মেডিকেল কলেজে জেনারেল সার্জারি, অর্থোপেডিক্স, প্লাস্টিক সার্জারি, কার্ডিওথোরাসিক সার্জারি, সার্জিক্যাল অনকোলজি, এনস্থেসিওলজি, ক্রিটিকাল কেয়ার-এ হাউস স্টাফশিপ করেছেন বেশ ক বছর। দেখেছেন রোগীদের ব্যথায় ভুগতে, ব্যথার উপশম যেন চিকিৎসকদের কাছে ঠিক গুরুত্ব পায় না--রোগ হলে ব্যথা তো হবেই এমনটাই যেন। অথচ ব্যথা থেকে মুক্তি পেতেই তো রোগীরা ডাক্তারের কাছে আসে।
মেডিকেল কলেজ থেকে বেরোনোর পর যখন কাজ করেছেন বেলভিউ-উডল্যান্ডসে সেখানে ব্যাপারটা অন্যরকম। রোগীর ব্যথা কমাতে ডাক্তারকে ছুটে আসতে হয় রাত বিরেতেও। তাহলে ব্যথার উপশম কি সচ্ছল মানুষের একচেটিয়া? সাধারণ মানুষের তাহলে ব্যথা থেকে কি মুক্তি নেই?
তারপর যখন শ্রমজীবী মানুষেরই এস আই হাসপাতালে যোগ দিলেন সেখানেও চিত্রটা সরকারি হাসপাতালের মতই। তীব্র কোমরের ব্যথায় ভোগা অনেক রোগী কোমরে ট্রাকশন লাগিয়ে বেডে শুয়ে আছেন। নিজেকেও একবার কোমরে ব্যথার জন্য ট্রাকশন লাগাতে হল। ট্রাকশনে আসলে কিন্তু কোমরে ব্যথা কমে না, আজকাল তো ট্রাকশন দেওয়াই হয় না। কোমরে ব্যথার জন্য অপারেশন করলে ব্যথা কমে না বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, অনেকের তো ব্যথা বেড়ে যায়।
একই দশা ক্যান্সার রোগীদের। ক্যান্সারের ব্যথা কমাতে মহৌষধি মরফিন। মরফিন আমাদের দেশে উৎপাদিত হলেও চলে যায় বিদেশে। আমাদের ক্যান্সার রোগীরা ব্যথায় কষ্ট পেয়ে মারা যান।
ব্যথা যে অন্য রোগের উপসর্গ মাত্র নয়, দীর্ঘস্থায়ী ব্যথাকে রোগ হিসেবে গণ্য করা দরকার এই উপলব্ধি আসে এই চিকিৎসকের মননে। তারপর নিজেকে শিক্ষিত করা, স্বীকৃতি অর্জন করা, সরকারি ব্যবস্থার লাল ফিতে ছিঁড়ে ব্যথা চিকিৎসার এক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা ইএসআই হাসপাতালে, ভারতের প্রথম ব্যথা চিকিৎসা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র-ই এস আই ইনস্টিটিউট অফ পেইন ম্যানেজমেন্ট।
ব্যথা চিকিৎসার এই পুরোধা পুরুষ চলে গেলেন ২০২৩-এর ৫ই জুলাই।
সুব্রত গোস্বামীর বয়স হয়েছিল মাত্র ৫৯ বছর। বছর তিনেক মোটর নিউরন ডিজিজে ভুগে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন তিনি। ১৯৬৪ সালের ৩০ শে জানুয়ারি হুগলি জেলার গুপ্তিপাড়ায় জন্ম সুব্রত গোস্বামীর। মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস পাঠক্রমে ভর্তি হন ১৯৮২ সালে, পাস করেন ১৯৮৭ সালে। যে সময় সুব্রত মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন তার পাঁচ বছর আগে ১৯৭৭ এর অভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থা উঠে যাওয়ার পর মেডিকেল কলেজের গণতান্ত্রিক ছাত্রছাত্রীরা এক স্বাধীন সংগঠনে ঐক্যবদ্ধ হন--গণতন্ত্র ঐক্য প্রগতি যার মূল মন্ত্র। সে সময় ছাত্র সংসদেও এই সংগঠন মেডিকেল কলেজ ডেমোক্রেটিক স্টুডেন্টস' অ্যাসোসিয়েশন--এমসিডিএসএ। এমসি ডিএসএ-র সক্রিয় সদস্য হিসেবে ছাত্র সুব্রতর বেড়ে ওঠা। এক শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখতে শুরু করা, সেই ব্যবস্থার চিকিৎসক যেমন হবেন সেই ডাক্তার নরমান বেথুন, ডাক্তার দ্বারকানাথ কোটনিসকে শিক্ষক হিসেবে মেনে নেওয়া। সমাজ পরিবর্তনের নেতৃত্ব দেবেন যারা সেই শ্রমিক শ্রেণীর কাছে পৌঁছুতে শ্রমিক বস্তিতে ছুটে যাওয়া।
১৯৮৪- র পর এমসিডিএসএ যখন সংকটে তখন সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। ছিলেন সংগঠনের আহ্বায়কও। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগঠন পিডিএসএফ-এর সঙ্গে তিনি যুক্ত হন।
১৯৮৩-র অল বেঙ্গল জুনিয়ার ডাক্তার ফেডারেশনের আন্দোলনের সময় সুব্রত ছিলেন ছাত্র, দ্বিতীয় দফার আন্দোলন ১৯৮৭-তে সুব্রত তখন জুনিয়ার ডাক্তার। এবিজেডিএফ-এর নেতৃত্বে ছিলেন তিনি।
এমবিবিএস পাস করার পর বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষানবিশি করেন সুব্রত, তা শুরুতেই বলেছি। আসলে লক্ষ্য ছিল পোস্টগ্র্যাজুয়েশন না করে নিজেকে শ্রমজীবী মানুষের দক্ষ চিকিৎসক হিসেবে তৈরি করা। মেডিকাল কলেজের পর্ব শেষ করে সিনিয়ার কিছু সহযোদ্ধার সঙ্গে বর্ধমান জেলার কয়লা খনি এলাকা পান্ডবেশ্বর-উখরায় ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সঙ্গে থেকে স্বাস্থ্য আন্দোলনের কাজও করেন তিনি। পরবর্তীতে লক্ষ্য ছিল ছত্তিশগড়ের শ্রমিক হাসপাতাল শহীদ হাসপাতালে যোগ দেওয়া। কিন্তু ১৯৯১-এ শংকর গুহ নিয়োগীর হত্যা ও কয়েক বছর পর ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চার ভাঙ্গন তাঁকে বিরত করে।
১৯৯৩ থেকে কলকাতা শহরের কিছু বড় বেসরকারি হাসপাতালে কাজও করেন। রাজ্যে এবং কলকাতা শহরে ক্রিটিকাল কেয়ারে দক্ষ চিকিৎসকদের প্রথম যে দলটি গড়ে উঠেছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন তিনি।
বেসরকারি হাসপাতালে ক্রিটিকাল কেয়ারবিদ হিসেবে কাজ করে গেলে রোজগার মন্দ হতো না। কিন্তু যৌবনের রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকে সুব্রত জানতেন সমস্ত মানুষের স্বাস্থ্যের দায়িত্ব নিতে পারে একমাত্র রাষ্ট্র। তাই সরকারি হাসপাতালে যোগ দেওয়া সুব্রতর।
আর সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় যোগ দিয়ে তাতে পরিবর্তন আনা ছিল তাঁর সু ব্রত। ১৯৯৪ সালে শিয়ালদহ ই এস আই হাসপাতালে এনাস্থেশিওলজির মেডিকেল অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। শ্রমিক জীবনের কাছাকাছি থাকতে চেয়েই তাঁর ইএসআই-এ যোগ দেওয়া।
১৯৯৫-এ ছত্তিশগড় থেকে ফিরে কানোরিয়া আন্দোলনের শ্রমিক-কৃষক মৈত্রী স্বাস্থ্য কেন্দ্র গড়ে তোলার কাজ শুরু করি আমি। ১৯৯৭-এ তাতে যোগ দেন একে একে অমিতাভ চক্রবর্তী, সুমিত দাশ, পরিমল মন্ডল, চয়ন দত্তরায়, পার্থ প্রতিম পাল…। কানোরিয়া জুট সংগ্রামী শ্রমিক ইউনিয়নের মধ্যবিত্ত নেতাদের সঙ্গে মতপার্থক্য হতে থাকে ক্লিনিক পরিচালনা নিয়ে।
ইউনিয়নের সঙ্গে স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সম্পর্ক ছিন্ন হয় ১৯৯৮-এ। তখন শ্রমিক-কৃষক মৈত্রী স্বাস্থ্য কেন্দ্র পরিচালনা এবং সারা বাংলা জুড়ে স্বাস্থ্য আন্দোলনের কাজ করার জন্য গড়ে ওঠে শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ।
শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগ রেজিস্টার্ড হয় ১৯৯৯-এর ডিসেম্বরে। যে ৭জনকে নিয়ে সোসাইটি শুরু করা তাদের মধ্যে ছিলেন সুব্রত গোস্বামী। তারপর বিভিন্ন সময় ছিলেন সহ-সম্পাদক, সহ-সভাপতি। শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের হয়ে ২০০০ ও ২০০১-এর বন্যা, ২০০৯-এর আয়লা, ২০২০-র আমফান, ২০২১-এর ইয়াসে চিকিৎসাত্রাণের টীমে থেকেছেন। ২০০৭-এ নন্দীগ্রামের মত জন আন্দোলনের ওপর রাষ্ট্রের নিপীড়ন যখন নেমে এসেছে তখনও শ্রমজীবীর চিকিৎসাদলে থাকতে দ্বিধা হয়নি সরকারী চাকুরে সুব্রত-র। ১৯৯৯-এ বাঁকুড়ার বেলিয়াতোড়ে শুরু হয়েছিল শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের গ্রামীণ স্বাস্থ্য কেন্দ্র মদন মুখার্জী স্মৃতি জনস্বাস্থ্য কেন্দ্র, এই মাসিক শিবিরের দায়িত্ব সুব্রত পালন করেছেন ১৯৯৯ থেকে অসুস্থ হওয়ার আগে অবধি।
যে হাসপাতালে যোগ দিয়েছিলেন ১৯৯৪ সালে, সেই হাসপাতালেই তাঁর গড়ে তোলা ইনস্টিটিউট অফ পেইন ম্যানেজমেন্টের কোর্স ডিরেক্টর হন সুব্রত ২০১৩ থেকে। রাস্তাটা সহজ ছিল না।
ই এস আই হাসপাতালে শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে ব্যথার সমস্যার দিকে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষিত হয়। ব্যথা মেডিকেল কন্ডিশন, সার্জিক্যাল কন্ডিশন বা অর্থপেডিক কন্ডিশনের জন্য এমনটা সব সময় নয়। ক্রনিক পেইন বা দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা এমন একটা সমস্যা যার সমাধানের জন্য চিকিৎসকদের আলাদা প্রশিক্ষণ লাগে। এই প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে প্রশিক্ষণ নেন নিজে। কিন্তু কেবল একা শিখলেই তো হবে না, গড়ে তুলতে হবে অনেক ব্যথা বিশারদদের, তাতেই তো সাধারণ মানুষের লাভ।
ইনস্টিটিউট গড়ে তোলায় মন্ত্রীর সাহায্য নিয়েছেন, শ্রমমন্ত্রী তখন কানোরিয়া আন্দোলনের এক প্রাক্তন নেতা, তাঁর ঘনিষ্ঠ এক নেত্রী পিডিএসএফ-এ সুব্রত-র সমসাময়িক। এই যোগাযোগ সুব্রত ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার না করে করেছেন পেইন ইনস্টিটিউট গড়ে তোলার জন্য সরকারী হাসপাতালে শ্রমজীবী মানুষ যাতে ব্যথার চিকিৎসা পায়।
এমবিবিএস করার পর এমডি বা এমএস করেননি সুব্রত, কেন না যাদের মধ্যে কাজ করবেন বলে স্বপ্ন দেখতেন তিনি তারা চিকিৎসকের দক্ষতা দেখে, ডিগ্রি দেখে না। কিন্তু পেইন ইনস্টিটিউটকে সামাজিক স্বীকৃতি দিতে গেলে নিজেরও আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ দরকার। ২০১০ এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ব্যথা চিকিৎসার ফেলোশিপ অর্জন করেন তিনি। ব্যথা ও বায়োমেকানিক্সে পিএইচডি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
সুব্রতর গড়ে তোলা ইনস্টিটিউট এর পাঠক্রম রাজ্যের স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি পায়। দেশের অনেকগুলি সরকারি বেসরকারি স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এই পাঠক্রমের আদলে নিজেদের পাঠক্রম তৈরি করে।
আজীবন সক্রিয় ছিলেন মেডিকেল কলেজ এক্স স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশনে। সম্পাদকও ছিলেন এক বছর। তার উদ্যোগেই সে বছর মেডিকেল কলেজ কাদম্বিনী গাঙ্গুলীকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়।
ইন্ডিয়ান ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন, ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অফ বেঙ্গল এবং ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে মেডিকেল ইউনিটে সক্রিয় থেকেছেন। CPR (কার্ডিও পালমোনারি রিসাসিটেশন) বা হৃদ শ্বাস পুনর্জীবন শিক্ষা দিয়েছেন অসংখ্য মানুষকে। CPR শেখানোর জন্য ভিডিও বানিয়েছেন। সুব্রত একাধারে ছিলেন সুলেখক, সুবক্তা এবং সুঅভিনেতা।
ইন্ডিয়ান সোসাইটি ফর দা স্টাডি অফ পেইন এ সংগঠকের ভূমিকা পালন করেছেন দীর্ঘকাল। আরজি কর মেডিকেল কলেজ এবং মেডিকেল কলেজে পেইন ক্লিনিক শুরুতে তিনি ছিলেন পরামর্শদাতা।
আই এ এস পি ডেভেলপিং কান্ট্রিস গ্রান্ট ২০২২, আই এ এস পি ওয়েস্ট বেঙ্গল চ্যাপ্টারের লাইভ টাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড, দ্বারকানাথ কাদম্বিনী সম্মান, নবম কৃষ্ণা মেমোরিয়াল অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন তিনি। ইন্ডিয়ান সোসাইটি ফর দা স্টাডি অফ পেইন এর ২০২৪ সালের লাইফ টাইম এচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড এর ঘোষিত প্রাপক ছিলেন সুব্রত। সেই সম্মান নেওয়া থেকে তাকে বিরত করল মৃত্যু।
২০২০ সালে ধরা পড়ে সুব্রত গোস্বামী, মোটর নিউরন ডিজিজে আক্রান্ত। ক্রমে বেড়ে চলা পক্ষাঘাত এবং শেষে মৃত্যু—এই অবধারিত পরিণতির সামনে দাঁড়ানো সুব্রত অকুতোভয়ে করে গেছেন নিজের বাকি কাজ যতটা করা যায়।
২০২২ এর ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ইএসআইয়ের ডেপুটি ডিরেক্টর (মেডিকেল) হিসেবে কর্মরত ছিল। অসুস্থতার কারণে স্বেচ্ছা অবসর নেন ২০২৩ এর ৩১ শে জানুয়ারি। তার পরের দিনগুলো ছিল কষ্টকর, শয্যাশায়ী, শ্বাসকষ্টের জন্য বাই-প্যাপ ভেন্টিলেটরে, খাদ্যগ্রহণের জন্য ফিডিং গ্যাস্ট্রোস্টমি, বারবার সংক্রমণ…
সুব্রত গোস্বামী যে কাজ শুরু করেছিলেন তাঁর ছাত্র-ছাত্রীরা, তাঁর বন্ধুরা সে কাজ চালিয়ে নিয়ে যাবেন এমনটা আশা করা যায়, কেন না সুব্রত গোস্বামী এক ব্যক্তি নন এক উজ্জ্বল মশালের নাম।