহত করবে কে? কোরান রাখার পরে যখন পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছিল, একটা বড় গণ্ডগোলের দিকে যাচ্ছে, তখন প্রশাসন কেন সেই নাশকতা ফেরাতে ব্যর্থ হল? প্রায় ঘোষণা দিয়ে আক্রমণ হল মন্দিরে – যে প্রশাসন ব্যর্থ হল এই আক্রমণ প্রতিহত করতে, তাদের কোথায়, কোন আলমারিতে রাখা উচিত?
প্রশাসনের ব্যর্থতা নিয়ে কোন দ্বিমত নাই। কিন্তু ওই যে বললাম একটু আগে শিকড় – এই শিকড় কত গভীরে পৌঁছে গেছে – তার খোঁজ যদি কেউ না নেয়, তাহলে সরকার বেটে তাবিজ করে গলায় ঝুলিয়ে দিলেও কোনোদিন এর সমাধান হবে না।
অশিক্ষিত জনগোষ্ঠী আমাদের এই সমস্যার সবচেয়ে বড় উপাদান। যারা শিক্ষিত, তারাও মানসম্পন্ন শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছে, এমন কথা জোর গলায় বলতে পারা যাবে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবর্তন পড়ানো হয় এই কথা বলে, যে এগুলা সব ভুয়া, পরীক্ষার জন্য পড়, বিশ্বাস করার দরকার নাই! আরেকদিন দেখলাম, কোন শিক্ষক শুধু ক্লাসে ইভল্যুশন শব্দটা বলেছে সাথে সাথে একজন উঠে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে, যে ইভল্যুশন নিয়ে কথা বলা যাবে না – এগুলা বলা হারাম! অন্ধকার কত তীব্র বুঝা যাচ্ছে?
মৌলবাদকে আপনি রুখবেন কী দিয়ে? সংস্কৃতিক আন্দোলন ছাড়া সম্ভব? এই দিক দিয়ে আমরা দিনদিন নির্জীব হয়ে যাচ্ছে। যার ফলে মৌলবাদী শক্তির পক্ষে মাথাচাড়া দেওয়া সহজ হচ্ছে। যে ছেলে পাড়ায় গান বাজনা, নাটক নিয়ে মজে থাকত, তাকে বুঝানো কষ্টকর হত যে ধর্মের নামে অমুকের বাড়ি জ্বালিয়ে দেও। আমাদের দুর্দান্ত সামাজিক পরিবেশটা আমরা নষ্ট করেছি। বা কেউ পরিকল্পিত ভাবে নষ্ট করেছে, আমরা ধরতেই পারিনি – যে কেউ কলকাঠি নেড়ে এই সব বন্ধ করছে। শীতের আগমনী বার্তা পাওয়ার পরেই দেখতাম পাড়ার বড় ভাই বোনেরা কী থেকে কী দিয়ে নাটকের আয়োজন করছে। কারো একজনের বাসায় চলছে মহড়া। আমরা ছোটরা চোখ বড় বড় করে দেখছি তাদের কাণ্ডকারখানা। আমাদের আশেপাশে অন্তত দুই চার বাড়ি পরে পরেই এমন বাড়ি পাওয়া যেত যাদের বাসায় হারমোনিয়াম আছে, কিছু হোক বা না হোক চেষ্টা চলত সঙ্গীত চর্চার। দরাজ গলায় আবৃত্তি শুনার অভিজ্ঞতা তো আমার ঢাকা গিয়ে হয়নি, তা তো আমার বাড়িতেই হয়েছে। চমৎকার আবৃত্তি করতেন মেজোপা, মনে আছে পুরো বিদ্রোহী কবিতা মুখস্ত ছিল উনার। আমার দাঁত লেগে যেত পড়তে গেলেই আর উনি এক টানে বলে যাচ্ছেন!
টাউন হলে সর্ব প্রথম মঞ্চ নাটক দেখেছিলাম আমাদের শেরপুরের পেশাদার থিয়েটার মোস্তফা থিয়েটারের। এতদিন পাড়ার ছেলেমানুষী জিনিস দেখে যখন মঞ্চের প্রকৃত চেহারা দেখলাম, তখন আমার সে কী শিহরণ! সবাইকে চিনি, তাঁরা কেমন পাল্টে গিয়ে চরিত্রের ভিতরে চলে যাচ্ছে! এই সব অলীক গল্প এখন। সমস্ত থিয়েটার বন্ধ। সর্বশেষ কবে মঞ্চনাটক হয়েছে, তা আমরা কেউ বলতেই পারি না।
টাউন হলে আরও কত কি হত। উপস্থিত বক্তৃতা, নাচ, বিতর্ক, নানান কুইজ! এগুলা সরকারি নানা আয়োজনের বাহিরেই হত। এখন সরকারিগুলোই হয় কি না, জানি না আমি।
আমার শহর পিছিয়ে আছে আর সব জায়গায় জোরেশোরে চলছে সব কিছু? না। মঞ্চনাটক ঢাকায় বন্দী হয়ে রয়েছে। মূলত সাংস্কৃতিক আন্দোলন যা বা যেটুকু টিকে আছে তা ঢাকাকেন্দ্রিক। আর ঢাকা, বাংলাদেশ না।
আমার কাছ থেকে সংস্কৃতি কেড়ে নিয়ে কী দেওয়া হল? আমাদের জন্য বহাল করা হয়েছে ওয়াজ! নানান কিসিমের বক্তা তৈরি হয়েছে। এক সময় সাইদি একা ছিল ওই মাঠের সুপার স্টার। এখন শত শত সাইদি। এরা মনের সুখে নিজেদের মত করে ধর্ম বয়ান করে চলছে। শীতের এই কয়দিন কোনো রোগী থাকতে পারবে না, বিধর্মীদের কানে তুলো দিয়ে থাকতে হবে, এখন কেউ শব্দদূষণ ধরনের কথা বলতে পারবে না। রোগী হোক বা ধর্মীয় কিছু হোক, এদের বিরুদ্ধে কিছু বললে ব্লাসফেমি হয়ে যাবে! কারো না কারো, কোথাও না কোথাও আঘাত লেগে যাবে! দেশ তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে তো এদের জোরেই! চিরশান্তির দেশ না আমাদের? প্রতি বছর দুর্নীতিতে প্রথম হওয়ার জন্য তীব্রভাবে চেষ্টা করি আর এই দেশেই ধর্মের অবমাননা হয় বলে প্রাণ যায় নিরীহ মানুষের।
বই পড়া তো আমরা পাপ বলে মনে করি। এইটা নিয়ে বেশি কিছু বললে মানুষ বিরক্ত হয়ে চলে যেতে চায় এদিক সেদিক। আরে, তুমি পড় না! সবাইকে বই পড়তে হবে কেন? জানার কিছু হলে গুগল করব, না হয় তোমাকেই জিজ্ঞাস করব, বই পড়তে হবে কেন? আমরা বই পড়ি না, বইয়ের আর বইয়ের লেখকের নাম মুখস্ত করি। এইটা লাভ, এতে লাভ আছে, চাকরির পরীক্ষায় কাজে লাগে। বই পড়তে হবে কেন? একজন সরকারি কর্মকর্তা আমার হাতে চিলেকোঠার সেপাই দেখে বলেছিল, এই বই তুই পড়ছস? উনার আরেকটা উপন্যাস আছে না? খোয়াবনামা? আমি আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলাম, ও পড়ছে কিনা? সে উত্তর দিছিল, আরে নাহ্! মুখস্ত করছিলাম চাকরির পরীক্ষার জন্য! এ যেন সহজ স্বীকারোক্তি, আমি যুগান্তরী নই! অতএব বই পড়ার দরকার নাই। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের জন্ম কোথায়, কত সালে, এগুলা কি আমি জানি? তারা জানে এবং তারা সরকারি কর্মকর্তা! লাভ কোনটা – হাড্ডি খিজিরকে চেনা, না দুধ ভাতে উৎপাত কার লেখা তা মুখস্ত করা? বই পড়া বন্ধ এই দেশে। বই পড়া ছাড়া অন্ধাকার দূরের আর কোনো রাস্তা আমার জানা নাই।
প্রসঙ্গ থেকে দূরে সরে এসেছি মনে হয়। নব্বইয়ে লজ্জা লিখে তসলিমা নাসরিন দেশ ছাড়া হয়েছিলেন। লজ্জার যে গল্প, তা থেকে এত বছরে কতদূর আসতে পেরেছি আমরা? কুমিল্লার ঘটনা কি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে না, যে আমরা সেখানেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছি কিংবা আরও পিছনে দৌড়াচ্ছি?
আশার আলো দেখা যায় কোথাও? প্রশাসন এখন পর্যন্ত প্রচুর মামলা আর আসামি ধরেছে। কুমিল্লার ঘটনার মূল কারিগর ইকবাল আর তার সহযোগীদের ধরেছে। কিন্তু কারা তাদেরকে উস্কে দিল, কাদের প্ররোচনায় এই কাণ্ড করা হল, তার ব্যাপারে খুব একটা কিছু আমরা জানতে পারিনি। বিপদ এখানেই শেষ হলে বেঁচেই যেতাম আমরা। সমস্ত আসামিদের ধরলেই কি এই বিপদ থেকে মুক্তি লাভ হবে? সাধারণ মানুষের মগজে যে বিষ সেই বিষের চিকিৎসা কই? শখ করে যারা বিষ নিয়ে ঘুরছে, তাদের থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় কী?
আমার জানা নাই। প্রতিবার একটা ঘটনা বা দুর্ঘটনা ঘটার পরে আমরা লেখালেখি করি, ঢাকাবাসী মিছিল করে, মানব বন্ধন করে শাহবাগের রাস্তা আটকে, টিএসসিতে তীব্র প্রতিবাদ হয়। পত্রিকায় শিরোনাম হয়। কিছুদিন পরে সব স্বাভাবিক। মানুষ ক্রিকেট, মেসি, রোনাল্ডো, বার্সা-রিয়েলে ভুলে যায়। আবার একজনের ঘরে আগুন দেওয়া হলে, একজন সব হারিয়ে সর্বস্বান্ত হলে, আবার কোন প্রতিমা ভাঙা হলে, কোথাও কারো রক্তপাত হলে আমাদের স্মরণ হয় যে আমরা একটা অন্ধকার সময় পার করছি। অন্ধকার আমাদের এমন ভাবে সয়ে গেছে, যে আমরা এখন আর আলো-অন্ধকারের পার্থক্য বুঝি না। আলোই দেখি না বলে হয়তো বুঝি না।