আশির দশকে যাদের টিভি দেখে বোঝার, টিভি দেখার একটু একটু নেশা হওয়ার বয়স হয়েছে তাদের কাছে “ইয়ে যো হ্যায় জিন্দেগী”, “নুক্কর”, “মনোরঞ্জন”, “ওয়াগলে কি দুনিয়া” এসব পরিচিত নাম। তার আগেই "জানে ভি দো ইয়ারো" হয়ে গেছে যদিও, আমি দেখিনি। “জানে ভি দো ইয়ারো” দেখার জন্য আমাকে আরো কয়েক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। সাধারণভাবে ডিডি ওয়ানের সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগে টিভি দেখতে পাওয়ার মধ্যে যে লটারি জেতার আনন্দ ছিল, তা এখন ভেবে উঠতে আমাদেরই কষ্ট হয়। ঈষৎ থেমে থেমে, আকাশবাণী বিবিধ ভারতীর ঘোষণার মত সেইসব স্মৃতি জায়গায় জায়গায় আবছা, কুয়াশাচ্ছন্ন। মুশকিল হল, কুন্দন শাহের কাজ নিয়ে আলোচনায় এই স্মৃতিভার মাঝে মাঝেই আমাদের বিহ্বল করবে। যা ক্ষতিকর, কারণ ভদ্রলোককে নিয়ে বলার অন্য অনেক কিছু আছে।
১৯৮৩ সালে কুন্দন শাহের আত্মপ্রকাশ, জানে ভি দো ইয়ারো ছবির মাধ্যমে। সেই ছবি তৈরির গল্প খুবই আশ্চর্য, প্রায় একইরকম আশ্চর্যের কুন্দন শাহের পরিচালক হওয়ার গল্পও। অনেক পরে, একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে কুন্দন শাহ বলেছিলেন, মূলত তেমন কিছু করার ছিলনা বলে পুনে ফিল্ম ইন্সটিটিউটে আবেদন করেছিলেন। তার আগে লেখক হওয়ার ব্যর্থ চেষ্টার পরে একটি পাবলিশিং হাউসে কেরানির চাকরি করেছেন বছর পাঁচ। পুনেতে শাহ এবং তাঁর আরো দুজন বন্ধু ডায়লগ লেখার পরীক্ষায় ফেল করেন। ইন্সটিটিউটের "প্রাচীন অরণ্য প্রবাদ" হল, ডায়লগ লেখার পরীক্ষাই ঠিক করে দেয়, কে পরবর্তীকালে আসলে ডিরেক্টর হয়ে উঠবে।
যাই হোক, ঐ ব্যর্থতা শাহকে ভাবায়, তাঁকে মনে করায় যে তিনি বইতে লেকচারে যা পড়ছেন সেই একই জিনিস তৈরি করতে চাননি। ফলে শুরু হয় নতুন ধরনের কমেডির খোঁজে, তাঁর যাত্রা, যা "জানে ভি দো ইয়ারো" তে আমাদের সামনে আসে। প্রসঙ্গতঃ, “জানে ভি দো ইয়ারোর” স্ক্রিপ্ট প্রথমে আলাদা ছিল। সেই অর্ধসমাপ্ত স্প্রিপ্ট মাঝপথেই বাতিল হয়, যখন একদিন রাতে ইন্সটিটিউটের দুই পুরোনো বন্ধুর সাথে রি-ইউনিয়নে শাহ ও বাকিরা তাঁদের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা শোনেন। ডিরেকশন ও ফিল্ম এডিটিং এর ডিপ্লোমা নিয়ে সেই দুই তরুণ তখন দক্ষিণে কাজের খোঁজে হন্যে হয়ে ফিরছেন। শেষে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিল্ম বানানোর একটাই কাজ পান, যেখানে কাজ ছিল, প্রধানত রিফ্লেক্টর ধরা। শাহ এই গল্প শোনামাত্র আগের স্ক্রিপ্ট সরিয়ে রেখে নতুন গল্প লিখতে শুরু করেন, সুধীর ও বিনোদের গল্প।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের একটি রিভিউতে "জানে ভি দো ইয়ারো" সম্পর্কে বলা হয়েছে, ছবিটি দেখতে দেখতে মনে হবে এই ছবি যেন কারুর বাড়িতে তৈরি। শাহ এই বর্ণনার সাথে প্রচন্ড একমত। ছবিটিতে ব্রিজ ভাঙার যে দৃশ্য আছে সেটি আসলে ছবি তৈরি হওয়ার আগেই তুলে রাখা, যখন একের পর এক ঋণের আবেদন নাকচ হচ্ছে, সেই সময়ের। একদিন যদি সত্যিই ছবিটা হয়, তাহলে ততদিন তো ব্রিজ পড়ে থাকবেনা, সেই কথা ভেবে। কুন্দন শাহের ছবি বানানোর দর্শন, তাঁর জীবন ও কেরিয়ার আমাদের কাছে জাদুবাস্তব, কারণ সময় - যা আমাদের জন্য অতি দ্রুত পরিবর্তনশীল, তা তাঁকে কোনদিনই তাড়াহুড়ো করিয়ে নিতে পারেনি। প্রায় তিন দশকে দশটি ছবি আর কয়েকটি টিভি সিরিয়াল, এছাড়া কুন্দন শাহের কাজ বলতে ধুলোয় ঢাকা অজস্র না হওয়া ছবির চিত্রনাট্য, যেগুলোর কথা পরবর্তীকালে আশুতোষ গোয়ারিকার আর সুধীর মিশ্র বলেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, "জানে ভি দো ইয়ারো"র হওয়ার পরে অনেকদিন শাহের কোন কাজ ছিলনা, ছবি মুক্তি পাওয়ার পরের বছর ইন্দিরা গান্ধী পুরষ্কার পাওয়া সত্ত্বেও। এমনকী পরে, "জানে ভি দো ইয়ারো"র দ্বিতীয় পর্বের চিত্রনাট্য বহু প্রযোজক প্রত্যাখ্যান করেন এবং সেই নৈরাশ্য থেকে মুক্তি পেতেই মূলত টিভি সিরিয়াল পরিচালনার কাজ শুরু হয়।
কিন্তু কী ছিলো মধ্যবিত্তের গল্প বলতে চাওয়া ডার্ক হিউমার সম্বলিত সেইসব গল্পে? নিজের কথা বলতে চাওয়ার কোন্ সে উপায় ক্রমাগত ধাক্কা খেতে খেতে একজন পরিচালক খুঁজে পেলেন, যা তাঁকে দিয়ে করিয়ে নিল "ওয়াগলে কি দুনিয়া", যেখানে হাসি আছে স্রেফ কান্নাকে অপমান করতে না চাওয়ার অঙ্গীকারে? এর উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের সেই সময়ে দাঁড়িয়ে আরেকটু ইতিউতি চাইতে হবে। ভারতীয় সিনেমার সেই সুবর্ণযুগে, যখন আমরা যথার্থভাবেই আধুনিক সিনেমার সমসাময়িক, এটা সেই সময়। এ সেই সময় যখন ভারতীয় ছবিতে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার লোকের অভাব নেই, যখন বাণিজ্যিক সাফল্যের বাইরেও একটি অঞ্চল অনেকদিন ধরে তৈরি হয়েছে। প্রায় দু’দশক ধরে তৈরি করা সেই জমিতে তখন একে একে সৈয়দ ও আজিজ মির্জা, কুন্দন শাহের মত পরিচালকেরা কাজ করতে আসছেন। জানে ভি দো ইয়ারোর পরের বছরই তৈরি হচ্ছে "মোহন যোশী জাহির হো!" মত ছবি, যা সেই কতবছর আগেই ভারতীয় বিচারব্যবস্থার অসারতা ও মধ্য/ নিম্নবিত্তের অসহায়তা মাপা কমেডির মোড়কে দেখিয়ে দিয়েছে।
টিভি সিরিয়াল পরিচালক হিসেবে কুন্দন শাহের একটি কাজ ব্যান হয়, যার বিষয়বস্তু ছিলো দুর্নীতি। সরকারপক্ষ থেকে বলা হয়, ছবিটি "সাবভার্সিভ"। স্থানীয় পুলিশের লোক কুন্দন শাহকে বলেছিলেন, " আমাদের দপ্তর, দুর্নীতির লিস্টে সতেরো নম্বরে আছে, আপনি জানেন? আগের ষোলোটা দপ্তর নিয়ে আপনাদের অসুবিধে নেই, আর আমাদের একজন অফিসার দু’হাজার টাকা চাইলেই দোষ?" ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি সরকারি দপ্তরগুলোতে কীভাবে ছাপ ফেলছে তাই ছিল সেই ছবির বিষয়বস্তু এবং সেখানে কমেডির কোন জায়গা রাখা হয়নি। এরপর আরো বেশি করে শাহ কমেডি মাধ্যমেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেন।
"ইয়ে যো হ্যায় জিন্দেগী"তে রঞ্জিত আর রেনুর সংসার, লক্ষ্মণের কার্টুন থেকে তৈরি ওয়াগলে কী দুনিয়ার ওয়াগলে দম্পতির সংসারের থেকে আলাদা ছিল। গোর্কির "দ্য লোয়ার ডেপথস" অনুপ্রাণিত "নুক্কর" তো আরোই অনেক আলাদা। কিন্তু এই কাজগুলোর সবকটাতেই সেই সময়ের দুটি চরিত্র স্পষ্ট। এক, এই সেই সময় যখন শিক্ষিত চাকরি করা স্বচ্ছল মধ্যবিত্তের সাথে নিম্নবিত্তের মানসিক দূরত্ব অনেক কম ছিল। দুই, ভারতীয় সমাজে তখনও ব্যক্তির থেকে সমষ্টির ভালোমন্দ বেশি গুরুত্ব পেত। এই দুটি ঘটনাই এখন অতীত, এবং ব্যক্তি বা সমষ্টির মধ্যে কার গুরুত্ব বেশি, সেই বিষয়ে আমার কোন মন্তব্য নেই, কুন্দন শাহের ছবিতে কালের নিয়ম মেনেই সেই চিহ্নগুলো ফুটেছে শুধু এট্কুই বক্তব্য। কুন্দন শাহের বংশে সিনেমার কোন ইতিহাস নেই। পরিচালক হিসেবেও তিনি নিজেকে বর্ননা করেছেন বৃত্তের বাইরের একজন হিসেবে, যাঁকে মেইনস্ট্রিমে ফেলা যায়নি, এবং তথাকথিত প্যারালাল সিনেমার কুশীলবদের তালিকাতেও রাখা হয়নি। এমনও নয়, তিনি একমাত্র পরিচালক যিনি মধ্যবিত্তের সুখদুঃখ নিয়ে কাজ করেছেন। কুন্দন শাহকে শুধু আলাদা করেছে তাঁর গল্পের চরিত্রেরা, কারণ তারাও আসলে অনেকেই পরিচালকের মতই সাফল্য-ব্যর্থতার বৃত্তের বাইরের মানুষ, তাদেরও কোন হিসেবে এঁটে ফেলা যায়না। দেগে দেওয়া যায়না "ব্যর্থ" হিসেবে। বরং তারা অবলীলায় ব্যর্থতার লাশ বয়ে হাসি
ঠাট্টায় মেতে উঠে পরবর্তী ব্যর্থ প্রোজেক্টের অনুসন্ধানে যাত্রা করে।
অতীত যত পুরোনো হতে থাকে, ততই তা আমাদের কাছে মধুরতর হয়। দূরত্বের একটা আফসোস আছে, তার প্রতি আকাঙ্খা একটু বেশিই যেন টের পাই আমরা। তাই লোডশেডিং চিত্রিত নুক্করের যুগ নস্টালজিয়া আনে। আমার মনে পড়ে রাত নটার আশেপাশের সময়টার কথা, যখন যৌথ পরিবারে রাতের খাওয়ার প্রথম ব্যাচ শুরু হবে, আর আমার বইপত্তর নিয়ে প্রহসনের অবসান। কানখাড়া করে শুনতে হবেনা অনুষ্ঠান, সরাসরি টিভির সামনে বসার ছাড়পত্র থাকবে পরের দু’ঘন্টা। আমার বাবা, যাঁর আমার খাপছাড়া হয়ে ওঠার পেছনে অনেক অবদান আছে, তাঁর পরোক্ষ প্রশ্রয়ে খুলে যাবে একটি জানলা। তখন জানতেই পারব না, ভারতীয় চলচ্চিত্র ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ের মধ্যে বসে থাকছি, পড়া কামাই করার আনন্দ যে বহুগুণ বেড়ে যাচ্ছে অকিঞ্চিৎকর বহু তুচ্ছ চরিত্রের সামনে বসে, তার পেছনে কিছু কার্যকারণ সম্পর্ক আছে, আমার আর্থ-সামাজিক পরিচয় আছে এবং মিছিলে না গিয়েও আমার রাজনৈতিক বক্তব্য তৈরি হচ্ছে, কারণ ভারতের রাজনীতির দাগ অন্তরে বয়ে নিয়ে হাজির হচ্ছে সেইসব দৃশ্য। কোন অর্থেই সেই মানুষগুলো গল্প ছিলনা, কোন অর্থেই তা ছিলনা শুধু বিনোদনের জন্য বানানো কিছু দৃশ্য বা সময় কাটানোর অছিলা।
কুন্দন শাহের ওবিচুয়ারিতে নাসিরউদ্দিন শাহ লিখেছেন, “কুন্দনকে ভারতীয় সিনেমা মিস করবেনা কারণ যে ধরনের ছবি কুন্দন করতে চেয়েছিলেন, বর্তমান ইন্ডাস্ট্রিতে তার কোন জায়গা নেই।” হক কথা। এই গতিময়তার যুগে তাঁকে আমাদের মিস করার কারণ নেই। আমাদের সামনে এখন কোন নুক্কড় নেই, তারা ওভারব্রিজের নিচে অদৃশ্য, হয়তবা ব্রিজ ভেঙে পড়লেও আমরা তাদের আর দেখতে পাব না। আমাদের সামনে কোন ওয়াগলে নেই, তাঁদের আমরা প্রান্তে ঠেলতে ঠেলতে চোখের আড়ালে পাঠিয়েছি। আমাদের কোন কোন সুধীর বা বিনোদ নেই, যদিও ক্যামেরা অজস্র হয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমাদের জন্য কোনো মোহন যোশী কুৎসিত এই বাড়িটার খুঁটি ধরে ঝাঁকিয়ে সব ভেঙেচুরে তছনছ করে দিচ্ছেনা।