মাগরিবের নামাযের সময় বাংলা ঘরে একটা ছায়ামূর্তি দেখে ওমর আলী চমকে উঠল। ঘরের ভেতরটা অন্ধকার। তিনি ভয় পেয়ে বললেন, কেরে ঐখানে?
ছায়ামূর্তি বলল, কাকা, আমি-
-আমি কে?
ছায়ামূর্তি কিছু বলল না। ওমর আলী চেঁচিয়ে ডাকল, হানিফ, হানিফ-
হানিফ কালকেই মাত্র এ বাড়িতে এসেছে কাজ করতে। কোন কাজই সে ঠিক মত করতে পারে না। সন্ধ্যাবেলা বাংলা ঘরে যে বাতি দিতে হবে সে খেয়ালও তার নেই। সে আশেপাশেই কোথাও ছিল। ওমর আলীর ডাক শুনে দৌড়ে এলো।
-ঘর আন্দার কইরা কই গেছিলি? ভিতরে কেডা বইয়া আছে?
হানিফ অপরাধীর মত মুখ করে বলল, একজন মাইয়া মানুষ আসছেন আপনার লগে দেখা করতে।
শাড়ির খসখসানি শুনে মেয়েমানুষ সেটা ওমর আলী আগেই বুঝেছিলো। তা মেয়েমানুষ হলেই তাকে হুট করে ঘরে বসতে দিতে হবে নাকি! ওমর আলী হানিফকে বকাঝকা করতে লাগল। দিনকাল বড় খারাপ। ৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। কাল সন্ধ্যাবেলাও মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা গুলি ফুটিয়ে জয় বাংলা বলে শ্লোগান দিয়েছে স্কুল ঘরের মাঠে। পুরো গ্রাম ভেঙ্গে পড়েছে তাদের দেখার জন্য। ঐ দলের পালের গোদা সেন্টু আজকাল কি রকম ঠেস মেরে মেরে কথা বলে। ছোকরার মাথায় কেউ ঢুকায় দিছে মেলিটারি আইসা ওমর আলীর বাড়িতেই বসছিল। খানাপিনা করছে। ওমর আলী ভাল উর্দু জানে। বাতচিৎ তার মাধ্যমেই হয়েছে। সেন্টু যে মুক্তিবাহিনীতে গেছে এইটা যদি মেজর সাবরে বলে ওদের বাড়িঘর সে জ্বালাই দিতে বলত, কি পারত না তখন ওমর আলী? গ্রামের মাইনষের উপকার করছে ওমর আলী। বাড়ি-ঘর জ্বালাইতে দেয় নাই। হিন্দু জেনানাদের নিজের ঘরে আশ্রয় দিছে। রাতের আন্দারে তাগো বর্ডার পার হইতে সাহায্য করছে। অহন যদি সেদিনকার চেংরা পুলাপান কান্দে মেশিনগান নিয়া চোখ গরম দেখায় কেমুন লাগে?
ওমর আলী ওযু করতে গিয়ে বার বার অন্যমনস্ত হয়ে পরল। ওযুর পানি গড়িয়ে ঢাল বেয়ে ঝোঁপঝারে গিয়ে পড়ছে। ছড়ছড় করে কিছু একটা ঝোঁপের মধ্যে নড়েচড়ে উঠল। তিনি গ্রাহ্য করলেন না। পাতলা কুয়াশার চাদর দূরের গাছপালার গায়ে জমাট অন্ধকারে লেপটে আছে। শীতের বিষণ্ন সন্ধ্যা। একটা বিষাদ নিরবতা সবখানে লেপটে আছে।
সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল গীতা ফিরে আসছে। ওমর আলীর বাড়িতে সবাই ভীড় করে এলো। সবাই জিজ্ঞেস করে, কিরে গীতা কুনহানতন আইলি? ইন্ডিয়া গেছিলি নি?
গীত জবাব করে না। কেমন একটু লাজুক লাজুক হাসে। পা নাচায়। বেশির ভাগ সময় মাথানত করে রাখে। অনেকে সহানুভূতিতে মাথা ঝাঁকায়, যুদ্ধের হাঙ্গামায় মাইয়ার মাথা হয়ত আউলায়া গেছে গা…।
এরমধ্যে সেন্টু কোত্থেকে তার দলবল নিয়ে এসে হাজির। সে এসে বাড়ি মাথায় তুলে নিয়েছে। ওমর চাচা কই, গীতাগো সোনাদানা গীতারে বুঝাই দেন।
ওমর আলী আকাশ থেকে পড়ে। কিসের সোনাদানা বাবা, কি কও তুমি?
-শুনলাম আপনার কাছে নাকি অরা জিম্মা রাখছিল?
-আল্লার গজব পড়ব আমার উপর! মেলিটারিরা গীতাগো বাইত যাইয়া ওর মা-বাপ আর ভাইরে মাইরা ফেলাইয়া যা পাইছে নিয়া গেছে। গীতা খালি দৌড়াই আমাগো ঘরে আইয়া লুকায়। আমি ওরে লুকাইয়া রাখছিলাম। মেলিটারি গেলেগা পরে অনেক রাইতে ওরে লোক দিয়া ইন্ডিয়াতে পাঠাই দেওনের ব্যবস্থা করি। এই উপকারটা কইরা মনে হয় বিরাট ভুল করছিলাম নারে-
ওমর আলী ভাবে, এ কি জ্বিন-পরীর কারবার নাকি! সারা গ্রাম গীতাকে দেখছে। সে একলা আন্ধার ঘরে গীতারে দেখলে কথা ছিল। ওমর আলী মাথা ঘুরান দিয়ে পড়ে গেলো উঠানে। সবাই ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে গেলো। মুখে জলের ছিটা দিতে জ্ঞান ফিরল। ঘর অন্ধকার করে শুয়ে রইল চুপ করে। রাত কত কে জানে। মাথার কাছে হানিফ দাঁড়িয়ে রইল।
-হানিফ, ঐ মাইয়া মানুষটা আমার কাছে কি চায়?
-কিছু কয় না তো। জিগাইলাম, কিছু কয় না।
-অহনও কি বাংলাঘরে বইয়া আছে।
-হ, বাইর হইয়া যাইতে কইলাম, হুনে না, খালি কয়, কাকার লগে একটা কথা কমু…
-ওমর আলী চোখ বুজল। বুকের উপর কি যেন চেপে বসছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।
রাত বারোটার সময় বাড়ি-ঘর ফাঁকা হলো। গ্রামের মানুষের গীতাকে নিয়ে আর কোন কৌতূহল নেই। গীতা তখনো বাংলাঘরের এক কোণে বসে আছে। ওমর আলী হানিফকে নিয়ে বাংলা ঘরে এল।
ওমর আলীর রূপ এখন বদলে গেছে। চোখ তীক্ষ, খড় দৃষ্টি। যেন কিছু একটা খুবলে নিবে এখনি। ওমর আলী খড়খড়ে একটা গলায় জিঞ্জেস করে, তর নাম কি গীতা?
গীতা একটুও নড়েচড়ে বসে না। কোন ভাবান্তর হয়েছে সেরকম কিছু বুঝেও যায় না। তবে কোন জবাব দেয় না। পায়ের নখ দিয়ে মাটি খুটে।
-তর বাপের নাম কি?
গীতা কথা বলে না।
-আমার কাছে কি চাস?
এবার গীতা মুখে তুলে তাকায়। ওমর আলীর চোখে চোখ রেখে গীতা অদ্ভূত একটা হাসি দেয়। ওমর আলীর বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠে।
-ঐ হারামজাদী কথা কস না ক্যা?
গীতা ফের নখ দিয়ে মাটি খুটে। কোন জবাব দেয় না।
ওমর আলী হানিফকে বাইরে যেতে বলে দরজা ভিজিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বলল, তুই কে আমি জানি না। তয় তুই গীতার মত দেখতে এইটা ঠিক, কিন্তু গীতা না। মরা মানুষ জ্যান্ত ফিরা আহে না! তর মতলব কি জানি না। টাকা-পয়সা লাগলে দিমু, তয় এরপর যদি কোনদিন তরে এই তল্লাটে দেহি তো একদম মাটির নিচে পুইত্তা ফেলমু! আমারে চিনছ নাই? আমি জ্যান্ত মানুষ পুইতা ফেলতে জানি! খোঁজ-খবর নিয়া আসোস নাই?
গীতাকে পাঁচশ টাকা দেয়া হলো। হানিফকে ওমর আলী বলল, এইটারে একদম পুবঘাটা নদী পার কইরা দিয়া আসবি। ভুলেও যেন এইখানে আর না আসে সেইটা বুঝাই দিবি-
লাঠি হাতে হানিফ গীতাকে নিয়ে বেরিয়ে গেলে ওমর আলী বিড়বিড় করতে থাকে একমনে। মরা মানুষ জ্যান্ত ফিরা আহে না। সাত হাত মাটির নিচের পঁচাগলা লাশ কেমনে কথা কয়! সারা গ্রামের মানুষরে বোকা বানাইতে পারলেও ওমর আলীরে বোকা বানাইবো ক্যামনে?