একুশতলার বারান্দায় অন্ধকার ভরা। বাড়িতে ঘন্টা দেওয়া ঘড়ি নেই, না হলে হয়ত অনেক আগেই শুনতে পেতাম বারোটা ঘন্টা কিংবা কোন সিম্ফনীর ভাঙ্গা টুকরো। সেই শব্দ পালটে নিতে পারতাম আবার পাখির ডাকে, সমুদ্রের ঢেউয়ে। কৃত্রিম ঢেউয়ের শব্দে আমার আলাদা কোন ভালো লাগা ছিল না ততদিনে, তুমিও তো বেশী আপন করে নিয়েছিলে সেই অন্য বাইরের বারান্দায় নোনা বাতাস, লবণাক্ত স্বাদ। সমুদ্র থেকেও বহুদূরে আমাদের সেই লবণাক্ত স্বাদ - রাতের ঘড়ির ঘণ্টায় মিশে যাওয় কত স্বাদকোষ, জিহ্বার কোণ দিয়ে মুছে নেওয়া স্বচ্ছ কেলাস।
এই বারান্দা থেকে বাড়ি দেখতে পাই না, আস্ত গোটা বাড়ি। ঘর দেখি, এই ঘরকে ওরা বাড়ি বলে, আমি দেখি ঘরের সারি, বেশীর ভাগই না হয়ে ওঠা বাড়ি, – অসম্পূর্ণ। কাল সকালে আবার কাজের দিন, আলো নিভে এসেছে প্রায় সব খানেই। একদম আশে পাশে কেউ নেই, দূর থেকে দেখা যায় না ঘরের মৃদু আলো, মিশে গ্যাছে যা রাতের সাথে। অলস ভাবে আকাশের চাঁদ খোঁজার চেষ্টা করি, এই বারান্দার উত্তর দিক কোনটা? ঘাড় ঘুরিয়ে চাঁদ ঘুঁজতে গিয়ে চোখ আটকে যায় এক ছোট জানালায়। ঝাপসা কাঁচের আলোর ওদিকে ওটা কি বাথরুম? সেই আলো নিভে আসে ক্রমে, তার পাশের বড় জানালাটা কেউ এসে ঢেকে দেয় – এবার জ্বলে উঠবে হয়ত মৃদু আলো। এর পরের গল্প হয়ত চেনা – এবার আমি আকাশের চাঁদ খুঁজি
সকাল আরো কাছ এগিয়ে আসে, বিছানায় যাওয়া জরুরী, কাল সকালে মিটিং আছে। ঘড়িটা ড্রয়ার থেকে টেনে বের করতে গিয়ে চোখ পড়ে যায় সেই মরফিন প্যাচ্-গুলোর প্যাকেটে। এখনো রয়ে গ্যাছে এরা? বেশ কয়েকটা প্যাচের প্যাক দেখলাম, হাত দিয়ে সরিয়ে আরো পেলাম মরফিন ট্যাবলেটও। মনে পড়ে গেল সেই ক্যানাল রোডের দোকান থেকে কেনা – সাথের ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনটা এগিয়ে দিয়েছিলাম, সেটা শুধু মরফিনেরই জন্য। ওরা আবেগহীন আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দেয় যন্ত্রণা – এই ডাক্তারের হাতের লেখা খুব সুন্দর, কালি পেনে লিখেছে। আমিও পড়ে নিতে পারি, ডাক্তার লিখে দিয়েছে চাইলে মাস দুয়েকের জন্য স্টক করে নিতে পারি মরফিন প্যাচ এবং ট্যাবলেট। ওরা প্যাচ এনে দেখায়, আমার চোখ চলে যায় ছোট ছোট ট্যাবলেটে। কেমন প্রশান্তি এনে দেবে এরা?
স্টক করে নিই – বেশ কয়েক পাতা প্যাচ আর অনেক মরফিন ট্যাবলেট। ওরা আবারো কৃত্রিম হাতে ঢুকিয়ে রাখে ড্রায়ারে ডাক্তারের কালি পেনের লেখা। সব প্যাচ আজে আসে নি, শেষ হবার সময় পায় নি সব ট্যাবলেটেও – ভুলেও গিয়েছিলাম এদের কথা। ড্রায়ার খুলে হাত বুলিয়ে নিই প্যাচ গুলোতে, আর লালচে মোড়কের ট্যাবলেটে। ততদিনে গুগুলে জানা হয়ে গ্যাছে এদের কাজ, প্রতিক্রিয়া তোমার শরীরের উপরে সম্ভাব্য। কিন্তু আমার? একটু দূরের বারান্দার পাশের ঘরের মৃদু আলো, ঢেকে দেওয়া জানালা কেমন যেন ঘোর লাগিয়ে দেয় – এক হাতে প্যাচ আর অন্য হাতে ট্যাবলেটের পাতা নিয়ে বেরিয়ে আসি আবার বারান্দায়।
কেউ তো দেখার নেই এই আঁধারে, ছুঁইয়ে পরা চাঁদের আলো বিহীন এই বারান্দা। গেঞ্জীটা ঘুলে ফেলি, ডান হাত দিয়ে বুলিয়ে নিই বুকের বাঁদিকটা, যেখানে হাড়ের পিছনে কম্পন থাকার কথা। আমারও বুক নির্লোম প্রায়, এইবারে কোন উঁচুনিচু পায় না আমার হাত, ডান হাত দিয়ে হৃদপিন্ডের উপরেই বুলাতে থাকি আঙুল। মধ্যমায় জড়ানো আঙটি কেমন ঠান্ডা হয়ে গ্যাছে, হালকা শিরশির করে ওঠে বুকের ত্বক আঙটি্র স্পর্শ পেয়ে। কত সময় কেটে গ্যাছে বুঝতে পারি না – একটু ঠান্ডা লাগছে বাইরের বাতাসে এই একুশ তলায়। হাতের মঠোয় ধরে থাকা মরফিন প্যাচটা খুলি – কেমন করে লাগাতে হয় সে বড় চেনা, আলোর দরকার হয় না, অভ্যস্ত হাতে বুকের ঠিক একই জায়গায় এঁটে দিই প্যাচটা। আবারো আকাশের চাঁদ খুঁজি, একদম তেইশ তলার উপরে হেলিপ্যাডের পাশে জ্বালিয়ে রাখা লাল আলোটা জ্বলতে নিভতে দেখি। এই ভাবে জ্বলতে নিভতে থাকা লাল আলোও বড় চেনা, আমি সেই সাথের আরো চেনা শব্দ কান পেতে শোনার চেষ্টা করি – কিন্তু এখানে শুধুই নিভৃতি।
জানি কতক্ষণ অপেক্ষা করার কথা – প্যাচে হাত বুলাই, এইবার কমবে। যন্ত্রণা খোঁজার চেষ্টা করি প্যাচের জন্য, মরফিনের জন্য – গহীন ভাবি, এই তো মনে হচ্ছে কেমন মোলায়েম হয়ে আসছে সব। পায়ে হাত বুলাই, কদিন আগে ফুটবল খেলা লব্ধ ফুলে থাকা জায়গার ব্যাথা কি ক্রমশ মনে আসছে? এখন অনেক অনেক রাত – যে ঘুম পাচ্ছে সেটা কি মরফিনের জন্য? আমি তো এই সময়ে এমনই ঘুমিয়ে পড়ি – ভাবতে ভাবতে বিছানায় গা এলিয়ে দিই।
মরফিন প্যাচের সংখ্যা কমে আসে – আর একটু করে চাঁদ সরে যায় বারান্দার দিকে। আমার পায়ের ব্যাথা তত দিনে ভালো হয়ে গ্যাছে – এতো তাড়াতাড়ি? বাহ মরফিনের এফেক্ট তো তাহলে ভালো, সামনের ম্যাচ খেলার জন্য আমি প্যাচ লাগিয়ে যাই গভীর রাতে। বুকের উপরে ঠান্ডা আঙটির ছোঁয়া লাগে এই এখনো। অথচ এই আঙটি পরে থাকার আর কোন মানে হয় না, কেউ তো অনুযোগের নেই, নেই তো কেউ সংস্কার মনে করিয়ে দেবারও। মরফিন প্যাচের সাথে আঙটি কথা বলে, চাঁদ নেমে আসে মৃদু আলোর পর্দার উপরে। ভিতরের মৃদু আলো আড়াল করে দেয় একঝাঁক মেঘের ফাঁক থেকে উঁকি মারা ভোর রাতের চাঁদ।
আর কয়টা প্যাচ রয়ে গ্যাছে? শুয়ে শুয়ে সিলিং-য়ের দিকে তাকিয়ে ভাবি – সিলিংয়ের রঙের নাম ‘মুনলাইট’, তোমার পছন্দের কেনা। মাথার দিকের দেওয়াল কোন এক পীচ রঙের শেডের, মনে করার চেষ্টা করি সঠিক কালার কোড। কিছুতেই মনে আসে না! ডান হাত বুকের উপর ঘোরা ফেরা করে, কাল তিনটে প্যাচ লেগেছিল ঘুম আনতে। অভ্যাস নেই বলে কি প্যাচের জন্য ভুলে যাচ্ছি অতিচেনা রঙও? এই ঘরে টিকটিকি নেই সেই আমাদের আগের বাংলোর মত। মনে মনে হাসি, যদি ভয় পেয়ে কেউ ঘুমের মাঝে বুকের উপর চলে আসে দুম করে – প্যাচগুলো বরং ঢেকে রাখি, যদি সরে যায় চাপ পেয়ে!
সিলিং-য়েও দিপদিপ করে জ্বলে এক ছোট লাল আলো, ফায়ার অ্যালার্মের ইন্ডিকেটরটা। এই লাল আলোও বড় চেনা - পরশু রাতে মনে হয়েছিল কেউ যেন ধূপ নিয়ে আঁধারে সন্ধারতি করছে। ঠোঁটের ফাঁকে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে, ভেবেছ কি ভুলে যাব এত সহজেই?
সেদিন রাতে আমেরিকার টিমের সাথে মিটিং ঠিক জমে না – অনেক কথা ভুলে যাই যা বলার ছিল। ম্যানেজার জিজ্ঞেস করে কিছু হয়েছে কিনা আমার। রাত যত বেড়েছে মন চলে গ্যাছে সেই ড্রয়ারের দিকে, প্যাচ লাগাবার সময় চলে যাচ্ছে, সময় পেরিয়ে যাচ্ছে তোমার সাথে গল্প করারও। দেরী করে বিছানায় গেলে তুমি যদি ঘুমিয়ে পর? কোন মতে মিটিং শেষ করে আমি শুতে চলে আসি, রাতের খাওয়া হয় না আজকাল, সে যতই বাড়ি থেকে মা মনে করিয়ে দিক না সময় মত খাবার কথা। ড্রয়ার খুলে আমার চমকে ওঠার পালা, প্যাচ নেই আর! বুকে হাত বোলানো হল আর, আজ কি হবে কথা বলা? বাইরের বারান্দায় এসে বসি – এখন চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে কাঠের চেয়ার, বসার টুল – তোমার পছন্দের বেতের মাদুর। রেন-ফেরেষ্টের গাছের গুঁড়িকে জিজ্ঞেস করি, তোমার মনে আছে, আমরা দুজন একসাথে তোমাকে পছন্দ করে এনেছিলাম বাড়িতে? আরো কত কত গল্প – এক সময় ভোর হয়ে এল।
পরের দিন অফিস থেকে ফেরার সময় লিফটে দেখা হয়ে যায় নীচের ফ্ল্যাটের কোন এক মহিলা এবং তার ছোট ছেলের সাথে। বড় সুন্দর সেজে তারা কোন এক বার্থডে পার্টি থেকে ফিরছে – ছেলেটার বয়স প্রায় বাবু-র মতই না? আর তার মায়ের বয়স? মনে নেই কতক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম ওদের দিকে – এখনো আমাদের লিফটে সি সি টি ভি ক্যামেরা বসে নি। তাই কোন প্রমাণ থাকবে না আমি ঠিক দেখছিলাম যাচাই করার। ভদ্রমহিলা কি আমার তাকিয়ে থাকার জন্য অস্বস্তিতে পড়েছিলেন? নিজের স্বামীকে কি বলেছেন সে কথা? তা না হলে কেন উনার স্বামী আমার দিকে আড়চোখে দেখছিল ওইদিন? কি ভাবে বোঝাতে পারা যায় সেই ঝলমলে শাড়ি নয়, লিফটের ওঠা টুকুর সময় আমি চেয়ে দেখছিলাম সংসার ?
রাতের বেলা হাত চলে যায় লাল মোড়কের ছোট মরফিন ট্যাবলেটের পাতা গুলোর দিকে – অনেক পাতা যে বেঁচে রয়েছে এখনো। এর এফেক্টও তো জেনেছি গুগুল থেকে। চাঁদ আবার ঘোর লাগিয়ে দেয়, বেশী ঘোর লাগায় সেই লিফটের ওঠা, ছেড়ে যাওয়া সুবাস আর অংশত সংসার দৃশ্য। একটা ট্যাবলেট খুলে খেয়ে নিই ফ্রীজ থেকে বের করে আনা কোকা-কোলার সাথে। আজ তো বাতাস বড় ফুরফুরে – রাত বাড়ে, ঠান্ডা লাগে না আজ কারণ গেঞ্জী তো খোলার দরকার হয় নি আজ। বসে থাকি – অনন্তকাল কি? তোমার ডাক শুনে হুঁস আসে। হ্যাঁ, অনেক রাত হল, এবার ঘুমাতে যাচ্ছি। বারান্দায় মেলতে দেওয়া কাপড় গুলো তুলতে বলছ? ঠিক আছে আমি তুলে নিচ্ছে – ফ্যাব্রিক কন্ডিশনার দিয়েছি কিনা জিজ্ঞেস করছ? আনা হয় নি বুঝলে অনেক দিন, শুধু লিকুইড ডিটারজেন্ট দিয়েই তো অনেক দিন ধুচ্ছি। ঠিক আছে তোমার শাড়ি গুলো আমি রোদে দিয়ে রাখব – আর সোয়েটার গুলো কেবল ইজি দিয়েই কাচব।
কত কথা হয় এরপর প্রতিদিন। অনেক দিনের না কেনা সাংসারিক জিনিস এসে যায়, ভরে ওঠে কিচেন আস্তে আস্তে। পোচামপল্লী শাড়িটা আগের বার পছন্দ করেও কেনা হল না বলছিলে – হঠ করে পুজোর আগেই অন্য দেশে ছুটতে হল জরুরী দরকারে। আমরা সিলিং-য়ে মেলে দিই শাড়ির আঁচল, বড় সুন্দর কাজ করা। দেখো, ওই কোনের দিকটা ঠিক করে ধরে রেখো। এ্যাই দেখেছো, গড়িয়ে পড়ছে শাড়িটা – ক্রমশঃ আমাদের মুখ-শরীর ঢেকে যায় শাড়িতে। আবার লবণের স্বাদ – মাত্র কিছুক্ষণ, তার পরেই মনে হয় পাশে শুয়ে থাকে বাবু-র শরীরও তো ঢেকে গ্যাছে সেই শাড়িতে – ছেলেটার বড় গরমের শরীর, ঘেমে গ্যাছে কপালটা, কিন্তু তবুও অঘোরে ঘুমাচ্ছে। পোচামপল্লী শাড়ির কোণ দিয়ে বাবুর কপাল মুছিয়ে দেওয়া হয়।
এক দিন তুমি পাশের ঘর থেকে ডাকলে শাড়ির কোঁচ ধরে দেবার জন্য – আমি বললাম এত রাতে আবার শাড়ি পরে কি হবে? কালকে আসলে লেডিস-টি পার্টি আছে সকালে, তাই রাতে একবার ট্রাই করে দেখে নেওয়া কেমন লাগছে। আমি সেই ঘুম ঘুম চোখে উঠে গেলাম শাড়ির আঁচল ধরতে।
ট্যাবলেটের পাতাও প্রায় শেষ হয়ে আসে। সেদিন বেশী রাত হয় নি – হাতে বেঁচে থাকা কয়টা ট্যাবলেট নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছি, আর হয়ত দিন দুয়েক হবে। এই নিয়ে কথা বলতে হবে তোমার সাথে, যদি তুমি ডাক্তার-কে বলে কন্টিনিউ করার কথা বল, তাহলে হয়ত আরো আনতে পারব। হঠ করে চোখ চলে যায় নীচের দিকে, এত উপর থেকে ঠিক নজরে আসে না – সুইমিং পুলে যাবার গেটটা খোলা কেন? আর ওটা, ওটা কে একেবারে পুলের জলের ধারে? একপায়ে দাঁড়িয়ে অন্য পায়ে পুলের গভীর দিকটার জলে দিয়ে খেলছে? চাঁদের আলোয় দেখি ফেলি বাবু-কে। তুমি কোথায়? বাবু কি করে ওখানে গেল? আমি চিৎকার করে বাবুকে ডাকবার চেষ্টা করি – কৈ, ও শুনতে পাচ্ছে না কেন? আমি বারান্দার রেলিং-টা টপকে যাই চট করে, একটু সময় লাগবে নীচের স্পর্শ পেতে।
আমি দেখতে থাকি, ওই তো বাবু মায়ের সাথে ওর ঘরের বিছানায়! এক ঘরে ওই তো বাবু নিজের লেখার টেবিলে কি আঁকছে – তুমি বিছানাটা ঝড়ছো – আবার তুমি ড্রেসিং টেবিলের সামনেও রাত পোষাকে মুখে ক্রীম ঘষছ – অন্য ঘরে পর্দাটা টেনে দিচ্ছে কেউ, মৃদু আলো – তুমি একটু অপেক্ষা করো, আমি বাবুকে নিয়ে ফিরছি – শুনতে পেলে কি?