একটা এক্সিডেন্ট হয়েই গেছিল প্রায়!
তবে মিতালী দক্ষ হাতে দ্রুত ব্রেক কষায় স্কুটিটা রাস্তার কোনাকুনি গিয়ে থেমে গেল।
ওদের গাড়ির হেডলাইটের চড়া আলো গিয়ে পড়েছে পাশের ধান ক্ষেতে। সেই অন্ধকারে একটি মানুষ অর্ধেক শরীর জলেকাদায় ডুবে বসে রয়েছে।
হেড লাইটের তীব্র আলো না থাকলে মানুষটিকে একটি কাদার ঢিপি বলেই মনে হত নিশ্চয়।
গাড়ির আলো এসে পড়তেই সে তিয়াষদের দিকে দেখেই উঠে দৌড়ে চলে গেল রাস্তা থেকে আরও দূরে ক্ষেতের দিকে, অন্ধকারে।
তবে মূর্তিটি চোখ তুলে তাকিয়েছিল যখন, তিয়াষ দেখেছে সেই মণিটি একেবারে বোবা। কোন ভাষা নেই সেখানে। কিন্তু কাদামাখা মুখের ভাঁজে ভাঁজে যেন কিসের আর্তি, দুঃখের বলিরেখা।
আগের দিনের সেই পাগল মহিলা। আজ তিয়াষ একেবারে সামনে থেকে দেখেছে।
এই ক্ষণিকের চমকের জন্য প্রস্তুত ছিল না তিয়াষ। মুহূর্তের বিস্ময় সরিয়ে রেখে বাচ্ছাদুটোকে দেখতে গিয়ে দেখে, ওরা দুজনে যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে। সামনে, পিছনে, ডানে, বামে কোথাও নেই। তিয়াষ একটু চমকে যায়।
তবে কি ভুল দেখল ও? এতটা ভুল? এমনকি ঐ দুইভাই একে অপরকে জড়িয়ে ধরা পর্যন্ত?
স্কুটিটাকে স্ট্যান্ড করে এতক্ষণে তিয়াষের দিকে ফিরেছে মিতালী।
মিতালী বললে, “আপনি অন্ধকারে ওকে দেখতে পেয়েছিলেন নাকি তিয়াষদি? ভয় পাবেন না। ও কারো ক্ষতি করে না। মাথায় একটু গোলমাল আছে। ও মাঠেঘাটে বাচ্ছাদের খুঁজে বেড়ায়।”
তিয়াস একটু সামলে উঠেছে, বলল “তবে তো শিগগির পুলিশে যাওয়া উচিত, বাচ্ছাগুলোকে ঐ পাগলে ধরলে কি হবে ভাবলেই আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে।”
মিতালী যেন একটু মলিন হাসল, “পুলিশ পাগলের কি করবে তিয়াসদি? আর বাচ্ছাই বা এখন কোথায়?”
তিয়াস এবার অবাক হয়ে তাকায় মিতালীর দিকে বলে, “বাচ্ছা দুটো তো………
পাশ দিয়ে একটা টেম্পো হর্ন বাজিয়ে চলে যায়। জায়গাটা মুহূর্তের জন্য আলোকিত হয়ে আবার অন্ধকারে ডুবে যায়। খুব অন্ধকার অবশ্য নয়। আকাশে চাঁদ উঠেছে।
মিতালী হয়তো ঠিক শুনতে পায়নি তিয়াষের কথা।
সে বলতে থাকে, “জানেন দিদি, ওরা প্রতিবছরই আসে। ছোট ছোট দলে। কোন দল আসে দক্ষিণের জলজঙ্গলের এলাকা থেকে। আবার কোন দল আসে পশ্চিমের রুখু মাটি থেকে। যেখানে আগুনে রোদে মাটি বেবাক ফুটিফাটা হয়ে থাকে বছরের বেশিরভাগ সময়। সেখানে জল নেই, কাজ নেই, ভাতও নেই। ওরা তখন বাপমায়ে ছেলেমেয়ে কোলে কাঁখে নিয়ে এই সিতাবপুরের মত জায়গায় কামলা খাটতে আসে।
এইসব হরিপুর, নবাবগঞ্জ, সিতাবপুরে। এদিকের মাটি উর্বর, দোফসলি। ধান, চালের মাটি। সারা বছর ধরে এখানে ক্ষেতে, খামারে খাটিয়ে লোকের দরকার।
ওরা আসলে দল বেঁধে থাকে ঐ বটতলার ধারে। তাঁবু খাটিয়ে হইহই করে।
ঐ পাগলীটাও একসময় এসেছিল এরকমই কোন একটা দলের সঙ্গে। তখন অবশ্য ও পাগল ছিলনা।
মানুষের পোষা গরু ছাগল ছাড়াও এই মাঠ আর জলার ধারে দু একটা অন্য জন্তুও যেমন শেয়াল, হায়েনা এসবও ঘোরাফেরা করে। বছর কুড়ি আগে আরও জঙ্গল ছিল এদিকে। সুযোগের অপেক্ষায় থাকে ওরা। কখনো যদি এদের ফেলে দেওয়া খাবারের উচ্ছিষ্ট মেলে। খুব একটা বেশি জোটেও না অবশ্য। এদের হাঅন্ন পেটে সব ঢুকে যায়।
শুধু তাঁবুর আশেপাশে বাতাসে ভেসে বেড়ায় গরম ভাতের সুঘ্রান, মাছের কাঁটাচচ্চড়ির আঁশটে গন্ধ।
তবে কোন একদিন হয়তো সুযোগ এসে গেছিল।
ছয় বছরের বড় ছেলেটার সঙ্গে আড়াই বছরের ছোটটাও তাঁবুতে ঘুমিয়ে ছিল। মা বাপে গেছিল জমিতে খাটতে। হায়েনা বা শিয়ালে কখন ছোটটার ঘাড় মুটকে টেনে নিয়ে গেছিল কে জানে? বড়টাও কি দৌড়ে গেছিল ভাইকে বাঁচাতে?
তবে জঙ্গলের কাছে মাঠে যখন পাওয়া গেছিল, ছোটটা বেঁচে ছিল না। মুখ, ঘাড় থেকে মাংস খুবলে নিয়েছিল দাঁতালের দল। বড়টা লড়েছিল বোধহয়। কামড়ও খেয়েছিল অনেক। তখনও নাকি বেঁচেছিল কিন্তু ছোট্ট শরীরটা চিকিৎসার ধকল নিতে পারেনি। তিনদিনের মাথায় সেও মারা যায়।
সেই থেকে ওদের মা আর দলের সঙ্গে ফিরে যায় নি। রয়ে গেছে এখানেই, তাও বছর কুড়ি হল। সারাদিন এই বটতলার চারিপাশে ঘোরে। এর বাড়ি, ওর বাড়ি থেকে কেউ খাবার দিলে খায়। রাতে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পাশে একটা ঘরে শুয়ে থাকে। আবার কখনো থাকে না, রাতভর ঘুরে বেড়ায়।
অপঘাতে মৃত্যু বলে ছেলে দুটোকে এই মাঠের আশেপাশেই কোথাও পুঁতে দিয়েছিল। সেই থেকে এই মাঠটার নামই হয়ে গেছে ছেলেপোঁতার মাঠ।’’
একটু থেমে মিতালী বলে, “তবে আগে নাকি অনেককে বলতো ও এখানে ছেলে দুটো কে দেখতে পায়, এখন তো অনেক দিন কথাও বলেনা আর।’’
মিতালী স্কুটিতে স্টার্ট দেয়।
তিয়াষ নির্বাক। ও উঠে বসে।
ওদের সামনে হেডলাইটের চড়া আলো।
তিয়াষ মুখ ঘুরিয়ে দেখে, পিছনে অন্ধকার। গাঢ় অন্ধকার।