২০১৯ এর মার্চ মাসে সংখ্যাটা ছিল ৬৭। এর মধ্যেই সেটা বেড়ে হয়েছে ৮০।
এই সংখ্যা মৃতের। আরো ঠিক ভাবে বললে খুন হওয়া আরটিআই একটিভিস্টদের সংখ্যা। কি সেই আইন যাকে বাস্তবায়িত করার চেষ্টায় এতোগুলো সাহসী মানুষের প্রাণ চলে যায় ? তাকে সংশোধন করে মর্জিমাফিক রূপ দেওয়াতেই বা শাসকের এতো আগ্রহ কেন ?
সরকারের মহাফেজখানায় যা রেকর্ড রূপে সংরক্ষিত আছে তাইই তথ্য এবং অল্প কিছু ক্ষেত্র বাদে সেগুলি জানার অধিকার এই গণতান্ত্রিক দেশে প্রত্যেক নাগরিকের আছে। নিয়মমাফিক আবেদন করলেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তা আমার আপনার হাতে তুলে দিতে বাধ্য। পঞ্চায়েতে কোন প্রকল্পে টাকা কী ভাবে খরচ হয়েছে, কারো চিকিৎসায় কোনো ভুল হলো কিনা, বা মন্ত্রীমশাইয়ের শিক্ষাগত যোগ্যতা, সব তথ্যই এই আইনের বলে সাধারণের জানা হয়ে যেতে পারে। গ্রামের রেশন দোকানের গরমিল থেকে শুরু করে রাফায়েল কারচুপি, সব ক্ষেত্রে জানতে চাওয়া মানুষ কাজে লাগিয়েছে এই আইনের অধিকারকে। গণতন্ত্রের অন্যতম লক্ষণ যে বিনা প্রশ্নে শাসকের ফরমান মেনে না নেওয়া তার বৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে এরই ছত্রছায়ায়। উপরন্তু সরকার এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মনে করিয়ে দেওয়া যে তাদের কৃত কাজের দায়িত্ব তাদেরই এবং সেগুলির ওপর নজরদারির কোনো অভাব নেই ।
স্বাভাবিক, আধিপত্যকামী শাসক এই আইনকে ভেঙেচুরে এমন রূপ দিতে চাইবে যাতে কোনো অস্বস্তিকর অপকর্ম ফাঁস হয়ে জবাবদিহির দায় ঘাড়ে এসে না পড়ে।
২০০৫ সালে আরটিআই এক্ট বা তথ্যের অধিকারের আইন এদেশে চালু হয়। তার পর থেকে স্বাধীন এবং গুরুত্বপূর্ণ এই আইনের বলে তথ্যের অধিকারকে কাজে লাগিয়ে প্রচুর অসাধ্য সাধন করা হয়েছে। যেমন আদর্শ হাউজিং সোসাইটি স্ক্যাম। কারগিল যুদ্ধে স্বামীহারাদের জন্য বানানোর কথা একটি ছ' তলা বাড়ি, সেটাই কী করে হয়ে উঠল একত্রিশ তলা প্রাসাদ যেখানে মন্ত্রীমহোদয়রা এবং আর্মি অফিসাররা বিলাসবহুল জীবন কাটাবেন, সেটা তথ্যের অধিকার না থাকলে কোনদিনই ফাঁস হতো না। ঠিক তেমনই 2G কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়া। টেলিকম মন্ত্রকের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় জালিয়াতির জাল বিছিয়ে প্রায় ২ মিলিয়ন অর্থ সরকারি কোষাগার থেকে লুট করা হয়। এই আইন না থাকলে এই কেলেঙ্কারি কখনো দিনের আলো দেখতে পেতো না।
বোঝাই যাচ্ছে স্বমহিমায় থাকলে তথ্যের অধিকারের আইন কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে কতটা কার্যকরী।
অত্যন্ত পরিতাপের কথা যে সাধারণ মানুষের হাত থেকে এই কার্যকরী অস্ত্র কেড়ে নেবার জন্য এবার আটঘাট বেঁধেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। এবং তাতে তারা সফল, কারণ এই আইনের সংশোধনী সংখ্যার জোরে সংসদের দুইকক্ষেই পাস করিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছেন দন্ডমুন্ডের কর্তারা।
তথ্যের অধিকারের আইনের এই অমোঘ ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তার জন্য বার বারই এর ওপর আনার চেষ্টা হয়েছে সংশোধনের খাঁড়া। এমনকি এই আইন প্রণীত হবার ছ' মাসের মধ্যেই সংশোধনী আনবার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু সচেতন আন্দোলনের ফলে তা বার বারই প্রত্যাহৃত হয়েছে। এবার গত ১৯ শে এপ্রিল এই আইনের কয়েকটি বিশেষ ধারার বদল চেয়ে সংসদে সংশোধনী প্রস্তাব আনা হয়। এই বিশেষ ধারাগুলির বলে কেন্দ্রীয় তথ্য আধিকারিকরা ইলেকশন কমিশনারদের এবং রাজ্যের তথ্য আধিকারিকরা রাজ্যের মুখ্য সচিবের সমান ক্ষমতাবান হিসেবে বিবেচিত হতেন। এবং ঐ দুই পদ মর্যাদার অফিসারদের মতোই স্বাধীনভাবে দক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে পারতেন। সেটাই স্বাভাবিক, কারণ এ কথা তো সবাই বোঝে যে
তথ্য আধিকারিকরা কারো মুখাপেক্ষী হয়ে কাজ করতে বাধ্য হলে তাদের কর্মপদ্ধতি ব্যাহত হবে এবং তাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এই আইন প্রণয়নের পেছনের মূল ভাবনা -- একজন সাধারণ নাগরিকেরও রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম সম্বন্ধে জানবার অধিকার আছে। সেই জানার ওপর ভিত্তি করে সে যদি মনে করে কোথাও অন্যায় হয়েছে তাহলে সে আদালতে সুবিচার চাইতে পারে।
তথ্য আধিকারিকদের স্বাধীনতা ও ক্ষমতা খর্ব করবার প্রবল আগ্রহ থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের এবারের বায়না, সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটির দ্বারা এবং নিখুঁতভাবে সংজ্ঞায়িত আইনের সাহায্যে এতোদিন ধরে তথ্যের অধিকার কমিশনারদের যে নিয়োগ এবং চাকরির শর্ত ঠিক হয়ে এসেছে, সেই প্রথা সম্পূর্ণ তুলে দিয়ে গোটা ব্যাপারটাই তারা নিজেদের হাতে নিয়ে নেবে। তারাই ঠিক করবে এই কমিশনারদেরদের মাইনে কতো হবে, ভাতাই বা কতো, কতদিন তারা কাজ করতে পারবে এবং তাদের চাকরির অন্যান্য সমস্ত শর্ত। এমনকি রাজ্যের তথ্য আধিকারিকরাও কেন্দ্রীয় সরকারের নির্মিত নিয়মকানুন মেনে চলতে বাধ্য থাকবে। দেখে নেওয়া যাক খুব দ্রুততার সঙ্গে পাশ করিয়ে নেওয়া এই বিলের প্রভাব কতো সুদূরপ্রসারী হতে পারে।
তথ্যের অধিকার করণের আধিকারিকদের কাজ সবসময়ই অন্য সরকারি কাজের থেকে আলাদা। ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে বসে থাকা ব্যক্তিদের সিদ্ধান্তকেও যাতে সাধারণ মানুষ চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে সেই পথ সুগম করা তো আর যান্ত্রিক কলমপেষার কাজ নয়। আজ্ঞাবহ দাসেরও কাজ নয়। পুরোপুরি স্বাধীন না হলে এই কাজ দক্ষতার সঙ্গে পালন করা যাবে না। গণতান্ত্রিক দেশে নাগরিকের প্রতিবাদ জানাবার জন্য সতত সতর্ক এবং নজর রেখে চলা একটি প্ল্যাটফর্ম বানানোও যাবে না। খুবই কঠিন কাজ, অনিচ্ছুক অথচ প্রবল ক্ষমতাবান এবং কায়েমি স্বার্থভোগীদের কাছ থেকে বিরুদ্ধ তথ্য ছিনিয়ে আনা। এর জন্য দরকার এমন একটি প্রতিষ্ঠান এবং আইনী কাঠামো যা শুধু স্বাধীন হলেই চলবে না। একে হতে হবে স্বচ্ছ, আদ্যোপান্ত সৎ। দরকার হলে স্বার্থসিদ্ধির কারণে ক্ষমতাবানদের গোপনীয়তা রক্ষার প্রবণতার এবং আগ্রাসী আধিপত্যকামিতার চরম বিরোধিতা করতে পারা চাই। মোটের ওপর গণতান্ত্রিক দেশে দলতন্ত্র এবং একনায়কতন্ত্রের ঝোঁকগুলিকে নিয়ন্ত্রণে রাখবার মতো যে ক'টি প্রতিষ্ঠান আছে, তথ্যের অধিকার কমিশন তাদের অগ্রগণ্য। এর কাজই হচ্ছে সাধারণ নাগরিককে ন্যায় এবং সাংবিধানিক নিশ্চয়তাগুলিকে পেতে সাহায্য করা।
এইগুলি অর্জন করা কি সম্ভব যদি এই কমিশনের সর্বোচ্চ আধিকারিকের বেতন,ভাতা, প্রোমোশন, এক কথায় তার চাকুরী জীবনের প্রাণভোমরা থাকে কেন্দ্রীয় সরকারের মুঠোবন্দী? একটি স্বয়ংশাসিত সংস্থার মালিক হয়ে বসে সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করার এই উদগ্র বাসনার অর্থ হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির স্বনির্ভরতা এবং আইনী কর্তৃত্বকে খর্ব করা।
এই সবই করা হচ্ছে যাতে ক্ষমতাবানেরাই তথ্যের অধিকারের নিয়ন্ত্রা হয়ে উঠতে পারে সেইদিকে চোখ রেখে।
পূর্ববর্তী সরকারগুলি, যেমন ইউপিএ অথবা এন ডিএ প্রস্তাবিত আরটিআই সংশোধনীগুলিকে জনসাধারণের জ্ঞাতার্থে আগেই ওয়েবসাইটে তুলে দিতো। আইন প্রণীত হবার আগেই তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা, তর্কের তুফান উঠেছে। কিন্তু এই সরকার কোন আলোচনা ছাড়াই এই বিল পাস করিয়ে নিতে বদ্ধপরিকর ছিল, তাই কারো মতামত জানতেও চায়নি। দাবী অনুযায়ী আলোচনার জন্য সিলেক্ট কমিটিতে না পাঠিয়ে সংখ্যার জোরে এবং বিরোধীরা এককাট্টা না হবার সুযোগ নিয়ে দুটি কক্ষেই এটি পাস করিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। কারণ খুব স্পষ্ট। যদি আগে থেকে নাগরিক এবং আরটিআই এক্টিভিস্টরা এ নিয়ে সরব হতেন তাহলে এ কথা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে যেত যে প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলি দেশের সংবিধান অনুমোদিত ফেডেরালিজমের আদর্শের পরিপন্থী, ইনফরমেশন কমিশনের স্বাধীনতা খর্বকারী এবং প্রশাসন ও জনজীবনে স্বচ্ছতা আনবার পথে অন্তরায়।
স্বাধীনতার পর প্রণীত সবচেয়ে প্রগতিশীল আইনটিকে এইভাবে শেষ করে দিয়ে ক্ষমতার আরো কেন্দ্রীকরণ করা হল। ইনফরমেশন কমিশনারদের নিজের বাঁশির সুরে নাচতে বাধ্য করা ক্ষমতালোভী শাসক ইতিহাসের কাছে দায়ী থাকলেও শেষ বিচারে চরম ক্ষতিগ্রস্ত হবে এ দেশের সাধারণ প্রতিবাদী মানুষ এবং গণতন্ত্র।