যার হবার কথা ছিল মাথার মণি, সে হয়ে গেল গলার কাঁটা। ভূস্বর্গ কাশ্মীর, তার অবস্থান, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, শান্তিকামী জনগণকে নিয়ে যে কোন রাষ্ট্রের সাধনার ধন হতে পারত। কপালদোষে তাকে নিয়েই গলার কাঁটা বেঁধে যাওয়ার মতো হাঁসফাঁস অবস্থা ভারতের। না পারা যাচ্ছে গিলতে, না ওগরাতে। আর এই দুরবস্থার পেছনে আছে দীর্ঘদিনের পারস্পরিক অবিশ্বাস, শাসকের ভ্রষ্টাচার, দমন ও শাসিতের মরীয়া বিদ্রোহ, চরমপন্থার জলঘোলা করা এবং অবশ্যই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের লম্বা নাক ঘন ঘন গলানো। দুই দেশই নিজের স্বার্থে যে ভূখণ্ডকে ব্যবহার করে চলেছে তার নাম কাশ্মীর। তবে এখন আর সে ভূস্বর্গ নয়, রক্তাক্ত, অসন্তুষ্ট এক নরকসদৃশ ঠাঁই যেখানে আত্মঘাতী জঙ্গী নিরাপত্তার ঘেরাটোপ অনায়াসে টপকে বিস্ফোরণে খতম করে দিতে পারে সেনা জওয়ানদের, আবার অন্যদিকে পাঁচশর বেশি নিরপরাধ নাগরিক শিকার হন নির্বিচার পেলেট গানের। তাদের মধ্যে শিশু, নারী, বৃদ্ধ অনেক। মৃত্যু, বিকলাঙ্গতা, অবিশ্বাস, সন্ত্রাস আর ষড়যন্ত্র যেখানে রাজ করে সেই ভূখণ্ডই আজকের কাশ্মীর।
রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস এবং বিচ্ছিন্নতাবাদ এখানে পরস্পরের উজ্জীবনে সাহায্য করে। দমনপীড়ন প্রচুর হওয়া সত্ত্বেও বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির বাড়বাড়ন্ত ঠেকানো যায়নি। উরি, পুলোয়ামা, পাঠানকোটের বদলা হিসাবে যতবারই সার্জিকাল স্টাইক, কারগিল যুদ্ধ বা সাধারণের ওপর নিপীড়ন নেমে এসেছে ততই আতঙ্কবাদীর সংখ্যা বেড়েছে। এটা পরীক্ষিত সত্য । এখন আতঙকবাদী সাপ্লাইয়ের জন্য পাকিস্তানে বরাত পাঠাতে হয়না, হোমগ্রোন টেররিস্ট বা ঘরের আতঙ্কবাদীর সংখ্যাই প্রচুর। এর পেছনে কাশ্মীরী অস্মিতা থাকে যদি, তবে তেমনি বলবৎ আছে রাষ্ট্রিক অকথ্য অত্যাচার। তিন চার মাস আগে টেলিগ্রাফ কাগজে রিপোর্ট বেরিয়েছিল, যে বাড়িতে সন্দেহভাজনরা লুকিয়ে আছে তার দেওয়ালে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে যাতে লুকিয়ে থাকারা ছাদে উঠে আসতে বাধ্য হয় এবং সামরিক বাহিনী তাদের চাঁদমারির লক্ষ্য করতে পারে।
কিন্তু তাতে কি কিছু লাভ হয়েছে? সন্দেহভাজনরা নির্দোষ হলে ক্ষোভে দুঃখে তাদের পরিজনরা সন্ত্রাসীর দলে নাম লিখিয়েছে, দোষী হলেও এই ভয়াবহ বর্বরতায় বিদ্রোহে ফেটে পড়েছে আস্ত জনপদ। কাশ্মীর এখন ক্ষুরস্য ধারা। সার্বভৌম, মহা শক্তিধর রাষ্ট্র, গোটা পৃথিবী, আন্তর্জাতিক সংগঠন, বিশ্ববিবেক, সবাই কাশ্মীর সমস্যার সামনে হতভম্ব, কিংকর্তব্যবিমূঢ়। শুধু অপ্রতিহতভাবে চলছে সাধারণ মানুষহত্যা, সঙ্গে আতঙ্কী ও সেনানিধন। এর শেষ কোথায়! কি এর সমাধান?
সরাসরি সে প্রশ্নে চলে যাবার আগে একটু অতীতচারণ দরকার। এ সেই অতীত, গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক সময় ও ঘটনার অভিঘাতে যার কুম্ভীপাক থেকে জন্ম নিয়েছে আজকের সংকট।
কাশ্মীর ভূখণ্ড ঐতিহাসিক ভাবে সমন্বয়ের পূজারী । কাশ্মীরীয়ৎ কথাটি বহু শতাব্দী প্রাচীন, এর অর্থ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন, দেশপ্রেম ও অতুলনীয় ভূখন্ডটির জন্য অসীম গর্ব। স্বাধীনতা,তার পরেই পাকিস্তানি হানাদারি এবং তৎসহ ঘটে যাওয়া নানা দুর্বিপাকেও কাশ্মীরি জনতা এই কাশ্মীরীয়তকে ধরে রেখেছিল। ২০০১ সালে সাউথ এশিয়া টেররিস্ট পোর্টাল MORI সার্ভে রিপোর্ট পেশ করে দেখায় যে জম্মু ও কাশ্মীরের জনমতের ৯২% মনে করে যে ধর্মের ভিত্তিতে উপত্যকা ভাগ হওয়া উচিত নয়। আবার ২০০৭ সালের দিল্লীর CSDS পোলের ফলাফলে দেখা যায় শ্রীনগরের ৮৪% মানুষ চায় কাশ্মীরি পন্ডিতরা প্রত্যাবর্তন করুন। এগুলো সবই সাধারণ মানুষের মতামত। ধর্মীয় বিভাজন যারা চায় সেই আতঙ্কবাদীরা এই হিসেবের বাইরে।
একথা তো ঠিক যে কাশ্মীরের ইতিহাস সর্বধর্ম সমন্বয়ের ইতিহাস। অনেক খ্রিষ্টান বিশ্বাস করেন যে রেজারেকশনের পর যীশু কাশ্মীরে চলে আসেন। কাশ্মীরিদের চেহারায় নাকি যীশুর আদল স্পষ্ট। আবার এখানেই হজরতবাল মসজিদে হজরত মহম্মদের মাথার চুল রক্ষিত আছে বলে বলা হয়। আকবরের দীন ইলাহি ধর্ম এখানে প্রভাব বিস্তার করেছিল। শিখধর্মও তাই। হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের ঐতিহাসিক কেন্দ্র কাশ্মীর। তেমনি প্রভাব এখানে সুফি মতবাদের। সুলতান জেইন উল আবেদিনের সময় থেকেই বহু ধর্মের একত্র শান্তিপূর্ণ বসবাস কাশ্মীরের ঐতিহ্য। আজও অমরনাথ যাত্রায় কাশ্মীরী মুসলমান বিশেষ ভূমিকা নিয়ে থাকে। রাষ্ট্রিক রোষ এবং আতঙ্কবাদের রমরমায় এই কাশ্মীরীয়ত আজ বিলীয়মান।
কাশ্মীরের এই দুর্দশার জন্য দায়ী যুধ্যমান দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র, যারা নিজের নিজের স্বার্থে এই সমস্যাকে জিইয়ে রাখতে চায়। কাশ্মীরি জনগণ রাজনীতির হাতের অসহায় পুতুলমাত্র। নাহলে দুই রাষ্ট্র হাত মিলিয়ে বহু আগেই এই আতঙ্কবাদকে নিশ্চিহ্ন করে কাশ্মীরকে বাঁচাতে পারতো। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানের কিছু সত্যিকারের অসুবিধে আছে। সে দেশের নির্বাচিত সরকার সত্য ক্ষমতার উৎস নয়। আসল ক্ষমতা সেখানে রয়েছে সেনাবাহিনীর হাতে। তাদের অঙ্গুলি হেলনেই শাসক বাছাই হয়, নির্বাচনে অকথ্য কারচুপি হয়, প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর চুপ করিয়ে দেওয়া হয়। ফলে পাকিস্থানের সাধারণ নাগরিক ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক চাইলেও, সেখানকার নির্বাচিত সরকার আলোচনায় আগ্রহী হলেও, পর্দার আড়ালে সেনাবাহিনীর মদতে শান্তিপ্রয়াস ব্যর্থ হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত আছেই।
বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারত সম্বন্ধে তা বলা যাবে না। এখানে সেনাবাহিনী সবসময় নির্বাচিত সরকারের অধীনে থেকে কাজ করেছে। বেশিরভাগ সময়েই বহু সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আসা সরকার দেশে রাজ করেছে। সেইসময় তারা আন্তরিকভাবে চাইলে কাশ্মীর সমস্যা সমাধানের পথে এগোত। দক্ষিণপন্থী শাসকের জমানায় জল আরো ঘোলা হয়েছে মাত্র। ব্যাপারস্যাপার দেখে এইরকম মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে কাশ্মীর সমস্যা জিইয়ে রাখা হলে রাজনৈতিক লাভ, কুমীরছানা দেখানোর মতো পাকজুজু দেখিয়ে ভোট বৈতরণী পার সহজ, অতএব থাক এ সমস্যা চিরকালের মতো। এই মনোভাবের শিকার কাশ্মীরিরা এবং বিভিন্ন সময়ে নিহত সেনা জওয়ানরা।
কাশ্মীর সমস্যা সমাধানে একসময় প্লেবিসাইট বা গণভোটের কথা বলা হয়েছিল। প্রতিশ্রুতি দিয়েও সেই গণভোট আর কখনওই অনুষ্ঠিত হয়নি। কারণ সেই একটাই। ভারত ও পাকিস্তান দুই রাষ্ট্রই এই সমস্যা জিইয়ে রাখতে চায়। নাহলে তখন কাশ্মীর ভারত ও পাকিস্তান থেকে সমদূরত্ব রাখায় আগ্রহী ছিল। কাশ্মীরীয়তপূর্ণ একটি স্বাধীন ভূখন্ডের কামনা ছিল তাদের, সেই স্বপ্ন সাকার হলে আজ দুই যুধ্যমান দেশের মধ্যে বাফার জোন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো স্বাধীন কাশ্মীর। প্রতিরক্ষা খাতে খরচ ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী হতো না, এতো প্রাণহানিও নয়।
আজও যখন কাশ্মীরে কোন উপদ্রব হয়, প্লেবিসাইটের দাবী ফিরে ফিরে আসতে থাকে। যেমন অভিনেতা কমল হাসান পুলোওয়ামা এটাকের পর গণভোট চেয়েছেন। এছাড়া ফেসবুকীয় বামেদের গরিষ্ঠ অংশ এবং কিছু অতিবাম এখনও প্লেবিসাইটের দাবীতে অনড়। কিন্তু সময় যেমন এগিয়ে গেছে, তেমনি দুনিয়াটা সাদা কালোর বিভাজন পেছনে ফেলে ধুসরতার দিকে এগিয়েছে লাফিয়ে লাফিয়ে। তখনকার কাশ্মীর পাকিস্তানকে অপছন্দ করত, ভারত বা পাকিস্থান কারোরই মাতব্বরি তার না-পসন্দ ছিল। আজকের কাশ্মীর কিন্তু দমনপীড়নের জাঁতাকলে পড়ে পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। পাক অধিকৃত কাশ্মীরের শোচনীয় অবস্থা জেনেও তারা মরীয়া এবং এখন গণভোট হলে সে ভোটের রায় ভারতের পক্ষে যাবে না একথা হলফ করে বলে দেওয়া যায়। যে ধর্মীয় আইডেন্টিটির কারণে কাশ্মীরী শালওয়ালা পশ্চিমবঙ্গে মার খায় পুলওয়ামা এটাকে তার তার কোন যোগ না থাকা সত্ত্বেও, সেই আইডেন্টিটিকে খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরতে কাশ্মীরকে বাধ্য করা হয়েছে বুটের তলায়।
মুশকিল হচ্ছে গণভোট এখন দূরতম কল্পনা। এর জন্য শুধু কিছু টেকনিক্যালিটিজ দায়ী নয়, আধিপত্যকামী মানসিকতা ও গভীর রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতাও দায়ী। ইউ এন সিকিউরিটি কাউন্সিল প্লেবিসাইটের জন্য সঠিক বাতাবরণ তৈরি করবার কথা বলেছিল। ভারত ও পাকিস্তানকে সৈন্য প্রত্যাহার করে একটি অন্তর্বতী কাউন্সিলের তদারকিতে গণভোট করার সুপারিশ করেছিল। পাক অধিকৃত কাশ্মীরে কত পাক সৈন্য আছে জানা নেই, কিন্তু কাশ্মীরে এখন ভারতীয় আর্মি আছে সাত লক্ষ। এদেরকে সরাবার দায়ভার কে নেবে? উপরন্তু পাকিস্তানের যোগসাজসে অশান্তি বাড়লেও স্থানীয় আতঙ্কবাদীর সংখ্যাই কিন্তু ক্রমবর্ধমান। ফলে বেড়ে বেটাকে ধরার পলিসি সবসময় সঠিক তা নয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ভূমিকাও সমালোচনার ঊর্ধ্বে নয়। বরং মাত্রাতিরিক্ত দমন ও অত্যাচার বার বারই বাহিনীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং শুভবোধ সম্পূর্ণ উবে গেছে। আরো ইন্ধন যুগিয়েছে সুজাত বুখারির মতো মধ্যপন্থীদের হত্যা। কোন রাজনৈতিক দলেরই মাটির সঙ্গে, মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। এদের কাছে ক্ষমতাই শেষ কথা। তার জন্য নিজের দেশের নাগরিকদের ওপর চূড়ান্ত দমনপীড়ন নামিয়ে আনতেও এরা অনাগ্রহী নয়। ধর্ম এবং আতঙ্কবাদ এখন তুরুপের তাস। নাহলে যতবারই আক্রমণ হয়, সরকার স্বীকার করে নেয় যে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় গাফিলতি ছিল। সে পাঠানকোট হোক বা পুলওয়ামা। শেষেরটিতে সি আর পি এফ জওয়ানরা আকাশপথে যেতে চেয়েছিল। তাদের মৃত্যু এল সড়কে। আমাদের দেশের ভোটের প্রচারে এতো আকাশপথ ব্যবহার করা হয় রাজনীতিজ্ঞদের সময় বাঁচাবার জন্য এমনি সময়েও, আর হুমকি থাকা সত্ত্বেও এতো জওয়ানকে কেন সড়কপথ ব্যবহারে বাধ্য করা হল সে এক রহস্য। এই তো সেদিন চন্দ্রবাবু নাইডুর হেলিকপ্টার তার ফলভরা পেঁপে খেতের ওপর নামিয়ে আনতে দেবেন না বলে পুলিশের মারধোরে প্রাণ হারালেন এক কৃষক। অভিযোগ তার মুখে বিষ ঢেলে দেওয়া হয়েছিল। এতো অসীম ক্ষমতা, এতো সময়ের দাম আমাদের নেতাদের, ঐ চাষির ছেলে যে সাধারণ সৈন্য তার প্রাণের দাম এদের কাছে কাণাকড়িও নয় কেন?কেন এতো বড় প্লাটুনকে সঠিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করেই সড়কপথে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হল? জওয়ানের দুঃখজনক অপমৃত্যুর দায় নেয় না শাসক, উলটে যে চাষির ঘর থেকে সে সেনাবাহিনীতে যোগ দেয় সেই চাষির ন্যায্য দাবীকে পাত্তা না দিয়ে নামিয়ে আনে নানা দমনপীড়ন। নাসিক থেকে শুরু হওয়া কিসান র্যালি এই মনোভাবের সাক্ষী।
গণভোট না করাবার পেছনে আরো কারণ আছে। কাশ্মীর উপত্যকার মানুষ চূড়ান্ত বীতশ্রদ্ধ তাদের জীবন, রুটিরুজি, মানমর্যাদা সবই হৃত, ফলে গণভোটে ভারতের হেরে যাবার সম্ভাবনা একশ পার্সেন্ট। হারলে সিকিউরিটি কাউন্সিলে ভারতের পার্মানেন্ট মেম্বারশিপ পাবার স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে। উপরন্তু সারা বিশ্বের কাছে একটি ভূখন্ডের অধিবাসীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগে সেই ভূখন্ডের ওপর জোর করে আধিপত্য কায়েম রাখবার অভিযোগ প্রমাণ হয়ে যাবে। পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কর্ণকুন্তীসংবাদের অর্জুন ও কর্ণের মতো - সেই শিশুকাল হতে টানিছে দোঁহারে / নিগূঢ় অদৃশ্য পাশ হিংসার আকারে। ফলে গণভোটে সম্ভাব্য পাকিস্তানি জয়কে ভারত নৈতিক এবং সামরিক পরাজয় হিসেবে বিবেচনা করবে এবং নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলে এই ভোট আটকাবে এটাই ভবিতব্য। গোটা বিশ্বের দরবারে ন্যায্য কারণেও হতমান হতে যে পরিমাণ নৈতিক বল লাগে তা বিশ্বের কোন রাজনৈতিক দলের বা নেতার এখন আর নেই।
তাহলে কি এইই চলতে থাকবে? এই মরণখেলা, এই রক্তের হোলি ? মানবাধিকারের প্রশ্ন তুললেই তাকে দেশদ্রোহী তকমা এঁটে দেওয়া হবে? বোঝার কোন চেষ্টাই করা হবে না যে কাশ্মীরে জীবন এখন শাঁখের করাত, আসতেও কাটে, যেতেও। সাধারণ কাশ্মীরীকে লাঞ্ছিত হতে হবে হয় আতঙ্কবাদীর হাতে, নয় সামরিক বাহিনীর হাতে। হামেশাই শারীরিক মানসিক লাঞ্ছনা ডেকে নিয়ে আসে ধর্ষণ ও মর্মান্তিক মৃত্যু। বৃত্তাকারে বেড়ে চলে প্রতিশোধকামী আতঙ্কবাদীর সংখ্যা।
সহানুভূতি ও আলোচনা ছাড়া এ সংকটের কোন নিরসন নেই। কাশ্মীরে এখন যা সুযোগ সুবিধা আছে তাতে অনেকের গাত্রদাহ দেখতে পাই। কিন্তু ওগুলো ভারতরাষ্ট্রে যোগ দেবার সময় যে চুক্তি মহারাজ হরি সিং ও ভারতের মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল তারই শর্তাবলী। সেগুলোর দিকে আঙুল তোলা অতি অন্যায্য। এ ছাড়াও শিক্ষা, কর্মসংস্থান, সৈন্যবাহিনীতে যোগ দেবার সুযোগ, নিরাপত্তা,গণতান্ত্রিক বাতাবরণ তৈরি করে মানুষের মন জয় করা আশু কর্তব্য। তবে তার জন্য দরকার অনন্য রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি, যা শুধু ছাপ্পান্ন ইঞ্চি বাজিয়ে কখনোই অর্জন করা যায়না। নদীর ধারা রুদ্ধ করবার মতো অবাস্তব কথা বলেও নয়। ভারত আজ তা করলে কাল অন্য দেশও তাই করবে। আজ ঝিলম শুকালে কাল শুকাবে ব্রহ্মপুত্র, সুতলেজ। কেন্দ্রে যে সরকারই থাকুক না কেন প্রতিশোধ স্পৃহাকে মাথায় উঠতে না দিয়ে কাশ্মীরীদের বিশ্বাস অর্জনের জন্য যা করা আবশ্যক তাকে তা করতে হবে। খুবই আশ্চর্য একটি নতুন কথা বাজারে চলছে। সেনাবাহিনীই নাকি ঠিক করবে পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে। একটি গণতান্ত্রিক দেশে সেনাবাহিনীর স্থান নির্ধারিত। সেই লক্ষ্মণ রেখার বাইরে গেলে ঠিক কি ঘটতে পারে তা সামরিক শাসনে বাস করা মানুষকে জিজ্ঞাসা করা দরকার। এই জিজ্ঞাসাবাদের সবচেয়ে ভাল পাত্র হতে পারেন একজন পাকিস্তানি।
খুবই দুর্ভাগ্য যে পুলওয়ামা আক্রমণের পর সারা দেশে নিরীহ মানুষ ভয়াবহভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন। রবীন্দ্রনাথ এখন ফ্যাশনদুরস্ত নন বটে, কিন্তু তাঁর সতর্কতা আমাদের মাথায় থাকুক - যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে ফেলিবে যে নীচে / পশ্চাতে ফেলিছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।
কাশ্মীর সমস্যা ভারতীয় উপমহাদেশের একিলিসের গোড়ালি, রাবণের মৃত্যুবাণ। এর সমাধানে যত্নবান রাজশক্তি কই?