
আজকাল বড়ো আলোর আধিক্য এই প্রাচীন নগরী আর পাশের দুটো উপনগরীতে । বিকেল হতে না হতে পার্কে পার্কে জ্বলে ওঠে আকাশছোঁয়া বাতিদানে বিশাল মেটাল হ্যালাইড। রাস্তায় রাস্তায় পেঁচানো সাদা আর নীল এল ই ডি ।“ মা “ফ্লাইওভার দিয়ে চিংড়িঘাটা নামতে গিয়ে চোখ ধাঁধিয়ে যায়, যেমন যায় নিউ টাউন রাজারহাটের ভেতর দিয়ে এয়ার পোর্টের দিকে যেতে গেলে। একবার ত্রিফলা আলোয় সেজে উঠল জনপদ। খুব বেশীদিনের কথা তো নয়। এরই মধ্যে দেখি প্রায় সব ত্রিফলা ভাঙা , আমার তল্লাটে তা এখন রঙচঙে বাগানের ঢঙে ভর্তি । জানি , দুদিন পর এ ঢঙও আবার ফিকে হয়ে যাবে। কিন্তু আলোহীন ন্যাংটো কাঠামোগুলিকে আমার লাগে যেন যীশুর অপেক্ষায় ক্লান্ত ক্রসের মতো নিষ্ঠুর ।
এক শীতের দিন ভোর চারটেয় ওই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম একজনকে বিমান বন্দরে পৌঁছে দিতে। ঠেলায় করে ভোর ভোর সবজি নিয়ে যাওয়া দুচারজন দেহাতী মানুষ ছাড়া কেউ কোত্থাও নেই, কুয়াশার ভেতর লি লি করছে নীল সাদা আলো , আর বহুদূরে ভুতের মতো দাঁড়িয়ে কামদুনীর মেয়ের কলেজ, মনে হয়েছিল ,আহা মেয়েটির ফেরার রাস্তায় আলো থাকলে হয়তো –
মনে হয়েছিল আরো অনেক কিছু , এতো অপচয় কেন , এতো আলোর কিছু ক্ষতিকর প্রভাব আছে কিনা পরিবেশের ওপরে । কারণ নিজেই দেখেছি বাড়ির সামনের পার্কে মেটাল হ্যালাইড ঘেঁষা যে কদম গাছ তাতে বরষাকাল ছাড়াও সারা বছর কুঁড়ি আসছে, আর একটি কুঁড়িও ফুলে পূর্ণতা পাচ্ছে না, সবুজ থেকেই ঝরে পড়ছে । আরো অদ্ভুত ব্যাপার দেখি , ফিঙের মতো কালো পুঁছওয়ালা রোগা রোগা পাখি সারা রাত ছোঁ মেরে বাতিদানের কাছে ওড়াউড়ি করা পোকা গেলে গবগব , তারপর সারাদিন কি ঝিমোয় ? মেটাল হ্যালোইডের বিশাল উঁচু স্তম্ভের মাথার গোল করে লাগানো কতো যে আলো ,নীচে দাঁড়ালে মনে হয় হাল্কা তাপের ঢেউ নীচে নেমে আসছে। হয়তো সেটা মনের ভুল , কিন্তু শীতকালে মর্ণিং ওয়াকে গিয়ে নজর করেছি মাঠের অন্য অন্য জায়গায় ঘাসের আগায় শিশির জমে থাকলেও আলোর ছাতা যতদূর ছায়া দেয়, ঠিক ততোদূর গোল করে ঘাস শুকনো কেঠো । যেন আকাশ বেছে বেছে ওই জায়গাটুকুকেই ষড়যন্ত্র করে শিশিরবঞ্চিত করেছে । তা তো নয় , আসলে প্রখর তাপে ওখানের শিশিরটুকু আগেই বাষ্প হয়ে যায় । তাতে কিছু যেত আসত না , যদি না একধরণের গান গাওয়া পাখির খাদ্যই না হত ভোরের শিশিরকণায় লুকিয়ে থাকা ছোট ছোট পতঙ্গ । খাবারও ওই , খাবার সময়ও ওই । বোঝাই যায় যত মেটাল হ্যালাইড , ততো ওই পাখির অপমৃত্যু ।
এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে যেটুকু জেনেছি বুঝেছি , রাতের ঘুম কেড়ে নেবার পক্ষে যথেষ্ট। অপ্রয়োজনীয় ও চড়া আলো বর্জনের পক্ষে যখন বিজ্ঞান ও সচেতনতা , তখন আমরা পিছু হেঁটে চলেছি বেশ সচেতনভাবেই। মাত্রাতিরিক্ত আলোতে বৈপরীত্যের ( contrast ) জ্ঞান হারিয়ে ফেলে মানুষ । চালক বা পথচারী দুইই হতে পারে এর শিকার । রাতকানা হয়ে পড়ে অধিকাংশ পশুপাখি। কোন নিরিবিলি জায়গায় সহর থেকে দূরে গেলে বোঝা যায় রাতের আকাশ কখনোই নিশ্ছিদ্র অন্ধকার নয়। ঘুটঘুটে অমাবস্যা রাতেও আকাশের গায়ে লেগে থাকে এক আভা। এই নিজস্ব আলোভাবের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় না গিয়েও সাধারণভাবে বলা যায় ভাসন্ত ধূলিকণায় বিচ্ছুরিত সূর্যাস্তের আভা ,দূরান্তরের তারা ও ছায়াপথ থেকে আসা আলোর রেশ রাতের আকাশকে পুরোপুরি অন্ধকার হতে দেয় না কখনোই। এই আলো উন্নয়নের চাপে হারিয়ে যাচ্ছে । এখন পৃথিবীর এক তৃতীয়াংশ মানুষ খালি চোখে ছায়াপথ দেখতে পায়না। সেটা বিষম ক্ষতি বলে যদি নাও মনে হয় , পৃথিবীতে বাস্তুতন্ত্রের যে ক্ষতি হচ্ছে তা কিন্তু অপূরণীয় । ওই আলোর রেখা ধরে পথ চলে ( navigate ) এমন পশুপাখীর সংখ্যা খুব বেশি । চাঁদের আলোয় রাস্তা চেনে এমন প্রাণীও কম নেই । তীব্র আলো তাদের চোখ ধাঁধিয়ে রাস্তা ভুলিয়ে দিচ্ছে এমনটি ঘটছে আকছার । যেমন অলিভ রিডলে প্রজাতির কচ্ছপেরা । আজ থেকে বছর বিশেক আগে একদল সমাজকর্মীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে মেরিনা বীচে অলিভ রিডলের সদ্য ডিমফোটা ছানাদের উদ্ধার করতে নেমেছিলাম । ডিমের খোলা ফটানোর পর ওদের প্রথম কাজ হয় তুরতুরে ঘাড় ঘুরিয়ে স্কাইগ্লো বা আকাশের নিজস্ব আলোটুকু খুঁজে বার করা । সমুদ্র যেখানে শুয়ে আছে ,সেখানে দিগন্ত-আলো থাকবে সমুদ্রে লগ্ন এটাই স্বাভাবিক । ওরা সেই আলোর আভাসে চলতে চলতে নিজেদের নরম শরীরগুলোকে ভাসিয়ে দেয় ঢেউয়ে । এটা যে করতে হবে বাচ্চাগুলোর জিনে এই নির্দেশ লুকিয়ে আছে। এখন সৈকতের চড়া আলোর শক্তি এতো বেশী যে চোখ ধাঁধিয়ে বাচ্চাগুলো চলতে শুরু করে একেবারে উল্টোবাগে ,যেদিকে শহরের কৃত্রিম আলোর ছটা সেদিকে । এইবার মহাভোজে নামে শেয়াল কুকুর । মানুষের পদপিষ্ট হয়ে মরে অনেক । তাই বাচ্চাগুলোকে ঝুড়িতে তুলে ঢেউয়ের দুলুনিতে ভাসিয়ে দিতে পেরে খুব আনন্দ পেয়েছিলাম । শুধু অলিভ রিডলে নয় , বেশির ভাগ সী টার্টলদেরই এই নিয়ম । তাদের কাছ থেকে দিগন্ত-আলো কেড়ে নেওয়া যায় ?
সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী হবার অহংকার যদি সব ঝোল নিজের কোলে টানতে চায় তাহলে তিল তিল করে গড়ে ওঠা বাস্তুতন্ত্রের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী । কেবলমাত্র রাতে ফোটে যারা এইরকম ফুলের বেশিরভাগের পরাগমিলন ঘটে রাতচরা মথের সাহায্যে । এই মথেরা পথভ্রষ্ট হয় চড়া আলোতে। পরিযায়ী পাখির ঝাঁক যেখানে পৌঁছবার কথা তার উল্টোবাগে উড়তে থাকে। এককথায় সব উল্টোপাল্টা করে দিতে পারে কৃত্রিম আলোর অপব্যবহার । নবারুণীয় ভাষায় “জগত জোড়া হলুদ হ্যালোজেনের আলো” এড়িয়ে চলাই ভালো।
কারণ শুধু প্রকৃতি নয়, মানবদেহ আর মনের ক্ষতিও তো কম হয়না।পুলিশ লক আপে অন্ধকারে কেন অভিযুক্তের চোখ বরাবর চড়া আলো জ্বলে তার কারণখানি খুবই বৈজ্ঞানিক । রাতজাগা চোখে চড়া আলো মনকে চঞ্চল এবং অবসাদগ্রস্ত করে ।খুব মারাত্মক হতে পারে এই মুড সুইং । শুরু হতে পারে ক্রনিক মাথাব্যথা , অল্প কাজেই ক্লান্তি ,স্ট্রেস , যৌন অক্ষমতা । নাইট শিফটের কাজে আলোর নীচে অনেকক্ষণ থাকলে ব্রেস্ট এবং প্রস্টেট ক্যান্সারের সম্ভাবনা তৈরি হয় । হরমোন ক্ষরণে গড়বড় দেখা দিতে পারে ।
এগুলো সবাই জানে । প্রশাসনে পরিবেশদূষণ নিয়ে ভাবার জন্য রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় স্তরে আলাদা মন্ত্রক রয়েছে । তবু নগরীর এই চটুল সাজ কেন ? কেন প্রয়োজনের থেকে অনেক বেশি আলো , চড়া আলোর মালা দুলছে চতুর্দিকে ? এর উত্তর নিহিত আছে এ রাজ্যের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থায় । ২০১২-১৩ তেই এখানে বিদ্যুত উদবৃত্ত হতে শুরু করে । ডোমেস্টিক সেক্টরে তখন চাহিদাবৃদ্ধি ঘটেছিল ১৯%, শিল্পক্ষেত্রে মাত্র ৪% । সে সময় হিন্দুস্তান টাইমস লিখেছিল গোটা দেশে একটিমাত্র রাজ্যে এমনকি গ্রীষ্মকালে, যখন চাহিদা থাকে তুঙ্গে, তখনো বিদ্যুৎ উদবৃত্ত হয় । সে রাজ্যটি ছিল পশ্চিমবঙ্গ । আর চার বছর পর ক্লাইমেটস্কোপ ২০১৭ তে দেখতে পাচ্ছি গড় বিদ্যুৎ ঘাটতি দশমিক তিন শতাংশ । শিল্পের কোন গল্প নেই যে দেশে সেখানে চার বছরে এই পরিবর্তনের কারণ কি হতে পারে ? গার্হস্থ্য বিদ্যুৎ চাহিদা বৃদ্ধি একা এই পরিবর্তন কখনোই ঘটাতে পারবে না । তাহলে কি এই বিপুল আলোকসজ্জার বিন্দুমাত্র অবদান রয়েছে বিদ্যুতের উদবৃত্তি ঘাটতি ইত্যাদির পালটে যাওয়া হিসেবের পেছনে ?
এ আশঙ্কা যদি অমূলকও হয়ে থাকে , এর মনস্তাত্বিক প্রভাব কিন্তু সুদূরপ্রসারী । আমার নগর আলো ঝলমলে বিদেশী শহরের আদল পেয়েছে এই ভেবে যারা শ্লাঘা বোধ করে , তাদের চোখের আড়ালে চিরকালই রয়ে যাবে রাতের সহরে বাড়ি ফেরা হা ক্লান্ত সিভিক পুলিশ বা শপিং মলের তিনহাজারী কর্মচারী । পরিবেশের কথা তাদের দূরতম চেতনাতেও আসবে না এটাই স্বাভাবিক ।
যারা বলবেন আলো লাগাবার সঙ্গে জনসাধারণের নিরাপত্তার প্রশ্ন আছে ,তাদের সবিনয়ে বলব এর সঙ্গে দুষ্কৃতিদের রমরমা কমবার কোন সম্পর্ক থাকবার আশা পশ্চিমবঙ্গে সমূলে নিহত হয়েছে বহুদিন আগেই । প্রমান শুধু পঞ্চায়েত ভোটের সময় নয় , তার আগে এবং পরে । পরিবেশদূষণ যদি নাড়া না দেয় , তাহলে আসুন এক কাজ করি । আর টি আই করে জেনে নিই শুধু কলকাতা কর্পোরেশনের পাঁচ বছর আগে ইলেক্ট্রিসিটি বিল কতো ছিল , এখন কতো হয়েছে । ইনফ্লেশন ইত্যাদির কারণে কতো যোগবিয়োগ গুণ ভাগ করা দরকার তা আমরা সবাই জানি । আর টি আই করার কথা বললাম , কারণ সাইটে এসব তথ্য আপনি কখনোই পাবেন না। নিজেদের ট্যাক্সের টাকা হ্যালোজেনের আলোয় পুড়তে দেখেও যদি আপনার চৈতন্য না ফেরে ,তাহলে আবার নবারুণকে স্মরণ কোরে বলা যেতে পারে, “ ব্ল্যাক মাল খেলে কখনো হলুদ হ্যালোজেনের জোনে যেও না ।“
আমরা ব্ল্যাক খাচ্ছি ও ত্যাগ করছি , সঙ্গে কালো করছি চারপাশের পরিবেশকে । আসলে শাসকের অগ্রাধিকার কিসে সেটা তো দেখতে হবে । নোদাখালি থেকে মাটির তলায় তলায় যে কাজটি হয়েছিল তার কোন আলোকোজ্জ্বল বহিঃপ্রকাশ না থাকলেও আগামী পঞ্চাশ বছর জলকষ্টের হাত থেকে বেঁচেছে বেহালাসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চল । এখন শাসক যদি ভাবে ওরকম ঢাকঢোল পিটিয়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে করা দীর্ঘমেয়াদী হিতকাজে দরকার নেই , এই ক্ষণিকের জাঁকই ভালো,তাহলে ছুটবে্ই মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিকারক আলোর বন্যা, কারণ বিদ্যুৎ তো সিন্দুকে তুলে রাখা যায় না ।
জনকল্যাণ হবার কথা ছিল এদেশের রাজনীতির প্রথম পাঠ , দুর্ভাগ্যবশত তা হয়েছে জনরঞ্জন , যতই তা হোক না কেন পরিবেশ প্রতিবেশের চূড়ান্ত ক্ষতিসাধন করে।
দ | unkwn.***.*** | ০৫ জুন ২০১৮ ০৪:৫৪84347
dc | unkwn.***.*** | ০৬ জুন ২০১৮ ০১:০৭84353
h | unkwn.***.*** | ০৬ জুন ২০১৮ ০১:০৭84354
h | unkwn.***.*** | ০৬ জুন ২০১৮ ০১:০৯84355
amit | unkwn.***.*** | ০৬ জুন ২০১৮ ০২:০৬84348
মৌসুমী | unkwn.***.*** | ০৬ জুন ২০১৮ ০৩:৩০84356
প্রতিভা | unkwn.***.*** | ০৬ জুন ২০১৮ ০৩:৩০84357
রুখসানা কাজল | unkwn.***.*** | ০৬ জুন ২০১৮ ০৪:০০84358
শামীম আহমেদ | unkwn.***.*** | ০৬ জুন ২০১৮ ০৪:৩৬84349
PT | unkwn.***.*** | ০৬ জুন ২০১৮ ০৮:০০84350
h | unkwn.***.*** | ০৬ জুন ২০১৮ ১২:৩৮84351
Prativa Sarker | unkwn.***.*** | ০৬ জুন ২০১৮ ১২:৪৯84352
শক্তি | unkwn.***.*** | ০৭ জুন ২০১৮ ০৪:১০84359
PT | unkwn.***.*** | ০৭ জুন ২০১৮ ০৪:৪২84360
pi | unkwn.***.*** | ১৯ জুন ২০১৮ ০৩:৫৫84361
একক | unkwn.***.*** | ১৯ জুন ২০১৮ ০৪:২৮84362
নিশানদিহি খাম্বা | unkwn.***.*** | ১৯ জুন ২০১৮ ০৪:৪৩84363
Ekak | unkwn.***.*** | ১৯ জুন ২০১৮ ০৪:৫৪84364
| unkwn.***.*** | ২২ জুন ২০১৮ ০৩:৪৫84365
π | unkwn.***.*** | ১৫ জুলাই ২০১৮ ০৮:৪৪84366
। | unkwn.***.*** | ১৭ জুলাই ২০১৮ ০৫:০৩84367