
পহেলা বৈশাখ এলেই আজকাল একজনের কথা আমার মনে পড়ে। ভদ্রলোক আর আমি পাশাপাশি ডেস্কে বসে কাজ করতাম এক সময়। চাকরি ছেড়ে দেবার পরও তার সঙ্গে আমার প্রায়ই দেখা হতো। এখনো হয় কালেভদ্রে।
আমাদের কলিগ সবিমল বসু ধর্ম নিয়ে প্যাঁচপ্যাচি ধরনের মানুষ। অফিস ছুটির পর দেখতাম কলা গাছের বাকল নিয়ে যাচ্ছেন। জিজ্ঞেস করলে বলত বাড়িতে কি নাকি পুজা আছে। সকালবেলা কখনো হাঁটতে বের হলেও দেখতাম ফুল কিনছেন। বাড়িতে নিজেই পুজা দেন। ঠাকুর দেবতায় খুব ভক্তি। আমাদের জীবন থেকে বাংলা কেলেন্ডার উঠে গেলেও সুবিমলকে দেখতাম বাংলা মাসের তারিখ পর্যন্ত মনে রাখছেন। উনার সঙ্গে কথা বলে মজা পেতাম কারণ উনি উনার জীবনে এখনো ইংরেজি তারিখের সঙ্গে বাংলা তারিখটি সমানতালে চালিয়ে যাচ্ছেন। যেমন বৃষ্টি কম হচ্ছে, এ বছর বৃষ্টির দেখা নেই… সুবিমলদা বলে উঠতেন আষাড়ের আজকে ২ তারিখ ১৪ তারিখে রথযাত্রা। এর আগে বৃষ্টি হবে বলে মনে হয় না…। কিংবা পৌষ ২২ চলছে কিন্তু শীতের দেখা নেই ইত্যাদি…।
এই সুবিমল কিন্তু আমার পাশের ডেস্কে বসতেন না। আসলে এই গল্প সুবিমলকে নিয়ে নয়। আমি শুরুতে যার কথা বললাম, যিনি আমার পাশের ডেস্কে বসতেন তিনি শেখ বোরহান উদ্দিন সাহেব।
তখনো বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম লাইম লাইটে আসেনি, ৯৬ বিশ্বকাপে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের দিন বোরহান উদ্দিন সুবিমলকে উদ্দেশ্যে করে বললেন, ও বাবু, আপনারা তো আজকা ইন্ডিয়া করবেন- ঠিক কইছি কিনা কন? বোরহান উদ্দিন সাহেবের ঠোটে চোরা শ্লেষ। সুবিমল বোরহান উদ্দিনকে একটু এড়িয়ে চলতেন। আমার সঙ্গেই তার সখ্যতা ছিল। বোরহান উদ্দিনের কথায় কাষ্ঠ হেসে বললেন, না দাদা, খেলা তেমন বুঝি না। দেখাই না। আগ্রহ নাই…।
বোরহান উদ্দিন আকাশ থেকে পড়লেন এমন ভান করে বললেন, ধুর মিয়া, মিছা কথা কন! আপনারা সব ইন্ডিয়া করেন। সব জানা আছে…।
সুবিমল বিব্রত ভঙ্গি হাসে। বলে, আমার ফুটবলের নেশা, ব্রাজিল করি…।
সুবিমল চলে যেতেই আমাকে নিচু গলায় বোরহান উদ্দিন বলল, হালারা করবো ইন্ডিয়া, কিন্তু মুখে স্বীকার করবো না!
আমি হেসে বললাম, আপনিও তো পাকিস্তান করবেন। উনি ইন্ডিয়া করলে দোষ কি?
বোরহান উদ্দিন আপত্তি জানিয়ে মাথা নেড়ে বলল, আমাদের পাকিস্তান করা আর তাদের ইন্ডিয়া করা এক না!
-কি রকম?
-এই যে দেখো তুমি তো মুসলমান, তুমি তো ইন্ডিয়ার সাপোর্ট করো আমি জানি। কিন্তু তুমি কোন হিন্দুকে পাকিস্তান করতে দেখেছো?
বোরহান উদ্দিনের কথায় সোজাসুজি উত্তর না দিয়ে বললাম, বাংলাদেশের মানুষ কি করে পাকিস্তানের সমর্থন করে সেটাই আমার বুঝে আসে না…।
বোরহান উদ্দিন মাঝে মাঝেই আমার এরকম মতামতে রুষ্ট হতেন। সুবিমল বসু যে সব প্রশ্নে কাচুমাচু হয়ে হাত কচলে বিব্রত হয়ে হাসত, আমি তার হয়ে জবাব দিতাম, যুক্তিগুলো থাকত শক্ত, বোরহান উদ্দিন বিরক্ত হতেন আমার উপর। তুমি আগ বাড়াই কথা কও ক্যা? হেরে কইতে দাও…। তিনি চাইতেন আমি উনার সঙ্গে গলা মিলাই। একদিন বলেই ফেলেছিলেন, তুমি মিয়া হিন্দুদের এত পক্ষ নেও ক্যান কও তো?
একবার সুবিমল বসু অফিস থেকে ছুটি নিলেন ইন্ডিয়া যাবেন বলে। বোরহান উদ্দিন টেবিলে একটা চাপড় মেরে বলল, দেখছ, সারা বছর যা জমাইছে সব এখন রাইখা আসবো!
-উনি উনার মায়ের চিকিৎসার জন্য যাচ্ছেন।
-ক্যা, আমাগো দেশে চিকিৎসা নাই? ডাক্তার নাই? আসল কথা চিকিৎসা যখন করামুই তখন দাদাগোই দিয়াই করাই, দাদারাই দুইটা পয়সা পাক- বুঝলা?
-ব্যাপারটা এরকম নয় বোরহান ভাই। উনাদের অনেক আত্মীয়-স্বজন কোলকাতা থাকেন। তার মায়ের বয়স হয়েছে, সবার সাথে আর দেখা হবে কিনা… তাই আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে যাবেন, এটাও একটা কারণ। আর সত্যি কথা কি জানেন, আমার মেজো খালু কিছুদিন আগে ইন্ডিয়া গিয়ে চিকিৎসা করিয়ে এসেছেন। এক ফুপা তিনিও ইন্ডিয়া গিয়ে চিকিৎসা করিয়ে আসছেন। ইন্ডিয়া এম্বাসিতে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, দেখবেন চিকিৎসার জন্য যত মানুষ এপ্লাই করছেন তাদের ৯৫ ভাগই বাংলাদেশী মুসলিম। তারা নিশ্চয় দাদাদের সেধে পয়সা দিতে চাইবে না?
-ধুর মিয়া তুমি হইলা হিন্দুগো দালাল!
বোরহান উদ্দিন কলিগ হলেও দীর্ঘদিন একই অফিসে কাজ করাতে, বয়েসে বড় ভাইয়ের মত হওয়াতে উনার আমাকে নিয়ে এরকম কথা বলার একটা অধিকার জন্মে গিয়েছিল। আমিও এসব শুনে হাসতাম।
বোরহান উদ্দিন বৈশাখের জন্য ইলিশ কিনেছেন। যে বছর রমনায় বোমা ফাটল সে বছরের কথা। আমাকে বললেন, দুপুরে বাসায় যাইবা, তোমার দাওয়াত।…
সুবিমল বসু ডেস্ক থেকে গলা উচিয়ে বলল, ইলিশ কিনছেন নাকি দাদা?
কথাটা বোরহান উদ্দিনকে উদ্দেশ্য করে। বোরহান উদ্দিন আমাকে চোখ টিপে ইশারা করে বলল দেখো কি বলে, তারপর সুবিমলকে উদ্দেশ্য করে বলল, ও বাবু, বৈশাখে আমাগো দাওয়াত দিলেন না?
-সুবিমল হে হে করে হাসতে লাগলো। বলল, আমাগো বৈশাখের দিনে তো অফিস খোলা থাকব দাদা!
-ও আপনাগো তো দাদা আবার বৈশাখ পরদিন! তো দাদা, এইটা কিন্তু ঠিক না, দেশে থাকবেন কিন্তু দেশের নিয়ম মানবেন না- এটা কেমন কথা?
সুবিমল বিব্রত মুখে হাসে, হে হে হে…
বোরহান উদ্দিন আমাকে নিচু গলায় বলল, দেখলা তো, বৈশাখটা পর্যন্ত তাদের আলাদা! তোমরা খালি সেুক্যলার সেক্যুালার করো- আর হিন্দুরা যে ইন্ডিয়ার লগে মিল রাইখা বৈশাখ করতাছে সেইটা কিছু কও না ক্যা?
বোরহান উদ্দিনের উত্তেজনা দেখে আমার হাসি পায়। সেভাবেই বলি, বোরহান ভাই, আমাদের জন্মের বহু বছর আগে সেই ৬৬ সালে পাকিস্তান সরকার তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের জন্য আলাদা ক্যালেন্ডার বানাইছিল যাতে পূর্ব বাংলার বাঙালীদের সঙ্গে কোলকাতার বাঙালীদের মধ্যে একই পালাপার্বন নিয়ে অনৈক্য থাকে। তাদের ভয় ছিল পাকিস্তান যে ধর্মীয় ঐক্যে গঠন হইছিল সেটা দুই পাড়ের বাঙালীদের মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষ কোন ঐক্য গড়ে উঠলে পাকিস্তানের ভিত্তি দুর্বল হয়ে যাবে। আর আপনার তো মনে থাকার কথা ৮৮ সালে, আমরা তখন খুব ছোট, ৬৬ সালের সেই ক্যালেন্ডারটাই প্রচলন শুরু করে।… সুবিমল’দার কোন দোষ তো আমি দেখতে পাচ্ছি না। সারা বছর লোকনাথ ক্যালেন্ডার দেখে যিনি জীবন চালান, তার পক্ষে বৈশাখ কত তারিখে সেটা জেনেও অন্যদিনে পহেলা বৈশাখ কিভাবে পালন করা সম্ভব?
-ধুর মিয়া, তোমার সমস্যা আছে! বংশে কেউ হিন্দু আছিল নি?
আমি এবার জোরে জোরে হাসতে লাগলাম। কেন হাসলাম সেটা বোরহান উদ্দিনও জানে। কথাটা বলেই তাই খুব বিব্রত হয়ে পড়ল। এই প্রথম আমার উপর খুব রাগ করে একটাও কথা না বলে চলে গেলো।
চাকরি ছেড়ে দেবার পর বোরহান উদ্দিনের সঙ্গে আর রোজ দেখা হয় না। তবে মাঝে মাঝে পথে দেখা হয়। হাসতে হাসতে টিপ্পনী কাটেন, এই যে সেক্যুলার বাংলাদেশ! কি খবর কন? আমি আগের মতই হাসি। এই কয় বছরে বোরহান উদ্দিনের পরিবর্তন চোখে পড়ার মত। হজ করছেন। দাড়ি রেখছেন। কপালে নামাজের কড় ফেলার দাগটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শেষবার দেখা হয়েছিল গত বছর বৈশাখের পর রাস্তায়। বোরহান উদ্দিন এক সময় ইলিশ কিনে বাড়িতে বড় করে বৈশাখ করতেন। আমরা অফিস থেকে কয়েকজন গিয়ে তার বাসায় গিয়ে খেয়েও এসেছি। কিন্তু এবার সে প্রসঙ্গ তুলতেই একদম অন্যরকম এক বোরহান সাহেব বেরিয়ে আসলেন। বললেন, এইসব তো আমাদের মুসলমানদের জন্য ঠিক না। এই যে পোলাপান কিসব নিয়া নাচানাচি করে। মেলায় যায়, রাক্ষস-খাক্কসের ছবি নিয়া মিছিল করে… আমাগো মুসলমানদের তো অন্যদের মত হলে চলে না।…
-এবার ইলিশ কিনেন নাই?
-আরে না, না, কি বলো তুমি! এসব কোরআন-হাদিসের কোখাও নাই!
-ও!
-এই যে মাইয়াদের উপর যে কান্ডটা হইল, কেন হইল? এরকম বেয়াল্লাপনা অনুষ্ঠানে শয়তান সাক্ষাৎ নিজে দাঁড়ায় থাইক্কা বদমাইশি করতে শেখায়-বুঝলা?
-তার মানে আপনি এখন এই অনুষ্ঠানের মধ্যে নাই?
-মুসলমানের দুই ঈদ ছাড়া আর কোন উৎসব নাই…।
-তাহলে সুবিমলদা ভুল কিছু করেনি কি বলেন?
-কার কথা কও?
-সেই যে সুবিমল…
-ও হের কথা, ক্যান সে কি করছে?
-না উনি যে ইন্ডিয়ার লগে মিল রেখে বৈশাখটা পালন করতেন তার কথা বললাম।
-হিন্দুরা তো বৈশাখফৈশাখ পালন করবই!
-এই জন্যই বললাম, বাংলা ক্যালেন্ডারটা সুবিমলদারাই হয়ত বাঁচিয়ে রাখবে! অন্তত হারাম হালাল বলে ত্যাগ করবে না। কি জানি, একদিন হয়ত সুবিমলদাদের বৈশাখটাই খালি বেঁচে থাকবে।
-কি কও তুমি বুঝতাছি না?
-পাঁচ বছর আগে আপনি সুবিমলদাকে বলেছিলেন তারা ইচ্ছা করে ইন্ডিয়ার সঙ্গে মিল করে বৈশাখ পালন করে। আর আপনি পাঁচ বছর পর বৈশাখটাই ত্যাগ করে দিলেন!
বোরহান উদ্দিন আমার কথা কিছু বুঝল কিনা বুঝা গেলো না। তিনি হঠাৎ ঘড়ি দেখে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বলেন, আজকা আর সময় দিতে পারুম না, যাইগা। আজান দিবো, নামাজ পড়তে যাই…।
বোরহান উদ্দিন হন হন করে উল্টো পথে হাঁটা দিলো মসজিদের দিকে। বোরহান উদ্দিনের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে আমার মনে হলো, তিনি যেন এগুচ্ছেন না, পিছিয়ে যাচ্ছেন। দ্রুত নিজের কাছ থেকে নিজে সরে যাচ্ছেন…।
Tim | unkwn.***.*** | ২৪ এপ্রিল ২০১৬ ০৫:০৯80529
aka | unkwn.***.*** | ২৪ এপ্রিল ২০১৬ ০৫:২৭80530
Abhyu | unkwn.***.*** | ২৪ এপ্রিল ২০১৬ ০৫:৪০80531
aranya | unkwn.***.*** | ২৪ এপ্রিল ২০১৬ ০৫:৫৩80532
Abhyu | unkwn.***.*** | ২৪ এপ্রিল ২০১৬ ০৫:৫৬80533
lcm | unkwn.***.*** | ২৪ এপ্রিল ২০১৬ ০৫:৫৭80534
aka | unkwn.***.*** | ২৪ এপ্রিল ২০১৬ ০৫:৫৮80535
দ | unkwn.***.*** | ২৪ এপ্রিল ২০১৬ ০৬:২২80525
Robu | unkwn.***.*** | ২৪ এপ্রিল ২০১৬ ০৭:০৯80526
অসম্ভব | unkwn.***.*** | ২৪ এপ্রিল ২০১৬ ০৭:১৫80527
san | unkwn.***.*** | ২৪ এপ্রিল ২০১৬ ০৭:২০80528
d | unkwn.***.*** | ২৫ এপ্রিল ২০১৬ ০৪:১২80536
de | unkwn.***.*** | ২৫ এপ্রিল ২০১৬ ১০:০৫80537
:-( | unkwn.***.*** | ২৫ এপ্রিল ২০১৬ ১০:২৭80538
প্রতিভা সরকার | unkwn.***.*** | ২৬ এপ্রিল ২০১৬ ০৭:১০80539
দেবাঞ্জন মহাপাত্র | unkwn.***.*** | ২৬ এপ্রিল ২০১৬ ০৭:১৬80540
Anunay Chakraborty | unkwn.***.*** | ২৬ এপ্রিল ২০১৬ ০৭:৪৩80541
reek | unkwn.***.*** | ১৬ নভেম্বর ২০১৬ ১১:০২80542