সেদিন মধ্যদুপুরে নগরীর কোর্ট পয়েন্টের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে যখন আব্দুল মজিদ ঘোষণা দিল যে সে একটি গল্প বলতে চায় তখন রাস্তায় চলাচলরত ব্যস্ত মানুষেরা তার দিকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল এবং ভেবেছিল সে একজন বদ্ধ উন্মাদ। কিন্তু আব্দুল মজিদের তাতে কোন অসুবিধা হল না। সে বার বার একই ঘোষণা দিয়ে যেতে লাগল যে সে একটি গল্প বলতে চায়।
আব্দুল মজিদের এই কার্যক্রম নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত মানুষদের কাছে অস্বাভাবিক ঠেকেছিল এবং অস্বাভাবিক জিনিসের প্রতি মানুষ এক ধরনের আকর্ষণ অনুভব করে সুতরাং কিছু মানুষ আব্দুল মজিদকে ঘিরে দাঁড়াল। আব্দুল মজিদ প্রচন্ড সূর্যের উত্তাপে গরম ভেজাল বিটুমিনের স্তর দ্বারা আচ্ছাদিত রাজপথে দাঁড়িয়ে তার চারপাশে জমে যাওয়া মুখগুলোকে দেখে ভেতরে ভেতরে পুলক অনুভব করল। তার মনে হল অনেক অনেক দিন পরে রাশি রাশি পক্ষীকূল তার ভেতরের দুনিয়ায় একসাথে উড়াল দিয়েছে এবং তারা এক স্বর্গীয় ছন্দে একসাথে ডানা কাঁপিয়ে উড়ে চলেছে। আব্দুল মজিদের শরীরের ভেতরের রক্ত টগবগ করে ফুটে উঠল এবং সদ্য দৌড়াতে শেখা বাছুরের মত তার সমস্ত শরীর জুড়ে ছুটে বেড়াতে শুরু করল অপার্থিব উচ্ছ্বলতাকে সঙ্গে নিয়ে। আব্দুল মজিদ এইসব অনুভব করে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না। তার কণ্ঠ ভারী হয়ে এল এবং চোখগুলো ঝাপসা হয়ে আসল। সে নিজের চোখকে উপস্থিত জনতার চোখের আড়াল করতে উত্তপ্ত রাজপথের দিকে তাকাল এবং সে দেখতে পেল স্থানে স্থানে চাকার ঘর্ষণের ফলে রাস্তার বিটুমিন উঠে গেছে। সেইসব জায়গা রাস্তার বুকের ক্ষত হয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে আর কোথাও কোথাও এইসব ক্ষত অগভীর গর্তে পরিণত হয়েছে। আব্দুল মজিদ ঝাপসা চোখ দিয়ে দেখলেও অনুভব করতে এইসব ক্ষত এবং গর্ত আসলে নগরের নাগরিকদের বিবর্ণ হৃদয়ের প্রতিচ্ছবি। তার খারাপ লাগে এবং সে নিজেকে শক্ত করে উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে মুখ তুলে বলে, আজ আমি আপনাদের একটা গল্প বলব। শহরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গল্প। এইগল্প এই শহর এবং শহরে বসবাসকারী মানুষের গল্প। আপনাদের মনে হতে পারে এই গল্পের সাথে শহর এবং শহরবাসীদের কোন মিল নেই। কিন্তু এই মনে হওয়া ভুল হবে। কারণ আমি এই চারপাশের বাস্তব পৃথিবীর ভেতরের অবাস্তব জগতটাকে দেখেছি এবং সেইমত বুঝে নিয়েছি এই শহরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গল্পটিকে। এখন আমার দায়িত্ব আপনাদের এই গল্প শোনানোর। আপনাদের কি এই গল্প শোনার সময় হবে?
আব্দুল মজিদের চারপাশে যে মানুষগুলো জড়ো হয়েছিল তারা বেশ আমোদ পেল। তারা হাসি হাসি মুখ করে আব্দুল মজিদের কথা শুনছিল এবং কেউ কেউ কথা বলছিল। তাদের সেইসব কথা এই গল্পের ক্ষেত্রে অগুরুত্বপূর্ণ বিধায় সেইসব উহ্য থাকল। আব্দুল মজিদের চারপাশে ভীড় বাড়ছে। কোন এক অদ্ভুত কারণে মানুষ এইসব জিনিসে আগ্রহ অনুভব করে। ব্যস্ত মানুষেরাও গাড়ি থামিয়ে, গাড়ির গ্লাস নামিয়ে দেখতে লাগল কী হচ্ছে এখানে।
আব্দুল মজিদের মনে হল গল্প বলার পক্ষে যথেষ্ট মানুষ হয়েছে। সে গল্প শুরু করার আগে একবার চিৎকার করে বলল, ব্যস্ত নাগরিকবৃন্দ, আপনাদের কি সময় হবে আমার গল্প শোনার?
উপস্থিত জনতার উত্তর ছিল হ্যাঁ সূচক।
সুতরাং আব্দুল মজিদ ভরাট কণ্ঠে গল্প শুরু করল। সে বলল, আপনারা আজ যেখানে জড়ো হয়েছেন, এখানে, ঠিক এইখানে আজ থেকে অনেক অনেক বছর আগে ছিল এক বিরাট দীঘি। সেই দীঘিতে ছিল মুক্তার মত জল। এবং সেই কানায় কানায় পূর্ণ দীঘির জলে সকাল বিকাল ভেসে বেড়াত পানকৌড়ির দল।
তখন নগরের লোকেরা সেই পানকৌড়িদের দেখত এবং তাদের পিঠে চড়ে নগর ভ্রমণের স্বপ্নে বিভোর থাকত শহরের যাবতীয় প্রেমিক যুগল। এই অদ্ভুত এবং উদ্ভট চিন্তা বা ইচ্ছা কেন তাদের মাথায় চেপে বসেছিল কেউ জানে না। হতে পারে এটা এমন কোন বিষয় যা মানুষ কেন প্রেমে পড়ে বা এইজাতীয় কিছু বিভ্রান্তিকর প্রশ্নের মত ব্যাখ্যাতীত। প্রেমিক যুগলেরা ছাড়া আর কেউ সেই পানকৌড়িদের দেখে তেমন কোন ইচ্ছাপোষণ করত না কিন্তু মোটের উপর শহরবাসীদের এই ধারণা ছিল যে এইসব পানকৌড়িরা আসলে খুব পবিত্র ধরনের প্রাণীবিশেষ।
আব্দুল মজিদ এই পর্যন্ত বলে দম নেয়। তার চারপাশে আরো মানুষ জমেছে। এবং আশ্চর্যের ব্যাপার, সবাই মনযোগ দিয়ে গল্প শুনছে। চারপাশে কোথাও কোন শব্দ নেই। শুধু দূর থেকে কিছু রিকশার টুং টাং শব্দ ভেসে আছে যা এই নীরবতাকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছিল যেন।
আব্দুল মজিদ কিছুটা অবাক হয়। এত মানুষ জমল কেন? আর তারা এত তন্ময় হয়ে শুনছেই বা কেন? সাধারন বিবেচনায় সে বুঝতে পারে, সে যেভাবে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে মানুষদের আহবান করেছে তা যেকোন একটা পাগল লোকের মত এবং এইসব জিনিসের সাথে নগরবাসীরা পরিচিত খুব। সুতরাং আব্দুল মজিদের ধারণা ছিল বেশিরভাগ লোক তাকে উপেক্ষা করে চলে যাবে।
তার মনে হয় এই গল্প সত্যি সত্যিই এই শহরের একমাত্র মৌলিক গল্প যা নগর তার আত্মায় ধারণ করে আছে শত শত বছর ধরে। সুতরাং, কোন এক ছুতায় যেহেতু গল্প আব্দুল মজিদের মুখ থেকে বের হচ্ছে তখন শহর তার সমস্ত সম্মোহনের শক্তি দিয়ে তার নিজস্ব বাসিন্দাদের টেনে এনেছে এবং নিজের গল্পের জাদুতে মুগ্ধ করে রেখেছে। আব্দুল মজিদ দেখতে পায় আরো মানুষেরা ছুটে আসছে।
আব্দুল মজিদ উত্তেজনা অনুভব করে এবং সে আবার গল্প শুরু করে, তারপর একদিন খুব ভোরে নগরবাসীরা যখন ঘুমে তখন শহরের সব প্রেমিক যুগল এক হল এই দীঘির পাড়ে। এইসময় পানকৌড়িরা স্থির হয়ে ধ্যান করে। প্রেমিকযুগলেরা পূর্বপরিকল্পনা মত সবাই একসাথে চেপে বসে একেকটা পানকৌড়ির পিঠের উপর।
আর পানকৌড়িরা দীঘির পাড়ে উঠে আসে। শহরবাসী ঘুম ভাঙ্গা চোখে তাকিয়ে দেখে পানকৌড়ির পিঠে চেপে নগর প্রদক্ষিণ করছে তাদেরই পরিচিত কিছু প্রেমিক যুগল।
তাদের খারাপ লাগে। তারা ছুটে যায় নগরপিতার কাছে। নগরপিতা চিন্তিত মুখে বললেন, কাজটা খুব খারাপ হয়েছে। এদের বিয়ে দিয়ে দিতে হবে।
তখন নগরের বাসিন্দাদের কেউ কেউ ভাবলেন হয়ত এর জন্যই শহরের সব প্রেমিক যুগল চেপে বসেছিল পানকৌড়ির পিঠের উপর। দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য এর চেয়ে ভালো উপায় আর কী আছে!
সুতরাং, যেসব প্রেমিক যুগলেরা পানকৌড়ির পিঠে চেপে নগর পরিভ্রমণ করেছিল তাদের সবার বিয়ের দিন ঠিক হল একই দিনে। সেই দিনে প্রচুর আয়োজন। তৈজসপত্রের জন্য নগরঋষি মন্ত্রযুক্ত কাগজ দীঘিতে নিক্ষেপ করার পর বিভিন্ন ধরনের রান্না বান্নার জিনিসপত্র ভেসে উঠল দীঘিতে।
তারপর সারা শহর মেতে উঠল আনন্দে।
যেদিন বিয়ে সম্পন্ন হল সেদিন থেকে নগরের কিছু পরিবর্তন শুরু হল সবার চোখের অগোচরে। দীঘির জল কমতে শুরু করল। জল কমার পরিমাণ বাড়তে থাকল দিন দিন। এবং এক পর্যায়ে দীঘির প্রাচীন বাসিন্দা পানকৌড়িরা উড়াল দিয়ে চলে গেল অজানা দিগন্তে। সেবার শীতে পুরো শুকিয়ে গেল এই বিশাল দীঘি।
আব্দুল মজিদের কন্ঠ ভারী হয়ে আসে। সে বলে, হ্যাঁ। এইখানে দীঘিটা ছিল। যেখানে আপনারা দাঁড়িয়ে আছেন।
আব্দুল মজিদের ভেতর থেকে এক ধরনের চাপা কষ্ট উঠে এসে গলার কাছে যেন দলা পাকিয়ে বসে থাকে। সে আর কোন কথা বলে না বা বলতে পারে না। মানুষেরাও দাঁড়িয়ে থাকে নিশ্চুপ।