-এই যে দ্যাখ, মক্কা শরীফের মাটি!
কাপড়ের পুটলির মধ্যে মুলতানি মাটির মত কিছু একটা দেখা যায়। মোকসদা ভুরু কুঁচকে পুটলির দিকে চেয়ে থাকে। লোকমানের চোখে-মুখে পবিত্র জিনিস ধরে থাকার বিনম্র গর্ব। মোকসদা বারোমাসী আমাশয় রোগী, সে জন্যই কিনা কে জানে তার ভক্তিটক্তি একটু কম। মেজাজটা সব সময় খিটিমিটি। স্বামীর দিকে চেয়ে ধারালো গলায় বলল, মক্বা শরীফের মাটি দিয়া আমি কী করুম?
লোকমান দ্বিতীয় চমক দেখানোর মত করে পানি ভর্তি একটা প্লাস্টিকের বোতল দেখায়। এই দেখ জমজমের পানি। সাবে নিজে আইয়া আমারে দিলো। কইছে, বিকালে আহিছ, জায়নামাজ আর টুপি দিমুনে…
বুইড়ার আক্কেল দেখে মোকসদার হাড় জ্বলে যায়। আরে খাটাসের বাচ্চা, তরে কি এইগুলি আনতে পাঠাইছি নি!
-গালাগালি করছ ক্যা সক্কাল বেলাই! সাবে হজ কইরা আইছে, ব্যাকতের লাইগা আল্লাপাকের পবিত্র জায়গার জিনিস আনছে। আমাগো মত গরীব মানুষের কোনদিন ভাগ্য হইবো নবীজির দেশে যাওনের!
-আরে বুইড়া, এই মাটি কি এখন জমজমের পানি দিয়া গুইল্লা খাইবি? ট্যাকা কই, ট্যাকা দিছে?
-কইলাম না বিকালে যাইতে কইছে। তখন কমুনে। অহন বাইত বড়তি মানুষ। ক্যামনে কই। পানি আর মাটি দিছে লইয়া আইছি।
-দুইডা খেজুরও দেয় নাই! আইছে মাটি লইয়া। এহন এই বিলাইয়ের গু পানি দিয়া গুইল্লা দেই- খা!
-কছ কি তুই! আরে মাতারী এই মাটির উপর আমাগো নবীজি হাটছে। কছ কি তুই…
মোকসদা ভেতরে ভেতরে রাগে কাঁপে। মাটি না বিলাইয়ের গু সে কী জানে!... আরো কিছু বলতে চাইছিল কিন্তু বলতে পারল না।… সে একটা পাপিষ্ঠ বুড়ি খানকি মাগী! এই মুখে আল্লা-নবীরে নিয়া আকথা-কুকথা রাগের মাথায় বাইর হইয়া যায়। এই জন্যই তো জোয়ান পোলাটা তার মইরা গেলো। তার পাপেই তার পোলাটা মরছে। আল্লায় কয়, মোকসদা, এইবার বুঝ ক্যামুন লাগে!...
কিন্তু মোকসদা অনেক চিন্তা করে দেখেছে পোলাডারে যে আল্লায় কাইড়া নিলো, ঠিক তার কোন পাপে? গায়েবের মালিক আল্লা সাক্ষী, জুম্মনের বাপ ছাড়া দুনিয়ার দ্বিতীয় কোন বেডার দিকে সে চাইয়া দেখে নাই। যখন বাসায় কাম করতো তখন ছোটখাটো চুরি করছে। কিন্তু কোলের মাইয়াটা পেটের অসুখে মইরা যাওনের পর মোকসদা যেন ঘুমের মধ্যে টের পাইছিল এইটা তার চুরির শাস্তি ছিল! বাইশ বছর আগে যে বাসায় কাজ করতো, ঘর মুছতে গিয়া একটা একশো টাকার নোট কোমরে গুঁজে ফেলেছিল। মনটা সারাদিন খচখচ করছিল। দুদিন পর মোকসদার মাইয়াটার পেট খারাপ। আর বাঁচলই না। মোকসদা বুঝেছিল তার চুরির পাপে মাইয়ারে আল্লায় কাইড়া নিছে…। কিন্তু তার বিশ বছরের জোয়ান পোলাটা কার পাপে আল্লায় নিয়া গেলো? জুম্মানের বাপে আগে মদ খাইত। কিন্তু হেকমতপুরের পীর সাবের মাজারে যাওনের পর থিকা মদ ছাইড়া দিছে। অখন কালামের ডাইল পুরির দোকানে দিনরাত বইসা সাঈদীর ওয়াজ শুনে। মোকসদার মেজাজ-মর্জি ভাল থাকলে লোকমান ক্যাসেটের ওয়াজ শুনে এসে মোকসদাকে শোনায়। সেই যে একটা বদমাইশ ব্যাটা খারাপ মাইয়াগো কাছে যাইতো। ব্যাটার আবার কুষ্ঠ ছিল। তো নেককার বউটা স্বামীর কষ্ট হইব বইল্লা নিজে কান্দে কইরা স্বামীরে খারাপ মাইয়াগো ডেরায় পৌছায় দিতো! জুম্মনের বাপে কয়, দেখছত নি, তরা অইলে করতি নি এমুন? মোকসদার মেজাজ ভাল থাকলে সম্মতির মাথা নাড়ে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবে, সত্যিই, স্বামীর দাসী তো হইতে পারল না সে…। কত জানি পাপ লেখা হইতাছে আল্লার খাতায়!... তয় এইটা ঠিক, এক জুম্মানের বাপ ভিন্ন কেউ তার কাছ ঘেষতে পারে নাই। যেদিন যৌবন ছিল, গতরে মাংস ছিল, সেই মাংসের লোভে পুরুষ ঘুর ঘুর করতো। গরীব মানুষ মনে করে অনেকে টাকা-পয়সার লোভ দেখাইত। চাইলের কলে কাম করতো তখন। মহাজনে কয়, তোমারে রইদের মধ্যে কাম করন লাগবো না। দেখছো নি কি শইলের রঙ! এই রইদে পুইড়া কালা হইয়া যাইবো। তুমি ঘরের মধ্যে কাম করবা। আমার উত্তর পাড়ার গদিতে তুমি রান্দনবারনের কামটা করবা…। মোকসদা রাজি হয়নি। বাপের বয়েসি মহাজনের চোখের চাউনি যদি মাইয়া মানুষ হইয়া না বুঝে তাইলে আর এই দুনিয়াতে মাইয়া মানুষ হইয়া নিজের রক্ষা করবো কেমনে? সেদিনই জুম্মনের বাপরে কইয়া দুইজনেই কাম ছাইড়া দিয়া আসে।… তাইলে তার জুম্মন মরলো কার পাপে? আমার জোয়ান পোলাটা, অগ্রাহণ মাসে বিয়া দিবে মনে করছিল। সেই তাজা জোয়ান পোলাটারে আল্লায় ক্যান কাইরা নিলো? মোকসদা এবার কাঁদতে বসে। নাকি স্বরে চৌকিতে শুয়ে কাঁদতে থাকে। লোকমান ব্যস্ত হয়ে মাটি আর পানি কাঠের তাকে রেখে বউকে গিয়ে ধরে।
-জুম্মনের মা, কানদোছ ক্যা? কইলাম তো বিকালে যামু, সাবেরে গিয়া কমু তিন মাস ট্যাকা পাই নাই। ঘর ভাড়া জইম্মা গেছে। ঘরে খওন নাই। তুই কানদোছ ক্যা?...
মোকসদা ভাবে পুরুষ মানুষ খালি ট্যাকার কথাই চিন্তা করে। এতবড় জোয়ান পোলাটা গেলো গা, আর আমি রাক্ষসী হের মরণের ট্যাকা খাইয়া বাইচ্চা আছি- এইটা জুম্মনের বাপের চোখে পড়ে না। পোলার জন্য তো একদিনও দুইটা চোখের পানি ফেলতে দেখলাম না। পোলায় যখন মরে তখন মামলা করতে কইছিল ইদ্রিস মেম্বার। কইছে মামলার চালামু আমি। তরা মামলা কর। কিন্তু জুম্মনের বাপে নগদ পাঁচ হাজার ট্যাকা পাইয়া মামলা করল না। জুম্মনের মালিক পোলায় মরনের দুইদিন পর রাতেবেলা আইয়া কয়, লোকমান, দেখ তোর পোলায় মইরা হুদাহুদি আমারে ফাঁসাই গেলো। এত কইরা কইলাম দেহিস পাকনামি কইরা নিজে হাত দিছ না। অফিস থন লোক আইয়া লাইন ঠিক করবো নে। না, তর পোলায় নিজেই খাম্বা বাইয়া উইঠা তারটারে জোড়া দিতে গেছে। অখন আমার দোষটা কী? আমার কারখানায় কাম করতো, এইটাই আমার দোষ! হুনসি মামলা করবি? মামলা করলে করিস না করমু না। তয়, তোর পোলারে তো ফিরাই দিতে পারুম না। হের মউত আছিল, আমি তো মারি নাই, তবু তগো লাইগা কষ্ট লাগে। তুই তো বাতে পঙ্গু। জুম্মনের মায়ও তো শোয়া। আমি তরা যতদিন বাইচ্চা আছোস, পাঁচ হাজার ট্যাকা কইরা দিয়া যামু। আর অখন এই পাঁচ হাজার রাখ। ইদ্রিস মেম্বার মামলা করতে কইছে তো, তা কর, কিছু কমুনা। যা ভাল মনে করবি করতে পারছ…।
জুম্মনের সাবের লগে সাংবাদিক হেদয়াতুল ফেরদৌস আইছিল। হেয় ঢাকার পূর্বদিগন্ত পেপারের সাংবাদিক। হেয় কইল, লোকমান, বেপারী সাবের কথা মাইন্না নাও। পোলারে তো আর ফিরা পাইবা না। মাথা ঠান্ডা কইরা ভাব…।
লোকমানে মাথা টাকার কথা শুনেই ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। সে টাকা হাতে নিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। জুম্মানের সাবে লোকমানের মাথা বুকে টেনে নিয়ে সান্ত্বনা দেয়। কান্দিস না, আমি বাইচ্চা থাকতে তগো না খাইয়া মরতে হইব না। এই গ্যারান্টি দিলাম। এই যে সাংবাদিক সাবে সাক্ষী…।
জুম্মান সাবে কথা রাখছে। প্রত্যেক মাসের ১ তারিখ থিকা ১০ তারিখের মধ্যে টাকা লোকমানের হাতে এসে পৌঁছায়। জুম্মান মরছে এক বছর। এই এক বছর কোন মাস যায় নাই লোকমানরে টাকার কথা জুম্মনের সাবেরে মনে কইরা দিতে হইছে। কিন্তু হজে যাওনের পর সমস্যা বাধল। জুম্মনের সাবে হজে যাওনের আগে লোকমানরে কইল, লোকমান, মাস শেষে আমার পোলার কাছে গিয়ে বললেই হইব, আমার বলা আছে। তর কোন সমস্যা হইব না। আর আমি আল্লাহর ইচ্ছায় ফিররা তো আইতাছিই…।
সাবের পোলায় মটর সাইকেল চালায়। চিপা প্যান্ট পইরা বেনসন টানে। কয়েক বছর মহল্লার মাইয়াগো স্কুল আর কলেজের পিছনে কাটাইয়া এখন বাপের কারখানায় বসা শুরু করছে। লোকমানরে দেইখা কয়, ঐ মিয়া, আপনের পোলারে কি আমরা মাইরা ফালাইছি? কন, মাইরা ফালাইছি? বাপের থে যে মাসকাবারি ট্যাকা লন বিষয়টা কি?... আমার বাপেরে বলদ পাইয়া যা খুশি করবেন ট্যাকা কি গাছে ধরে… এইসব ক্যাচাল আমার লগে কইরা লাভ হইব না। বাপের জিনিস বাপের লগে বুঝবেন। আমি কিছু দিতে পারুম না সোজা কথা…।
জুম্মনের সাবে তিন মাস পর হজ থিকা ফিরছে। এই তিনটা মাস কেমনে ঘর ভাড়া দেয়, কেমনে খায় সেইটা আল্লাপাক ছাড়া কেউ জানে না। হজের থন ফিরা আইসা এখন অব্দি সাবের লগে কথাই কওন যায় নাই। ঘর ভর্তি খালি মানুষ। জ্ঞাতি-গুষ্টি তো কম না বেপারীগো। সবাই আহে দেখা করতে। সাবে তো মনে করছে ট্যাকা লোকমান ঠিকই পাইছে। পোলায় কি আর না দিবো। কিন্তু বিকালে গিয়া সাবেরে লোকমান সব কইব। তিনটা মাস একটা ট্যাকাও আপনের পোলায় দেয় নাই। বুড়াবুড়ি কী খাইয়া বাঁচি কন বেপারী সাব!
বেপারী সাব এইসব শুনলে আগুন হইয়া যাইবো পোলার উপর। কইবো, ঐ মাঙ্গের পো! ট্যাকা কি তর বাপের! আমার ট্যাকা আমি লোকমানরে দিমু তুই কওয়ার কেডা?... বেপারী সাবের মুখ কেমুন লোকমান জানে। উচিত কথায় হ্যায় নিজের পোলারেও ছাড়ে না। সব বড়লোক তো আর হারামী না। বেপারী সাবের বিবেক আছে। জুম্মন তো মরছে বেপারী সাবের কথাতে খাম্বা বাইয়া উঠতে গিয়া। জুম্মন রাজি হই নাই। বেপারী সাবে কয়, ঐ মাঙ্গের পো, ডরাছ ক্যা, আমি আছি না, খালি উপরে উইঠা তারটা লাগাই দিবি…। জুম্মন কয়, সাব কারেন্ট আছে শট খামু তো…। সাবে কয়, ঐ হালার পো, যখন রাইতে ব্যাটমিন্টন খেলছ তহন কারেন্ট থাকে না?... যা ব্যাটা উঠ, আমি খাড়াই আছি…। ধমক খাইয়া জুম্মন খাম্বা বাইয়া উপড়ে উঠে। ছিঁড়া তারটা গিয়া ধরে। তখনও কিছু হয় না। কিন্তু ঐটা যখন আরেকটা তারের উপর গিয়া পড়ে, তারপর যে কি হয়…। জুম্মনের সাবে কয়, পোলা ফিরাই দিতে পারুম না। তয় মাসে মাসে পাঁচ হাজার কইরা দিয়া যামু তগো। যতদিন আমি বাঁইচা আছি দিয়া যামু।…
বস্তির ঘর ভাড়া দেড় হাজার! পোলায় বেতন পাইতো চাইর হাজার। এখন জুম্মনের সাবে দেয় পাঁচ হাজার। দুইটা মানুষ কোনমতে চলে যায়। কিন্তু তিন মাস ধরে কোন ট্যাকা নাই। ঘরে খওন নাই। মোকসদার মেজাজ তো খারাপ হইবই। জমজমের পানি আর মক্কা শরীফের মাটি দেইখা এই জন্যই তার মেজাজ খারাপ হইছে। সাইদী সাবের একটা ওয়াজ আছে সেইটা মোকসদারে শুনাইতে হবে। আল্লাপাক যে কেমতে বান্দারে পরীক্ষা করে সেইটা ওয়াজে সুন্দর কইরা বলছে। হুজুরে কয়, মিয়ারা তুমরা গরীব থাকবা এইটা আল্লাপাকের একটা পরীক্ষা। অভাবের মধ্যে থাইক্কা তুমরা কতবার আল্লারে দিনে স্মরণ করো সেইটা আল্লাপাক দেখতে চায়।… বুঝছোত মুকসদা, এই যে আমরা গরীব, তার উপর জোয়ান পোলাটা গেলো গা, এইসব হচ্ছে আল্লাপাকের একটা পরীক্ষা। আল্লাপাক দেখতে চায় এইরকম পেরিশানিতেও আমরা উনারে মনে রাখি কিনা…। মোকসদা খটখটে শুকনা চোখে কয়, আল্লায় কি জানে না পরীক্ষায় কে পাশ করবো আর কে ফেল করবো?... কথা শুনে লোকমান একটা ধাক্কাই খায়। জীবনেও তো এই রকম কথা সে শুনে নাই। আল্লাপাকের কাছে তো কোন কিছুর অজানা নাই। তিনি গায়েবের মালিক। মনে মনেও যা ভাবো সেইটাও তার জানা হয়ে যায়। তাইলে এইটা আল্লাপাকের কেমুন পরীক্ষা?...
-মোকসদা নামাজ পড়! দোযগের লাড়কি হইবি মাগী… পইড়া পইড়া আর ঘুমাইছ না…। ভোররাতে লোকমান ফজরের নামাজ পড়তে মসজিদে যেতে যেতে বউকে উদ্দেশ্য করে গালি দিতে থাকে। মোকসদা জেগেই ছিল। আগের রাতে পুরোনো আমাশয়টা ফের শুরু হয়েছে। আমাশয়টা শুরু হলেই তার কোমর ব্যখা শুরু হয়। তখন বিছানায় শুয়ে থাকা ছাড়া নড়বার ক্ষমতা থাকে না। শরীর ভাল থাকলে সেও ফরজ অক্তে উঠে অজু করে নামাজ পড়ে। কিন্তু এখন মোকসদা সেসব কথা না পেড়ে লোকমানকে টাকার কথা মনে করিয়ে দেয়। বলে, জুম্মনের সাবের লগে দেখা কর। হেয় তো রাইতে বাড়ি ফিরছে। সক্কাল সক্কাল গিয়া দেখা করো…।
লোকমান আকাশ ফর্সা হলে কালামের দোকানে দিনের প্রথম কেটলির পানির চা খায়। কালাম তখন মাত্র চুলা ধরাইছে। লোকমান সময় নিয়া চা খায়। তারপর সাবের বাসায় গিয়ে দেখা করে। জমজমের পানি আর মাটি নিয়া লোকমান যখন ঘরে ফিরছে তখন চরচর করে রোদ তেঁতে উঠেছে। মোকসদার মেজাজও তিরিক্ষি হয়েছে। এখন কালামের দোকান থেকে কয়েকটা ডাল পুরি কিনে মোকসদাকে খেতে দিয়ে লোকমান বের হয়ে আসে। আসার আগে চেয়ে দেখে বুড়ি চায়ের মধ্যে পুরি ভিজায় খাচ্ছে। লোকমান দেখে আশ্বস্ত হয়। সেই ভরসায় বলে, সাবে আয়া পড়ছে অখন আর আমাগো চিন্তা কি। বিকালেই গিয়া ট্যাকা আনমুনে…। বলেই লোকমান আর দাঁড়ায় না। ঘরের বাইরে চলে আসে।
যাওয়ার বিশেষ জায়গা নেই। মসজিদ আর কালামের দোকান পর্যন্ত। জুম্মনের জানের দোস্ত আছিল কালাম। জুম্মনের মরনের পর কালাম কয়, চাচা, আপনে কুনুদিন আমার দোকান থিকা চা খাইয়া, পুরি খাইয়া যদি ট্যাকা হাদেন তাইলে আপনের লগে আর কথা নাই!... তারপর থিকা প্রায় সারাদিন কালামের দোকানে লোকমান গিয়া বসে থাকে। দোকানের ভিতর থেকে মানুষের হাঁটাচলা দেখে। সারাদিনটা এইখানেই কাটে…।
ঘর থেকে বের হয়ে লোকমান কালামের দোকানের উদ্দেশ্যেই হাঁটতে থাকে। অসময়ে মসজিদের মাইকটা হঠাৎ ঘড়ঘড় করে উঠতে সজাগ হয়ে উঠে লোকমান।
মুয়াজ্জিনের গলা শোনা যায়।… একটি শোক সংবাদ… বেপারী বিড়ি ফ্যাক্টরির মালিক বিশিষ্ট শিল্পপতি জনাব মজিদ বেপারী সকাল ১১টার সময় হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে ইন্তিকাল করেছেন, ইন্নালিল্লাহে…।
লোকমান ভিরমি খায়! কয় কি হালায়? কেডায় মরছে আর কার নাম কয়? মনে হলো মাইকে কেউ মশকরা করতাছে। সকালবেলা বেপারী সাবের লগে দেখা কইরা আইছে সে। দুই ঘন্টা হইছে, আর অখন কইতাছে হৃদযন্ত্র বন্ধ হইয়া… এইটা কুনু কথা হইল?
-নিঃশ্বাসের বিশ্বাস নাইরে লোকমান! তুই কি আমি কি… কে যে কখন যাইবো…।
-কি বালের কথা কছ! বেপারী সাবে মরবো ক্যা? লোকমান খেঁকিয়ে উঠে।
শামসুদ্দিন বন্ধু মানুষ, হঠাৎ লোকমানের রাগ বুঝে উঠতে পারে না।
-মাইকে কইতাছে হুনলাম, তুই রাগ করছ ক্যা?... শামসুদ্দিন ধমক খেয়ে বিরক্ত হয়।
লোকমান বিড়বিড় করে, এইটা কুনু কথা হইল! মাইনষের একটা বিবেক নাই…
লোকমান বুকের ভেতরটা বাষ্প হয়ে উঠে। সমস্ত দুনিয়াটাকে তার বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্রকারী বলে মনে হয়। এই আকস্মিকতা সে মেনে নিতে পারে না। বেপারী সাবে কেমতে মরে হ্যায় না মাত্র আইল হজ থিকা? মরণের তো একটা রকম আছে? এইটা কুনু কথা হইল? এইসবই যেন লোকমানকে জব্দ করার ফন্দি! শামসুদ্দিন দেখো কেমন ধোয়া ইস্তারি করা পাঞ্জাবী পইরা চইলা আসছে! দুনিয়ার সব মানুষ বেপারী সাবের মৃত্যুকে কী সুন্দর মেনে নিচ্ছে। অথচ লোকটা এই তো সক্কাল বেলা কইল, বিকালে আহিস, তর কথা শুনুম নে…। এখন লোকমানের কথাগুলি কে শুনবো?... বেপারী সাব আপনের পোলায় আমারে একটা ট্যাকাও দেয় নাই। উল্টা গাইল পারছে। দুইটা মানুষ কি খাইয়া বাচি কন দেহি! খালি আপনের ফিরনের আশায় বাইচ্চা আছি কোন মতে… তিনমাসের ঘর ভাড়া বাকী, ঘরে একটা খওন নাই…।
বেপারী ভিলায় লোকে লোকারণ্য। আগরবাতির গন্ধে পুরা বাড়ি ময় ময় করতাছে। পরিষ্কার গিলা করা পাঞ্জাবী আর টুপি লাগাইয়া মহল্লার মানুষ দেখতে আসছে। বেপারীগো বিরাট গোষ্টি। অগো লোকেরই জায়গা হয় না। লোকমান উঠানের এককোণে মাটিতেই বসে থাকে। কালাম লোকমানের কাঁধটা চেপে ধরে পিছন থেকে ফিসফিস করে বলে, চাচা, আল্লায় বিচার করছে! গরীবের বিচার আল্লায় করে…।
লোকমান এই প্রথম হাসে। মোকসদার কথা মনে পড়ে। সারাদিন বুড়ি বেপারীরে অভিশাপ দিতো। অখন মোকদসা কি কইবো- আল্লায় বিচার করছে? বিয়ান বেলা বাসি মুখে এই কুলক্ষণা কথাগুলি যে কলি এখন কী খাবি? মোকসদার প্রতি একটা বুনো ক্রোধ তির তির করে জমা হতে থাকে লোকমানের ভেতর। ….মোকসদা তোর চোপা যদি জুতা দিয়া না ভাঙ্গি তো আমার নাম লোকমানই না…। লোকমান দাঁতে দাঁত চাপে। বউয়ের উপর প্রচণ্ড একটা রাগ আপাতত বেপারী সাবের মৃত্যু শোক তাকে কিছু সময়ের জন্য ভুলিয়ে রাখে…।