গ্রামের শেষে, জঙ্গুলে ভেজা ভেজা জায়গায় গুহাটা চোখে পড়ল পিটারের। পা টিপে টিপে গুহাটার মধ্যে ঢুকেই পড়লো সে। এমনটা নয় আগে গুহাটার কথা পিটার শোনেনি। সেই ছোট্ট বেলা থেকেই মা ভয় দেখিয়ে পই পই করে বারণ করেছে জঙ্গলের এইদিকটায় না আসতে। আর ঠাকমাবুড়িটা? সেতো ফোকলা গালে সেদ্ধমাংস-রুটি চিবতে চিবোতে পিটার আর ওর ভাইদের ভূতের, ডাইনীর গল্প বলে। সুর করে ছড়া কাটে
গাঁএর বাইরে যেও না।
গুহার ভিতরে ঢুকোনা
ডাইনী বুড়ির উলটো পা
মটকাবে ঘাড় ছাড়বে না
পিটার আগে কোনদিন এদিকে আসেওনি। কিন্তু এই চোদ্দ – পনের বছর বয়সটাই এরকম, নিষেধ মোটে শুনতে ইচ্ছে করেনা। বরং নিষেধের দেওয়ালের উল্টো পিঠে যে না-জানা জগৎটা আছে তার প্রতিই একটা চোরা আকর্ষণ থাকে। সেই আকর্ষণটাই যেন তাদের ঠেলতে থাকে দেওয়ালটা ডিঙিয়ে যেতে, ওপারটায় ঝুঁকে দেখতে। পিটারও বন্ধুদের সাথে খেলতে খেলতে আনমনেই গিয়ে পড়েছিল জঙ্গলের মধ্যে গুহার সামনেটায়। তখনই মনে হল গুহার ভিতরে একবার ঢুকে দেখলে কেমন হয়? আর সে তো মোটেই একা নেই, ক্লিক তার সাথেই আছে। ক্লিক পিটারের পোষা কাঠবেড়ালি। ওর কাঁধে পকেটে দিব্যি ঘুরে বেড়ায় সারাদিন, এখনও ওর কাঁধ থেকেই ঝুলছে নরম প্রাণীটা।
গুহার সামনেটায় বড় বড় গাছ না থাকলেও, লতাপাতা, বুনো গাছপালা তো আছেই। কাঠ, গাছের ডাল দিয়ে একসময় বন্ধ করা হয়েছিল এখন সেসব ভেঙে পড়েছে। তবে এযাবৎ কালে মানুষের পা বিশেষ পড়েনি বলেই মনে হচ্ছে। সেসব সরিয়ে ভিতরে ঢুকতে বেশ হাঁপিয়েই গেল পিটার। ভিতরটায় একেবারে নিকষ অন্ধকার নয়, কেমন যেন আলো আঁধারি আবছায়া । বিদঘুটে সোঁদা গন্ধে, প্রথমটায় দম আটকে আসে পিটারের। চোখটা একটু সয়ে আসতে দেখে গুহার ভেতরটা বেশি বড় নয়। দূরে উপরের একটা ফাটল দিয়ে একচিলতে আলো ঢুকছে, যদিও এই প্রায় সন্ধ্যায় সেই ম্রিয়মান আলোতে বিশেষ কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। তবু পিটার আলোর ফাটলটার দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল। জলও তবে ঢুকতে পারে এই ফাটলটা দিয়ে, তাই বুঝি চারিপাশটা কেমন কালচে সবুজ শ্যেওলায় লেপা, তবে উঁচুনিচু পাথরও কোথাও কোথাও জেগে আছে। ফাটলটার নীচেই একটা কুয়ো একটা। কুয়োটায় বেশ জল আছে। ওপর থেকেই দেখা যাচ্ছে। যাহ্, ঝুঁকে দেখতে গিয়ে পিটারের হাতের লাট্টু টা নিচে কুয়োর জলে পড়ে ছপ করে আওয়াজ হলো। ক্লিক একটু বেশিই যেন চঞ্চল হয়ে পড়েছে, ওকে ঘাড় থেকে নামিয়ে হাতে ধরে নিচে জলের দিকে তাকিয়ে দেখে পিটার।
কিন্তু একি? সে কি ভুল দেখছে? তবে কি নিচে ওটা জল নয়?
নইলে লাট্টুটা তো জলের ওপর কাত হয়ে থাকতে পারেনা, ওটা তো জলে পড়ে ডুবে যাবার কথা, তাই না? এবার কি একটু বুকের নিচে হিম হিম ভয় চেপে বসছে পিটারের ? রঙটাও কেমন যেন মেটে ধূসর হয়ে যাচ্ছে না ওটার ? উপর থেকে হাত বাড়িয়ে ছোঁয়া যাবে কি? লাট্টুটার দিকে হাত বাড়াতেই ক্লিক সড়সড় করে ওটার দিকে নেমে গেল। চকিতেই পিটার ধরে ফেলার আগেই সেটা হাতের ওপর দিয়ে গড়িয়ে কুয়োর জলে গিয়ে পড়ল ।
এইবার পিটার পরিষ্কার দেখতে পেল, ক্লিক জলে পড়ে মোটেই ডুবে গেলনা, ওর কিছুটা মুখ আর সামনের একটা পা জলে গেঁথে গেল, যেন কাদায় পড়েছে। কুয়োর জলটা ঠিক তরল নয় কিন্তু স্বচ্ছ। পিছনের পা আর লেজটা যন্ত্রণায় নাড়ছে প্রাণীটা, আর ওর দেহের রঙটা কেমন যেন … কেমন যেন?
হ্যাঁ, এইবার বুঝতে পেরেছে পিটার, পাথর, পাথর হয়ে যাচ্ছে ক্লিক। ছটফট করতে করতে স্থির হয়ে গেল পিটারের আদরের ক্লিক।
এবার পিটার ভয় পেয়েছে। একটা প্রচণ্ড শীতল ভয় তার শিরদাঁড়া দিয়ে নেমে যাচ্ছে। পা দুটো কাঁপছে। হৃদপিণ্ডটা যেন ফেটে যাবে মনে হচ্ছে।
পালাতে হবে। এই মৃত্যুগুহা ছেড়ে যেমন করেই হোক এক্ষুনি পালাতে হবে।
গুহার মুখ পর্যন্ত আসতেই ওর জীবনীশক্তি প্রায় শেষ। বাইরের ফাঁকা জায়গাটায় এসে, দিগবিদিগ শূন্য হয়ে ছুটতে শুরু করে পিটার। কি করে যে গ্রামের ধারে চাষির বাড়ির সামনে এসে সে জ্ঞান হারিয়েছে তা ওর আর মনে নেই।
সেই চাষিরাই পিটারকে বাড়ি দিয়ে গেছে।
গরম গরম স্যুপ খাইয়ে দিয়েছে ওর মা।
বাবার কাছে বকুনি খেয়ে পিটার ঠাকুমার কাছে শুয়ে আছে। ঠাকুমা পিটারকে পাথুরে কুয়োর অভিশাপের গল্প বলছে।
গল্পটা যদিও ছোটদের নয়। তবু পিটার কে জানতেই হবে এই গুহার পাথুরে কূপের অলৌকিক রহস্য।
সে বহু বহু বছর আগের কথা।
ইংল্যান্ডের এই নেইসবারগ গঞ্জটা তখন নেহাতই গ্রাম। নেড নদীর জল আরও শান্ত, আরও স্বচ্ছ। এখানেই বাবা মা এর সাথে থাকত কিশোরী আগাথা। বাপের চোখের মনি আগাথা। মায়ের বুকের পাঁজর আগাথা। তার যেমন সুন্দর মুখশ্রী তেমনি একমাথা লালচে চুল। গা দিয়ে যেন মাখন গড়িয়ে পড়ে আর গালদুটো টুকটুকে আপেলের মত লাল। বাপ শহর থেকে আদুরে মেয়ে কে এনে দেয় লেসের ফিতে, ক্রিম, পাউডার, জড়ির পুতুল।
রোজি, মেরি, অ্যানি, আগাথার বন্ধুরা সব খেলতে আসে, ‘ও আগাথা, তোর জড়ির পুতুলটা কি সুন্দর ! একটু দে না খেলি।’
আগাথা কিন্তু পুতুল দিতে মোটে রাজি নয়। ওদের পুতুল সব ছেঁড়া ন্যাকড়ার পুঁটলি আর কাঠের ভাঙা ল্যাকপেকে। তার মতো লেসের জামা পরা জড়ির পুতুল মোটেই কারো নেই। পুতুল না পেয়ে, কাঁদতে কাঁদতে মেয়ের দল চলে যায়, যেতে যেতে বলে, ‘রাক্কুসি মেয়ে একটা, চাইনে আমাদের অমন পুতুল।’
স্কুলেও আদুরে মেয়ে আগাথার শুকনো ফল আর ঘন দুধের মিষ্টি পরিজে ভাগ নেই কোন বন্ধুর। ওরা সিদ্ধ আলু আর হাতরুটি খেতে খেতে আড়চোখে আগাথার দিকে দেখে আর গলা নামিয়ে বলে, ‘রাক্কুসি মেয়ে একটা।’
এইভাবেই নেইসবারগের দিনরাত নেড নদীর পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল। আর সুন্দরী আগাথা কৈশোর পার করে একটু একটু করে প্রজাপতির মতো ডানা মেলছিল। তার বিলোল কটাক্ষে, শরীরী বিভঙ্গে কাঁপন ধরাচ্ছিল নেইসবারগ এর ছেলেগুলোর মনে। আর মেয়েগুলো ঠিক তেমনি ভাবে মনে মনে ভাবছিল ‘রাক্কুসি, রাক্কুসি, রাক্কুসি।’
এমনি সময়ে একদিন আগাথার বাবা শহরে গেল কিন্তু সেখান থেকে আর ফিরলো না। কেউ বলল পথেই মারা গেছে, কেউ বললে রাজার পেয়াদা ধরে জেলে দিয়েছে, কেউ বলল অন্য সংসার পেতেছে। কিন্তু ঠিক কি হয়েছে তা কেউই বলতে পারল না। একজন মানুষের মৃত্যু তার আপনজনদের শোকার্ত করে, কিন্তু নিখোঁজ হয়ে যাওয়া মানুষের পরিজনেরা শোকার্ত হবার সুযোগটুকুও পায়না। প্রিয়জন কে খুঁজতে খুঁজতে আর পাড়া প্রতিবেশিদের নিত্য কৌতূহল মেটাতে, মেটাতে তাদের কপালে শোকটুকু করারও অবকাশ জোটে না । আগাথার মাও বুঝি ভিতরে বাইরে এই ধাক্কা নিতে পারল না। একদিন সকালে উঠে আগাথা দেখল মাও তার চিরনিদ্রায় চলে গেছে।
সেইদিন আগাথা আচমকা আবিষ্কার করল এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে সে একেবারেই একা। কিন্তু এই জগতের বেঁচে থাকার কড়া নিয়মকানুন সে কিছুই জানেনা শেখেনি।
দুএকদিন প্রতিবেশীরা সাহায্য করলেও, তারপর যে যার হাত গুটিয়ে নিল। টাকাপয়সা যা আছে তাতে দুবেলা খাবার জুটবে কিনা সন্দেহ। সেলাইফোঁড়াই, রান্নাবান্না এসব কাজও সে এমন কিছুই করতে শেখেনি, যে উপার্জন করে খাবে। চেয়ে চিন্তে অন্যের মন জুগিয়ে চলাও তার ধাতে নেই। বন্ধু বলে পাশে থাকবে, দুটো সুপরামর্শ দেবে এমন ও তারসাথে কেউ নেই। তাই সে নিজের সমস্যার সমাধান নিজের মত করেই করল। নিজের যা মূলধন, তাই সে কাজে লাগাল।
সেই অনিন্দ্যকান্তি রূপ।
যা একদিন নক্ষত্রের মত দূর থেকে মায়াআবেশি আলো ছড়াত, এখন তাই মাকড়শার জাল হয়ে ফাঁদ পাতল জীবনধারণের উদ্দেশ্যে।
সেই ফাঁদে ধরা দেওয়া পতঙ্গেরও কমতি হলনা। একদিন সকালে টমের সাথে বনভোজনে, তো পরদিন মাইকেলের জন্মদিনের ভোজবাড়িতে আগাথার নিমন্ত্রণ । কোনদিন আবার হ্যারির পাখি শিকারের দলে দেখা যেতে থাকল আগাথাকে। টাকাপয়সা, সাজসজ্জার অভাব রইলনা, কিন্তু দামও তার মেটাতে হল এক্কেবারে আদিম পদ্ধতিতে। মেয়েরা আঙ্গুল মটকে বলতে লাগল ‘রাক্কুসি, রাক্কুসি, রাক্কুসি।’
ঐ টম, ম্যাক হ্যারির দলে তাদের পছন্দেরও কেউ ছিল। কারো আবার স্বামীও ছিল ঐ দলে। নেইসবারগের সেই ছেলের দলের সামনে তখন একটাই আগুনে পাখি, ঐ আগাথা। তাই কথাটা আর ‘রাক্কুসি’ তে থেমে থাকল না, আড়ালে আবডালে সবাই বলতে লাগল ‘বেবুশ্যে, বেবুশ্যে, বেবুশ্যে।’
বছরখানেক এভাবে কাটলেও, যখন আগাথার বয়স প্রায় বছর ষোল আর একটি প্রাণের অস্তিত্বের খবর তার শরীর জুড়ে এমন ভাবে জানান দিতে লাগল যে তা আর চাপা দেওয়া গেলনা। স্বাভাবিক ভাবেই কুমারী মেয়ের অবৈধ সন্তানটির বাবার পরিচয়ের জন্য কানাঘুষো চলতে থাকে। কেউ বলল নদীর ধারের ম্যাক। কেউ বলল কামারশালার হ্যারি। আর কুমোরপাড়ার পিটের স্ত্রী অবিশ্বাসীর চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকল। পরিস্থিতি এরকম দাঁড়ালো যে একটা বিচারশালা না বসালেই নয়। গাঁওবুড়োরা চার্চের ফাদার কে সঙ্গে নিয়ে একদিন ডাকলেন আগাথাকে।
এমন সন্তানের পিতৃপরিচয় তো তাকেই দিতে হবে। কিন্তু এ যেন আর সেই পুরনো আগাথা নয়। কোথায় সেই অনিন্দ্যকান্তি রূপ, চটুল বিভঙ্গ? উষ্কখুষ্ক চুল, চোখের তলায় গাঢ় কালি, এই আগাথা একজন ভেঙে পড়া মানুষ। কিন্তু হাজার অনুরোধর, উপরোধেও তার মুখ দিয়ে আসল কথাটি কিছুতেই বলানো গেলনা। কে জানে সে নিজেই জানে কি না? নাকি এতজন পুরুষ সঙ্গের ভিড়ে সে সন্তানের পিতৃত্বের হিসাবটি রাখতে পারেনি? নাকি কেউ তাকে ভয় দেখিয়েছে? নয়তো মাথাটাই তার বেবাক খারাপ হয়ে গেছে? ছেলের দল মুখ লুকিয়ে রইল।
গাঁয়ের মেয়েরা প্রথমে বেশ ভয়ে ছিল, কে জানে আগাথা কার বাড়ির ছেলের নাম বলে দেয়।
সে কিছু বললে না দেখে তারা গায়ের ঝাল মিটিয়ে বলল ‘শয়তান। শয়তানই নিশ্চয়ই এই রাক্ষুসি বেবুশ্যের নাগর। এখুনি এই শয়তানের বাচ্চা আর রাক্কুসি কে গ্রাম থেকে বের করে দেওয়া হোক।’
তাই ঠিক হল। পিতৃ পরিচয়হীন সন্তান আর তার মা গ্রামে থাকতে পারবেনা। আগাথার তাতেও কোন হেলদোল দেখা গেল না। সে কি যেন একটা ভয়ে কেমন কুঁকড়ে আছে। মা হবার মত শারীরিক বা মানসিক কোন প্রস্তুতিই তার ছিল না। সে কোথায় যাবে, কি ভাবে যাবে কিছুই জানেনা। আগাথার শীর্ণ শরীর দেখে চার্চের ফাদারের বুঝি একটু মায়া হল, তিনি বললেন, গাঁয়ের বাইরে যে গুহাটি আছে আপাতত সেখানেই থাকুক আগাথা। স্বাস্থ্যকর জলের একটি কূপও আছে ঐখানে, মেয়েরা মাঝে মধ্যেই জল আনতে যায়, ওরাই কেউ খাবার দিয়ে আসবে। সন্তান হলে আগাথা যেন এই গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। আগাথা কিছুতেই কোন প্রতিবাদ করেনা। নিজের বাড়ি ছেড়ে, গ্রামের বাইরে গুহায় চলে যায় সে। সবাই তাকে ঘেন্না করলেও, তাদের বাড়িতে কাজ করত যে বুড়ি জেন, সেই শুধু আগাথা কে এই বিপদে একলা ছাড়তে পারল না। খাবার নিয়ে সে মাঝে মাঝেই ঐ গুহায় গিয়ে উপস্থিত হয়। আগাথা কখনো খায় আবার কখনো আবার শুধু খানিকটা জল খেয়েই পড়ে থাকে। কবে তার সন্তান আসবে এ নিয়ে কেউ খবর রাখেনা। সে নিজেও রাখে কি?
তবে প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মেই আগাথার সন্তান এল।
ভূমিষ্ঠ হল এক রাতে। আর তার সাথে নিয়ে এল আজব গজব এক ঝড়। সেই রাতে ঝড়ের তাণ্ডবে পুরো গ্রাম তছনছ হয়ে গেল। ঝড় যেন একটা আতিকায় সাপ হয়ে সেই রাত্রে সমস্ত গ্রামটাকে লেজে তুলে আছাড় মারল। বাতাস আর বাজের গর্জনের সাথে পশুপাখিদের আর্তনাদ মিশে গিয়ে প্রলয়ঙ্কর শব্দে গ্রামবাসীরা ভয়ে দিশাহারা হয়ে গেল। ঝড়ে মারা গেল ঘরের গরু, হাঁস, মুরগি। তারসাথে দুজন চাষিও ব্জ্রাঘাতে ঝলসে গেল।
সেই রাত্রে আগাথার কথা কারো তেমন মনে পড়েনি, মনে পড়ার কথাও নয়। যে যার নিজের ঘর বাঁচাতেই ব্যস্ত ছিল, সে অভাগীর কথা কেই বা ভাববে? শুধু ভোররাত্রে ঝড়ের মধ্যেই সেই বুড়ি জেন দৌড়ে গেছে গুহায়। গিয়ে দেখে রক্তে কাদায় অর্ধঅচেতন, প্রসবজনিত রক্তপাতে মৃতপ্রায় আগাথা। মেয়ে হয়েছে তার। প্রসবকালীন যন্ত্রণাতেই হয়ত মরেই যেত আগাথা। শুধু বুড়ি জেন এর মমতায় এ যাত্রা প্রাণটা টিকে গেল। বুড়ি জেন গাঁওবুড়োদের বলে কয়ে আগাথা কে তার পুরনো বাড়িতেই ফিরিয়ে নিয়ে গেল আবার। ঐ পাথুরে গুহাতে পড়ে থাকলে মেয়েটা বুঝি মরেই যাবে। এই পরিস্থিতিতে গাঁওবুড়োরাও আপত্তি করলো না।
কয়েকদিন পর থেকে একে একে গ্রামের লোকেরা আগাথার মেয়ে দেখতে আসে। একজন আসে, তার মুখে মেয়ের কথা শুনে আর একজন আসে। তার মুখ থেকে শুনে আরো অনেকে ভিড় জমায়। আগাথা কে গ্রাম থেকে তাড়ানোর কথা বোধহয় তারা ভুলে গিয়েছে। এক অন্য নতুন বিষয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে সব্বাই।
সবার মুখে মুখে এখন আগাথার মেয়ের গল্প। সেই অতিপ্রাকৃত ঝড়ের রাত্রে, প্রকৃতির উন্মত্ত ধবংসলীলায় যেদিন মনে হচ্ছিল যেন আকাশ থেকে নেমে এসেছে কোনো শয়তানি শক্তি, সেই রাত্রে ঐ পাথুরে গুহায় যে বাচ্চাটি জন্মেছে তাকে দেখতে অবিকল কোন রূপকথার গল্পের ডাইনীর মতো।
এমন জ্যান্ত ডাইনী দেখেছে কেউ? আশেপাশে সাতটা গাঁয়ে? তবে তাকে দেখতে তো লোক ভেঙে পড়বে না?
জেন বুড়ি তার নাম দিয়েছে উরসুলা। আগাথা সাউথেল এর মেয়ে উরসুলা সাউথেল। বাপের নাম শয়তান।
চিরনদাঁতি, ঢিপকপালি উরসুলার হাত পা গুলো কাঠির মতো, আর ভিতর দিকে বাঁকা। নাকখানা ঈগলের ঠোঁটের মত তীক্ষ্ণ আর লম্বা। গায়ের রং টা যেন কালচে হলদেটে।
অদ্ভুত জন্মগত ত্রুটি? নাকি বাবা মায়ের কোন ঘৃণ্য যৌনরোগ ? নাকি অপুষ্টি? এসব ভাবার লোক নেই গ্রামে, তারা শুধু বললে সাক্ষাৎ শয়তানের মেয়ে ‘জ্যান্ত ডাইনী’। রূপসী, সুন্দরী আগাথার মেয়ে যেন এক মূর্তিমতী ব্যঙ্গ হয়ে তার দিকে চেয়ে রইল। আগাথার আর না ছিল জীবনের থেকে কোন প্রত্যাশা না ছিল প্রাণশক্তি। সন্তানের দিকে তাকিয়ে সে বাঁচবে এমন ইচ্ছেও তার আর রইলো না। উরসুলা জন্মানোর বছর খানেকের মধ্যে অভাগিনী আগাথা মরে বাঁচল, আর তার বেহিসাবি জীবনের অভিশাপ সর্বাঙ্গে বহন করে বেঁচে রইল জ্যান্ত ডাইনী উরসুলা সাইথেল।
বুড়ি জেন এর থেকে ওর থেকে চেয়ে চিন্তে খাইয়ে পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখে ছোট্ট উরসুলাকে। আর অবাক হয়ে দেখে, এইটুকু প্রাণের কি অপরিসীম জীবনীশক্তি। বেঁচে থাকার যে টুকু রসদ পাওয়া যায় তাই শুষে নিয়ে আস্তাকুড়ে বেড়ে ওঠা লকলকে লতার মতো বেড়ে উঠতে থাকে শয়তানের জ্যান্ত মেয়ে।
দিন দিন তার রূপের বাহার আরও খোলতাই হতে থাকে। বছর সাতেক বয়সে তার একমাথা মিশকালো চুলে ঢাকা লম্বাটে মাথা। একটি পা, আরেকটি পায়ের তুলনায় ছোট, খুঁড়িয়ে হাটে। হাত ঘুরিয়ে মুছে নেয় ব্যাঁকা নাক। গায়ের রংটা পীতজ্বরের রুগীর মত ম্লান হলদে, বিবর্ণ। সমস্ত অবয়বটা নিজেই যেন একটা অমঙ্গলের বার্তা। শুধু চোখ দুটো কেমন যেন। সারা গ্রামে এমন জ্বলজ্বলে চোখ আর কারো দেখেনি জেন বুড়ি। সেই জ্বলজ্বলে চোখ ঘুরিয়ে অদৃশ্য কার সাথে যেন কথা বলে চলে মেয়েটা। দেখেশুনে ভয়ে জেনের বুক হিম হয়ে যায়। কে জানে মেয়েটা কি বলে, কার সাথেই বা বকে?
কিন্তু জেন এর বয়স হচ্ছে । তার একার পক্ষে আর উরসুলার ভার বহন করা সম্ভব হচ্ছে না। একদিন তো মেয়ে টাকে পাওয়াই যাচ্ছিল না। খুঁজতে খুঁজতে দেখা গেল দোলনায় সে চিমনি কাছে দুলছে আর কয়েকটা বাঁদর তার সাথে খেলছে। গাঁয়ের লোক বললে ‘এরা নিশ্চয়ই ওর বাপ শয়তানের চ্যালা’। মেয়েটাকে একটু একটু করে বড় হতে থাকে, তার সাথে বাড়তে থাকে গ্রামের লোকের ঘৃণা। সব্বাই সেই ছোট্ট ডাইনীকে দেখলেই দূর দূর করে ।
জেন বুড়ি অনেক ভেবে চিন্তে একদিন গ্রামের গির্জার ফাদারের কাছে এল। ফাদার অনেক ভেবে দুটি কাজ করলেন। গ্রামের ধনী পরিবার সিম্পসনদের একমাত্র ছেলে বুনো শিয়ালের কামড়ে মারা গেছে। ছেলেকে হারিয়ে সিম্পসন গিন্নি বড় ভেঙে পড়েছিলেন, তাঁর একটি অবলম্বন দরকার ছিল। ছেলেটির মাকে উরসুলাকে দত্তক নিতে নিমরাজি করালেন। কদাকার শিশুটিকে হয়তো সিম্পসনরা নিজের মেয়ে হিসাবে তাকে গ্রহণ করল না তবু তার ভরণপোষণ, দেখভালের দায়িত্ব নিল।
এতদিনে উরসুলা একটি পরিবার পেল। দ্বিতীয়ত, ফাদারের কথায় গ্রামের স্কুলে উরসুলাকে ভর্তি করে নিল। জেনের দায়িত্ব এত দিনে মিটল তবে, উরসুলার ডাইনী জীবনের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হল।
ছোট্ট গ্রাম নেইসবারগ। মোটামুটি সব খবরই ফাদারের কানে আসে। আর রবিবার দিন তো বেশিরভাগ লোকই গ্রামের গির্জায় প্রার্থনার জন্য জড়ো হয়। এমনই এক রবিবারে, স্কুলের শিক্ষকের কাছে, এক অদ্ভুত গল্প শুনলেন ফাদার। উরসুলা স্কুলে যাচ্ছে তা প্রায় বছর খানেক হল। কিন্তু অন্য ছাত্রছাত্রীদের বাবা মাদের অভিযোগে তাকে আর স্কুলে রাখা যাচ্ছে না। ফাদার খুব একটা বিস্মিত হলেন না। তিনি জানতেন এরকমটা হতেও পারে। অনাথা মেয়েটির হয়তো পড়ায় মন নেই। যে অবসাদময় অসুস্থ জীবনে সে অভ্যস্ত ছিল তাতে মনযোগী পড়ুয়া হওয়া সম্ভব নয়। আর কদাকার বলে এমনিতেই তো সে সকলের চক্ষুশূল। কিন্তু তাঁর অবাক হবার বাকি ছিল।
শিক্ষক বললেন, উরসুলার মত ছাত্রী তিনি এই গ্রামে কেন তাঁর সমগ্র শিক্ষক জীবনে পেয়েছেন কিনা তাতে সন্দেহের আছে। আসাধারণ প্রতিভাময়ী ছাত্রী উরসুলা সাইথেল। এই বছর খানেক সময়েই সে স্কুলের শিক্ষকদের চোখের মণি। ওর নিজের বয়সের ছেলেমেয়েদের থেকে উরসুলা অন্তত তিন চার ধাপ এগিয়ে রয়েছে। এতেই তার সহপাঠীরা তাকে বেজায় হিংসে করে। একে তো তার ডাইনী বদনাম রয়েইছে, তারপর পড়াশোনায় তাদের থেকে এগিয়ে যাওয়ায় ছেলে মেয়েগুলো তাকে বিব্রত করে, রাগায়, বদনাম দেয়। আর সমস্যার শুরু সেখানেই। উরসুলা সেই নিগ্রহ চুপ করে শুনে নেবার মেয়ে মোটেই নয়। সুযোগ পেলেই সে এর পাল্টা মার ফেরত দেয়। জর্জের হাতটা মুচকে গেলে, ন্যান্সির দাঁত ভেঙে গেলে বা বিল দোলনা থেকে পড়ে গেলে প্রতিবার দুটো করে ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। বাকিরা বলে ঐ ডাইনী যাদু করেই তাদের মেরেছে। আর উরসুলার বয়ান সম্পূর্ণ অন্য। তার বক্তব্য, এরাই তাকে বিরক্ত করছিল, সে তাদেরকে উচিৎ শিক্ষা দিয়েছে। সে যাই হোক, স্কুলে তাকে আর রাখা যাবে না। তাহলে অন্য বাবা মায়েরা বাচ্চাদের আর স্কুলে মোটেই পাঠাবে না, একথা তারা জানিয়ে দিয়েছে।
স্কুলে তবে ডাইনীটার আর জায়গা হল না।
কিন্তু অন্য একটা জায়গায় তার পাকা জায়গা হয়ে গেল। শিক্ষকদের মনে উরসুলা সাইথেল নিজের জায়গা করে নিয়েছিল।
তার স্কুল বন্ধ হলেও পড়াশোনা কিন্তু বন্ধ হল না। উরসুলা প্রথমে পড়াশোনার জন্য বেছে নিয়েছিল তার জন্মস্থান সেই নির্জন গুহাটিই। স্কুল, চার্চ থেকে বই এনে পড়ে। চার্চের ফাদার আর শিক্ষকেরা দুরের শহর লন্ডন থেকে আনান নানা বই। উরসুলা ভাগ বসায় তাতেও। তারপর আস্তে আস্তে গুহার আসে পাশের জলজঙ্গল বনপাহাড় তাকে নিবিড় ভাবে আকৃষ্ট করতে লাগল। উরসুলা ক্রমশ বড় হতে লাগল, এই গুহা আর জঙ্গল হয়ে উঠল তার গবেষণাগার। একাগ্র মনোযোগে সে চিনে নিতে থাকে ভেষজ গাছপালা। বনের কিছু পশুপাখির ওপর সে প্রথমে পরীক্ষা করে তার অধীত বিদ্যা। তাদের বিভিন্ন ব্যধিবেদনায় প্রয়োগ করে সেইসব ওষধির। কিছু সে নিজেও খেয়ে খেয়ে দেখে। এক সকালে হ্য়তো, এরকমই একটি আহত বনবিড়ালের পায়ে ফুটে যাওয়া কাঁটা বের করতে গিয়ে রক্তে ভেসে যাচ্ছিল তার হাত। জঙ্গলে কাঠ কুড়োতে এসে কেউ দেখে, গ্রামে গিয়ে বলে, ‘আজ ডাইনীর ভোজ বনবিড়াল।’ জ্যান্ত ডাইনী উরসুলার ভয়ে কেঁপে ওঠে নেইসবারগ গ্রাম। তবে বনবিড়ালটি বেশ সুস্থ হয়ে যায়।
তবে সবাই যে তাকে ঘেন্না করে এমনটাও নয়। তার ছোটবেলার দাইমা বুড়ি জেন, তার নতুন মা সিম্পসন এরা তাকে বেশ ভালোইবাসে। প্রথমে সে এদেরই কারো রোগ সারায় তার ভেষজ জড়িবুটি দিয়ে। তারা আবার অন্য কাউকে দেয় সেই ওষুধ। তারা সুস্থ হয়ে আবার অন্যকে দেয় উরসুলা ডাইনীর গাছগাছড়ার অনুপান। তার বয়সী মেয়েরাও আসে কেউ কেউ, লজ্জায় ভয়ে যেসব মেয়েলি রোগ তারা লুকিয়ে রাখে অথচ ব্যথা যন্ত্রণায় মরে, উরসুলার কাছে আছে তার ওষধি।
ও বাবা! বিলকুল সেরেও যায় সেইসব রোগ। উরসুলা ডাইনীর ওষুধে যাদু আছে তো !
ক্রমশ একসাথে অনেকে মিলে আসে মেয়েগুলো। ওষুধ নেয়। সে কাউকে কখনো কাউকে বলে দেয় সন্তানধারণের সঠিক সময়। কারো শরীরে্র লক্ষ্মণ দেখে বলে দেয় কি রোগ হতে পারে। তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ শক্তি, মেধা আর অধীত বিদ্যার প্রয়োগে এরকম অনেক কিছু আগে ভাগেই বলে দেয় ডাইনীটা। ঝড়, বৃষ্টি, থেকে শস্যের ফলন নিখুঁত তার ভবিষ্যৎ বাণী। রিটা, মেরি, জেসিকা ওষুধ নিতে এসে জানতে চায়, কবে ওদের বিয়ে হবে, কেমন হবে ওদের সংসার। উরসুলা ভেবে চিন্তে বলেও তাদের দু একটা কথা। কখনো মিলেও যায় সেইসব।
গ্রামেরই ছেলে পিট শিপটন।
গ্রামের সবচেয়ে বড় ছুতোরের দোকানটা ওরই।
মার জন্য বাতের ব্যাথার ওষুধ নিতে আসত উরসুলার কাছে। ডাইনীটা কি মায়া করলো কে জানে, পিট ঐ ডাইনীটার প্রেমে পড়ল। কুৎসিত মেয়েটার মধ্যে এমন কি দেখল সে যে একেবারে বিয়ে করে বসল? যাই হোক উরসুলা সাইথেলা হল উরসুলা শিপটন। সন্তান তাদের না হলেও পিটের সাথে উরসুলার বিয়েটা সুখেরই হয়েছিল। পিট তবে তার বউটাকে ঠিক বুঝেও উঠতে পারেনা। জ্যান্ত বাচ্চা ধরে কড়মড় করে খাচ্ছে বা ঝ্যাঁটায় চড়ে আকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে এরকমটা সে হয়তো দেখেনি। কিন্তু তার বউটা ঠিক আর পাঁচটা মেয়ের মতও নয়। রান্না বান্না ঘরের কাজ তার একনিমেশে হয়ে যায়। ঠিক যেমন ডাইনীদের হয়। আর দেখতে কুৎসিত হলে কি হবে? শক্তপোক্ত শরীরটায় রোগবালাই বলে কিছু নেই। এরপর সারাদিন মেয়েটা বইতে মুখ গুজে থাকে। মাঝে মাঝে কিসব বিড়বিড় করে বকে, সেসবের মাথামুণ্ডু কিছুই নেই। কোন দূরের শহরের ব্রিজ, না চার্চ ঠিক বানানো হয়নি, একদিন ভেঙে পড়বে, আকাশ দিয়ে নাকি লোহার ডানা লাগিয়ে মানুষ উড়ে বেড়াবে, সমুদ্দুরের তলা দিয়েও নাকি লোক যাবে। ঘোড়া বিনেই গড়গড়িয়ে গাড়ি দৌড়বে। এসব কেউ শুনেছে?
পিট বলে ‘দূর পাগল তাই আবার হয় নাকি?’
উরসুলা জ্বলজ্বলে চোখ তুলে বলে, ‘হবে, হবে নিশ্চয়ই হবে একদিন। হয়তো সেদিন আমরা থাকবো না। এক চুটকিতে খবর পৌঁছে যাবে এই গ্রাম থেকে ওই দূরের শহরে।’
পিট বলে ‘তুই বরং মেলেশার বর কেমন হবে তাই গুনে বল, নইলে এসব শুনলে এতদিন লোকে বলত ডাইনী,এবার বলবে পাগলি।’
তবে ‘শুনলে’ বললে তো আর চলবে না ‘শুনেছে’ অনেকেই। উরশুলা ডাইনীর ভবিষ্যতের দিন দেখতে পাওয়ার গল্প। দূর দূর থেকে লোক আসে তার কাছে, ভাল সময়টা জেনে নিতে, সন্তান হবে কিনা জানতে। উরসুলা বলতে থাকে। কারো মেলে কারো বা মেলে না। তবে একটা ঘটনায় উরসুলার নাম অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ল। দূর গ্রাম থেকে একজন লোক এসেছে উরসুলার কাছে ভবিষ্যৎ জানতে। তার বাবা বহুদিন শয্যাশায়ী, অসুস্থ, কিন্তু অগাধ সম্পত্তির মালিক। ছেলে এসেছে উরসুলার কাছে বাবার মৃত্যুর সময়টি যদি জানা যায়, বা ইঙ্গিতে জানায় যদি সেই সময়টা একটু এগিয়ে আনা যায়। সম্পত্তি হাতাতে তার বড্ড তাড়া। ডাইনীরা কত কিছুই তো পারে, যাদুমন্তরের ছোঁয়ায়। উরসুলা প্রথমেই তার অপারগতা জানায়, কারো মৃত্যুর বিষয়ে সে কোন ভবিষ্যৎ বাণী করেনা। তবু সে বান্দা নাছোড়, শেষে সে উৎকোচের উপস্থাপনা করতে উরসুলা তাকে বাড়ি থেকেই বের করে দেয়। গোলমালে গাঁয়ের লোক জমে যায়। লোকটি বেগতিক দেখে পালিয়ে বাঁচে। দিন দুই তিন পরে শোনা যায় ঐ ব্যক্তি নাকি অসুস্থ হয়ে মারাই গেছে, আর তার বাবা দিব্য ভালো হয়ে উঠেছেন। কোন উৎসাহী ব্যক্তির কাছে তিনি উরসুলার সাথে তাঁর ছেলের দেখা করার ঘটনাটি শুনে থাকবেন। পুত্রশোক সামলে একদিন তিনি এসে উরসুলার সাথে দেখা করলেন। বললেন, ‘ছেলের আমার শাস্তিটা হয়তো একটু বেশিই হয়ে গেল, তবু হয়তো তুমিই আমার প্রাণ বাঁচালে, আজ থেকে তুমিই আমার মা।’ উরসুলা তেমনই নির্বিকার। তবে সেই থেকে কোন সন্তানের মা না হয়েও উরসুলার নাম হয়ে গেল ‘মাদার’ উরসুলা শিপটন, সংক্ষেপে ‘মাদার শিপটন।’
ইংল্যান্ডের সর্বকালের খ্যাতনামা ডাইনী ‘মাদার শিপটন।’
ইয়র্কশায়ারের সেরা রহস্যময়ী ‘মাদার শিপটন।’
তবে ইংল্যান্ডের রাজধানী লন্ডনে তখনও তার নাম পৌঁছয়নি। ইয়র্কশায়ারের আশেপাশের লোকজনই তার কাছে ভবিষ্যৎ জানতে, ওষুধ নিতে আসত। একদিন ইয়র্কশায়ারের কেউ সেরকম এসেছে মাদার শিপটনের কাছে, তারা বলাবলি করছে, এক প্রভাবশালী আর্চবিশপ নাকি ইয়র্ক শহরে থাকতে আসছেন। শুনতে পেয়ে আত্মগত ভাবে মাদার বলে , ‘কিন্তু উনি তো ইয়র্ক শহরে এসে থাকতে পারবেন না।’ শিপটনের ও শত্রুর অভাব ছিল না। তারা কেউ হয়তো আর্চবিশপের কানে কথাটা তুলে থাকবে, তিনিও বিশদে ব্যাপারটা জানতে ছদ্মবেশে দূত পাঠালেন। মাদার শিপটন কে জানে কি এক অলৌকিক দক্ষতায় তাদের চিনে ফেলল, এবং আবারও বলল, সে যা বলেছে তাই হবে। আর্চবিশপ ইয়র্ক শহরে এসে থাকতে পারবেন না। তারা মাদারকে প্রচ্ছন্ন হুমকিও দিয়ে গেলেন আর্চবিশপ ইয়র্কশায়ারে এসে পুড়িয়ে মারবেন এই কুশ্রী ডাইনীকে। মাদার শিপটন একইরকম উত্তাপহীন। ইয়র্কশায়ারে আসার পথে ওই আর্চবিশপ অসুস্থতায় মারা গেলেন।
ঘটনাটিতে দেশ জুড়ে বিশেষত লন্ডন শহরে বেশ শোরগোল পড়ে গেল। রাজা হেনরির ও কানে উঠল কথাটা। শোনা যায়, ‘রাজার চিঠি’ও নাকি এসেছিলো মাদার শিপটনের কাছে। রাজা হেনরিও নাকি স্পেনের সাথে ইংল্যান্ডের যুদ্ধের আগে মাদার শিপটনের কাছে দূত পাঠিয়েছিলেন। মাদার রাজার জয়ের আভাষই দিয়েছিলেন। সেই যুদ্ধে ইংল্যান্ডের জয়ী হয়।
সে যাই হোক, বয়স বাড়তে মাদার শিপটনের বেশ খানিকটা খ্যাতি ছড়িয়েছিল।
তবে দৈনন্দিন জীবনটা ছিল তার আগেরমতই একই রকম একাকীত্বে ভরা ।
সেই বই, সেই জঙ্গল আর গুহা। পিট বিয়ের কিছু বছর পরেই মারা যায়। আর গ্রামবাসীারাও তার কাছের হয়নি কোনদিন, তারা মাদারের সাথে একটা ভয়ভীতির দূরত্ব বজায় রেখেই চলত। নেইসবারগের ঐ গুহাতে সে কিসব গাছ গাছড়া পাথর নুড়ি নিয়ে নাড়াচাড়া করতো সে সারাদিন।
ওখানেই বুড়ি ডাইনী মাদার শিপটনের মৃতদেহটা একদিন দেখতে পায় তারা। ওর পাশেই তাকে দায়সারা কবর দিয়ে দেয় । এরপর অনেকে বুড়ির ভূত দেখতে পেত ঐ গুহার আশেপাশে। তাই আর কেউ ওদিকে ঘেঁষত না।
কয়েকবছর পরেই দেখা যায় কূপের জলে কিছু পড়লে পাথর হয়ে যায়। তাই ওরা গুহার মুখটা গাছ ডালপালা দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছিল। গাঁয়ের লোকে বলে, ঐ ডাইনী নিজের প্রিয় গুহার কূপটাকে নিশ্চয়ই যাদু করে রেখেছে, তাই ওতে কিছু পড়লেই পাথর হয়ে যায়। সে মোটেই চায়না আর কেউ ওদিকে যাক। তাই মরার আগে বুঝি কুয়োটাকেই অভিশপ্ত করে রেখে গেছে।
পিটার ঠাকুমার গল্প শুনে স্তব্ধ হয়ে শুয়ে থাকে।
ডাইনীর অভিশপ্ত কূপটাকে তার আর অত ভয়ঙ্কর মনে হয়না। সে দেখে, ঐ কূপটার পাশে একটা ছোট্ট মেয়ে ফুল পাতা নিয়ে খেলছে। ক্লিক ও মাঝেমাঝে ওর গায়ে উঠে ডাক দিচ্ছে চিক চিক চিক। ভালবাসার কাঙাল মেয়েটার চোখদুটোয় বড় বেদনাভরা মায়া।
পিটারের চোখ ঘুমে জড়িয়ে আসে।
[ মাদার শিপটন ( ১৪৮৮-১৫৬১) ইংল্যান্ডের উত্তর ইয়র্কশায়ারের নেইসবারগ গ্রামে জন্মান। স্থানীয় এক পতিতার গর্ভে জঙ্গলের গুহায় এই বিকলাঙ্গ শিশুটির জন্ম হয়। তার নাক হাত পা সবই যেন ডাইনীর মত। তাই গাঁয়ের লোক তাকে 'জ্যান্ত ডাইনী' বলত। জঙ্গলের গাছ গাছড়া দিয়ে ওষুধ তৈরি করতে সিদ্ধ হস্ত ছিলেন। বহু ভবিষ্যৎবাণী করে গেছেন। ইঞ্জিন, সাবমেরিন, এরোপ্লেন, এমনকি অন্তর্জালের কথাও হেঁয়ালির আকারে তাঁর ছড়ায় পাওয়া যায়। এগুলি ডাইনীর ভবিষ্যৎবাণী নাকি তীক্ষ্ণ ধীশক্তি সম্পন্ন একজন মানুষের মনীষার ফসল? শোনা যায় রাজা তাঁর ভবিষ্যৎ বানীর উপর ভরসা করতেন। সেই বাণীগুলি কি শুধুই অতিপ্রাকৃত অদ্ভুতুড়ে বিস্ময়? নাকি প্রখর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রকাশ? অনাদি অতীত যে কথা কয়না, তাই কিছু বিষয় আমাদের অজানাই থেকে যায়। জানা যায় না একজন প্রতিভাময়ী চিকিৎসক, রাজনীতিবিদ, কবির অবদান থেকে মানবসভ্যতা বঞ্চিত হল কিনা।
তাঁর জন্মস্থানের গুহার কূপটি আজও অলৌকিক। সেখানে কিছু বস্তু পড়লেই তা পাথর হয়ে যায়। একি ডাইনীর অভিশাপ? যেখানে একটি অসহায় অনাথ শিশু তার শারীরিক ত্রুটির জন্য উপহাসের পাত্র হয়, এতটুকু মমতার আশ্র্য়ও পায়না, সেখানকার জীবনের স্রোতে একটু অভিশাপ তো মিশে থাকবেই। বিজ্ঞানীরা যতই শক্তিশালী খনিজ টনিজের ব্যাখ্যা দিন না কেন, আমরা প্রকৃতির অলৌকিকতাতেই বিশ্বাস রাখব। পাথরহৃদয় মানুষের কপালে পাথুরে জলের কূপই তো জুটবে, তাই নয় কি?
‘জ্যান্ত ডাইনীর কূপ’ কোন ইতিহাস নয়, নিতান্তই গল্প। মনের মাধুরি মিশিয়ে অন্তর্জালের কিছু তথ্য নিয়ে বানানো এক কিস্সা। এতে ঐতিহাসিক সত্য খুঁজতে না গিয়ে আমরা বরং একটি দুঃখী মেয়ের জন্য একটু মমতার খোঁজে যেতেই পারি।]
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।