ছোটবেলায় একটা সহজ সুন্দর কার্টুন দেখেছিলাম, যে সময়ে নারীবাদে হাতেখড়িও হয়নি।
একটি মেয়ে তার বাবাকে জিগ্যেস করছে, বড় হয়ে আমি কী হব, বাবা?
বাবা বলছেন, তুই ডাক্তার হতে পারিস।
মেয়ে বলছে, কেন, কেন, আমি তো নার্স হব। ডাক্তার তো ছেলেরা হয়।
বাবা হাঁ করে তাকিয়ে আছেন।
এই একই কথা ছোট্টবেলায় আমাদের মাথায়ও আসত। তখনো পৃথিবীতে নারীপুরুষের সংজ্ঞায় অনেক কিছু শিখতে বাকি। ইংরিজি ছবির বই মাত্রেই, সাদা পোশাকের ডাক্তার পুরুষ আর সঙ্গের নার্স মহিলা। এর ব্যত্যয় দেখিনি কখনো। প্রশ্নটা ওই ছোট্ট মেয়েরই মত মাথায় এসেছে অবচেতনে কখনো না কখনো।
বড় হয়ে গেলাম কবে যেন। কিন্তু অজস্র বান্ধবী ডাক্তার হবার পরে, অসংখ্য বিজ্ঞাপন, ছায়াছবি, ম্যাগাজিনের ছবি সবকিছুতে মেয়ে ডাক্তারদের ছবি ছাপার পরে, আজ মাথার মধ্যে আমার অন্য প্রশ্ন জাগে।
কতখানি মুক্ত, কতখানি সহজ, কতখানি অনায়াস ডাক্তারির জগতে মেয়েদের হাঁটাচলা?
দুটো ছোট ঘটনা মনে পড়ছে। এক, এক চাইল্ড স্পেশালিস্ট ডাক্তার (পুরুষ তিনি) এর স্ত্রী গাইনোকলজিস্ট। ছেলের পরীক্ষার আগে মা হাসপাতাল থেকে ছুটি নিয়েছিলেন, বাবা নেন নি।
দুই, আমার বান্ধবী, ডাক্তারিতে ভাল রেজাল্ট করেও বিয়ের পর ১৫ বছর কোন কাজে যোগ দিতে পারেনি, কেননা ছেলে ছোট আর শ্বশুরবাড়িতে বলা হয়েছিল, আমাদের ছেলের যা মাইনে, তাতে বউমার চাকরি করার দরকার কী? এতো পরিবারের অসম্মান।
আজকের দিনে যে মেয়েরা ডাক্তারি পাশ করে বেরোয়, তাদের মনে হয় এই “স্বাভাবিক” ডিসক্রিমিনেশনের মুখোমুখি হতে হয়না!
যা হোক, যে ক্ষেত্রটা বেশি চিনি, তা নিয়েই দু চার কথা বলি বরং।
২
আমি যে চাকরিটা করি, সেটা ভারতের সিভিল সার্ভিসের অন্তর্ভুক্ত। প্রতিবছর কেন্দ্রীয় পাবলিক সার্ভিস কমিশন আট থেকে নশোটা ফাঁকা পদ পুরণ করে একটা পরীক্ষার মাধ্যমে। সেই পরীক্ষায় যারা ছাঁকনিতে ছেঁকে ওঠেন, তাঁদের মধ্যে আবার মেরিট অনুসারে, এবং তাঁদের পছন্দের তালিকা অনুসারে, নানা সার্ভিসে অ্যালট করে দেওয়া হয়। অর্থাৎ, কে বাকি জীবন কী কাজ করবেন সেটা নির্দিষ্ট হয়ে যায় পরীক্ষার ফল বেরোবার সঙ্গে সঙ্গেই। সুতরাং, ১৯৯১ সালের পরীক্ষার ভিত্তিতে আমার চাকুরিপ্রাপ্তির পর পরই নির্ধারিত হয়ে যায়, আমি ভারতীয় অডিট ও অ্যাকাউন্টস সার্ভিসের সদস্য হব।
ভাগ্যক্রমে, এই সার্ভিসটি আমার পছন্দের তালিকাতেও ছিল। যদিও ওই পরীক্ষাটি দিতে যারা যায় তাদের অভীষ্ট থাকে আই এ এস বা ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসে যোগ দেওয়া (যার ফলে পরীক্ষাটার একটা মোটা দাগের নাম হয়ে গেছে আই এ এস পরীক্ষা), কিন্তু বছর বছর আই এ এসের ভেকেন্সি বা ফাঁকা পদের সংখ্যা পালটে যায় এবং অতি বড় ভাগ্যগণকও বলতে পারবে না, কে আই এ এস পাবে কে পাবে না।
ভারতে আই এ এসের সম্বন্ধে বলা হয়, রাজার সার্ভিস। কেন তা বলা হয়? কেননা, ডিসট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট ও ডিসট্রিক্ট কালেকটরের যে মূর্তিটি একদা নয়া জমিদারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল (শোলা হ্যাট ও সাইকেল সহকারে), তা ক্রমে ক্রমে ওয়েলফেয়ার স্কিম অর্থাৎ সরকারের যাবতীয় দান খয়রাতের মূল হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। সরকারি প্রশাসন যন্ত্রের মূল কাঠামোটা আই এ এসদের মধ্যেই দিয়েই জনগণের সঙ্গে যোগ রেখে চলে, অন্যদিকে, এই সার্ভিসটি প্রকৃতপক্ষেই সরকারের ডানহাত হিসেবে বেশ কিছু সুযোগ সুবিধা ভোগ করে। অসুবিধা যে কিছু নেই তা নয়। যেমন রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধাচরণ করলে, তার ফল হতে পারে সপাটে অন্যত্র পোস্টিং, বোরা বিস্তর বেঁধে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যেতে হতে পারে।
পুলিশ অথবা বিদেশ সেবা, এ দুটোরও দিব্যি জাত আছে জনমানসে। পুলিসের যে ধারাটি আসছে ঐ সিভিল সার্ভিসের পরীক্ষা থেকে, তার নাম ইন্ডিয়ান পুলিস সার্ভিস, বছর ছ সাত চাকরি করলেই জেলার পুলিস সুপার হতে পারার সুযোগ। বিদেশ সেবা একদা খুব প্রীতিকর ছিল। এখন তার কদর কমেছে, কেননা প্রবাসে, বান্ধবহীন অবস্থায়, গুটি কয়েক অধস্তন ভারতীয়কে নিয়ে, নির্জন কোন দ্বীপে বা মাইনাস চল্লিশ ডিগ্রি শীতে পোস্টিং করার তুলনায়, ভারতের ভেতরেই পোস্টিং করাটা সবার কাছে আকর্ষণীয়। সবচেয়ে বড় কথা, হাতের ভেতর দিয়ে কতটা টাকা গলছে তার হিসেবেই মাপকাঠিটা বাঁধা হচ্ছে। একজিকিউটিভ সার্ভিস, এঁদের হাত দিয়ে টাকাপয়সার সরাসরি লেনদেন চলে, কেননা এঁদের হাত দিয়েই রূপায়িত হয় সরকারের কাজের রূপরেখা।
আমার সার্ভিসটি এই সবের তুলনায় কম উল্লিখিত, জাত আছে তবে বেশি কেতাবি, তুলনামূলকভাবে ডেস্ক জব। নাইন টু ফাইভ জব । কেননা, আমাদের কাজ শুরু হয় পোস্ট মর্টেম হিসেবে। যখন শেষ হয় একজিকিউটিভের কাজ, তখন শুরু হয় অডিটের কাজ। নিয়ম কানুন মেনে টাকা খরচ হয়েছিল কিনা, তা থেকে শুরু করে, যে টাকা খরচ হয়েছে, তার সবটাই উদ্দিষ্ট ক্ষেত্রে পৌঁছেছে কিনা, সবটাই দেখার কাজ করেন অডিট ডিপার্টমেন্টের লোক। ফলো দ্য রুপি, বা একটা টাকা মূল থেকে গন্তব্য অব্দি পৌঁছল কিনা তা গোয়েন্দার মত পিছু নিয়ে ট্র্যাক করার কাজটাই আমরা করে থাকি। এই টাকা অবশ্যই হতে হবে সরকারি টাকা, কনসলিডেটেড ফান্ডের থেকে যার উৎস।
৩
মেয়েদের ভূমিকায় এবার প্রবেশ করি।
ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশনের যে কোন চাকরিতেই বেশ কিছু বছর ধরেই অনেক নারীর যোগদান আছে। কিন্তু তার ভেতরেও অনেক রকমের প্যাঁচ আছে। যেমন মনে পড়ছে, ১৯৯১ তে আমার লিখিত পরীক্ষার ফলের ওপর ভিত্তি করে যে মুহূর্তে ইন্টারভিউতে ডাক পাওয়া, সে মুহূর্তেই কানে এসেছিল, অবশ্যই পুরুষ প্রার্থীদের একটি কথা, পেয়ে যাবে, পেয়ে যাবে, মেয়েদের একটা কোটা আছে, হিডেন কোটা, কুড়ি শতাংশ মহিলা নেবেই ইউ পি এস সি!
অর্থাৎ, মেরিটে তুমি যেখানেই থাকো না কেন, আসলে তোমাকে চাকরিটা দেওয়া হচ্ছে দয়া দাক্ষিণ্য হিসেবেই, তোমার থেকে দশগুণ যোগ্য পুরুষ প্রার্থীকে ডিঙিয়ে তুমি চাকরি পেয়ে যাচ্ছ, কেননা তুমি মেয়ে।
বলাই বাহুল্য কোন লিখিত রুল রেগুলেশনে এই “মহিলাদের জন্য হিডেন কোটা” নামক দিবাস্বপ্নটির কোন স্থান নেই। ওটা সম্পূর্ণ পুরুষ প্রার্থীদের মস্তিষ্ক প্রসূত বলেই মনে হয়।
যেখানে সংখ্যার ওপোর ভিত্তি করে লিখিত পরীক্ষার ফলাফল নির্ধারিত হয়, সেখানে পুরুষ বা নারী, সকলেই তো শেষ মেশ একটা রোল নম্বর মাত্র। ইন্টারভিউতে চাক্ষুষ দেখাসাক্ষাৎ ঘটলেও, তা কি এতটাই বায়াসড হতে পারে, মেয়েদের প্রতি, যে মেয়েরা ঠিক গুণে গুণে কুড়ি শতাংশ অব্দিই ঠাঁই পান সিভিল সার্ভিসে?
এ তো গেল একটা মিথ।
অন্য মিথ, আরো চমৎকার। অডিট অ্যাকাউন্টস সার্ভিস নাকি “মেয়েদের জন্য আইডিয়াল” সার্ভিস। কেন? কেননা ডেস্ক জব, কেননা নাইন টু ফাইভ জব, কেননা পুরোটাই কেতাবি। রাত বিরেতে রেডে বেরোন নেই, গুন্ডাদের সঙ্গে মারপিট নেই, এমনকি রাজনৈতিক নেতাদের রক্তচক্ষুও নেই।
অথচ, আমাদেরই অনেক বান্ধবী ইনকাম ট্যাক্স সার্ভিসে সারারাত রেড করেছেন, অনেকেই পুলিশে গিয়ে সফলভাবে মারপিট করেছেন, আর কে না জানে যে ফিল্ডে নেমে মারপিট করা ছাড়াও পুলিশের আরো অনেকগুলো কাজ আছে এবং কিছুটা পদোন্নতির পর সবটাই মাথা খাটানোর কাজ, আইনের রক্তচক্ষুকে বাঁচিয়ে নানান ধরণের ক্রাইমের গ্রে-স্কেলের চুলচেরা বিশ্লেষণ আর ক্রিমিনালদের টাইট দিতে পারা-না-পারার কাজ।
অথচ, দেখা যাবে, অডিট ডিপার্টমেন্টের পুরুষেরা, নিজেদের কাজটাকে সর্বদাই অন্যান্য একজিকিউটিভ সার্ভিসের সঙ্গে তুলনা করে দুঃখ পেয়ে চলেছেন। কেন, তা লিখিত আকৃতিতে না-ই বা লিখলাম। দুর্জনে বলে থাকেন, আমার সার্ভিসে উপরির সুযোগ কম।
আর যে কাজে উপরি নেই, বিয়ের বাজারে সে কাজের কদর যে কম, কে না জানে।
যাইহোক, মিথ তো আছে ভাঙবার জন্যেই। আমি ও আমার মত অনেক নারী, অডিট সার্ভিসে থেকেই, দেরি করে অফিস ছেড়েছি কাজের চাপে, প্রবল ট্যুরিং করার সুফল কুফলে রীতিমত পালিশ হয়ে গেছি, কাজের চ্যালেঞ্জ নিতে এতটুকু পিছপাও হইনি, আবার বিদেশ ভ্রমণ করে ফেসবুকে ছবি পোস্টও করেছি। আর এখনো “মেয়েদের জন্য ভাল” অডিট সার্ভিসে মাত্র এক তৃতীয়াংশের কাছাকাছিই কেন মহিলা, তার কোন ব্যাখ্যা পাইনি। যদি এমনই হত যে এটা “মেয়েলি” সার্ভিস তাহলে অন্তত আশি শতাংশ মহিলা থাকা উচিত ছিল...তা তো নেই। অন্যান্য কয়েকটি প্রধান অ্যাকাউন্টস সার্ভিস আছে এই একই পরীক্ষা দিয়ে যে সব সার্ভিসে প্রবেশ করা যায়, সিভিল অ্যাকাউন্টস ডিফেন্স অ্যাকাউন্টস, রেলওয়ে অ্যাকাউন্টস, টেলিকম অ্যাকাউন্টস, ইত্যাদি। সেখানেও ডেস্ক জবের সূত্রে মহিলাপ্রাধান্য হবার কথা অডিট সার্ভিসের মতই। সে সব ক্ষেত্রে কিন্তু দেখা যাবে চিত্রটা একই রকম।
একটা কথা এখানে স্পষ্ট করে রাখতে চাই, যে আমি যে চাকরিটা করি তা কিন্তু কোনভাবেই ভারতের সামগ্রিক জনগোষ্ঠীর কর্ম সংস্কৃতির প্রতিভূ নয়, বরঞ্চ অত্যন্ত সংখ্যালঘু একটি দল। কেননা, ওপরের সারিতে প্রশাসনিক কাজের সঙ্গে যুক্ত কেন্দ্রীয় সরকারের গ্রুপ এ সার্ভিসের সদস্যদের মধ্যে ক’জন মহিলা, তা থেকে গোটাভারতের ছবি কিছুতেই উঠে আসবে না।
গোটা ভারতের কথা পরে বলছি। আগে বলি, আমার ডিপার্টমেন্টেই, একটু নিচের দিকে মেয়েদের অংশগ্রহণের অপ্রতুলতার কথা। নানা স্তরের চাকরিতে মেয়েদের অনুপ্রবেশ দেখলেই “শিক্ষিত”, “মধ্যবিত্ত” মেয়েদের চাকরির ছবিটা স্পষ্ট হবে। এবং যে কোন মিথ ভেঙে যাবে।
আমার অফিসে আমি যে পদে আসীন, তার তলায় তিন-চারটে ধাপ। আছে অডিট অফিসার এবং অ্যাসিস্টেন্ট অডিট অফিসার ক্যাডার। এখানে তীব্রভাবে প্রকট হবে পুরুষতান্ত্রিকতা। এই ক্যাডারকে বলা চলে অডিটের কাটিং এজ, বা জনগণের সঙ্গে সংযোগ সৃষ্টিকারী অংশ। আমাদের ক্ষেত্রে অবশ্য সংযোগ জনগণ না, অডিটি সংস্থার সঙ্গে। মানে যাদের আমরা অডিট করছি ।
যেটা আগেই বলেছি, গ্রুপ এ ক্যাডারে যদি সার্বিক সংখ্যার এক তৃতীয়াংশ হন মহিলা, এই তলার ক্যাডারের মধ্যে যেটি অডিট অফিসার/ অ্যাসিস্টেন্ট অডিট অফিসার, অর্থাৎ গ্রুপ বি ক্যাডারে সেটা দশ ভাগের এক ভাগ। ১০০ জনের মধ্যে দশ জন মহিলা । ্তার নিচে গ্রুপ সি ক্যাডারে, যেখানে অডিটর, ডেটা অপারেটর, ক্লার্ক টাইপিস্ট পোস্টগুলি, সেই ক্যাডারে মেয়েদের সংখ্যার অপ্রতুলতা আরো বেশি। এ থেকে দুটো জিনিশ বোঝা যায়। এক, ঘুরে ঘুরে অডিট করার চাকরির ব্যাপারে, অন্তত সরকারি চাকরির একেবারে নিচের থাকে এখনো মেয়েরা অপ্রতুল। চাকরির আনুষঙ্গিক অবস্থাগুলো যেখানে মেয়েদের পাশে দাঁড়ানোর মত ততটা নয়।
দুই, উচ্চশিক্ষিত উচ্চবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারগুলি থেকে মেয়েরা যে হারে আসছেন সরকারি চাকরিতে, তলার থাকগুলো থেকে ততটা আসছেন না, অ্যাপিয়ার হচ্ছেন না বিভিন্ন সরকারি চাকরির পরীক্ষায়।
একেবারে নিচের নতুন থাক এম টি এস। ২০১০-১১ তে পরীক্ষা নিয়ে অতি সম্প্রতি এক ঝাঁক নতুন ছেলে মেয়েকে ইনডাক্ট করা হয়েছে সেখানে। এই চাকরির পরীক্ষায় বিপুল কম্পিটিশন হয় । যেহেতু, সরকারির চাকরির বিজ্ঞাপনই বেরোয় খুব অনিয়মিত, ইদানীং ফ্রিজ হয়ে ছিল বহু বছর। আগে যে পোস্টগুলিকে গ্রুপ ডি পোস্ট বলা হত, দারোয়ান, সাফাইওয়ালা, পিওন, ভিস্তি ইত্যাদি ইত্যাদি প্রাগৈতিহাসিক নামকরণ ঘুচিয়ে ইউফেমিজম করে “মাল্টি টাস্কিং স্টাফ” নামের মিষ্টি আবরণের তলায় রেখে সেই পোস্টে বিপুল লোক নেওয়া হয়েছে সম্প্রতি। এখানে উলটো চিত্র, পঁচিশজনের মধ্যে পাঁচজনই মহিলা।
এবং এই পঁচিশজনই বি এ, এম এ পাশ, কেউ কেউ চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি পাশ, কেউ কেউ এম টেক অব্দি! মেয়েরা তথৈবচ! কম্পুটারে ডিপ্লোমা আছে, ভূগোলে এম এস সি, মেয়েটিকে ঘরে ঘরে ফাইল বা জল পৌঁছে দিতে আমরাই বাধা দিয়ে, আই টি বিভাগে পোস্ট করতে বাধ্য হয়েছি।
অর্থাৎ, সময় পাল্টাচ্ছে। সে সময়টা আসছে তাতে ছেলে কি মেয়ে কোনটাই না দেখে বাবা মায়েরা উচ্চশিক্ষিত করে তুলছেন এবং তারা সমানভাবেই চাকরির বাজারে ঢুকে পড়ছে, তারপর সরকারি চাকরির ভেকেন্সির অপ্রতুলতায় তারা যে কোন সরকারি চাকরিতেই অ্যাপ্লাই করছে, কমপিটিটিভ পরীক্ষাতেও বসছে।
কিন্তু এক্ষেত্রে এই নয়া প্রজন্মের মেয়েদের বিশাল একটা অংশ সরকারি চাকরির হায়ারার্কি অর্থাৎ উল্লম্ব যে ছোটবড় ভেদাভেদ আছে (যা জাতিভেদ প্রথার চেয়ে কম কিছু নয়) তার সঙ্গে কীভাবে অ্যাডজাস্ট করতে পারছে, তাদের প্রত্যাশা পূরণ হচ্ছে কিনা, কাজের ক্ষেত্রের ব্যাক্তিগত-নৈর্ব্যক্তিক পরিসর কতটা রক্ষিত কতটা লঙ্ঘিত হচ্ছে, এগুলো নিয়ে গভীরভাবে ভাবার ও অনুধাবন করার দরকার আছে।
আর প্রয়োজন আছে পরিসংখ্যান গুলো নিয়ে বসে তুলনামূলক পর্যালোচনা করবার, প্রাইভেট সেক্টর ও সরকারি সেক্টরের মধ্যে কতটা ফারাক আছে লিঙ্গগত বৈষম্যের এই সংখ্যাগুলোকে দেখলে।
৪
আগেই বলেছি, সরকারি চাকুরেরা সমগ্র ভারতীয়দের অতি ক্ষুদ্র অংশ। তাই, গোটা ভারতের পরিসংখ্যানের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিতে পারলে ভাল, নইলে যে অংশের হয়ে আমি কথা বলছি তার প্রতিনিধিত্বের মূল্যমান কতটা তা স্পষ্ট হবে না পাঠকের কাছে।
২০০১ এর সেন্সাস বা জনগণনা অনুসারে ভারতের মোট কর্ম-ক্ষম জনগণের সংখ্যা ৪০ কোটি। তা গোটা দেশের জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ। এর ভেতরে ৩১.২ কোটি মূল কর্মী আর ৮.৮ কোটি হলেন প্রান্তিক কর্মী, অর্থাৎ যাঁদের তার আগের বছরে ১৮৩ দিনের ওপরে কাজ ছিল না।
কর্মক্ষম চল্লিশ কোটি মানুষের ভেতরে ১২.৭ কোটি মাত্র নারী। অর্থাৎ ২৫.৬% নারী আছেন ভারতীয় কর্মক্ষেত্রে। মূলধারা আর প্রান্তিক কর্মীদের মধ্যে যদি তুলনা করি, দেখব, মূলধারায় মাত্র ২৩.৩ % কর্মী হলেন মহিলা। অথচ প্রান্তিক ধারায় মহিলারা পুরুষদের তুলনায় বেশি। অন্যদিকে কর্মী মহিলাদের ৮০ শতাংশই কিন্তু আসছেন গ্রাম থেকে। অর্থাৎ চাষবাসের কাজের সঙ্গে যুক্তদের একটা বিশাল অংশই যেমন প্রান্তিক ধারার, তাঁদের অর্ধেকের ওপরই মহিলা।
শহরের কর্মীদের মধ্যে ঘরে ঘরে কাজ করার মহিলার সংখ্যাই বেশি।
এবার আসি, সরকারি বেসরকারির হিসেবে। অবশ্যই এটা অর্গ্যানাইজড সেক্টরের কথা। লেবার ব্যুরো, কেন্দ্রীয় সরকারের ২০০৫ এর একটি কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৩০ লাখ মহিলা পাবলিক সেক্টরে কাজ করেন, আর ২১ লাখ মহিলা প্রাইভেট সেক্টরে। কিন্তু কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যানের যথাযথতা কতখানি বলা মুশকিল। একটা অর্থে ধরেই নিতে পারি যে অর্গ্যানাইজড সেক্টরে যেটুকু যা মেয়েদের অংশগ্রহণ, সেনসাসের মাধ্যমে বা অন্যান্য রিপোর্টিং এর মাধ্যমে তা ধরা পড়বে। কাজেই এই তথ্যটুকুকে কাজে না লাগিয়ে আমাদের উপায় নেই।
সাম্প্রতিক কিছু স্টাডিও বলছে, মেয়েদের অর্গ্যানাইজড সেক্টরে বেশি না আসার কারণ প্রথাগতভাবে বিয়ের পর চাকরি ছেড়ে দেওয়ার প্রবণতা। এবং কিছু ক্ষেত্রে চাকরি ছেড়ে দেবে এই ভয়ে, তাদের প্রাইভেট সেক্টর ফার্মগুলি নিতে চাইছে না। অর্থাৎ একটা পঙ্কিল আবর্তের মত কাজ করছে এই ব্যাপারটি। এর সঙ্গে সঙ্গেই ওই স্টাডি থেকে আরো দেখা যাচ্ছে যে কর্মক্ষম মহিলাদের (১৫ থেকে ৫৯ বয়সী) মাত্র ৬.৫% হাই স্কুল পাশ করেছেন। সুতরাং যে সব কাজে কলেজ-পাশের বিদ্যে দরকার বা কোন বিশেষ কাজের দক্ষতার প্রশিক্ষণ দরকার এমন ভাল মাইনের চাকরি জুটবে না সেই সব মেয়েদের, যাঁরা সামান্য লেখাপড়া করেছেন। ফলত মেয়েরা অধিকাংশই কাজ করেন খুব খারাপ মাইনেতে।
আর সেখানেই লিঙ্গবৈষম্য মারাত্মক। সামাজিক সুরক্ষা থেকে শুরু করে ছুটিছাটার সুযোগ (বিশেষ করে মেটার্নিটি লিভ) বা অন্য কোন রকম সুযোগ সুবিধা তো তাঁদের নেইই, এমনকি সমান মেধা বা দক্ষতা সম্পন্ন পুরুষদের থেকেও তাঁরা অনেক কম মাইনে পান। যেখানে নিরক্ষর এক পুরুষের দিনমজুরি ১৭৭ টাকা, এক নিরক্ষর মহিলার মজুরি ৮৫ টাকা মাত্র।
জানার চেষ্টা করি, এইসব মেয়েরা কোথায় কাজ করছেন তাহলে?
ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অরগ্যানাইজেশনের পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০০৯-১০ এই সময়কালে, এক লক্ষ গৃহ থেকে সংকলিত তথ্যের ভিত্তিতে, ভারতে নারী কর্মীর সংখ্যা, ১১.২ কোটি। (২০১১ র জনগণনা অনুযায়ী দেশে নারীর সংখ্যা ৫৮ কোটি)। লক্ষ্য করব, আগেই যে তথ্য পেশ করেছি, তার ভিত্তি ছিল ২০০১ এর জনগণনা। সেখানে বলা হয়েছে নারী কর্মীর সংখ্যা ১২.৭ কোটি। অর্থাৎ ২০০১ এর জনগণনার চেয়ে ২০১০ এর রিপোর্টে নারী কর্মীর সংখ্যা কম দেখা যাচ্ছে। যাই হোক, মূলত কোথায় কাজ করেন এঁরা?
১। চাষবাস, পশুপালন - ৬৮ শতাংশ
২। তামাক শিল্প, বস্ত্র শিল্প, দর্জির কাজ- ১০.৮%
৩। গৃহনির্মাণ কাজ (মূলত ইঁট, বালি ইত্যাদির বহনের শ্রমিক হিসেবে) - ৫%।
৪। ইস্কুল/কলেজ – বিভিন্ন স্তরে শিক্ষাদানের সঙ্গে যুক্ত থাকা -৩.৮%
৫। মুদি -দোকান দেওয়া (চাল ডাল তেল খুচরো সবজি এবং পানসিগারেটের দোকান দেওয়া) ২.১
৬। গৃহকর্ম (ঝাড়পোঁছ, বাসন মাজা, কাপড়কাচা প্রভৃতি ) ১.৬%
৭। ব্যক্তিগত সেবা (ম্যাসাজ, বিউটি ট্রিটমেন্ট, বেবি সিটিং ইত্যাদি) ১.৫%
৮। স্বাস্থ্য সেবা ১.১ %
৯। ব্যুরোক্রেসি (সরকারি চাকরি) ১%
লক্ষ্যণীয় যে, চাষবাস থেকে শুরু করে নির্মাণ ও শিল্প সর্বত্রই সামান্য হলেও মেয়েদের যোগদান গত দশবছরে কমে এসেছে দেখা যাচ্ছে। এমনকি গৃহকর্মের ক্ষেত্রেও মেয়েদের যোগদান কমেছে সংখ্যাতত্ত্বের নিরিখে। দুই শতাংশ থেকে নেমে ১.৬% । একমাত্র ব্যুরোক্রেসি তেই, .৭ % থেকে উঠে গেছে ১% এ !
৫
সেই এক শতাংশেরই একজন আমি। কেমন করে আর বলি, আমি তোমাদেরই লোক । সমাজ সুরক্ষা থেকে পেনশন, গ্রাচুইটি আরো নানা রকমের সুযোগ সুবিধায় লালিত সরকারি কর্মচারী, লোকে বলে এ চাকরি পাওয়া কঠিন, ছাড়া আরো কঠিন। ছাড়ালেও না ছাড়ে, আমার এক বান্ধবী স্বামীর সঙ্গে বিদেশ গিয়ে ছ বছর কাটিয়েছিল উইদাউট পে, তারপরও তার প্রোমোশন অর্ডার বেরিয়ে যায়, কালচক্রের নিয়ম অনুযায়ী, সে লিখে লিখেও নিজের রেজিগনেশন অ্যাক্সেপট করাতে পারছিল না তার ডিপার্টমেন্টে!
তো এইহেন সরকারি চাকুরির ক্ষেত্রটিতে বিচরণ করে আমরা কীভাবে বেড়াই? কতটা সুবিধাভোগী এই শ্রেণীর ভেতরে আবার মহিলা অফিসার কুল?
দুটো গল্প বলি।
এক, আমার এক সিনিয়র, আমারই সার্ভিসের, ভদ্রমহিলার সঙ্গে একদিন কথা হচ্ছিল। আশ্চর্যভাবে মিলে গেল দুটি অভিজ্ঞতা, যে গাড়িটি আমরা চড়ি, অফিস থেকে দেওয়া এবং বিশেষভাবেই চিহ্নিত, কারণ ওপরে গভর্মেন্ট অফ ইন্ডিয়া লেখা থাকে, এবং মাথায় একটি লাল টুপির মত বাতি থাকে (যে বাতিটা ইদানীঙ খুলে নিতে হয়েছে, অন্তহীন অপব্যবহারের ফলে যে বাতিটি এখন শুধুমাত্র গুটিকতক ব্যক্তিই ব্যবহার করতে পারবেন যে কোন রাজ্যে, রাজ্যপাল, চিফ জাস্টিস, মুখ্যমন্ত্রী, ইত্যাদি ইত্যাদি বাদে, আর কেউ নয়, কিন্তু সে অন্য এক গল্প)। গাড়িতে চড়ার জন্য পুরুষ অফিসারদের কিছু কেতা কানুন আছে, যেমন প্রতিবার তিনি যখন গাড়িতে উঠবেন বা নামবেন, সাদা পোশাক পরা ধোপ দুরস্ত ড্রাইভার দরজা খুলে দেবেন। আমার সিনিয়র ভদ্রমহিলার পর্যবেক্ষণ বলে, মহিলারা এভাবে ড্রাইভারের দরজা খুলে দেওয়ার তোয়াক্কা করেন না, সটান নিজেই দরজা খুলে নেবে আসেন। এতে ড্রাইভাররা প্রথম প্রথম থতমত খেলেও, পরে দিব্যি মেনে নেয়, এবং গাড়ি থেকে নামবার নামটিও করে না। এই গল্পের সঙ্গেই ফুটনোট হিসেবে একটা ফাউ গল্প পাই তাঁর কাছে, তাঁর ভাইয়ের একবার একটা ছোট পথ দুর্ঘটনায় গাড়িটি জখম হয়, এবং যে গাড়িটি তার গাড়িকে ধাক্কা দিয়েছিল, সেই গাড়ির মালিক কোন রাজনীতিক বা প্রভাবশালী লোক, তাই ভাই ক্ষতিপুরণ পাবার বদলে গলাধাক্কা পেয়ে বাড়ি ফেরে। সেই প্রভাবশালীর ড্রাইভার ভাইটিকে শোনায়, জানেন এটা কার গাড়ি? অমুকচন্দ্র তমুক, অমুক মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান। পাঙ্গা নিতে আসবেন না। প্রবল অপমানিত হয়ে, ভাই সেই রাস্তাতেই চীৎকার করে বলে, আপনাকে দেখে নেব, আমার দিদিও অ্যাকাউন্টেন্ট জেনেরাল। ভয়ানক বিচলিত ও খুব আহত ভাই, তার দিদিকে ফিরেই চার্জ করে, দিদি, তুই আমার দিদি না হয়ে দাদা হলে আজ আমার বেশি সুবিধে হত, তুই যে অ্যাকাউন্টেন্ট জেনেরাল, তবু তোর নাম নিয়ে আমি কোন সুবিধে করতে পারলাম না ! এখন ব্যবস্থা কর দেখি, ওই লোকটার গাড়ির লাইসেন্স বাতিল করিয়ে দে, অথবা অন্য কিছু?
অ্যাকাউন্টেন্ট জেনেরাল, শব্দযুগল মনের ভেতর যে ছবিটা ফুটিয়ে তোলে তাতে অনেকটা সম্ভ্রম আর বেশ কিছুটা পৌরুষ আছে, মহিলা টিপ্পনী দিয়ে আমাকে বলেন। দাদা এ জি হলে যতটা ভাও পাওয়া যায়, দিদি এ জি হলে কি আর ততটা পাওয়া যায়?
আমার চোখে, এ গল্প এক বিশাল ভারতীয় লঘু কাহিনি। ভারতের আমলাতন্ত্র, ভারতের প্রদূষিত ভ্রষ্টাচারী রাজনীতিতন্ত্র, সুবিশাল ঐতিহ্যের মত বহন করা আমাদের মধ্যযুগীয় মানসিকতায় রাজকীয় এই শোষণ পদ্ধতি, এগুলির সঙ্গে পুরুষতন্ত্রও কতই না ওতোপ্রোত। খারাপ একটা সিস্টেম বাপু আপনাদের এই পশ্চাৎপদ ভারতবর্ষের আমলা-নেতাতন্ত্র। বলতেই পারেন যে কেউ। ত, এ গল্প তারই এক ছোট টুকরো। এটা না হলেও চলে যায়, তাই এটা লঘু ঘটনা, কিন্তু ঘটনা তো বটেই!
অন্য ঘটনা আমার নিজের চোখে দেখা। আমার নিজের অভিজ্ঞতা বলে, মহিলা হিসেবে আমার নিজের কোন মাথাব্যথা নেই, কিন্তু অন্যদের কাছে আমার মহিলা আইডেন্টিটি খুব গুরুত্ব পেয়ে যায়, যখন, এক কনফারেন্স রুম ভর্তি পুরুষ অফিসারের মধ্যে বসে, আমি এক এবং অদ্বিতীয় মহিলা হিসেবে থাকি। প্রত্যেকটা মিটিং এ তাদের মাথার ওপরে আমি আছি এটা টের পাওয়ানোর খেলাটা খেলতে খেলতে হঠাৎ খেয়াল করি, এই যে পুরুষসিং হের দল, যাঁদের আমি “আপনারা আমার টিম” “আপনারা অডিট ডিপার্টমেন্টের স্তম্ভ” ইত্যাদি ভাল ভাল কথা বলে কাজে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছি, এঁরা প্রত্যেকে তাঁদের পরিবারে এক একজন সম্রাট এবং স্ত্রীরা এঁদের কাছে হয়ত বা জুজু। এখানে মাথা নত করে এঁরা “ম্যাডামের” কথা শুনছেন এবং বকাবকিতেও চুপ থাকছেন। বহু মিটিং চলতে শুরু করার অনেক অনেক পরে সচেতন হয়ে দেখেছি, আমার নারী সত্তা প্রকাশ্যে আমি নিজে আনিনি, কিন্তু পরিস্থিতিগত বৈষম্য আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছে, হংস মধ্যে বক যথা আমি নারী হয়ে এঁদের পরিচালনায় আছি। এই সচেতনতা আমার মধ্যে এনে দিচ্ছে ছোট ছোট শরীরী ভাষা বা ইঙ্গিত হয়ত বা। তাই হয়ত, এঁদের ভেতরে যে যুগসঞ্চিত বিশাল পুরুষতন্ত্রের দেওয়ালটা আছে তাতে ধাক্কা লাগবে বলেই কি আমিও, আমার কন্ঠস্বরে আমার কথায় বন্ধুত্ব এবং টিম ওয়ার্কের কথা বলছি বার বার? এ আমারই অচেতন দুর্বলতার প্রকাশ নয়ত?
একটা হাসির গল্প দিয়ে এই লঘুনাটিকার ইতি করি। অসম প্রদেশে অ্যাকাউন্টেন্ট জেনেরাল হিসেবে যোগ দেবার পর, কিছুদিনের মধ্যেই অসমের বেশ কিছু ভাল বাংলা পত্রপত্রিকার সন্ধান পাই, অনেক লেখক সম্পাদকের সঙ্গেও সঙ্গে দিব্য জমে ওঠে আলাপ পরিচয়। সেখানেই সৌমেন ভারতিয়া-র সম্পাদিত ব্যতিক্রম নামের পত্রিকাটিতে “অসমের প্রথম মহিলা অ্যাকাউন্টেন্ট জেনেরাল” এই শব্দবন্ধ দিয়ে আমার একটা সাক্ষাৎকার প্রকাশ পায়। আমি এই শব্দবন্ধটিতে বড়ই জড়োসড়ো বোধ করি, কেননা, ঠিক যেভাবে চাকুরি ক্ষেত্রে মহিলাদের জন্য সংরক্ষণ আমার না পসন্দ, সেভাবেই, প্রথম মহিলা অমুক তমুক সেমুক হয়ে ওঠায় আমার বেশ অসুবিধে। কিন্তু এবার সচেতন হয়ে আমি সত্যিই দেখি আমার অফিসে রাখা বিশাল কাঠের ফলকে, যাতে ১৯৪৭ থেকে সব অ্যাকাউন্টেন্ট জেনেরালের নাম আছে, (আর এক মধ্যযুগীয় প্রথা)... আমার নামটিই শুধু মিস/মিসেস/এম এস লাঞ্ছিত।
বোঝাই যায় কেন অসমে গিয়ে, এয়ারপোর্টে আমাকে রিসিভ করতে আসা সেক্রেটারি সাহেব যখন গলা দু ধাপ নামিয়ে সামনের খাকি উর্দির লোকটিকে বলেছিলেন, আমাদের ম্যাডাম এজি, তখন খাকি উর্দির ভদ্রলোক আশেপাশে তাকিয়ে স্যার এজি-কে খুঁজছিলেন।
শুধু একবার নয়, বহুবার এই অভিজ্ঞতা। এজি ম্যাডাম মানে, এজি সায়েবের স্ত্রী, এটাই ছিল ও অঞ্চলের প্রায় অধিকাংশের ভাবনার দস্তুর। যে ম্যাডামটি এখন গাড়ি থেকে নামলেন তিনি যে কোন জাঁদরেল পুরুষ্টু গোঁফ সম্পন্ন কোন অফিসারের পত্নী নন, নিজেই অফিসার, এটা বিশ্বাস করার মত অভিজ্ঞতা বা ডেটাবেস হয়ত তাঁদের নেই,তাই এ নিয়ে বেশি ভাবিনি, নিছক গল্প করে বলার মত ঘটনা হিসেবে, হাসির খোরাক হিসেবেই আছে। সত্যি বলতে অসম ক্যাডারের আই এ এসেও, মহিলার সংখ্যা অতি নগণ্য। পারুল দাস বা এমিলি চৌধুরীর মত হাতে গোণা কয়েকজন মহিলাকেই আমি সিনিওর আমলাদের মধ্যে পেয়েছিলাম আমার অসম বাস কালে।
রাজনীতির মঞ্চেই বা অসমে কজন মহিলাকে দেখা গেছে? সে অর্থে দেখলে, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গীগুলি তো নির্ধারিত হয় তথ্য থেকেই। বারংবার এক একটা তথ্য চোখ কানের ওপর আছড়ে পড়ার গতিবেগে দৃষ্টিভঙ্গীও পরিবর্তিত হয়।
আপাত দৃষ্টিতে অবশ্যই, একজন জনমজুর মহিলার চাইতে ক্যাডারভিত্তিক অফিসারদের ভেতরে পুরুষ নারী বৈষম্যের ব্যাপারটা নেইই। মাইনে এক, প্রোমোশনের পদগুলি বা প্রোমোশন হবার জন্য যা যা করণীয় সে সবই পুরুষনারী নির্বিশেষে এক। বিদেশের নানা জার্নালে পড়া গ্লাস সিলিং এর বিষয়টি তথাকথিতভাবে অন্তত আমাদের সার্ভিসে নেই। গ্লাস সিলিং অর্থে, অদৃশ্য বাধা, ওপরের দিকে উঠতে। যেখানে, একটি মানুষ, তার সমস্ত যোগ্যতা সত্ত্বেও, কেবলমাত্র নারী বলেই, সবচেয়ে উঁচু পদে উঠতে পারছেন না। কোন কারণ না দর্শিয়েই তাঁকে রেখে দেওয়া হচ্ছে মধ্যমানের পদে। ম্যানেজেরিয়াল পোস্টে থেকেও, তিনি কখনোই সংস্থার নিয়ন্ত্রক ভূমিকায় আসতে পারছেন না। কেননা, তাঁর আশপাশের পুরুষরা কখনোই চাইছেন না, একজন মহিলা ওই পদে বসুন। অসংখ্য অধস্তন কর্মচারীর কাছেও একজন মহিলার কাছে জো হুজুর করাটা খুবই অসম্মানের।
আপাতদৃষ্টিতে রুলস রেগুলেশনে বাঁধা আমাদের সার্ভিস। তার ভেতরে এই রকমের কোন আবছা পলিটিক্স নেই।
কিন্তু সত্যিই কি নেই?
হ্যাঁ, আমরা মহিলারা পুরুষদের থেকে পে স্কেলে, কাজের বিবিধ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। কিন্তু “মানসিকতা” নামক বিষয়টি তো রুলস রেগুলেশনের আওতায় পড়ে না। তাই কী কী দেখতে পাচ্ছি, বা পেয়েছি নিজের জীবনে, যা অন্য অনেক মহিলা অফিসারের সঙ্গে কথা বলেও দেখেছি?
পুরুষ উর্ধতন অফিসারের মনে, একটি মেয়ের কর্মক্ষমতা সম্বন্ধে একটা সন্দেহের ভাব। যেটাকে কাটিয়ে উঠতে কখনো বা মহিলা অফিসাররা একটু বেশি বেশি কর্তব্যপরায়ণ, একটু বেশি বেশি নিজের কাজের ব্যাপারে কঠোর। নিজেকে প্রমাণ করে যেতে হবে সর্বদা তাঁদের। নতুবা অদৃশ্য ছাপ্পা পড়ে যাবে পিঠে, তুমি তেমন দড়ো নও।
কোন অফিসার যদি বিবাহিত হন, এবং সন্তানবতী। তাঁর ক্ষেত্রে পরিবারের বিষয়ে কোন প্রি অকুপেশন থাকলে তো হয়ে গেল। পুরুষ বস, এমন কি মহিলা বসের চোখেও, সেই অধস্তন মেয়েটি তখন চূড়ান্ত অক্ষমতার প্রতীক, বিরক্তির সূচক। মাথা উঁচু করে, কোন অপরাধবোধ হীনভাবে সন্তানের জন্ম দিতে দীর্ঘ ছ মাসের ছুটি নিতে আমি পারিনি, আমার মনে হয়েছিল আমার অফিস খুশি নয়। ঠিক যেমন ছমাস পরে অফিসে ফিরে যেতে গিয়ে আমার মনে হয়েছিল আমার বাড়ি খুশি নয়। বাড়িতে এমন জল্পনাও শুনেছিলাম যে, এখন কি আর পারবে নটা ছটা চাকরি করতে, এখন থেকে তো চারটের সময়ে ফিরে আসতেই হবে বাচ্চার জন্য।
বিবাহিত মেয়েরা, বিশেষত যারা জীবনের একটা বড় পর্বেই এই দোটানায় চাকরি করেন। সবাই করেন। কিন্তু নিজেদের মধ্যে কেউ এ নিয়ে আলোচনা করেন না । কোন হেল্প লাইনও মজুদ নেই। একা একাই এই গোটা সমস্যাটাকে নিজের মত করে যুঝতে যুঝতে জীবনের অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটা বছর কেটে যায়। যখন কাজের ক্ষেত্রেও ক্রমশ সিনিয়র হয়ে উঠছেন সেই মহিলা। ক্রমশ দায়িত্ব বাড়ছে।
যে কোন মহিলা, যে সময়টায় সন্তানের জন্ম দিচ্ছেন, সন্তানকে মানুষ করছেন, তাঁদের টানাপোড়েনের যেন শেষ নেই। সংবেদনহীন পুরুষ উর্ধতন, এমনকি মহিলা উর্ধতনরাও, সন্তানকে সময় দিতে চাওয়া মেয়েটিকে নানাভাবে অসহযোগিতা করে যাবেন। অথচ, না, মেয়েটি তার অফিসের কাজের যে সময় তাকে কোনভাবেই ফাঁকি দেন না। নটা থেকে ছটা অফিস করেন। নিজের করণীয় কাজের তালিকা ধরে ধরে শেষ করেন। তার পরেও, উর্ধতন অফিসারটি শনি রবিবার কাজে ডাকেন, বা রোজকার কাজের দিনে অনাবশ্যক সন্ধে অব্দি বসিয়ে রাখেন অধস্তন মহিলাকে, সাতটা আটটা অব্দি কাজের ছুতোয় নিজের ঘরের উল্টোদিকের চেয়ারে। ওফিসে কিছু সিজনাল কাজের চাপের সময়ে, আরো দেরি হয়। মেয়েটি বাড়ি ফিরতে পারেননা অনেক রাত পর্যন্ত। বাড়িতে সন্তানের দেখভাল করা শাশুড়ি বা অন্যান্যদের ভ্রুকুটি ক্রমশ কুটিল হয়ে ওঠে।
অফিস থেকে ট্যুরে যেতেই হয়। কখনো অসুবিধে থাকলেও পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাকে, বাড়িতে অসুস্থ সন্তানকে ফেলেই যেতে হয় এমন ট্যুরে, যা হয়ত না গেলেও চলত। এ কাহিনি আমার শুধু নয়। আমার নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে অন্য নারীদের অভিজ্ঞতাকে টুকরো টুকরো জুড়ে বানানো এক কাঁথার মত। যেমন, কাজ করতে করতে আমার সঙ্গেই কর্মরত কিন্তু অনেকটাই বয়সে ছোট এক মহিলার একটা গল্প শুনে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। তার ক্ষেত্রে ঘটে যায় চূড়ান্ত ঘটনা। তার চাকরির জন্য ছোটাছুটির প্রয়োজন, অথচ সে অন্তঃসত্ত্বা। বসকে জানায়, এখন ডাক্তারের কথা অনুযায়ী আমাকে বিশ্রাম নিতে হবে। বস শুনিয়ে দেন, কাজটা না হলে চলবে না। তারপর যতখুশি বিশ্রাম কর। তাকে দুদিনের মধ্যে দুবার প্লেনে চেপে এ শহর ও শহর করতে হয়। কিন্তু এর ফলে মেয়েটির শরীরে চাপ পড়ে এবং তার গর্ভপাত হয়ে যায়। সারাজীবন ঐ ভদ্রলোকটিকে ক্ষমা করতে পারেনি মেয়েটি। অত্যন্ত কর্মদক্ষ মহিলা । আমাকে যখন গল্পটি বলেন, কেঁদে ফেলেছিলেন। ঘটনা থেকে তখন তিনি দশ বছরের দূরত্বে। পরে আর একটি সন্তান এলেও, প্রথম অজাত সন্তানের জন্য বেদনা তখন তাঁর চোখে মুখে।
আমার কানে এই ঘটনাটি কোথায় যেন নিজের অভিজ্ঞতার প্রতিধ্বনি বলে মনে হয়েছিল। অথচ আমার তো কখনো গর্ভপাত ঘটেনি। কিন্তু অনুরূপ অন্য অভিজ্ঞতা কি আমার নেই? সবচেয়ে বড় কথা, এই বাধ্যতা, মানসিক অত্যাচার, নীরব অসহযোগিতা, এগুলো সবই আমার চেনা।
সবচেয়ে বড় যে কথাটা আমার মনে হয়েছে তা অন্য । মনে হয়েছে, আশ্চর্য, আমাদের কখনো জেন্ডার নিয়ে ট্রেনিং দেওয়া হয়না কেন? পুরুষদের ট্রেনিং দরকার সবচেয়ে বেশি, একজন মহিলার জীবনের নানা সময়ের যে অত্যন্ত জরুরি কাজগুলো সেগুলো সমাজের কাজ। সেগুলো সম্বন্ধে সংবেদন তৈরি করতে। মেয়েদের ট্রেনিং ও জরুরি। কেননা, কীভাবে এই ধরনের সমস্যার সমাধান করা যায় তা আমাদের শিখিয়ে দেওয়া হয়নি। উলটে, অন্য কারুর সঙ্গে এগুলো শেয়ার করার কথাও আমরা কোনদিন ভাবিনি। বলতে কি, আমার যা যা ঘটেছে, অন্যদেরও তাই ঘটে থাকবে, এটাই যেন ভাবিনি। ভেবেছি এগুলো একান্তভাবে আমার ব্যক্তিগত সমস্যা। কিন্তু এ সমস্যা একটা সামাজিক সমস্যা এবং এর সমাধান আমার বাইরে, অন্য কোথাও থাকতে পারে, এভাবে ভাবতে আমরা অভ্যস্ত নেই। তাই বিভিন্ন সময়ে কাজে যোগ দেওয়া মেয়েদের অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ একই ধরণের হলেও তাদের মধ্যে সংযোগের কোন সূত্র নেই। হেল্প লাইন নেই শেয়ারিং নেই। তাদের কোন ফোরাম নেই। যেখানে বয়স নির্বিশেষে এসে তারা বলতে পারবেন নিজের সমস্যা।
এই প্রসঙ্গে বলি, আমার খুব রাগ হয় যখন গল্পে উপন্যাসে পড়ি, একটি মেয়ে চাকরি করতে গিয়ে কী কী কম্প্রোমাইজ করল তার কাহিনি ফেঁদে বসা হয়। উর্ধতন পুরুষ বসের সঙ্গে দৈহিক সম্পর্কের চটুল বিবরণ আঁকা হয়। কিন্তু বেসরকারি ক্ষেত্রে এই ঘটনাটা কতটা সুলভ জানি না, সরকারি ক্ষেত্রে একেবারেই সুলভ নয়। অন্তত কোন পুরুষ উর্ধতনকে আমি যৌন ইঙ্গিতবাহী বা অন্য ধরণের আকর্ষণবাহী কিছুই আচরণ করতে দেখিনি। এবং যারা আমার আশেপাশে আছে তাদেরও দেখিনি। আসলে ভারতীয় ব্যুরোক্রেসির কতগুলো অলিখিত নিয়ম ও অদৃশ্য দেওয়াল আছে। একটা দেওয়াল হল, এই সার্ভিস ক্যাডারগুলি অত্যন্ত রক্ষণশীল, অত্যন্ত গভীরভাবে প্রথাসিদ্ধ কিছু আদবকায়দায় গাঁথা, যাকে বলি ডেকোরাম। এবং সর্বোপরি খুব নারীবিদ্বষী। অর্থাৎ সমস্যাটা উল্টোদিকের। নারীদের দূরে রাখো, এই নীতিতেই চলেছে আজও, ভারতীয় আমলাতন্ত্র। মেয়েদেরও হয়ে উঠতে হচ্ছে “পুরুষের মত”। যাকে, মজা করে কেউ কেউ বলে ব্লটিং পেপার। একজন কিরণ বেদি বা একজন লীনা চক্রবর্তী বিখ্যাত হন “পুরুষ” দেরও হার মানিয়ে দিতে পারার ক্ষমতা দিয়েই।
প্রশাসনের চেয়েও আরো বেশি এই নারীবিদ্বেষ লক্ষ্য করেছি জুডিশিয়ারি বা বিচারবিভাগীয় কাজকর্মের ক্ষেত্রে। কোন লোয়ার কোর্ট যখন চলে, সেখানে বিচারকরা তাঁদের চারিপাশে যে নিশ্ছিদ্র ডিসিপ্লিনের বলয় রক্ষা করেন, তা দেখার মত। এই সময়ে সেই কোর্টরুমে সামান্য কথাবার্তা বললেও তা “আদালত অবমাননা” আর আপনি যদি মহিলা হন, এবং কালো কোট পরিহিতা না হন, তাহলে আপনার দিকে যে রোষদৃষ্টিতে তাকানো হবে তা রীতিমত ধাক্কা দেওয়া। একবার আমি অফিসের কোন কেসের ব্যাপারে এমন এক কোর্টরুমে আমার সহকর্মীর সঙ্গে হেসে কথা বলছিলাম, এবং প্রায় রুলের গুঁতো খেয়েছিলাম। ওই মহিলা ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছেন কেন? বেরিয়ে যেতে বলুন ওনাকে।
আদালতের যে ভয়ংকর হায়ারার্কি, তার একটা আবছা ছায়া এখনো বাকি প্রশাসনেও রয়ে গেছে। সম্পূর্ন উল্লম্ব এক প্রবল মান্যতার সিঁড়ি আছে। সাপসিঁড়ি খেলার চেয়েও যার ছোবল সাঙ্ঘাতিক।
এই এই করতে নেই, এই এই করতে হবে, এই নিয়মগুলো প্রায় অলঙ্ঘ্যনীয়। বসেরা সচরাচর খুব কড়া, নিজেদের বস-ত্ব প্রমাণ করতে অসম্ভবরকম উদ্যোগী হয়ে অধস্তনদের উৎপীড়ন করে রাখেন সাগ্রহে। পুরুষ নারী নির্বিশেষে, ঘন্টার পর ঘন্টা ডিটেন করা অথবা আচমকা মেজাজ হারানো, ছুটি দিতে অস্বীকার করা, এসব করে তো থাকেনই, মেমো, শো কজ, সাসপেনশন ইত্যাদিও পান থেকে চুণ খসলেই হতে পারে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে অধস্তনদের আমার জমিদারির প্রজা, অথবা “স্বতঃই গবেট” “বেসিকালি ফাঁকিবাজ” বলে ধরে নিতে পারিনা বলেই, তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করে থাকি। সেটা আমার কোন কৃতিত্ব নয়, বরং জেনেটিক কোডিং, এবং কোন কোন ক্ষেত্রে আমার দুর্বলতা হিসেবেও পরিগণিত হয়, আমি জানি। বস হিসেবে আমার অধস্তনদের চোখে খুবই নরম সরম আমি। অন্তত নিচের দিক থেকে পাওয়া ফিডব্যাকে এরকমই জানতে পারি। মুখে তাঁরা বলেই থাকেন যে “ম্যাডাম আপনার মত বস পাব না” কিন্তু মাঝে মাঝে আমার মন বলে, হয়ত আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে এঁদের আউটপুট বেড়ে যেত, ভয় এখনো ভারতীয় কর্মীবৃন্দের বড় চালক । ভয়ের জন্য ঠিক সময়ে অফিসে আসা থেকে শুরু করে আরো নানা ডিসিপ্লিন চলে।
এক্ষেত্রে একটা কথা অপ্রিয় হলেও বলে ফেলা ভাল। সে কথাটা বললেই আমি পলিটিকালি ইনকারেক্ট হয়ে পড়ব, এবং প্রাদেশিকতা বা পক্ষপাতিত্বের দায় এসে ঘাড়ে চাপবে। তবু, যেসব অসংবেদনশীল অফিসারদের সংগে মহিলা অফিসারদের সমস্যাগুলো বেশি করে হয়, এবং যে সব অফিসাররা নিজের অধস্তনদের সঙ্গে সাংঘাতিক অসভ্যতা করেও, ভয়ের রাজত্ব নির্দ্বিধায় স্থাপন করে নিতে পারেন, তাঁরা বেশির ভাগই আসেন একটা বেল্ট থেকে, যাকে ভারতের কাউ বেল্ট বলা হয়। বিহার উত্তরপ্রদেশ মধ্যপ্রদেশ এইসব রাজ্য থেকে এখনও নারীবিদ্বেষ, জাতপাত এবং অন্যান্য সুপ্রাচীন ঐতিহ্যগুলো যায়নি। যথেষ্ট জমিদারীসুলভ সামন্ততান্ত্রিক আদবকায়দার চল তাই এঁরা বহাল রেখেছেন কর্মক্ষেত্রেও।
কিন্তু এই সামন্ততন্ত্রে ক্ষমতাময়রা শুধু না, ক্ষমতাময়ীরাও কম যাননা।
৬
আসলে ভূগোলকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। বরং এই প্রশ্নটা থেকেই এসে পড়ি আর এক অস্বস্তির জায়গায়। মেয়েদের সমস্যার কথা শুরু হলেই একদল পুরুষ বলেন, কেন, মেয়েরা নিজেরা কি ধোয়া তুলসীপাতা নাকি? তারা ঘুষ নেয়না? তারা অত্যাচার করেনা অক্ষমের ওপর?
হ্যাঁ, এঁরা ঠিক বলেন। আসলে, পুরুষ নারী এগুলি কোন নির্ধারক নয় । আসল নির্ধারক বোধ করি ক্ষমতা। পাওয়ার। যে ক্ষমতা পাবে, সে অক্ষমের ওপরে অত্যাচার করবে। এটাই সমস্যার জায়গা। সুতরাং একাধিক মহিলাও ক্ষমতার অলিন্দে নিজেকে পালটে ফেলেন, যে মুহূর্তে হাতে রাজদন্ড এসে পড়ে, তাঁদের রূপ বদলে যায় । এবং আগেকার প্রতিবাদী চরিত্র চলে গিয়ে এসে পড়ে একটা সংবেদনহীনতার মূর্তি।
এমনকি মেয়েদের ব্যাপারেও তখন তাঁদের কোন সংবেদন দেখা যায় না। ঠিক যেমন, বাংলা সিরিয়াল কাহিনিতে শাশুড়িরা বৌমাদের ওপরে অত্যাচার করার সময়ে, ভুলে যান তাঁদের বৌমা অবস্থার কথাগুলি, তেমনি, প্রশাসক যদি মহিলা হন, তাঁর অধস্তনের সমস্যাগুলোও তাঁর কাছে তখন আর লক্ষ্যনীয় থাকেনা। তিনি তখন জাস্ট লাইক এনি আদার প্রশাসক। তিনি তখন ক্ষমতার কেন্দ্রভূমি। সুতরাং।